প্রণয় রেখা পর্ব ২০

0
454

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০.

বিকেলটা আজ কেমন যেন বিষাদপূর্ণ। যেন চারদিক একটু বেশিই গুমট হয়ে আছে। কেমন নিস্তব্ধ, ক্লান্ত বিকেল। তেজহীন দিবাকর শান্ত হয়ে ঢলে আছে অন্তরীক্ষের পশ্চিমকোলে। সেও যেন আজ খুব চুপসে আছে। তেজ নেই, নেই উজ্জ্বলতা। যেন জীবনের সব প্রাণ সঞ্চার ফুরিয়ে এখন শেষের পথে। এত কিসের হাহাকার ওদের। প্রকৃতিও কি তবে মোহনার শোকে শোকাহত? হতেও পারে? মানুষ মন বোঝে না। হয়তো প্রকৃতির প্রাণহীন বস্তুগুলোও মানুষের চেয়ে ভালো মন বোঝে। মোহনা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। অতৃপ্ত মন নিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। যদি তার দৃশ্যপটে কোনো সুন্দর দৃশ্য পড়ে, সেই আশায়।

মাহিয়াও আজ খুব চুপচাপ। সচরাচর সে এতক্ষণ চুপ থাকার মেয়ে না। তবে আজ যেন কোনো কথা বলতেই তার ইচ্ছে হচ্ছে না। সারাক্ষণ বোনের সাথে ঝগড়া করলেও বোনের সামান্য মন খারাপ তার সহ্য হয় না। স্কুল থেকে এসেই তাই সে নিশ্চুপ হয়ে আছে।

বেলকনিতে মোহনা অনেকক্ষণ ছিল। ঠিক মাগরিবের আযান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ভেতরে আসে। ওযু করে একটা জায়নামাজ মাটিতে বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায়। মোহনা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি না হলেও একেবারেই যে নামাজ পড়ে না তা না। যখন আল্লাহর বান্দাগুলোর উপর তার খুব অভিযোগ হয়, তখন চট করেই নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করতে বসে পড়ে। কষ্ট চেপে রাখলে তা বাড়ে, তাই সে জায়নামাজে বসে কেঁদে কেটে তার কষ্ট দূর করার চেষ্টা চালায়।

মাহিয়া বিছানায় বসে বসে বোনের কান্না দেখছে। মোহনা মোনাজাতে হাত তুলে কিছু বলছে আর কাঁদছে। তার সেই চোখের পানি দেখে মাহিয়ারও যেন কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তাই সে আর সেই রুমেই থাকল না। বেলকনিতে চলে গেল। সেখানে গিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে এক মনে বলল,

‘আমার আপুর সব কষ্ট দূর করে দাও, আল্লাহ। আপুকে আর কষ্ট দিও না।’

নামাজ শেষ করেই মোহনা মাহিয়াকে ডাকে। অনেকক্ষণ পর মোহনার স্বর শুনতে পেরে যেন মাহিয়া তার প্রাণ ফিরে পায়। সে এক ছুটে বোনের কাছে যায়। খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলে,

‘কী হয়েছে আপু?’

‘কফি না চা খাবি?’

মাহিয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘কফি।’

মোহনা তারপর কফি বানাতে যায়। আর মাহিয়া তখন খুশিতে আত্মহারা।

মোহনা কফি নিয়ে আগে মা বাবার রুমে যায়। উনারা তখন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। মোহনাকে দেখে থেমে গিয়ে লায়লা বেগম বললেন,

‘কিরে মোহনা, তোর চোখ মুখ এত ফোলা কেন?’

মোহনা হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘কই না তো, ফোলা কোথায় দেখলে তুমি? ঠিকই তো আছে।’

মোহনার বাবা বললেন,

‘আচ্ছা মা, তুমি বসো এদিকে।’

মোহনা বাবার পাশে গিয়ে বসল। তার বাবা এবার বললেন,

‘তোমার এই সেমিস্টারের ফাইনাল কবে?’

‘এইতো বাবা, আর এক মাস পর।’

‘আচ্ছা। আর তারপর তো আবার একমাসের বন্ধ, তাই না?’

‘জ্বি।’

‘হুম। উম..আসলে আমি আর তোমার আম্মু, আমরা দুজনে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

মোহনা বিস্মিত সুরে বলল,

‘কী সিদ্ধান্ত বাবা?’

‘বলব, সময় এলে সব বলব। আগে একটা কথা বলতো মা, আমরা তোমার উপর আস্থা রাখতে পারব তো? আমাদের কিন্তু তোমাকে নিয়ে খুব গর্ব। তুমি সবসময় আমাদের গর্বটা ধরে রাখতে পারবে তো, মা? কখনো আমাদের বিশ্বাসে আঘাত করবে না তো? আমরা কিন্তু তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। আর আমরা চাই, আমাদের সেই বিশ্বাস যেন একেবারে শেষ পর্যন্ত এভাবেই টিকে থাকে। কোনোদিন এমন কিছু করো না, যার জন্য মা বাবা কষ্ট পাবেন। মা বাবার বিশ্বাসে আঘাত লাগবে এমন কোনো কাজ করো না। কারণ একবার যদি বিশ্বাস ভেঙে যায় তাহলে কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও সেটা আর জোড়া লাগাতে পারবে না। তুমি ছোট নও, আশা করছি আমি কী বলতে চাইছি তা বুঝতে পারছো।’

মোহনা নতমস্তকে মাথা নাড়াল। মন বলছে, কিছু একটা হয়তো হতে চলেছে। হয়তো মা বাবা তার অনুপস্থিতেই কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আর এখন তারা আশা রাখছেন যে মোহনা সব শোনার পর খুব সহজেই সবকিছু মেনে নিবে।

মোহনা তার রুমে এসে দেখল, মাহিয়া তার ফোন দিয়ে যেন কার সাথে কথা বলছে। কফির স্ট্রে টা সাইডে রেখে সে মাহিয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কার সাথে কথা বলছিস?’

খানিক চমকে মাহিয়া জবাব দিল,

‘লরিন ভাইয়া।’

মোহনা মাহিয়ার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের কানে ধরল। কর্কশ স্বরে বলল,

‘কল কেন করেছেন?’

ওপাশ থেকে লরিন ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘এশাকে ভুল বুঝো না মোহনা। ও আমার কথা শুনেই এসব করেছে।’

মোহনা খুব ক্ষেপে গেল। বলল,

‘আপনি কি এশার হয়ে সাফাই গাইতে কল দিয়েছেন?’

‘না, তা না। আসলে ও…’

‘দেখুন লরিন, আমাকে দয়া করে আর কিছু বোঝাতে আসবেন না। এখানে স্বার্থ আপনারও ছিল আর এশারও ছিল। আর আপনাদের দুজনেরই স্বার্থের বলি হয়েছি আমি। এতদিন কত নাটক করেছেন দু’জন। আর আমি কত বোকা, কত সহজেই আপনাদের বিশ্বাস করে গিয়েছি। যাকগে, জীবনে এক দু’বার ধাক্কা না খেলে মানুষ চেনা যায় না। আমি আর এসব নিয়ে ভাবব না। তবে, আপনার সাথে আমার লাস্ট কিছু কথা আছে। যদি কাল ফ্রি থাকেন তবে বিকেলে দেখা করবেন। এখন রাখছি।’

লরিন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। কল কেটে দিয়ে মোহনা জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। সব ধোঁকা সহ্য করা গেলেও বন্ধুত্বের ধোঁকা সহ্য করা যায় না।

মোহনা ঢকঢক করে গরম কফিটাই গিলতে লাগল। বুকের দহনে যখন ঐ তপ্ত গরম কফি গিয়ে ঠেকল তখন যেন তা আরো বেশি উত্তাল হয়ে উঠল। তাতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না সে। কফি খাওয়া শেষ করে মাহিয়ার দিকে চেয়ে দেখল, মেয়েটা কেমন অসহায় ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোহনা তা দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘ভয় পাস না, ঠিক আছি আমি।’

মাহিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,

‘এশাপু এমন কেন করল, আপু?’

মোহনা ঢোক গিলে বলল,

‘এসব কথা থাক। আগে বলতো, আমাকে কিসে মানাবে? শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা?’

মোহনার এসময়ে এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে মাহিয়া কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

‘হঠাৎ শাড়ি আর লেহেঙ্গার কথা কোথ থেকে এল? কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?’

মোহনা হেসে বলল,

‘আরে বাবা, আমার বিয়েতে আমাকে কী পরলে মানাবে সেটা বলছি।’

‘তোমার বিয়ে? তোমার কেন বিয়ে হতে যাবে?’

মাহিয়ার যেন মাথায় কিছুই ঢুকছে না। মোহনা হাসতে হাসতে বলল,

‘আশ্চর্য, তুই এত অবাক হচ্ছিস কেন? আমি বড়ো হয়েছি, আমার বিয়ে হবে না?’

‘হবে, কিন্তু হুট করেই আজকে বিয়ের কথা কেন বলছো? এর আগে কখনও তো বিয়ে নিয়ে কিছু বলোনি।’

মোহনা নিশ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘মানুষের জীবনে সবকিছু হুট করেই হয়। প্ল্যান মাফিক কিছু করতে গেলেই ব্যাঘাত ঘটে। তার চেয়ে হুটহাট করেই সব হয়ে যাওয়া ভালো। এখন এত না ভেবে বল, বিয়েতে কী পরব? শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা?’

_________________________________

পরদিন মোহনা ভার্সিটিতে গেল না। তার বাবার কপালের ব্যান্ডেজ খোলা হবে। সে সেই অজুহাত দেখিয়ে আজ বাসায়ই থেকে গেল। সকাল থেকেই রাফাত মোহনাকে অনেক কল করেছে। কিন্তু মোহনা তার কোনো কলই রিসিভ করেনি আর করবে না বলেই পণ করেছে। রাফাতের এত এত কল সে রিসিভ করছিল না বলে অবশেষে রাফাত তাকে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠায়। যেখানে লেখা ছিল, “দোস্ত, অন্তত আমার কলটা তো রিসিভ কর।” তবে মেসেজ দেখেও মোহনা রিপ্লাই করল না। সে ফোন রেখে গোসলে চলে গেল।

দুপুরে খেতে বসে মোহনার বাবা বললেন, আগামীকাল নাকি অরূপের বাড়িতে দাওয়াত আছে। তাই তারা স্বপরিবারে কাল সেখানেই যাবেন। কিন্তু মোহনার যেতে ইচ্ছে করল না। সে নরম গলায় বলল,

‘বাবা, আমি যাব না। আমার কালকে একটা সি.টি আছে।’

‘কয়টার দিকে?’

মোহনা মিথ্যে বলল। বলল,

‘ঐ তো তিনটার দিকে।’

‘ঠিক আছে তাহলে, তিনটার পরেই যাব।’

মোহনা খুব হতাশ হয়ে পড়ল। মিথ্যে বলেও লাভের লাভ কিছুই হলো না।

বিকেলের দিকে মাহিয়াকে নিয়ে মোহনা বেরিয়ে গেল লরিনের সাথে দেখা করতে। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখল, লরিন আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। লরিনকে দেখে মাহিয়া খুব খুশি হলো। লরিনের মুখেও হাসি ফুটল তাকে দেখে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাসি বিলিন হয়ে গেল মোহনার ম্লান মুখপানে চেয়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here