প্রণয় রেখা শেষ পর্ব

0
895

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯.(অন্তিম পর্ব)

মাহবুব সাহেব বড্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ফোনটা কেটে দিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ সাহেব আবারও কল করলেন। তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ঐদিকে ছেলের বাড়ির লোকজন তাড়া দিচ্ছেন। মাহবুব সাহেব কল রিসিভ করলেন না, এখন কল রিসিভ করলেই কথা বাড়বে। তখন আবার ছোট কথার সূত্র ধরে বড়ো ঝামেলাও হতে পারে। আপাতত, তিনি কোনো ঝামেলা চান না, কোনোরকমে মেয়ের বিয়ে দিয়ে একটু স্বস্তি পেতে চান।

যখন কাজী সাহেবকে নিয়ে মাহবুব সাহেব মোহনার রুমে ঢুকলেন মোহনার মনটা তখন আরো চুপসে গেল। সে ভয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। বুঝতে পারল, হৃৎস্পন্দন তার আরো বেড়ে গিয়েছে। সে টের পাচ্ছে ধুকপুক ধুকপুক শব্দগুলো। ভয় হচ্ছে, পেটে মোচড় দিচ্ছে, হাত পা কাঁপছে। সঙ্গে গলাও শুকিয়ে উঠছে।

কাজী সাহেব একটা চেয়ারে বসলেন। তার পাশে মোহনার বাবা, লরিনের চাচাসহ আরো কয়েকজন মুরব্বি বসলেন। মোহনার মা ততক্ষণে বেরিয়ে গেছেন। মোহনার কাছে এখন এশা, মাহিয়া আর লরিনের আরো দু’জন কাজিন বসে আছে। কাজী সাহেব তার তীক্ষ্ণ কন্ঠে কাবিননামা পড়ে শুনালেন। অতঃপর সে কাঙ্খিত সময় চলে এল। কাজী সাহেব মোহনাকে বললেন,

‘মা, বলো কবুল।’

মোহনার জান যায় যায় অবস্থা। এর আগে কখনো এতটা নার্ভাস লাগেনি তার। ভয়ে বুক কাঁপছে যেন। এটা কিসের ভয়, তা তার জানা নেই। কোনোভাবেই নিজের মনকে বোঝাতে পারছে না। লায়লা বেগম, পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। এই তো কিছুক্ষণ পরই মেয়ে তার পর হয়ে যাবে। যেন চোখের পলকেই তার ছোট্ট মেয়েটা বড়ো হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন সে ভূমিষ্ঠ হলো, তাকে জড়িয়ে তিনি কত আদর দিলেন। মেয়েটা তার আজ হুট করেই যেন খুব বড়ো হয়ে গিয়েছে।

মোহনার গলার স্বর থমকে গিয়েছে। চেয়েও কথা বের করতে পারছে না সে। মাহিয়া পলকহীন চোখে বোনকে দেখছে। তার এই পৃথিবীতে সবথেকে আপন মানুষ, প্রিয় মানুষ, তার বোন। সে যখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে তখন হয়তো মাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশই হয়ে যাবে। আজ তাই আর তার কান্না পাচ্ছে না। এই ভেবে শান্তি যে, বিয়ে হয়ে গেলেও এখনই তো বোন আর তাকে ছেড়ে যাবে না।

কাজী সাহেব মোহনাকে আবারও কবুল বলতে বললেন। মোহনা শুষ্ক চোখে একবার বাবার দিকে চাইল। বাবার রুক্ষ চোখ আজ চিকচিক করছে। এই পাথরের ন্যায় শক্ত চোখের জমিনেও আজ পানি জমেছে মনে হচ্ছে। মোহনা চোখ নামিয়ে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। এশা কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

‘বলে ফেল দোস্ত। যত সময় নিবি ততই কষ্ট লাগবে, বলে ফেল।’

মোহনা ঘনঘন নিশ্বাস নিল। এক ঢোক পানি খেতে পারলে হয়তো গলাটা ঠিক হতো। কিন্তু সেটারও এখন উপায় নেই। সে চোখ বুজে নিজেকে ধীর স্থির করল। আসলেই সময় নিলে কষ্ট আরো বাড়বে। তার চেয়ে বলার দরকার, বলে দিলেই ঝামেলা শেষ। অবশেষে সে নিজেকে শক্ত করল। ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’

পরপর তিনবার কবুল বলার পর কক্ষে উপস্থিত সবাই একসঙ্গে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন। তাদের এই আনন্দ ধ্বনি পাশের কক্ষেও গেল। লরিনের কানে এই ধ্বনি পৌঁছাতেই ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ফুটে উঠল তার। অবশেষে সে পেরেছে, নিজের ভালোবাসাকে জেতাতে পেরেছে।

লরিনের কবুল বলা শেষে সকলে মোনাজাত ধরে। তারপর শুরু হয় মিষ্টি খাওয়ার হুড়াহুড়ি। এর মাঝে লরিনের অস্থির মন আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠে, মোহনাকে এক পলক দেখার জন্য। তার বউকে এখনো কেন এই রুমে আনা হচ্ছে না? কেউ কি বুঝতে পারছে না, সে কতটা ছটফট করছে? কেউ কি তার কষ্টটা একটুও বুঝতে পারছে না? আশ্চর্য, বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখনো বউ দেখতে এত অপেক্ষা করতে হবে কেন? মানুষগুলো সব অদ্ভুত! কেউ তার মন বুঝে না।

লরিন বসে বিরক্ত মনে ফ্যাচফ্যাচ করেই চলছে। আর এক সেকেন্ডও যেন তার ধৈর্যে কুলাচ্ছে না। এখন কেবল কতক্ষণে সে মোহনাকে দেখবে সেই চিন্তাতেই অস্থির। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মোহনাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসা হলো। লরিনের দৃষ্টি কাটল তার অতিরঞ্জিত এই মোহনীয় পরিটা। সে নিষ্পলক কিছুক্ষণ চেয়ে মনে মনে ভাবল, “এটা তার বউ?”

মোহনার তার পাশে বসে আছে। ঐদিকে লরিন হতভম্ব। কাউকে লাল রঙে এত কীভাবে সুন্দর লাগে? আশ্চর্য, এত পুরো লাল রঙের মাদক, যাকে ছুঁতে হয় না, দেখলেই নেশা ধরে যায়।

পাঞ্জাবী গায়ে লরিনের এই রূপটা মোহনার কাছে নতুন। আর নতুন জিনিস দেখলে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মস্তিষ্ক প্রথমে কিছুটা বিস্মিত হয়। পরে ধীরে সুস্থে সেটাকে মানিয়ে নেয়। মোহনারও এখন হয়েছে তাই। লরিনকে এর আগে সে কখনো পাঞ্জাবীতে দেখেনি। আজ প্রথম বারের মতো দেখছে। আর আজ প্রথম বারের জন্যই তার মনে হচ্ছে, ছেলেটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর। আর চিরন্তন সত্য হলো যে, শুভ্রর গায়ে শুভ্রের ছোঁয়া এমনিতেই দৃষ্টিনন্দন।

রাতের খাবার শেষ করে লরিনের বাড়ির লোক সবাই চলে গেলেন। রয়ে গেল কেবল লরিন আর এশা। এতক্ষণ সব স্বাভাবিক থাকলেও এখন লরিনের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। তার এখন ইচ্ছে করছে চলে যেতে। মোহনাও তখন থেকে গম্ভীর। এশা আর মাহিয়া বেশ মজার মুডে থাকলেও লরিনের তাতে মন পুষছে না।

সবাই যার যার মতো শুয়ে পড়েছে।

মোহনা দুধের গ্লাসটা লরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘আম্মু বলেছে, এটা খাওয়ার জন্য।’

লরিন বাধ্য ছেলের মতো ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করল। মোহনা খালি গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে লরিনকে গিয়ে বলল,

‘উঠে দাঁড়ান।’

লরিন ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কেন?’

‘সালাম করল।’

লরিন বলল,

‘মুখে দিলেই হবে।’

মোহনা তাকে মুখেই সালাম দিল। তারপর সে বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। লরিন চুপচাপ চেয়ে রইল। মোহনা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কিছু বলবেন?’

মোহনা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘না, মানে হ্যাঁ।’

‘বলুন।’

লরিন বুঝতে পারছে না তার কেন এমন হচ্ছে। ছেলে মানুষের আবার এত কিসের অস্বস্তি। এটা তো তারই বউ। বউয়ের সামনে নো অস্বস্তি।

নিজের মনে সাহস জুগিয়ে সে বলল,

‘তুমি তো এখনও উত্তর দাওনি।’

‘কিসের?’

লরিন বিরক্ত হয়ে বলে,

‘ভুলে গেলে? ঐ যে ছাদে বলেছিলাম, ভালোবাসার কথা বলতে হবে।’

মোহনা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,

‘বিয়ে করেছি তাতেই খুশি থাকুন। এর থেকে আর বেশি কিছু করতে পারব না।’

লরিন কপাল কুঁচকে বলল,

‘যেন বিয়ে করে আমাকে উদ্ধার করেছে? আশ্চর্য, ছোট্ট একটা কথা, বলে দিলেই হয়; না, সেটা নিয়েও এত ঝামেলা করতে হবে। মেয়েদের মনে এত প্যাচ কেন বুঝিনা?’

মোহনা খুব ক্ষেপে গেল। তেড়ে এসে বলল,

‘এই যে মি. বেশি কথা বলবেন না। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে ভাববেন না এখন আপনি যা খুশি তাই বলেই পাড় পারবেন। বেশি কথা বললে একদম সুই সুতা দিয়ে মুখ সেলাই করে দিব। সো, এখন থেকে সাবধানে কথা বলবেন, বুঝেছেন?’

লরিন তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘এসবে আমি ভয় না। মি. ডানিয়েল লরিন তার সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়া আর কাউকেই ভয় পায়না। আর আপনার মতো বাচ্চা মেয়েকে তো একদমই না।’

‘ও হ্যালো, আমি মোটেও বাচ্চা মেয়ে না। বয়স জানেন কত আমার? চব্বিশ। কয়দিন পর পঁচিশ এ পড়ব। আসছে আমাকে বাচ্চা বলতে। আর কি যেন বলছিলেন আপনি? আমাকে ভয় পান না, তাই না? শুনুন মি. নিজের বউকে ভয় পায়না পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ মানুষ নেই। বড়ো বড়ো রাজা বাদশারাই বউয়ের ভয়ে সবসময় কাবু ছিলেন, সেখানে আপনি তো নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র বালক। আপনাকে তো আমি তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিতে পারব।’

মোহনার কথা শেষ হতেই লরিন তার বাম হাতে জোরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মুখের কাছে নিজের মুখ এনে ম্লান সুরে বলে,

‘আচ্ছা তাই? তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিতে পারবে। এত শক্তি তোমার? তাহলে তো একটু শক্তির পরীক্ষা করতেই হয়, তাই না?’

লরিন মোহনাকে চোখ মারে। মোহনা ঢোক গিলে বলে,

‘হাত ছাড়ুন।’

লরিন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

‘আজকের রাতে নো ছাড়াছাড়ি, ডিয়ার। চলো, একবার তাহলে শক্তির পরীক্ষা করা যাক।’

মোহনা রেগে গিয়ে বলল,

‘বাজে কথা বলবেন না, লরিন। আমার কিন্তু বিরক্ত লাগছে।’

‘এখন বিরক্ত লাগছে, আর একটু পর লজ্জা লাগবে। সমস্যা নেই।’

তারপর….

তারপর..একটা রোদ ঝলমলে সকাল এল। একটা নতুন সকাল। যার মিষ্টি রোদে মিষ্টি হাসল মোহনা। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, সামনে এক বিশাল জগত। পাশ ফিরে দেখল এক বিস্তীর্ণ ভালোবাসা। এই তো সামনের সুন্দর জগতে তার এই ভালোবাসা কী অপূর্বভাবে মিশে যাচ্ছে। যেন তারা একে অপরের পরিপূরক। আজ তার মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস এই ছেলেটা তার জীবনে এসেছিল, নয়তো এই অফুরন্ত প্রেম সে কোথায় পেত? কোথায় পেত এই নিদারুণ সুন্দর সময়? ভাগ্যিস, ছেলেটা তার জীবনে এসেছিল।

মোহনা উঠে চোখ বুজে দু হাত দু’দিকে মেলে দিয়ে উচ্ছাস নিয়ে বলতে লাগল,

‘I want to do with you,
What Spring does with the Cherry trees…I love you, lorin. I love you so much.’

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here