দুইটা পয়তাল্লিশ পর্ব ৫

0
333

গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ

লেখকঃ Parvez Rana

পর্বঃ৫

নওরিন শুভ্রের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। সে জানেনা শুভ্র তার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবে। কারণ আগের বার শুভ্র তার সাথে সরাসরি টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলেছিল। কিন্তু এবার কিভাবে বলবে নওরিন তা জানে না। শুভ্র বলেছিল এগারো দিন পর নওরিনের সাথে কথা বলবে। আর এই এগারো দিন ধরে নওরিন শুধু এই দিনটার অপেক্ষায় থাকত। কখন সে শুভ্রের সাথে কথা বলবে। কখন সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা বলবে। আর এখন তার অপেক্ষার অবসান ঘটার দাড় প্রান্তে। কিন্তু এখনো শুভ্রের সাথে কথা বলার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। বিছানায় তার মন ছটফট করছিল। তার সব কিছু অসহ্যকর লাগছিল। সেটা শুধুই শুভ্রের জন্য। একবার পানি খাওয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠে বসে। টেবিলে পানির গ্লাস হাত দিয়ে ধরার পর নওরিন একধরনের অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়। তাই সে গ্লাসটা ছেড়ে। শুরুর দিকে আওয়াজটা অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। তাই গভীর মনোযোগ দিয়ে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলে নওরিন বুঝতে পারে যে সেটা শুভ্রের সেই মধুর হাসির শব্দ। সে হাসির শব্দ শুনে নীরবে কেদে ফেলল। সে বুঝতে পারছিল না কেন তার খুশি হওয়ার মুহূর্তে সে কেদে ফেলছে। হয়তো এটা তার খুশির কান্না। হয়তো বা সে অনেক অনেক বেশি খুশি বলে সে কেদে ফেলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে আসল। এতোটাই স্পষ্ট যে নওরিনের মনে হচ্ছিল শুভ্র তার পাশে বসেই হাসছে। নওরিন নিজের কান্না থামাতে পারছিল না। শুভ্র হাসিমাখা কন্ঠে বলল, ‘কি ব্যাপার! তুমি কাদছ কেন? আমি তোমার সাথে এখন কথা বলছি বলে কি তুমি মন খারাপ করছ?’
নওরিনের কান্না থামছিল না৷ নওরিন চুপ করে ছিল। কিছু বলছিল না। শুভ্র আবার বলল, ‘আমাকে এখন ভালোলাগছে না? কথা বলার কি কোন ইচ্ছা নেই আমার সাথে? আমি কি চলে যাব?’
নওরিন কানতে কানতে বলল, ‘না! কেন আমার সাথে এমন করছ?’
‘আমি আবার কি করলাম! এবার তো তোমাকে কোন রকম ভয় দেখালাম না। তবুও রাগ করেছো?’
‘আমি সেটা বলছি না।’
বলে নওরিন ফুপিয়ে কেদে ফেলল। সে কান্না থামানোর অনেক চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। শুভ্র আবার হাসি হাসি ভাব নিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু জানি তুমি কেন কাদছ।’
‘তুমি কেন আমার থেকে এতোটা দূরে থাকো? আর যখন দূরেই থাকবে তাহলে কেন আমাকে তোমায় ভালোবাসতে বাধ্য করলে?’
‘আমি তো ইচ্ছা করে তোমার থেকে দূরে থাকি না। আমি যে বড় একটা সমস্যা তৈরি করে ফেলেছি। সেটা থেকে যে বের হতে পারছি না।’
‘তুমি হয়তো মানুষ না হতে পার কিন্তু আমি তো মানুষ। আমার ভালোবাসার কি একটু মূল্য দিবে না?’
‘কে বলেছে আমি মানুষ না? আমিও মানুষ। তোমার মতোই মানুষ। আর সবার মতোই মানুষ। কিন্তু আমি একটু অন্যরকম মানুষ। আমারও বাবা-মা আছে। সরি ছিল। তারাও অন্যদের মতো সাধারণ মানুষ।’
নওরিনের কান্নাটা হঠাৎ থেমে গেল। নওরিন যেন কিছুটা ধাক্কা খেল। নওরিন কষ্ট করে তার কান্না আটকিয়ে ফেলে। নওরিন চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘ছিল মানে কি? কি হয়েছে তোমার বাবা-মার? আমাকে প্লিজ বলো না। আমি তোমার ব্যাপারে সব কিছু জানতে চাই।’
‘আমার বাবা-মা ছিল মানে হচ্ছে যে তারা একসময় ছিল এখন নেই। মারা গেছেন দুজনেই। এই কারণে আমি এখনো একা। একা একা জীবনযাপন করি। কোথাও কেউ নেই।’
‘আমাকে প্লিজ বলো না। তোমার জীবনের কাহিনীটা। কিভাবে তুমি এই সুপার পাওয়ার পেয়েছো। আর তুমি এখনই বা কোথায়?’
‘আচ্ছা বলছি। আমি কোনদিন কাউকে নিজ সম্পর্কে বলি নি। তোমাকে বলছি। কি কারণে জানো? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। সেদিন থেকে যেদিন আমি তোমাকে সরাসরি প্রথম দেখি।’
শুভ্র কিছুক্ষণ সময় নিল। যেন কিছু একটা গুছিয়ে নিল। অন্যদিকে নওরিন চুপচাপ থাকল। শুভ্র এভাবে বলতে থাকল,
‘আমার জন্ম ঢাকার অভিজাত এক পরিবার। আমাদের একটা দোতলা বাড়ি ছিল। এখনো আছে। বাড়িটার সামনে মাঝারি সাইজের একটা লন ছিল। লন পুরোটা সবুজ ঘাসে আবৃত। একটা ছোট্ট বাগানও ছিল। আমার দাদা শখ করে বাড়িটা তৈরি করেছিল। কিছুটা রাজবাড়ির মতো। ভাবছ আমার বাসা যদি ঢাকায় হয় তাহলে আমি স্বপ্নে কি দেখিয়েছিলাম। সেটাও সত্য৷ তবে সেটা আমি নিজের মস্তিষ্কের শক্তি দিয়ে তৈরি করেছিলাম। আমি একসাথে দুইটা জায়গায় অবস্থান করতে পারি। একটা বাস্তবে আরেকটা কল্পনায়। আমার বাবা-মা দুজন ভালোবেসে বিয়ে করে। কিন্তু এটা আমার নানা-নানীরা মেনে নিতে পারেনি। আমার বাবা কোন খারাপ ছেলে ছিল না। আমার বাবা আমার কাছে মনে হয় হাজারে না লাখে একজন ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ সব সময় থাকে যারা মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় মেয়ে যদি কোন ছেলেকে ভালোবাসে। তবে সেটা মেনে নিবে না। কারণ তাদের কাছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের ভালোবাসা হচ্ছে পাপের মতো। নানা আমার মায়ের বিয়ে ঠিক করে অন্য এক ছেলের সাথে। তাই বাবা নানার সাথে সরাসরি কথা বলতে যায়। সেখানে গিয়ে নিজেদের ভালোবাসার কথাটা নানাকে জানায়৷ আর নানা এতে রেগে যায়। কারণ তার কাছে ভালোবাসা শব্দটাই ছিল বিষের মতো। তাই আমার নানা আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তাই আমার বাবা-মা দুজনে আমার নানাবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। অন্যদিকে আমার দাদা-দাদী ছিল একদম বিপরীত। তারা আমার বাবা-মার ভালোবাসা অনেক সহজেই মেনে নেয়। তারা বাবা-মার দুজনের বিয়ে ঠিক করে। বিয়ের আগে আমার দাদা নানার সাথে সরাসরি কথা বলতে নানা বাড়িতে যান। যাতে সব কিছু ঠিকঠাক করা যায়। নানাও যেন মত দেয় বিয়েতে। কিন্তু আমার নানা আমার দাদাকে অপমান করে বের করে দেয়। আমার নানার কাছে কখনো ভালোবাসার কোন মূল্য ছিল না। তার কাছে তার সিদ্ধান্ত সব। পরে আমার দাদা ঢাকায় ফিরে এসে ধুমধাম করে আমার বাবা-মার বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার দাদা-দাদী আমার বাবা-মা উভয়ের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিল। বিয়ের কিছুদিন পর আমার দাদী ক্যান্সারের কারণে মারা যায়। তখনো আমার জন্ম হয়নি। এতে আমার দাদা অনেকটা ধাক্কা খায়। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। কিন্তু তার এই মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটা বেশি দিন স্থায়ী রইল না। কারণ আমার মা আমার বাবাকে একটা খবর দেয়। আর সেটা হচ্ছে তাদের প্রথম সন্তান অর্থাৎ আমার পৃথিবীতে আসার খবর৷ আর এই খবর আমার বাবা আমার দাদাকে দিলে আমার দাদা তার সব কষ্ট ভুলে যায়। আর দাদা হওয়ার আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সবাই এই আনন্দে বিভোর হয়েছিল৷ কারণ আমি হচ্ছি তাদের বংশের প্রদীপ। আমার বাবার কোন ভাই ছিল না। তাই সবার মাঝে এক নতুন আমেজ চলে আসে। ধীরে ধীরে সেদিন চলে আসল। যেদিন প্রথম এই পৃথিবীর আলো আমি দেখলাম। সবাই অনেক খুশি। আমার বাবা-মার আনন্দ ছিল সীমাহীন। আর দাদার আনন্দ ছিল বলার বাহিরে। আমি জন্ম থেকেই অনেকটা ফর্সা ছিলাম। অনেকটা দুধের মতো সাদা। এই কারণে আমার বাবা-মা আমার নাম রাখে শুভ্র। শুরুতে সবাই সব কিছু স্বাভাবিক ভেবেছিল। কারণ কেউ জানত না আমি একটা অস্বাভাবিক ক্ষমতার মতো কিছু নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি।’
শুভ্র এতোটুকু বলার পর থেমে গেল। সব কিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। নওরিন পুরো সময় মনযোগ দিয়ে শুভ্রের কথাগুলো শুনছিল। শুভ্র চুপ হয়ে যাওয়ায় নওরিন বলল, ‘এরপর কি হয়েছিল?’
নওরিন শুভ্রের বর্তমান অবস্থা বুঝে উঠতে পারছিল না। কারণ সে শুভ্রকে দেখছিল না। শুধু টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বহুদূর থেকে শুভ্র কথা বলছিল। হঠাৎ করে চুপ হয়ে যাওয়ায় নওরিন কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। যখন কোন আওয়াজ পাচ্ছিল না নওরিন ভাবল শুভ্র হয়তো এখন আর নওরিনের সাথে কথা বলবে না। নওরিন বলল, ‘কি হলো কথা বলছ না কেন? কথা বলো প্লিজ। আমাকে ছেড়ে আবার চলে যেও না। প্লিজ।’
তখন নওরিন শুভ্রের কাশির আওয়াজ শুনতে পেল। নওরিন এই আওয়াজে যেন নিজের জীবন ফিরে পেল। শুভ্র বলল, ‘সরি। কফি আনতে একটু নিচে গিয়েছিলাম।’
‘তুমি এখন কোথায় আছো?’
‘আমি এখন নিজের বাসায় আছি। বাস্তবের বাসায়৷’
‘সেটা কি ঢাকাতেই?’
‘হুম৷ তোমাকে দ্রুত নিয়ে আসব৷ আসবে কি আমার সাথে?’
‘হুম। আমার এখনই তোমার কাছে চলে আসতে ইচ্ছা করছে। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। আর ভালো লাগছে না। তোমাকে কতদিন দেখি না।’
‘আমি কিন্তু তোমাকে এখনো দেখছি। তোমার পরনের সবুজ শাড়ি। হাতের চুড়ি সব কিছু দূর থেকে আমাকে মুগ্ধ করছে। আচ্ছা আজ এতো সাজগোছ করেছো কেন? কোথাও বেরোনোর ইচ্ছা ছিল?’
‘নাহ। এমনিতেই আমি বাসায় থাকলে সাজগোছ করি। কোথাও বের হই না। আমার তো কোন বয়ফ্রেন্ড নাই যে আমাকে হাত ধরে ঘুরতে নিয়ে যাবে৷ আমি তো এখন বেসরকারি সিঙ্গেল।’
শুভ্র হেসে দিল৷ শুভ্রের হাসির আওয়াজটা নওরিন পাচ্ছিল। শুভ্র বলল, ‘তুমি বেসরকারি সিঙ্গেল মানে? আমি কিন্তু বুঝতে পারলাম না। সরকারি সিঙ্গেল হলে কি হতো?’
নওরিনও হেসে দিল। নওরিন বলল, ‘বেসরকারি সিঙ্গেল কারণ আমার তোমার মতো একটা বয়ফ্রেন্ড আছে। এই আছে তো এই নেই। কোন স্থায়িত্ব নেই আবার সম্পূর্ণ স্থায়ী। আর সরকারিভাবে সিঙ্গেল থাকলে তো পার্মানেন্ট সিঙ্গেল। একদম একা। কেউ থাকত না। বাদ দাও আমি এমন পাগলামি কথা বার্তা মাঝে মাঝে বলে থাকি। তুমি তো আমাকে দেখছ। তোমার ইচ্ছা হলেই আমাকে দেখতে পারো। আমার কি তোমাকে একটুও দেখতে ইচ্ছা করেনা? আমারও ইচ্ছা হয় তোমার হাত ধরে হাটতে। সব সময় মনে হয় আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি।’
শুভ্র হেসে দিল। শুভ্র বলল, ‘এক সময় তুমি আমার থেকে দূরে পালাতে। আর এখন আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। আর এখন হাত ধরে হাটতে চাও। আচ্ছা বাদ দাও। পরে আমি তোমাকে নিয়ে আসব। হয়তো আমার বাসাটা আমার কল্পনার মতো এতোটা সুন্দর না। কিন্তু কোন অংশে খারাপ হবে বলে আমার মনে হয় না। আর ভালো না লাগলে না হয় তোমাকে কল্পনাতেই নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে। আচ্ছা দুইটা পয়তাল্লিশ এর আসল রহস্যটা কি একটু পরিষ্কারভাবে বলো না। কেন তুমি আমার সাথে শুধু দুইটা পয়তাল্লিশ মিনিটেই কথা বলতে? এর পেছনে কি লুকিয়ে আছে?’
‘আচ্ছা বলছি।’
শুভ্র আরেকবার কাশি দিল। ঠান্ডা লাগলে যেমন কাশি দেয় তেমন। নওরিন বলল, ‘তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে? তুমি কি অসুস্থ? যদি অসুস্থ হও তাহলে আর কথা বলতে হবে না।’
‘আরে না। আমি সুস্থ। শুধু একটা ছোট্ট সমস্যার মধ্যে আছি। সেটা থেকে দ্রুত বের হয়ে যাব। এমন সমস্যায় আগে অনেকবার পড়েছিলাম। আবার বের হয়েও এসেছি তাই তেমন কিছু না।’
শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ রইল। যেন সব কিছু গুছিয়ে নিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল। শুভ্র বলল, ‘আসলে দুইটা পয়তাল্লিশ এর অনেকগুলো রহস্য আছে। স্পেসিফিকভাবে বলতে গেলে রহস্যটা রয়েছে দুই, চার আর পাঁচ এর মধ্যে। এক এক করে বলি। আসলে এই সংখ্যা সম্পূর্ণ জীবনটা জুড়ে আছে। আমার জন্ম হয় চব্বিশে মে। মানে ভাঙলে পেতেছো সিরিয়ালে দুই চার পাঁচ। আর জন্মের মুহূর্তটা হচ্ছে রাত দুইটা পয়তাল্লিশ। আমার জন্মের পর থেকে আমার পরিবারকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমার জন্মের পর প্রথম যে সমস্যাটা দেখা দেয় সেটা হচ্ছে আমার কান্না নিয়ে। আমার এই সমস্যার কারণে অনেক মানুষকে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। সেটা হচ্ছে আমি যখন কান্না করতাম তখন যারা আমার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেত তাদের প্রত্যেকের প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করত। এর কারণ হচ্ছে আমার কান্নার সাউন্ড ওয়েভ ছিন্ন একদম অন্য রকম। যেটা মস্তিষ্কের নিউরনের সংযোগস্থল অর্থাৎ সিন্যাপস এ সরাসরি আঘাত করত। যার কারণে যারা শুনত তাদেরই মাথা ব্যাথা করত। এই অনেকে কারণে আমার বাবা-মাকে আমাকে মেরে ফেলার পরামর্শ দেয়। তাদের ধারণা ছিল আমি আসলে মানুষ না। কোন পিশাচ বা এমন কিছু। যাকে মেরে ফেলাই সবচেয়ে উত্তম। কিন্তু আমার বাবা-মা দুজনের একজনও এটা মেনে নেয় না। কারণ তারা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসত। আমার দাদাও এর সম্পূর্ণ বিরোধীতা করে। আবার আমার কারণে কেউ একটু শান্তিতেও থাকতে পারত না৷ আমার কান্না শুনলে সবার এতোটা মাথা ব্যাথা করত যা বলার মতো না৷ সেদিন রাতে তোমার যতটা মাথা ব্যাথা করছিল তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি। এই কারণে বাড়িতে আর যারা থাকত তারা যাতে শান্তিতে থাকতে পারে তাদের জন্য আমাকে এক আলাদা ঘরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যে ঘরটা হবে সম্পূর্ণ কাচের তৈরি। আর সেখান থেকে কোনভাবে কোন ধরনের আওয়াজ বের হতে পারবে না। আমাকে সেখানে রাখা হতো। আমার মা খেয়াল করে দেখত যে আমি কাচের ঘরে একা থাকলে আরও বেশি কান্না করতাম। আর এটা মা সহ্য করতে পারত না।’
এতোটুকু বলতে বলতে শুভ্রের আওয়াজ একটু ভেজা ভেজা শোনা যেতে লাগল। যেন সে কেদে ফেলেছে৷ তবে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিল। তার কান্নার কোন আওয়াজ নওরিন পাচ্ছিল না। তবে নওরিন বুঝতে পারছিল যে শুভ্র হয়তো কাদছে। নওরিন বলল, ‘তুমি কি কাদছ?’
‘জানি না৷ খারাপ লাগছে অনেক। মায়ের কথা মনে পড়ছে। আর আমি যদি এখন কাদি তাহলে তোমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে। তোমার কি মাথা ব্যাথা করছে?’
‘নাহ। তোমার কি এই সমস্যাটা এখনো সাথে আছে?’
‘হুম। এটা আমাকে কখনো ছেড়ে যায়নি। রোগটা আমাকে ভালোবাসে তো তাই সাথে থেকে যায়।’
বলে শুভ্র হেসে ফেলল। নওরিন শুভ্রের হাসির আওয়াজ শুনে হাফ ছাড়ল একটা। শুভ্র আবার বলতে শুরু করল, ‘মা আমাকে কান্না করতে দেখে কাচের ঘরে ঢুকে যেত৷ আর আমি মাকে দেখেই কিছুক্ষণ কান্না করে থেমে যেতাম। হাসতাম। মা আমাকে আদর করত৷ আমি যেন মাকে দেখলে নতুন কিছু পাওয়ার মতো আনন্দিত হতাম। এরপর এমন হলো যে কাচের ঘরটা নিজের জায়গাতেই থাকত শুধু আমাকে আর সেখানে রাখা হতো না। আমি দিনের কিছু মুহূর্ত কান্না করতাম। আর সেটা মা কষ্ট কিরে সহ্য করে নিত। তবুও কাচের ঘরে রাখত না৷ এই কারণে বাড়ির কাজের লোকগুলো বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল। কারণ তারা মাথা ব্যাথা সহ্য করতে পারত না। কিন্তু মা সেটা সহ্য করে আমার সাথেই থাকত। জানি না এটা কি শুধু আমার মা করত নাকি সবার মা করতে পারত। আমাদের বাড়ির জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকল। নতুন নতুন কাজের লোক অনেকে আসত কিন্তু থাকতে পারত না। তবে এটা বেশি দিন স্থায়ী রইল না। কারণ আমি ধীরে ধীরে কান্না থামিয়ে দিলাম। একটা সময় আসল যখন আমি কান্না করা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে থাকলাম। কিন্তু সেটা বেশ দেরি হয়ে গেল৷ এর আগেই আমি একটা জিনিস হারিয়ে ফেলতে চলেছিলাম। আমার শুধু এই কান্নার কারণে যে আমাকে সব থেকে ভালোবাসত তাকে হারাতে যাচ্ছিলাম।’
শুভ্র আবার আটকে গেল। কিছু বলার মতো পাচ্ছিল না। সে এবার আওয়াজ করেই ফুপিয়ে কেদে ফেলে। তার হাহাকার সব বাধা হার মানিয়ে যাচ্ছিল। নিজের মনের ভেতরকার কষ্ট আর ধরে রাখতে পারছিল না। তার ভেতরকার আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল। শুভ্রের কান্নার আওয়াজের কিছুটা বের হওয়ার সাথে সাথে নিজেকে সংযোত করে ফেলে। নওরিনের কানে কিছুটা এই আওয়াজ পৌছানোর সাথে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। তীব্র মাথা ব্যাথা। যেন মাথা ছিড়ে যাচ্ছিল। সব কষ্ট যেন এই কষ্টের কাছে হার মেনে যাচ্ছিল। শুভ্র স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি। আমার কারণে তোমার মাথা ব্যাথা করছে। আমি এখনই কমিয়ে দিতেছি।’
নওরিনের এমন অবস্থা হয়ে গেল যে কিছু যেন বুঝতে পারছিল না৷ তবুও নওরিন বলল, ‘তুমি আমার মাথার যন্ত্রণা কমাতে গেলে আবার তোমার মাথা ব্যাথা শুরু হবে। এর চেয়ে আমি এই কষ্ট সহ্য করি।’
‘তুমি পারবে না। আমি জানি এটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক। তুমি চুপ করে পাঁচ পর্যন্ত গুনতে থাকো দেখতে মাথা ব্যাথা একদম উধাও হয়ে গেছে।’
নওরিন চোখ বন্ধ করে পাঁচ পর্যন্ত গুনে। আর সাথে সাথে মাথা ব্যাথা ঠিক হয়ে যায়। আগে যতটা ভালো লাগছিল এখন তার থেকেও বেশি ভালো লাগতে শুরু করে। নওরিন বলল, ‘তোমার কি এখন মাথা ব্যাথা করছে?’
‘বলছি। জানো আমি যদি আগে জানতাম যে আমি এই কাজটা অনেক সুন্দর ভাবে করতে পারি। মানে যে কারো মাথা ব্যাথা মুহূর্তের মধ্যে শেষ করতে পারি তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো৷’
‘কি হয়েছিল তোমার সাথে? আর তোমার বাবা-মার কি হয়েছিল?’
‘আমার বয়স যখন আট মাস তখন আমার মায়ের ব্রেন টিউমার দেখা দেয়। আর এটা আমার জন্য হয়। কারণ আমি যখন মায়ের সামনে কাদতাম তখন মা আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে রাখত। এখন তুমি যে রকম মাথার যন্ত্রণায় কাতর ছিলে তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি। এটা তার ব্রেনে ইমপ্যাক্ট ফেলে৷ যা ধীরে ধীরে টিউমারে পরিণত হয়ে যায়। আমি খেয়াল করতাম যে আমার মায়ের মাথা ব্যাথা প্রায় সব সময়ই করত৷ কিন্তু আমি সেটা কমাতে পারতাম না। কারণ আমি নিজের শক্তি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতাম না৷ জানতাম না যে আমি সহজেই কারও মাথা ব্যাথা কমাতে পারি। থাক আমি আর কিছু বলতে পারছি না। দুই বছর বয়সে আমি আমার মাকে হারিয়ে ফেলি। যে আমাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসত তাকে হারিয়ে ফেলি। যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম তাকে হারিয়ে ফেলি। আজ আমার বুকের ভেতরে হাহাকার করছে৷ আমার কারণে আমার মা আজ এই পৃথিবীতে নেই। শুধু আমার কারণে। আমার এখন একটু কাদতে ইচ্ছা করছে। বহুদিন কাদি না।’
নওরিন স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনছিল। সে কিছুটা অন্তত শুভ্রের কষ্টটা বুঝতে পারছিল। কারণ সে নিজেও তার মাকে হারিয়েছে। নওরিনের চোখ দয়ে পানি বের হচ্ছিল। নওরিন বলল, ‘আই’ম সরি।’
‘সরি বলার কিছু নেই। যাকে ভালোবাসো তার বিষয়ে এতোটা জিজ্ঞাসা করার অধিকার তুমি নিশ্চয় রাখো। আজকের মতো বিদায় নেই। আর দ্রুত তোমার সাথে কথা বলব। গুড বাই।’
চারদিকে নীরবতা ছেয়ে গেল৷ নওরিনের কথাগুলো শোনার পর অনেক মন খারাপ করতে লাগল। কোন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল না। চারদিকে স্তব্ধতা ছেয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর নওরিন যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেছিল ঠিক তখন আবার শুভ্রের কন্ঠস্বর শুনতে পায়৷ ঠিক মতো লক্ষ্য করলে বুঝতে পারে শুভ্র হাসছে। কিন্তু স্বাভাবিক হাসি না। সেই প্রথম দিকে যেমন হাসি দিত তেমন। অনেক পৈশাচিক হাসি। নওরিন বুঝতে পারছিল না শুভ্রের হঠাৎ এমন পরিবর্তন এর কারণ। নওরিন বলল, ‘কি হয়েছে তোমার? এমন করে হাসছ কেন?’
‘এতোক্ষণ যা বললাম তা কি বিশ্বাস করেছো?হাহাহা।’
নওরিন ভয় পেয়ে গেল। ভীত কন্ঠস্বরে বলল, ‘হুম। কেন করব না?’
‘কারণ এমন তো হতে পারে যে এতোক্ষণ যা বললাম সেগুলো সব মিথ্যা। হয়তো আমি এগুলো শুধু তোমার সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য বললাম। যাতে তুমি আমার দিকে ঝুকে পড়ো। আমি আসলে তো মানুষ নাও হতে পারি। আমি কোন খারাপ কিছু হতে পারি। আমি এলিয়েন হতে পারি আবার ভুতও হতে পারি। হয়তো কোন মানুষ রূপী পিশাচ হতে পারি। আবার শুধু তোমার কল্পনাও হতে পারি। অনেক কিছুই হতে পারি। হাহাহা।’
নওরিন আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল। কিছু বুঝতেছিল না। চোখ ছলছল করছিল। হঠাৎ করেই সব কিছু আবার উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছিল। কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছিল না। নওরিন বলল, ‘কেন করছ এমন? এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে আমাকে আবার ভয় দেখাচ্ছ কেন?’
‘হয়তো এটাই আমার স্বাভাবিক আচরণ আর এতোক্ষণ ভালো সেজে ছিলাম তোমাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য।’
শুভ্র কঠিন একটা হাসি দিল৷ যেনো তার মধ্যে কোন পশু প্রবেশ করেছে। আর এই পশুটাকে নওরিন ঘৃণা করে। সব থেকে বেশি ঘৃণা করে।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here