পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৩)

0
2188

পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৩)
– সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ

আকিবের এমন আবেগী কথা শুনে পুষ্পও আবেগী হয়ে পড়ে। চোখের কোণে আবারও এক বিন্দু অশ্রু জমা হয়।
ইশ, ঠিক কতখানি ভালোবাসলে একটা মানুষ এমন আবদার করতে পারে?

তবে যতই ভালোবাসুক, নিয়তি তাদের আলাদা করে দিয়েছে। এখন আর ওর সাথে কথা বলে মিছামিছি মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। পুষ্প নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এইটা হয় না আকিব। ও কোনোভাবে জানতে পারলে খারাপ হইবো অনেক।”

মুখে মুখে এটা বললেও পুষ্পর মন আবার অন্য কথা বলছিল। মন বারবার বলছিল, “রাখ না আকিবের এই আবদারটুকু! কী এমন হবে প্রতিদিন এক মিনিট ওর সাথে কথা বললে? কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু না। আচ্ছা তুই কি ওকে ভালোবাসতি না, বল?”

একদিকে মন এভাবে ক্রমাগত ওর মগজ ধোলাই করে যাচ্ছিল, আর অন্যদিকে মগজ ধোলাইকে পরিপূর্নতা দান করতে আকিবের আবেগী কথাবার্তা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে পুষ্প নিজের সাথে পেরে উঠতে পারল না। সে রাজি হয়ে গেল আকিবের প্রস্তাবে। সবার অগোচরে সর্বনাশা যাত্রার অশুভ উদ্ভোদন সেদিন এই লগ্নেই হয়েছিল।

এক মিনিটের জন্য ফোন দিয়ে একটুখানি কণ্ঠস্বর শুনে মনকে প্রশান্তি করার আবদারটা পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবেই ক্রমশ আরো বিস্তৃতি লাভ করছিল। প্রথম দুই-একদিন এক মিনিটেই মন ভরলেও আস্তে আস্তে দেখা যাচ্ছিল যে, এক মিনিটে ঠিক মন ভরছে না। এক মিনিট থেকে পাঁচ মিনিট, পাঁচ মিনিট থেকে দশ মিনিট, দশ মিনিট থেকে আধাঘণ্টা; এভাবে কথা বলার সময়কাল ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল, বেড়েই যাচ্ছিল।

পুষ্পর একবার মনে হত যে, সে ভুল করছে। কিন্তু পরক্ষণেই আকিব ওর ব্রেন ওয়াশ করে যখন বুঝাতো যে এইখানে ভুল কিছু হচ্ছে না, তখন পুষ্পও বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে চুপচাপ মেনে নিত আকিবের কথা। এভাবে কথা বলতে বলতে ওদের সম্পর্ক আবার কখন যে অবৈধ প্রেমের অর্থাৎ পরকিয়ার দিকে গড়িয়েছে সেইটা পুষ্প টেরই পায়নি।

পুষ্পর শ্বশুরবাড়িকে শ্বশুরবাড়ি বলা যায় না। তাকে ওই বাড়ির বউ না বলে মেহমান বললেও ভুল হবে না। সারাক্ষণ ফোনে হাতে নিয়ে টইটই করে এই বাড়ি, ওই বাড়ি ঘুরাঘুরি করা আর শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া ওর দ্বিতীয় কোনো কাজ ছিল না। মুন্নি যখন রান্না করতো সে তখন রান্নাঘরের পাশে বসে মুন্নির সাথে হয়তো গল্প করতো কিংবা তাকবিরের সাথে ফোনে চ্যাটিং করত। বিয়ের এক বছর পরেও রান্নার ‘র’ও সে জানে না। অন্যান্য কাজের কথা না হয় না-ই বা বললাম।

এমনও হয়েছে যে, গোসল করে পরনের কাপড়গুলো ধুয়ে শুকা দিতে পুষ্প ভুলে গিয়েছে। আর মুন্নি সেই কাপড় বিনাবাক্যে নিজে থেকে ধুয়ে রশিতে মেলে দিয়েছে শুকানোর জন্য।

ওদিকে পুষ্পর সারাদিন ফোন নিয়ে শুয়ে বসে থাকা নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ির কারো কোনো মাথা ব্যথাও ছিল না। সংসারের একমাত্র অর্থের যোগানদাতা ইতালি প্রবাসী টাকাওয়ালা বউ-পাগল ছেলের মন রক্ষার্থে তার বউকে সবাই তোলা তোলা করে রাখত সবসময়। আদর-যত্নে কোনোরূপ ত্রুটি যেন না হয়, বউ কর্তৃক ছেলের কাছে বাড়ির কোনো সদস্যের ব্যাপারে কোনোরূপ অভিযোগ যেন না যায় সে ব্যাপারে বাড়ির প্রতিটা সদস্য সর্বদা সচেতন ছিল।

সেজন্যই হয়তো-বা যেকোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় শাশুড়ি মা মুন্নিকে বাদ রেখে শুধুমাত্র পুষ্পকে নিজে থেকে পার্লারে গিয়ে সাজগোজ করার প্রস্তাব দিতেন। শ্বশুরমশাই মুন্নিকে বাদ রেখে শুধুমাত্র পুষ্পকে বৈশাখী মেলায় ঘুরতে নিয়ে যেতেন, নাগরদোলায় চড়াতেন, মুড়ি-মুরকি কিনে দিতেন, কাচের চুড়ি কিনে দিতেন।

মোটকথা মুন্নি সে বাড়ির বউ হলেও স্বামীর টাকার জোরে পুষ্প ছিল সে বাড়ির অতি আদরের ছোট্ট মেয়ে কিংবা মেহমান।

আমাদের আকিব ভাই এসএমএস তেমন লিখতে পারত না। কিংবা লিখতে পারলেও সেসব শুদ্ধ হত না। সে ফোনে কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। তাই পুষ্প আকিবের সাথে বেশিরভাগ সময় ফোনে কথা বলত। এবং একইসাথে তাকবিরের সাথেও চ্যাটিং করে যেত। আকিবের সাথে ফোনের লাইনে থাকাকালীন তাকবির ফোনে কথা বলতে চাইলে তাকবিরকে এটা সেটা অজুহাত দেখিয়ে পরে ফোনে কথা বলবে বলে অপেক্ষা করাত। ওদিকে দিনের অধিকাংশ সময় পুষ্পকে ফোনে কথা বলতে দেখে আশেপাশের সবাই ভাবত তাদের ছেলের সাথেই সে কথা বলছে।

অবৈধ প্রেমে অন্ধ হয়ে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল পুষ্প। এইযে এভাবে দিনের পর দিন এতগুলো মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিল সে, এতে করে বুঝি ওর ভেতরটা একটুও কাঁপত না। তিরমিযী শরীফের একটা হাদিসের মূলভাব এটাই যে, “মানুষ পাপ করতে করতে একটা সময় এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যে, তখন পাপকে তার কাছে আর পাপই মনে হয় না। অধিক পাপ করার দরুন অন্তরের এমনভাবে মরিচা পড়ে যায় যে, সে গুনাহের কাজ ও সওয়াবের কাজের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করার ক্ষমতা হারায়। সে দোষকে গুণ, পাপকে পূণ্য, পূণ্যকে পাপ মনে করতে থাকে এবং সেই সাথে রবের প্রতি তার অবাধ্যতা বাড়তেই থাকে।”

পুষ্পর কাহিনীর এই পর্যায়ে এসে আমার এই হাদিসটার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল যে, রাসূল (স.) যেন পুষ্পদের উৎসর্গ করেই এই হাদিস বাতলে গিয়েছেন।

দেখতে দেখতে দুইবছর চলে গেল। সেই সাথে তাকবিরের দেশে ফেরারও সময়ও ঘনিয়ে এলো। তাকবির পুষ্পকে বলেছিল, এইবার দেশে এসে পুষ্পকে তার সাথে করে ইতালি নিয়ে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করবে। ওই দূর দেশে এই পুতুলটাকে ছাড়া যে তার বড্ড বেশি কষ্ট হয়। দুইবছর অনেক কষ্টে কাটিয়েছে। আর কোনো কষ্ট সহ্য করতে সে রাজি না। তাই পুষ্পকে এবার যাওয়ার সময় সাথে করেই নিয়ে যাবে।

কিন্তু তাকবির সেই সুযোগ আর পায়নি। সে দেশে আসার ঠিক আটাশ দিন আগে পুষ্প এতগুলো মানুষের সাথে প্রতারণার চূড়ান্তে গিয়ে আকিবের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।

দিনটি ছিল বুধবার।
পুষ্প গতকালই বাবার বাড়ি এসেছে। মাসখানেক পরই তাকবির দেশে আসতে যাচ্ছে। তাকবির দেশে আসলে তো বাবার বাড়ি এসে সে আর থাকতে পারবে না। তাই পুষ্পর শ্বশুর-শাশুড়ি ওকে বললেন, তাকবির দেশে আসার আগে আগেই বাবার বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসতে।

পুষ্পর সম্মতি পেয়ে ওর শ্বশুর ওকে কয়েকদিনের জন্য ওর বাবার বাড়ি রেখে যান। নির্বোধ শ্বশুর তখনো বুঝতে পারেননি যে, অতি আদরের এই পুতুল বউমাকে এইটাই তঁর শেষ রেখে যাওয়া। এমনকি এটাই তাদের শেষ দেখা।

বুধবারে আসরের আজানের পরপর পুষ্প ফোনে কথা বলতে বলতে বাহির বাড়ির দিকে বের হয়। বাহির বাড়িতেও উঠানের মতো খোলা এক জায়গা আছে। সেটা পেরুলেই গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা।

পুষ্প হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই বাইকের পাশে দাঁড়ানো এক যুবককে দেখতে পায়। তাকে দেখতে পাওয়া মাত্রই সে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যায় সেই বাইকের কাছে। তার দিকে নজর পড়তেই সেই যুবক দ্রুত বাইকে উঠে বসে। পুষ্পও আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত গতিতে যুবকের পেছনে বাইকে চেপে বসে।

কোনো প্রস্তুতি না, কোনো কিচ্ছু না। সাথে কোনো টাকা-পয়সা কিংবা গয়না; কিছুই নিয়েছিল না পুষ্প। গয়নার মধ্যে শুধু নাকের নাকফুলটা ছিল। শুধুমাত্র পরনের এক কাপড়ে, স্যান্ডেল পায়ে, হাতে ফোন ও কামিজের নিচে লুকিয়ে ওর প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র নিয়ে আকিব ভাইয়ের বন্ধুর বাইকের পেছনে চেপে এতগুলো মানুষের আদর, ভালোবাসা, বিশ্বাসকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সে চলে এসেছিল বাড়ি ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে।

আকিব ভাইয়ের বন্ধু সুজন ভাই পুষ্পকে সদর পর্যন্ত নিয়ে আসে। সদরে আকিব ভাই অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। আকিব সরাসরি পুষ্পকে আনতে গেলে ওই এলাকার কোনো মানুষ আকিবকে দেখে সন্দেহ করত কিংবা ঝামেলা হত, এসব ভেবেই আকিব নিজে না গিয়ে বন্ধুকে পাঠায়।

পুষ্প সদরে আসার পর কোর্টম্যারেজ করে ওরা সরাসরি ঢাকায় পাড়ি জমায়। এদিকে পুষ্পকে খুঁজে না পেয়ে দুলাভাই আগে আকিব ভাইয়ের খোঁজ করে। ওদিকে আকিবের ফোন নাম্বার অফ থাকায় আকিবের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করতে পারলেন না। দুলাভাই যখন আকিব ভাইকেও নিজের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে দেখলেন তখন তাঁর যা বোঝার তিনি বুঝে গেলেন।

প্রথম অবস্থায় রাগের মাথায় আমাদের বাড়িতে ফোন দিয়ে নানারকম হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করলেন। তাঁর বোনকে আকিব ফিরিয়ে না দিলে এই বাড়ির সবকয়টা মানুষকেই তিনি জেলের ভাত খাওয়াবেন। সবাইকে খুন করে ফেলবেন তিনি। এরকম আরো কত উল্টা-পাল্টা কথাই যে তিনি বললেন! স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার পর দুলাভাইয়ের মাথাটা পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বোনের ওই সুখের নীড়ের এমন নির্মম ধ্বংস তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।

বুধবার রাত নয়টা বেজে পনের মিনিট।
পুষ্পর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কানে এখানো কিছু পৌঁছায়নি। ফোনে একদফা রাগারাগি, চিল্লাচিল্লি শেষে দুলাভাই এবার এসেছেন আমাদের বাড়িতে। এসে অবশ্য রাগারাগি কিংবা চিল্লাচিল্লি কিছুই করছেন না। বরং নিঃস্ব, রিক্ত, কপর্দকশূণ্য ভঙ্গিতে চেয়ারের উপর বসে থাকা বড় কাকার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে অনুনয়ের স্বরে হাতজোড় করে বললেন, “আমার বোনটারে ফিরাইয়া দেন চাচা। আমি জানি, আপনাদের সাথে আপনাদের ছেলের যোগাযোগ আছে। দয়া কইরা ফিরাইয়া দেন আমার বোনরে। ওর অতো সুখের জীবনডা এমনে নষ্ট কইরেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে।”

কথাটুকু বলে দুলাভাই আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুলাভাই কাকার হাঁটুর উপর মাথা রেখে অবুঝ, নিঃস্ব, ছোট বাচ্চাদের মতো ডুকরে কেঁদে উঠলেন সবার সামনে। দুলাভাইয়ের ক্রন্দনে উপস্থিত সবার চোখে পানি চলে এসেছিল। পানি চলে এসেছিল বড় কাকার চোখের কোণেও। কিন্তু কাকাই বা কী করবেন? সত্যি বলতে, আকিব ভাই আত্মীয় মহলের গুরুজন সম্পর্কিত কারো সাথেই ওই মুহূর্তে যোগাযোগ রেখেছিল না। আর যে অঘটনটা ঘটিয়েছে সেটার ব্যাপারে কেউ অবহিতও ছিল না। কেউ তো কল্পনাও করতে পারেনি যে, বিবাহিত একটা মেয়েকে আকিব এভাবে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে। এটা তো রীতিমতো অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব একটা কর্ম।

সেই অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব কর্মটাকে অতি সহজেই সম্ভবে পরিণত করে আকিব ভাই আর পুষ্প ভাবি ঢাকায় গিয়ে ওদের নব্য সংসার জীবনের সূচনা ঘটায়। সে নব্য সংসারের অন্তরালে কারো বদদোয়া, দীর্ঘশ্বাস, বুক ফাটা আর্তনাদ, হাহাকার, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ব্যতীত অন্য কিছুই ছিল না।

চলবে ইন-শা-আল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here