দুইটা পয়তাল্লিশ শেষ পর্ব

0
443

গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ
পর্বঃ ১১ বা সমাপ্তি পর্ব
লেখকঃ Parvez Rana

সব কিছু অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আলো আধারের খেলার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হচ্ছিল। নিজের শরীরের উপর থেকে নিজেই যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম। এটাই কি মৃত্যু যন্ত্রণা! মানুষ কি এই যন্ত্রণা থেকে বাচতে এতো কিছু করে! এই প্রশ্নটার উত্তর আমার বড্ড জানতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু কে দিবে এই সবের উত্তর? কিছু বুঝা যাচ্ছিল না। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। শুধু অন্ধকার দেখছি। আমি কি সত্যিই মারা গেছি? চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে ‘আমাকে কেউ একটু সাহায্য কর৷ কেউ এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। ক্রিস্টিনকে অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে। কেউ আমাকে ক্রিস্টিনের কাছে পৌছে দাও। প্লিজ।’ আমি কাদছিলাম। অসহ্যকর যন্ত্রণায় বারবার চিৎকার দিয়ে উঠছিলাম। কেউ সে চিৎকার শুনে আমাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছিল না। কোন জবাব আসছে না। কেউ কি সত্যিই তাহলে আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। চারদিকে শুধুই স্তব্ধতা। কোন আলো নেই কোন আওয়াজ নেই। অন্ধকারে ডুবে রয়েছে সব কিছু। এমন হচ্ছে কেন? তাহলে কি শুভ্রের কথা সত্য হয়েছে? আমি কি সত্যি মারা গিয়েছি? তাহলে তো ক্রিস্টিন একদম একা হয়ে গেল। আমি এখন কাদতে পারছি না কেন? আমার অনেক বেশি কাদতে ইচ্ছা করছে। আমি যে কাদতে চাই কিন্তু কাদতে পারছি না কেন? কেউ একটু প্লিজ সাহায্য করো। আমাকে এখান থেকে প্লিজ বের করে নাও। আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আমি মুক্তি চাই।
হঠাৎ বহুদূর একটা আলোর ঝলকানির মতো কিছু একটা দেখতে পেলাম। চারদিকে অন্ধকার। কোথাও কোন আলোর ছিটেফোঁটা নেই। শুধু সেই রশ্মিটা দেখা যাচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল ছুটে যাই সেখানে। কিন্তু পা যে অবশ হয়ে রয়েছে। এগোতে পারছি না। পা যেন আটকে গেছে চোরাবালিতে। এখান থেকে যেন কখনো বের হতে পারব না। চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। স্থবিরতা যেন আমাকে গিলে খেয়ে ফেলেছে। আলোক ঝলকানিটা এগিয়ে আসছিল সাথে তার পেছনের অংশকে আলোকিত করতে করতে আসছে৷ মনে হচ্ছিল কেউ যেন অন্ধকারকে বধ করতে মশাল হাতে এগিয়ে আসছে। আমি দৃঢ়ভাবে তার জন্য অপেক্ষা করছি। এক অজানা বিশ্বাস রয়েছে তার উপর। কিন্তু কেউ কি আসলেই আসছে নাকি আমার চোখের ভুল। কি হচ্ছে আমার সাথে বুঝতে পারছিলাম না। অপেক্ষায় রইলাম শুধু সেই আলোর জন্য। যেটা আমার দিকে আসছিল ধীরে ধীরে। এই আলোর বেগ যেন সাধারণ আলোর বেগের মতো না। এই আলোর বেগ সামান্য। যে বেগে আমার কাছে পৌছাতে পারছিল না। কিন্তু আমি যে সেটার জন্য গভীর ভাবে অপেক্ষা করছি। যে আসছে সে কি জানে না আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। সে কেন দ্রুত আসছে না! সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল আমার দিকে।
আলোটা এক পর্যায়ে আমার কাছে পৌছে গেল। পৌছানোর সাথে সাথে যেন সব কিছু আলোকিত হয়ে গেল। যেন চারিদিকে আলোটা ছরিয়ে আলোর সর্বোচ্চ বেগে। অন্ধকার দূরীভূত হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এই আলোর মধ্যে আমি একজনকে দেখতে পেলাম। যে এই আলোটাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। সে আমার দিকে এগিয়ে আসল। সে এসে বলল, ‘ভাইয়া আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’
শুভ্রের কথা আমার ঘোর কেটে গেল। শুভ্রকে আমি অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। কেমন যেন সব কিছু পুরোনো দিনের সাদা কালো মুভির নায়কদের মতো শুভ্রকে দেখতে লাগছিল। আশেপাশের সব কিছুই সাদা কালো লাগছিল। রঙিন কোন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। কোন উত্তর না না দেয়ায় শুভ্র আবার বলল, ‘ভাইয়া আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? এখনো কি ভয় কাটেনি?’
আমি বললাম, ‘আমি এখনো ভয় পাচ্ছি।’
শুভ্র আমার দিকে ওর হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার হাতটা ধরুন। দেখবেন ভয় কিছুটা কমে যাবে। আর ভয় পাবেন না আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্য এসে গেছি।’
আমি শুভ্রের হাতটা ধরে ফেললাম। কিন্তু কোন ধরনের অনুভূতি পেলাম না। একজন মানুষের হাত ধরলে তার স্পর্শের অনুভূতি পাওয়া যায় কিন্তু আমি সেই অনুভূতি পাচ্ছিলাম না। আমি শুভ্রকে বললাম, ‘আমরা কোথায় এখন? আমি এখানে কেন এসেছি? আর কিভাবেই বা এসেছি? কিছু মনে পড়ছে না কেন আমার?’
শুভ্র খানিকটা হাসল। তারপর বলল, ‘আপনি এখন স্বপ্ন দেখছেন। আর আমি আপনার স্বপ্নের ভেতর এসেছি। আপনি হসপিটালে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। এখনো আপনার সেন্স ফিরে আসেনি। ডাক্তাররা আপনার সেন্স ফিরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। আর সেন্সলেস অবস্থায় আপনি স্বপ্ন দেখছেন। তাই এই বর্ণ, গন্ধ, অনুভূতিহীন এক অবস্থার মধ্যে আছেন।’
আমি বিচলিত কন্ঠে বললাম, ‘ক্রিস্টিন! ক্রিস্টিন এর কি হয়েছে? ও ঠিক আছে তো?’
শুভ্র বলল, ‘হ্যা সে ঠিক আছে। আপনি সেন্স হারিয়ে তার গায়ের উপর পড়ে গিয়েছিলেন। তার জন্য আপনাকে ফ্লোরে পড়ে যেতে হয়নি। সে আপনাকে আকড়ে ধরে রেখেছিল। এখন সে গভীর দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’
‘আরেকটা কথা তুমি এখানে এসেছো কিভাবে? আমার স্বপ্নে তুমি কিভাবে এসেছো?’
শুভ্র আবার হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম আমি যে কারো স্বপ্নে যেতে পারি, নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, স্বপ্ন দেখাতে পারি। আমি রঙিন স্বপ্নও দেখাতে পারি। আসলে নওরিনকে রঙিন স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে আমার এই অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। মানে হসপিটালে যেতে হয়েছিল। আগেও একবার যেতে হয়েছিল কিন্তু তারা আমার ব্রেইনের সার্জারি করেনি। কোন রকম সাধারণ মেডিসিন দিয়ে ঠিক করেছিল। কিন্তু আপনি একদম সার্জারি করেছেন। আচ্ছা বলুন তো আমি কিভাবে স্বপ্নের ক্ষমতা পেয়েছি?’
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। কিন্তু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তখন অজান্তেই বলে ফেললাম, ‘তোমার ব্রেইনের নার্ভ সিস্টেম একটু ব্যতিক্রম। আমার মনে হয় এই কারণেই পার। তবে এর চেয়েও বেশি যে কারণটা হতে পারে সেটা হচ্ছে এটা সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দিয়েছে।’
শুভ্রকে একটু গম্ভীর দেখাচ্ছিল। শুভ্র বলল, ‘হ্যা আপনি ঠিক বলেছেন। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এই শক্তি দিয়েছে। সাথে এই শক্তির লিমিটও দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি সেটাকে অতিক্রম করে গিয়েছিলাম। যেটা আমার ঠিক হয় নি। তাই আমার অবস্থা এতোটা করুণ হয়েছিল। প্রায় মারা গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি বাচিয়ে তুলেছেন।’
আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে বাচাইনি। সৃষ্টিকর্তা যদি না চাইত তাহলে আমি কেন কোন শক্তিই তোমাকে বাচাতে পারত না।’
শুভ্র একটু হাসল। তারপর বলল, ‘আপনি এটাও ঠিক বলেছেন। আপনি কি কারণে মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছিলেন সেটা কি আপনি পরিষ্কার ভাবে জানেন?’
আমি কিছুটা সময় নিয়ে বললাম, ‘সেটা আমি জানিনা। কিন্তু এটা জানি, যে ব্যক্তি মৃত্যুকে ভয় পায় সে খারাপ কাজ করতে পারে না। তার মধ্যে সব সময় এই ভয়টা থেকে যায়। মৃত্যুকে ভয় পাওয়া খারাপ কিছু না৷ বরং সৃষ্টিকর্তাই মৃত্যুকে ভয় করতে বলেছেন। এতে আমরা পাপ কাজ থেকে বেচে থাকতে পারব।’
শুভ্র একটু গম্ভীরভাবে বলল, ‘হুম বুঝলাম। আপনি কি এখন একটু আমাকে সাহায্য করতে পারবেন? মানে আমি এখন একজনের সাথে কথা বলব। আপনি শুধু আমার পাশে থাকবেন। থাকতে পারবেন তো? এটা আপনার এবং আমার দুজনের জন্যই ভালো হবে।’
আমি শুভ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমি শুভ্রের কথা বুঝতে পারছিলাম না। আমি বললাম, ‘আমি কিছু বুঝতেছি না। তুমি কি বলতে চাইতেছ? আর এখানে কার সাথেই বা কথা বলবে? এটা তো স্বপ্ন। এখানে সেই বা আসবে কিভাবে?’
শুভ্র আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি আমার সাথে একটু আসুন আপনি সব বুঝতে পারবেন। এখন আর কোন কথা না বলে চলুন আমরা এগিয়ে যাই।’
আমি আর কিছু বললাম না। সব কিছু যেন ওলটপালট লাগছিল। অনেকটা বিরক্তিকর অবস্থার মতো লাগছিল। এগিয়ে চলতে লাগলাম। রাস্তাটা সম্পূর্ণ অচেনা। কোন গাছপালা দেখছিলাম না। কিছুটা ভয় লাগছিল। হৃদপিণ্ডের প্রতিটা বিট বুঝতে পারছিলাম। কিছুটা পথ এগোনোর পর শুভ্রকে বললাম, ‘শুভ্র একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?’
‘হুম অবশ্যই। কি জিজ্ঞাসা করবেন এই যে আমি আর নওরিন কেন হসপিটাল থেকে পালিয়ে এসেছি?’
কথাটা বলে কিছুটা অস্ফুটে হাসি দিল। শুভ্র স্বপ্নের মাঝেও আমার মনের প্রতিটা কথা বুঝতে পারছিল। আমি যেটা জিজ্ঞেস করব সেটা ও আগেই বলে দিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে৷ কিছু আর বললাম না। কারণ কিছু বলার মানে নেই। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই শুভ্র বুঝে ফেলতে পারে। শুভ্র হাটতে হাটতে বলল, ‘আমি আর নওরিন পালিয়ে এসেছি কারণ আমার একটা জরুরী কাজ ছিল। যেটা আমি হসপিটাল থেকে করতে পারতাম না। নওরিন যদিও আসতে চায় নি। কিন্তু আমি এমন ভাবে অনুরোধ করেছি যে সে আর মানা করতে পারে নি।’
আমি আর শুভ্র দুজনেই হাটছিলাম। জানিনা কখন পথ শেষ হবে। সময় এগোচ্ছিল কিনা সেটাও বুখতে পারছিলাম না। সব কিছু অচেনা মনে হচ্ছিল। আমি আবার বললাম, ‘কি কাজ ছিল সেটা হসপিটালে করতে পারতে না? আর এভাবেই বা পালিয়ে আসলে কেন? নিজের কোন ঠিকানাও রাখো নি। কেন এমন করলে?’
শুভ্র কিছুক্ষণ হাসল। মনে হচ্ছিল কোন জবাব দেবে না। ওর হাসির মধ্যেও অনেক কিছু লুকিয়ে ছিল। যেগুলো আমি বুঝতে পারছিলাম না। শুভ্র বলল, ‘আমি এগুলোর উত্তর দিব না। কারণ আপনার মনের ভেতর আমি রহস্য রেখে যেতে চাই। যেগুলো আপনি কখনো সমাধান করতে পারবেন না। আর কিছু কিছু রহস্য অমীমাংসিত থাকাটাও ভালো। এতে সে ব্যাপারে সব সময় আগ্রহ থাকে।’
ররহস্যগুলোর সমাধান সত্যিই জানতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু শুভ্র এর সমাধান দিবে না। আমি পথচলার দিকে মনযোগ দিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার বারবার ক্রিস্টিনের কথা মনে পড়ছিল। তার চেহারাটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ক্রিস্টিনের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু জানি না কখনো যেতে পারব কিনা। হাটতে হাটতে শুভ্রকে বললাম, ‘আমি কি সত্যিই মারা গেছি? আমি কি কোন দিন ক্রিস্টিনের কাছে ফিরে যেতে পারব না? কোনদিনও কি ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে না। ওকে তো গুড বাইও বলা হয় নি।’
বলতে বলতে আমি কেদে ফেললাম। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এখন আমি স্বাভাবিকভাবেই কাদছিলাম। কিন্তু একটু আগেও পারছিলাম না। সব কিছুর মধ্যে ধীরে ধীরে বাস্তবতা ফিরে আসছিল। শুভ্র আমার দিকে একবার তাকালো। তারপর বলল, ‘আমি আপনাকে আগেও একবার বলেছিলাম যে আপনি এখনো বেচে আছেন। আপনি মারা যাননি। আর যদি বেচে থাকেন তবে অবশ্যই আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা করতে পারবেন। তবে আরেকটা কথা বলি সেটা হয়তো আপনার খারাপ লাগতে পারে। সেটা হচ্ছে এখন আপনি ঠিকই বেচে আছেন। কিন্তু আপনি কিছু সময়ের মধ্যে মারাও যেতে পারেন। একটু পর সেটার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
আমি অপলক দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি শুভ্রকে বললাম, ‘কারা সিদ্ধান্ত নিবে? কেনই বা সিদ্ধান্ত নিবে? আর কিসের সিদ্ধান্ত নিবে? আমি তো কোন ভুল করিনি।’
শুভ্রের মুখে কিছুটা রহস্যের হাসি দেখা গেল। হাসিটা দেখে আমার বুকটা কেপে উঠল। আমি অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শুভ্র বলল, ‘সময় এমন একটা জিনিস যেটা মানুষকে তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তরও দিয়ে দিবে। আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি আমাদের গন্তব্যে।’
পরিবেশ একদম পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আগে সব কিছু সাদা কালো লাগলেও এখন রঙিন দেখাচ্ছে। একটু আগেও মনে হচ্ছিল আমরা মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাটছি কিন্তু এখন গাছপালা দেখছি। বিভিন্ন ফুল গাছ দেখছি, ফল গাছ দেখছি। মনের ভেতর আলাদা একটা প্রশান্তি আসছিল। মনের ভেতরে সব কিছু ভালো লাগতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল এটা আসলেই স্বপ্ন। মানুষ স্বপ্নকে যতটা সুন্দর ভাবে তার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছিল। ক্রিস্টিনকে যদি এখানে পাশে পেতাম তাহলে আরও বেশি ভালো লাগত। একটা কুড়ে ঘরের মতো কিছু একটা দেখাচ্ছিল। আর শুভ্র সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। আমিও শুভ্রের পিছে পিছে যাচ্ছিলাম। কাছে গিয়ে দেখি ঘরটা কুড়ে ঘরের মতো লাগলেও একদম কুড়ে ঘর না। অদ্ভুত একটা ঘর। শুধু দেখতে কিছুটা কুড়ে ঘরের মতো লাগছিল। রংটাও অদ্ভুত। মনে হচ্ছিল এমন রং কোন দেখিনি। সব কিছুই বিচিত্র লাগছিল। শুভ্র ঘরে ঢুকে গেল। আমার ভেতরে যেতে ভয় করছিল। বুকের ভেতরে ঝড় বইছিল। কিছুই ভালো লাগছিল না। বুঝতেই পারছিলাম না স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা। মনে হচ্ছিল বাস্তবতা আর স্বপ্ন সমান্তরালে চলে এসে গেছে। শুভ্র ঢোকার প্রায় এক মিনিট পর আমি ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। সময় ঠিক ভাবে আন্দাজ করা যাচ্ছিল না মনে হচ্ছিল সময় থমকে গেছে। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে চমকে গেলাম। দেখলাম একজন বৃদ্ধ লোক একটা চেয়ারে বসে আছে। চেয়ারটাও সাধারণ কোন চেয়ারের মতো না কিছুটা সিংহাসন এর মতো। তার চেহারায় বয়সের ছাপ থাকলেও তার রূপে বয়সের কোন ছাপ পড়েনি। কোন বৃদ্ধ মানুষের চেহারা এতোটা সুন্দর, এতোটা উজ্জ্বল হতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি ঢোকার শুনলাম যে তিনি বলছেন, ‘তুমি আবার এসেছো?’
আমি বুঝতে পারছিলাম না কাকে বলছেন। কারণ তিনি চোখ বন্ধ করে তার হাতের দুইটা আঙুল কপালের সাথে লাগিয়ে রেখেছেন। দেখে মনে হচ্ছিল কোন কিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন। আমি শুভ্রের প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে দিকে তাকালাম। তখন শুভ্র বলল, ‘হ্যা এসেছি আমি।’
উনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু চোখ খুললেন না। তারপর বললেন, ‘তোমার সাথে কে এসেছে?’
শুভ্র একবার আমার দিকে তাকালো। তারপর বলল, ‘আমার সাথে নিখিল ভাইয়া এসেছে। ভাইয়া একজন ডাক্তার।’
উনি একটু হাসলেন। হাসিটা অনেকটাই রহস্যময়। এমন হাসি আমি আগে শুভ্রের মুখে দেখেছিলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি ডাক্তার এনেছো কেন? আমার চিকিৎসা করানোর জন্য। আমার তো কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। কারণ চিকিৎসা প্রয়োজন হয় জীবিত মানুষের জন্য। কিন্তু আমি তো একজন মৃত মানুষ। যে বহুযুগ আগেই মারা গেছে।’
আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ আমার সামনে একজন মৃত মানুষ বসে আছেন। বারবার শিউরে উঠছিলাম। কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিল। শুভ্র কিছু বলছিল না। নীরব হয়ে গিয়েছিল। তিনি চোখ খুলে ফেললেন। আমি তার চোখ দেখে অনেকটা অবাক হয়ে গেলাম। তার চোখের রং ছিল কিছুটা সবুজ৷ সবুজ রঙের চোখ যে কারো হতে পারে আমার জানা ছিল না। কেমন যেন ভয় ভয় হতে লাগছিল। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। তারপর তার হাত আমার ওনার হাত আমার কাধের উপর রাখলেন। হাতটা রাখার সাথে সাথে যেন আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। সব কিছু ওলট পালট লাগছিল। ওনার চাহনি দেখে আমি বারবার শিউরে উঠছিলাম। উনি বললেন, ‘তুমি জানো আমি কে? আমি হচ্ছি শুভ্রের দাদার বাবা। মইংরেজিতে যাকে বলে গ্রেট গ্র‍্যান্ডফাদার। শুভ্রের যেমন অস্বাভাবিক কিছু শক্তি আছে তেমনি আমারও এ ধরণের শক্তি ছিল। কিন্তু আমি কখনো শুভ্রের মতো এই শক্তির ভুল ব্যবহার করিনি। কিন্তু শুভ্র করেছে। আর বারবার করেছে। এই অস্বাভাবিক শক্তিটা আমাদের বংশপরম্পরায় পাওয়া। আমার আগে আমার গ্রেট গ্র‍্যান্ডফাদারের ছিল। আমাদের মধ্যে কেউই এ শক্তির অপব্যবহার করেনি। কিন্তু শুভ্র বারবার করেছে।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারপর বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকালাম৷ শুভ্র তখন মাথা নিচু করে দাড়িয়েছিল। শুভ্র কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমি এই শক্তির কোন অপব্যবহার করিনি। হ্যা কয়েকবার নিয়মভঙ্গ করেছি কিন্তু সেটা ভালো কাজ করার জন্য করেছি।’
ওনার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তার চেহারার কাঠিন্য ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম। তিনি কঠিনভাবে বললেন, ‘তুমি অপব্যবহার করোনি! তুমি এই ডাক্তারকে এখানে নিয়ে এসেছো এটা অপব্যবহার না? নাকি তুমি জানোই না কোনটা অপব্যবহার?’
আমি বারবার শুভ্রের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম আবার সেই বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। কিছু বোঝা যাচ্ছিল না কি ঘটছে। শুভ্র বলল, ‘আমি ভাইয়াকে এনেছি কারণ আপনারা ভাইয়াকে মেরে ফেলতে পারেন। আমার ভয় হয় এটা নিয়ে। কারণ আজ পর্যন্ত যারাই আমাকে সাহায্য করে আপনি তাদেরকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যান। যারা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচায় আপনি তাদেরকেও মেরে ফেলেন। শুরুতে আমার মাকে কেড়ে নিলেন, তারপর দাদুকে, তারপর আমার বাবাকে, অবশেষে আমার অদিতিকে। এমনকি যেসব লোক আমাদের বাড়িতে কাজ করত আর আমাকে ভালোবাসত আমি খবর নিয়ে দেখেছি তারাও কেউ বেচে নেই। কেন এমন করেন আমার সাথে? কেন আমার কাছ থেকে সবাইকে কেড়ে নেন? কেন আমাকে একা করে দেন? যদি একা করে দিবেন তাহলে আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন কেন? কেন? কেন? এই সব কেন এর জবাব দিতে পারবেন?’
শুভ্র কথা বলতে বলতে কেদে ফেলল। কারও কান্নার আওয়াজ এতোটা করুণ হতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি ওর শোনার সাথে সাথে আমার মাথা ঝিম ধরে যাচ্ছে। শুভ্রের হাহাকারের কথা শুনে আমার বুকের ভেতরও হাহাকার করতে লাগল। কারণ ওর আমার কিছুটা মিল আছে। কারণ শুভ্রও আমার মতো প্রথমে ওর মাকে হারিয়ে ফেলেছে। তারপর আবার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমার থেকেও ওর কষ্টটা বেশি। কারণ শেষ পর্যন্ত নিজের ভালোবাসাটাও হারিয়ে ফেলেছিল। আমার নিজেরও অনেক বেশি খারাপ লাগতেছিল। শুভ্রের গ্রেট গ্র‍্যান্ডফাদার বলল, ‘তুমি কাদবে না। কারণ তুমি কাদলে এই স্বপ্নের মধ্যেও ইফেক্ট পড়ে। আমার উপর না পড়লেও ডাক্তারের উপর পড়বে৷’
শুভ্র অকাতরে কাদছিল। যেন কান্না থামবে না। শুভ্র কিছুটা থেমে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘হ্যা। এখন তো এটাও বলবেন। কারণ আমাকে তো কান্নার স্বাধীনতাটাও দেন নি। সেটাও তো কেড়ে রেখেছেন। কেন এই শক্তি দিয়েছিলেন আমাকে যার কারণে আমাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়?’
শুভ্রের চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। আমি নিজের মৃত্যুর খবর শোনার পর যতটা কেদেছিলাম শুভ্রের কান্নার পরিমাণ তার থেকেও বেশি। শুভ্রকে বাইরে থেকে বুঝা না গেলেও ওর ভেতরে যে অনেক বেশি পরিমাণে বেদনা আছে সেটা বুঝা যাচ্ছিল। পরিবেশটা স্তব্ধ হয়ে উঠছিল। বুঝতেছিলাম আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। কেমন যেন পরিবেশটার পরিবর্তন ঘটছিল। মনে হচ্ছিল কিছু অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে যাচ্ছিল। আমার ভয় করছিল। বৃদ্ধ লোকটা বলল, ‘তুমি কি জানো কারও মৃত্যু আমার হাতে নেই৷ আমি কাউকে মেরে ফেলতেও পারি না। আবার কারও মৃত্যুর সময় আসলে তাকে বাচিয়েও রাখতে পারি না। আমি শুধু তোমার গাইড হিসেবে থাকি। কাউকে মেরে ফেলার জন্য না।’
শুভ্র কাদছিল। আমি শুভ্রের কাছে গিয়ে ওর কাধের উপর হাত রাখলে। শুভ্র আমার হাতটা ওর হাত দিয়ে কাধ থেকে সরিয়ে ধরে রাখে। তারপর বলল, ‘জানেন ভাইয়া আমার আমার মনে হয় আমি কোন কারাগারে আছি। এটা আমার হাত পা সব কিছু শিকল দিয়ে বেধে রেখেছে। আমি নিজের স্বাধীনতা কি জিনিস সেটা আমাকে দেয়া হয় নি।’
আমার কিছু বলার ছিল না। আমার কাছে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোন শব্দ ছিল না। চুপচাপ সব কিছু দেখতে হচ্ছিল কারণ আমার নিজের কিছু বলার অধিকার নেই। শুভ্র এতো কথা বলছিল কিন্তু বৃদ্ধ লোকটার মুখে কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছিল না। যেন তার মধ্যে কোন ইমোশন নেই। হার্টলেস একজন মানুষের মতো লাগছিল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, ‘আমি কখনো তোমাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখিনি। আমি তোমাকে আগলে রেখেছি। যাতে তুমি কখনো বাহিরের বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে পার। আর তুমি বলছ আমি তোমার কাছ থেকে সবাইকে কেড়ে নিয়েছি এটা আসলে একটা ভুল কথা। আমি কখনো কাউকে কেড়ে নেয় নি। বরং সবাইকে আরও তোমার কাছে শক্ত করে বেধে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি তো একজন মৃত ব্যক্তি আমার তো কোন শক্তিই নেই। তবুও সকল চেষ্টা করেছি।’
এই প্রথম বার ওনার কন্ঠের ব্যাকুলতা লক্ষ্য করা গেল। কথার মাঝে কিছুটা আটকে যাচ্ছিল। তিনি ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি কোনদিন চায় নি তুমি তোমার মাকে হারাও বা বাবা বা দাদা অথবা তোমার ভালোবাসা অদিতি অথবা তোমার অন্যান্য কাজের লোক এমনকি আমি এটাও চায় নি যে দ্বিতীয় বার নওরিনকে স্বপ্নে আনার পর তোমার কোন ক্ষতি হোক৷ আর তুমি বলছ আমি ডাক্তারকে মেরে ফেলতে পারি। তুমি কি জানো আমি কত মানুষকে জীবনে হারিয়েছি? কত ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলেছি? তুমি জানো না। জানার প্রয়োজনও নেই। তুমি তো চেয়েছিলে নওরিনকে একটা সুন্দর স্মৃতি উপহার দিয়ে মারা যেতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি চাই নি। কারণ তুমি আমাদের বংশের শেষ ব্যক্তি যে এখনও বেচে আছে। আর দূর দূর পর্যন্ত সবাই মারা গেছে। তুমি যদি মারা যাও তবে আমাদের বংশ পরম্পরা যে একদম শেষ হয়ে যেত। তুমি যখন মারা যাচ্ছিলে তখন আমি তোমাকে নিজের শেষ চেষ্টা দিয়ে বাচিয়ে রেখেছিলাম।’
সব কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেল। ওনার গলার আওয়াজে কান্না কান্না ভাব ফুটে উঠছিল। কিন্তু বুঝা যাচ্ছিল যে নিজের আবেগকে সংযত করার চেষ্টা করছেন। আমি আর আমি আর শুভ্র দুজনে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বললেন, ‘শুভ্র তুমি তোমার দাদু মারা গেলে অনেকটা কষ্ট পেয়েছিলে ঠিক না?’
শুভ্রের চোখের পানির বিন্দু তখনও দেখা যাচ্ছিল। শুভ্র মাথা নাড়ল। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেল। আমার নিজের অজান্তেই নিজের চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। এবার খেয়াল করলাম ওনার চোখ দিয়েও পানি বের হচ্ছিল৷ শুভ্র গ্রেট গ্র‍্যান্ডফাদার বললেন, ‘তুমি কিভাবে ভুলে যাচ্ছ যে ও আমার ছেলে ছিল। ওর মৃত্যুতে আমি মারা গিয়েও কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তা কি কোনদিন বুঝতে পারবে? বাবার কাছে ছেলের মৃত্যুটা কষ্টের সেটা আমি নিজের মৃত্যুর পরেও টের পেয়েছি। তুমি কি কোনদিন সেটা বুঝতে পারবে?’
উনি এবার একদম সম্পূর্ণ কেদে ফেললেন৷ ওনার আর্তনাদ আমার হৃদয়ে আঘাত করছিল। কারও যে এতোটা কষ্ট থাকতে আমি জানতাম না। সব সময় ভাবতাম হয়তো সবচেয়ে কষ্টে আমিই ছিলাম কিন্তু কারও মনে মারা যাওয়ার পরেও এতোটা কষ্ট থাকতে পারে আমার জানা ছিল না৷ কোন দিন হয়তো সেটা বর্ণনাও করতে পারব না। সব কিছু যেন হাহাকারের মতো মতো লাগছিল। তিনি কাদছিলেন। শুভ্রও কাদছিল। জানিনা কেন আমিও কাদছিলাম। তিনি আবার বললেন, ‘তোমার দাদু যেমন তোমাকে ভালোবাসত আমিও তেমন আমার নাতিকে মানে তোমার বাবাকে ভালোবাসতাম। আর তুমি বলতেছো আমার কারণে তুমি তোমার বাবা মাকে হারিয়ে ফেলেছো৷ একবার ভেবে দেখো আমি কিভাবে চাইব সে চলে তোমাকে একা ফেলে রেখে চলে আসুক। শোন আমি কোনদিনও চাই নি যে তুমি সবাইকে হারাও। কিন্তু নিয়তির কারণে তুমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছো। আর তোমাকে হয়তো হারাতে হবে না। আর তুমি সবার সাথে ডাক্তার সাহেবের মৃত্যুটা গুলিয়ে ফেলেছিলে। তার যদি মৃত্যু থাকে তবে সেটা কেউ আটকাতে পারবে না। এটা সম্পূর্ণ যিনি সৃষ্টি করেছেন তার হাতে। কারণ একমাত্র সৃষ্টিকর্তার হাতে সৃষ্টিকে মেরে ফেলার ক্ষমতা আছে। আমার কোন ধরণের ক্ষমতাই নেই। আর আমি তো নিজেই মৃত কিভাবে অন্যকে মেরে ফেলব। সময় ফুরিয়ে আসছে। চলে যাও তোমরা। শুভ্র তুমি আর আমাকে পাবে না। কারণ তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো৷ এখন আর তোমার গাইডের প্রয়োজন নেই। আমি এখন চলে যাব। আর তুমি আমাকে অনেক আগেই তর্কে হারিয়ে দিয়েছিলে যখন তোমার সার্জারি হচ্ছিল। এখন আর আমি থাকব না। থাকলেও তোমার সাথে দেখা করব না।’
আমি আর শুভ্র দুজনেই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালাম। আমি অনেক বেশি অবাক হয়ে গেলাম। শুভ্রের মুখে ততটাও বিস্ময়ের ছাপ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু কিছুটা হলেও অবাক হয়েছিল৷ শুভ্র এগিয়ে গিয়ে ওনার হাতটা ধরল। তারপর কেদে ফেলল। কেদে কেদে বলল, ‘আপনি কেন এসব আগে বলেন নি? আমি আপনার সাথে বারবার খারাপ ব্যবহার করতাম। কিভাবে ভুলে যেতাম তারা আমার থেকেও বেশি আপনার আপনজন ছিল। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিবেন। আর এভাবে চলে যাবেন না।’
ওনার মুখের কোণে একটা হাসি দেখা গেল। কেমন রহস্যময়ী হাসি৷ উনি বললেন, ‘অনেকদিন তো তোমার সাথে থাকলাম। আর আমি তো একজন মৃত ব্যক্তি৷ মৃত মানুষের থেকে জীবিত মানুষের সাথে সমিয় কাটানোটা বেশি ভালো হবে। শেষ বারের মতো বলি নিজের শক্তিটার কখনো অপব্যবহার করবে না। এ বারের যাত্রায় ডাক্তার বাচাতে পারলেও পরের বার বাচাতে পারবে না। আর ডাক্তারের মৃত্যুর যে ভবিষ্যতবাণী করেছিলে এটা তোমার ভুল ধারণা ছিল। এমন ভূল ভবিষ্যতবাণী করে কাউকে কষ্ট দিও না। কারণ কেউ কারও ভবিষ্যতবাণী করতে পারে না। আচ্ছা ঠিক আছে আমার চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। এখন বিদায় নিতে হবে।’
শুভ্র গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে আরও বেশি কেদে ফেলল। আর উনি ধীরে ধীরে মিলিয়ে মিলিয়ে যেতে থাকল। একপর্যায়ে সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেলেন।
শুভ্র অনেকক্ষণ কাদল। যতক্ষণ কাদল আমার মাথাটা ঝিম ধরেছিল। কোন অনুভূতি যেন পাচ্ছিলাম না। নিউরন যেন ইলেকট্রিক সিগনাল পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেকক্ষণ কান্নার পর চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘ভাইয়া আমি অনেক দুঃখিত। আমার কারণে আপনাকে অনেক মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। আর যেতে হবে না। এখন আপনি তো দেখলেন আমার ভুল কোথায় ছিল। যাই হোক আমারও চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে স্বপ্নের মধ্যে আছি। এর ফলে আপনার ক্ষতি হতে পারে। যাই হোক আমিও বিদায় নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো আপনারও জ্ঞান ফিরবে। বিদায়।’
কিছু বলার আগে শুভ্রও উধাও হয়ে গেল। এতোটাই আচমকা ঘটল যে আমি ভয়ে কেপে উঠলাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমারও জ্ঞান ফিরে আসল।

সেদিন অজ্ঞান হওয়ার পর কয়েকদিন রেস্টে থাকতে হলো। ক্রিস্টিনও এ কয়দিন স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছিল। এর মাঝে নওরিন আর শুভ্র এসে ওদের বিয়ের কার্ড দিয়ে যায়। যখন এসেছিল তখন ক্রিস্টিন শুভ্রকে আমাকে দেখানোর জন্য একটু বকাঝকা করল। শুভ্র ক্রিস্টিনের বকাঝকা খেয়ে হাসছিল। আজ নওরিন আর শুভ্রের বিয়ে। ক্রিস্টিন বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য সাজগোছ করছে। সবাই অনেক খুশি। কারণ অনেক চড়াই-উৎরাই পেরোনোর পর দুজনের বিয়ে। দুজনের জীবনের চড়াই-উতরাই শেষ হবে আজকের মাধ্যমে।

বক্তব্যঃ এই পর্বের মাধ্যমে #দুইটা_পয়তাল্লিশ এর পূর্ণ সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আর এর মাধ্যমে লেখালেখি থেকে অনেক লম্বা একটা বিরতি নিতেছি৷ কারণ এই গল্পের লাস্ট এপিসোডগুলো একটুও ভালো হয় নি৷ আর সমাপ্তি পর্ব হিসেবে এটাও তেমন ভালো হয় নি। এর জন্য দুঃখিত। নিজেকে আরও পরিণত আর পরিবর্তন করে ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতেও আপনাদেরকে পাশে পাব।
ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here