দুইটা পয়তাল্লিশ পর্ব ১০

0
236

গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ
লেখকঃ Parvez Rana
পর্বঃ ১০

গাড়ি চলছিল হাসপাতালের দিকে। সাথে আমার টেনশনও বাড়ছিল। সেই টেনশনটা ছিল শুধু শুভ্রের জন্য। মন বার বার বলছিল সে বাচবে না। তাকে বাচানোর ক্ষমতা হয়তো আর আমার নেই। আমার চিন্তা বার বার এগুলোর ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এই চিন্তা থেকে বের হতে চাইছিলাম। এই চিন্তার বিপরীত চিন্তা করতে চাইছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। সব কিছু আমার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিল। বিশেষ করে আমার মনটা আমার বিপক্ষে ছিল। হসপিটালে পৌছে দেখি নওরিন ছটফট করছিল। তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। সে কাদছিল। নওরিনের কান্না দেখে আমার নিজেরই অনেক খারাপ লাগছিল। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। হয়তো অপারেশন এর সময় আরেকটু ভালোভাবে চেষ্টা করলে নওরিন শুভ্রকে সুস্থভাবে ফিরে পেত। আমি গিয়ে দেখলাম শুভ্রকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। রুমে ঢোকার পর দেখি শুভ্র জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। দেখে অনেক বেশি খারাপ লাগছিল। ডাক্তার হিসেবে যে আবেগটা থাকার কথা না সেটাই বার বার আমাকে ঘিরে রেখেছিল। আমি কোন এক মায়ায় বাধা পড়ে যাচ্ছিলাম। এ ধরণের মায়া সাধারণত পরম আত্মীয়দের ক্ষেত্রে হয়। কিন্তু শুভ্র আর নওরিনকে এর আগে কখনো দেখিনি। তবুও আমার মায়া হচ্ছিল। আমি আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে শুভ্রের পাশে দাড়ানো ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললাম, ‘পেশেন্টকে কি কোন ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন?’
সে আমার দিকে অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে বলল, ‘না স্যার। এখন যা অবস্থা তাতে ইনজেকশন দিতে ভয় হচ্ছে।’
আমি বললাম, ‘একবার ইনজেকশন দিয়ে দেখুন। পেশেন্ট হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে।’
একটা রিস্ক নিয়ে ফেললাম। কারণ আমিও নিশ্চিত ছিলাম না ঘুমের ইনজেকশন দিলে কি হবে। তবে মনের অজান্তেই বলছি ঘুমের ইনজেকশন দিতে। হয়তো আমার সিক্সথ সেন্স বলছে। বুঝতে পারছিলাম না কোন ভুল হচ্ছে কিনা। কারণ আমি পুরো অকারণেই ঘুমের ইনজেকশন দিতে বলতেছি। এটার সাইড ইফেক্টও হতে পারে। ব্যাপক ভাবে হতে পারে৷ এই নিয়ে অনেক ভয়ে ছিলাম। কিন্তু এসব কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। যেন কোন একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। নিজের উপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ যেন চলে যাচ্ছিল। ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি দিয়ে দিব?’
আমি নিস্তেজ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। কি হবে নিজেরও জ্ঞানের বাইরে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। কয়েকবার রুমাল বের করে ঘাম মুছে ফেলছিলাম। কিন্তু আবার ঘাম জমছিল। আমার নিজের শরীরটাও সায় দিতে ছিল না। শুভ্রকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে শুভ্র অনেকটা শান্ত হয়ে যায়। আর রিস্ক নেয়াটা কাজে লেগে যায়। অনেকক্ষণ ধরে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দেই। কিছু ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল আমার ব্লাড প্রেসারটাও বেড়ে গেছে। অনেকদিন পরে এমন হলো। কিছু ভালো লাগছিল না। শুভ্র ঘুমিয়ে গেলে শুভ্রকে আবার এমআরআই এর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ একটা সন্দেহ হচ্ছিল মনের মধ্যে যে সব কিছু ঠিক আছে কিনা। এমআরআই শেষ এ রিপোর্ট দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রিপোর্ট এ অস্বাভাবিক কিছু দেখা গেল না। বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ হঠাৎ করেই শুভ্রের বার বার এমন হয় কেন। ইচ্ছা করে এই কেইসটা থেকে হাত ধুয়ে সরে দাড়াই। কিন্তু অস্বাভাবিক একটা টান আমাকে আটকে রাখছিল। আর শুভ্রের ব্যাপারে সব কিছু জানতে ইচ্ছা করছিল। ইচ্ছা করছিল নওরিন বা ওর বাবা বা অন্য কারও কাছে শুভ্রের ব্যাপারে সব কিছু জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু তাদের মনের অবস্থা বিবেচনা করে আর জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল না। শুভ্রের অবস্থা তুলনামূলক ভালো দেখে রাত সাড়ে বারটার দিকে বাসায় ফিরে আসলাম। একটু রাগ হচ্ছিল ডিউটি ডাক্তারদের উপর। যদি তারা একবার রিস্ক নিয়ে শুধু একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিলেই হতো। তাহলে আর এই রাতে আমাকে শুধু এতো কষ্ট করে হসপিটালে আসতে হতো না। তবে ওনাদের উপর রাগ করে লাভ নেই। কারণ শুভ্রের দেখে মনে হচ্ছিল অনেক বেশি ক্রিটিকাল। কিন্তু একটা ঘুমের ইনজেকশন দেয়ায় এতো সহজে কাজটা হবে সেটা আমি নিজেও ভাবিনি। বাসায় ফিরে দেখি ক্রিস্টিন জেগে জেগে এক্সামের খাতা দেখছিল। শরীরে অনেক ক্লান্তি ভাব এসে গিয়েছিল। তাই আরেকবার খাওয়া দাওয়া করেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ তখন না খেয়েই চলে যেতে হয়েছিল।

অন্যদিকে শুভ্র গভীর ঘুমে ছিল। আর নওরিন শুভ্রের পাশে বসেছিল। নওরিনের বাবা নওরিনকে বার বার ঘুমাতে যেতে বলছিল। বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্যেও কয়েকবার বলেছিল। কিন্তু নওরিন যায় নি। নওরিন শুভ্রের পাশে বসে বার বার নওরিন শুভ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মনে মনে শুভ্রের সুস্থতার জন্য দোয়া করছিল। আর প্রায়ই কেদে কেদে উঠছিল। নীরবে কেদে কেদে উঠত। নওরিন তার ভালোবাসার মানুষকে এই অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারছিল না৷ নওরিন এর মনের ভেতর শুধু ছিল হাহাকার আর বেদনা। যে বেদনা অন্ত ঘটতে পারে শুধু মাত্র শুভ্র ঠিক হয়ে গেলে। কিন্তু তার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না৷ নওরিন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার পর একপর্যায়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।

পরেরদিন সকালে হসপিটালে গিয়ে হা করে দাড়িয়ে রইলাম। কারণ গিয়ে দেখি শুভ্রের সেন্স ফিরেছে। দেখে মনে হচ্ছে না কিছু হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগছিল এই মানুষটার জন্য এতো টেনসড ছিলাম। এই মানুষটার মৃত্যুর ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছিল। আমাকে বার বার ভয়াবহ দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। শুভ্রকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে শুভ্রের অনেক বড় একটা সার্জারি হয়েছে। যেখানে ওর বার বার সেন্স ফিরে আসছিল। এতো বড় মিরাকল কিভাবে ঘটল বুঝতে পারছিলাম না৷ শুভ্র আমার মনের ভেতর অনেক বড় একটা রহস্যের জাল বুনছিল। যেটা আমাকে একদম আটকে রেখেছে। শুভ্রের যে শুধু জ্ঞান ফিরেছে সেটা না শুভ্র রীতিমতো হাসছিল। শুভ্রকে দেখে একদম সুস্থ মনে হচ্ছিল। আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম। শুধু আমি একা না সবাই অনেক বেশি অবাক হয়েছে। বিশেষ করে আকরাম স্যারের মুখ দেখার মতো ছিল। আমি যখন রুমে যাই তখন শুভ্র হাসি মুখে আমাকে বলল, ‘ডাক্তার সাহেব আপনি কেমন আছেন?’
এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করল যেন আমি রোগী আর শুভ্র ডাক্তার। আমি থতমত খেয়েছিলাম। কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটছে। কোন উত্তর না দেয়ার শুভ্র আবার বলল, ‘নিখিল সাহেব আপনি ভালো আছেন তো?’
আমি তখন আরও বেশি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ শুভ্র কিভাবে আমার নাম জানল সেটা আমার মাথায় ঢুকছিল না৷ আমি বললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি। আপনার শরীরের অবস্থা কেমন এখন?’
শুভ্রের মুখে তখনও হাসি বিরাজ করছিল। ওর হাসিটা একটু বেশিই সুন্দর। ছেলেদের হাসি এতোটা সুন্দর হতে পারে আমার জানা ছিল না। শুভ্রের যখন জ্ঞান ছিল না তখনও ওর মুখে হাসি ছিল। এমনকি অপারেশন এর সময়ও ওর মুখে হাসি ছিল। তবে এখনকার হাসিটা একটু বেশি সুন্দর। শুভ্র বলল, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না আপনি সুস্থ আছেন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখে বিশাল একটা শক খেয়েছেন। শুধু দেখে না আমি বুঝতেও পারছি যে আপনি আসলেই অনেক বড় একটা শক খেয়েছেন। আর আপনার মনের ভেতরে অনেক বেশি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমাকে নিয়ে। ঠিক না?’
শুভ্র ঠিকই বলছিল আমি অনেক বড় একটা শক খেয়েছিলাম। আর সেটা সামলাতে আমার অনেক সময় লাগছিল। আমি চুপচাপ সেখানে দাড়িয়েছিলাম। আর নওরিন শুভ্রের পাশে বসেছিল। নওরিনের চোখ ফোলা ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল সারারাত কান্না করেছে। কিন্তু এবার ওর চোখে মুখে আনন্দের ঝলক দেখা যাচ্ছিল৷ অনেক খুশি মনে হচ্ছিল। মনটা নওরিনের উৎফুল্ল হয়ে ছিল। শুভ্র নওরিনের হাত ধরে বসেছিল। কিছুটা আমারও আনন্দ হচ্ছিল শুভ্রকে সুস্থ দেখে কিন্তু এতো বড় শক খেয়েছি যে আনন্দটা চাপা পড়ে গেছে। যদি শুধু জ্ঞান ফিরত তাহলে হয়তো এতো বড় একটা শক খেতাম না। কিন্তু শুভ্রকে দেখে এতোটা সুস্থ লাগছে যে শুভ্র যে রোগী তা বুঝা যাচ্ছিল না। যদি না ওর মাথায় ব্যান্ডেজ গুলো থাকত তাহলে কেউ বুঝতেই পারত না শুভ্র একজন পেশেন্ট। শুভ্র আমাকে আবার বলল, ‘আপনি তো দেখছি কোন কথাই বলছেন না। কি হলো বলুন তো আপনার?’
আমি বললাম, ‘না আমার কিছু হয় নি।’
শুভ্র বলল, ‘আপনি একটু আমার পাশে বসবেন? নাকি আপনার কোন জরুরি কাজ আছে?’
আমি বললাম, ‘না এই মুহূর্তে আমার কোন কাজ নেই।’
শুভ্র নওরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক্তার সাহেব এখানে বসলে আবার তোমার সমস্যা নেই তো? ডাক্তার সাহেব কিন্তু অনেক ভালো মানুষ। এমন মানুষ খুব কম হয়।’
নওরিন হাসিমুখে মাথা না নেড়ে না সূচক জবাব দিল। আমি বার বার অবাক হচ্ছিলাম। শুভ্র এমন ভাবে কথা বলছিল যে শুভ্র আমাকে বহুদিন ধরে চিনে। আমার সাথে বহুদিনের পরিচয়। কিন্তু এই ঘটনার আগে আমি কখনো শুভ্রকে দেখিইনি। শুভ্র বেডে শুয়েছিল। আমি গিয়ে একদম নওরিনের বিপরীত পাশে সামনাসামনি বসলাম। বসার পর শুভ্র আমাকে বলল, ‘তো ডাক্তার সাহেব আপনি আজ সকালে খাওয়া দাওয়া করে এসেছেন তো? নাকি কালকের মতো আজও না খেয়ে এসেছেন। কাল তো আপনাকে সেই ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই আমার অপারেশন করতে হয়েছিল। অনেক কষ্ট হয়েছিল ঠিক না?’
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়ে দাড়ালো। কারণ শুভ্রের জানার কথা না। কিন্তু ও কিভাবে বলছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথা ঘুরছিল। সাথে গলাটা শুকিয়ে আসছিল। পানি খেতে ইচ্ছা করছিল। ঠিক তখন শুভ্র আমার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল। আমার অবাক হওয়ার পরিমাণ বেড়ে চলেছিল। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে শুভ্র বুঝতে পারছিল আমার মস্তিষ্কের মধ্যে কি ঘটছে। কিন্তু আমার মাথায় এটা ঢুকছিল না যে শুভ্র কিভাবে পারছে৷ আমি শুভ্রের হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে নিলাম। তারপর বললাম, ‘আজ খাওয়া দাওয়া করে এসেছি। কালকের মতো আজ হয়নি। কাল তো আপনার ইমার্জেন্সিটা আসায় ব্রেকফাস্ট এর টাইম পাইনি।’
তখন নওরিন বলল, ‘কিহ! আপনি ব্রেকফাস্ট না করেই চলে এসেছিলেন? আবার অপারেশনও করেছিলেন? আর আমি আপনার সাথে গতকাল এতোটা খারাপ ব্যাবহার করলাম এখন নিজের উপরই রাগ ধরছে। আমাকে প্লিজ আপনি মাফ করে দিবেন। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আই এম রিয়েলি সরি।’
আমি হেসে বললাম, ‘এটা তেমন কিছু না। ভালোবাসার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে কারো মাথা ঠিক থাকে না৷ এতে মনে করার কিছু নেই। আর ডাক্তার হিসেবে এমন অনেক ঘটনা অনেক বার ফেইস করতে হয়েছে। আচ্ছা আপনারা দুজন কি বিবাহিত?’
দুজনই হেসে দিল। আর একবার নিজেদের দিকে তাকালো। নিজেদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হাসল। তারপর নওরিন বলল, ‘আরে না। আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। তবে আশা করি বিয়েটা হয়ে যাবে। আমাদের দুজনের পরিচয় হয়েছে মাত্র দু মাসের মতো। এখন বিয়েটা করে ফেলা দরকার।’
আমি বললাম, ‘দু মাসেই এতোটা ভালোবাসা। বাহ দারুণ তো। আশা করি আপনাদের ভালোবাসা অনেক দূর পর্যন্ত এগোবে।’
দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি দুজনই কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেছে। তবে নওরিন কিছুটা বেশি লজ্জা পাচ্ছিল। শুভ্র তখন বলল, ‘আপনাকে একটা রিকুয়েষ্ট করি। আপনি প্লিজ আমাকে আপনি আপনি করে বলবেন না। আমি আপনার থেকে বয়সে কিন্তু ছোট। আমাকে কেউ আপনি করে বললে ভালো লাগে না।’
তখন নওরিনও বলতে শুরু করে দিল। নওরিন বলল, ‘আপনি আমাকেও আপনি করে বলবেন না। যদিও কাল আপনি একবার আমাকে তুমি করে বলেছিলেন। পরে আবার আপনি করে বলতে শুরু করেছেন। যাই হোক আমাকেও তুমি করে বলবেন।’
আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
কিছুক্ষণ চুপ থাকল। দেখে মনে হচ্ছিল কিছু ভাবছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে শুভ্র যখন আমার দিকে তাকায় তখন সরাসরি চোখের দিকে তাকায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শুভ্র আমাকে বলল, ‘আপনার মনে অনেক প্রশ্ন আছে আমাকে নিয়ে। ঠিক না? শুধু আপনার না নওরিনের মনেও অনেক বেশি প্রশ্ন আছে। শুধু ভালোবাসে বলে আমাকে জিজ্ঞাসা করে না। এই দেখুন আমি হঠাৎ করেই এতোটা সুস্থ কিন্তু নওরিন আমাকে কিছু বলছে না। যেখানে গতরাতেও আমার মারা যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল।’
নওরিন শুভ্রের দিকে কিছুটা বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে ফেলল। আমি কি বলব বুঝতেছিলাম না। একটু কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বললাম, ‘হ্যা আমার মনে তোমাকে নিয়ে কিছু রহস্যের ধোয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ আমাকে বার বার তোমার জন্য সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।’
শুভ্র বলল, ‘সব চেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছিলেন যখন ওটিতে আমার বার বার সেন্স ফিরে আসছিল। আপনাদের এতো পাওয়ারের ইনজেকশন পুশ করার পরও আমার সেন্স ফিরে আসছিল। আপনার চেহারা তখন দেখার মতো ছিল। দেখলেই যেকেউ হেসে দিত। মুখটা একদম চুপসে গিয়েছিল। হাহা।’
শুভ্র হাসছিল। মনে হচ্ছিল এই কথা বলে অনেক মজা পাচ্ছে। কিন্তু ওর অবস্থা দেখে আমার মাথা ঘুরছিল। বার বার শুভ্র আয়াকে চমকে দিতেছিল। আমি বললাম, ‘আচ্ছা এসব তোমাকে কে বলেছে? ওটির কথা কি কেউ বলেছে?’
‘নাহ। আমি এমনিতেই বুঝতে পেরেছি। তখন আমার একদম জ্ঞান ছিল না যে তেমন না। আবার পুরোপুরি সেন্স ছিল সেটাও না। আরকি সাব-কনশাস মাইন্ড একটিভ ছিল। আর ভালো ভাবেই ছিল। যাই হোক বাদ দেন।’
শুভ্র কথা গুলো শেষ করলে ওর মুখে হাসির একটা রেখা দেখা যাচ্ছিল। কিছুটা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসছিল। ওর সব কিছুই আমার কাছে তখন রহস্যময় মনে হচ্ছিল। আমাকে রহস্য বেড়াজালে বন্দী করে রাখছিল। তখন শুধু আমার চোখে বিস্ময় ছিল সেটা না নওরিনের চোখেও অনেক বেশি বিস্ময় ছিল। আমি শুভ্রকে বললাম, ‘আচ্ছা তুমি তো অপারেশন এর সময় স্বপ্ন দেখছিলে। কারণ আমি লক্ষ্য করেছিলাম তোমার REM হচ্ছিল। স্বপ্নের মধ্যে কি দেখছিলে সেটা তোমার মনে আছে?’
নওরিন তখন হঠাৎ করে বলে উঠল, ‘তুমি সার্জারির সময়ও স্বপ্ন দেখছিলে? আবার কি স্বপ্নের দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলে? তুমি কি ভুলে যাচ্ছ তোমার স্বপ্ন দেখার কারণে তোমার এই অবস্থা হয়েছে। এই স্বপ্নের কারণে আমি তো প্রায় তোমাকে হারিয়েই ফেলেছিলাম। কেন করো এমন আমার সাথে?’
শুভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন আমি শুভ্রকে আটকে দিয়ে বললাম, ‘দাড়াও স্বপ্ন দেখার কারণে এমন অবস্থা হয়েছে এর মানে কি?’
আবার নওরিন যখন কিছু বলতে যাবে ঠিক তখন শুভ্র নওরিনকে আটকে দিয়ে বলল, ‘কিছু না। আমি আপনাকে পরে বলব। এখন বললে আপনি কনফিউজ হয়ে যাবেন। আর অপারেশন এর সময় আসলেই স্বপ্ন দেখছিলাম।’
‘কিভাবে দেখছিলে? আর এটা কিভাবে সম্ভব?’
শুভ্র অস্ফুটে একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আসলে সার্জারির সময় আমিই যে প্রথম স্বপ্ন দেখেছি সেটা কিন্তু না। এর আগে অনেকেই স্বপ্ন দেখেছে। তবে বেশির ভাগ মানুষ ওই মুহূর্তে যে স্বপ্ন দেখে সেটা হচ্ছে তারা দেখে যে তারা মারা গেছে৷ আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম কারণ তখন আমার সাব কনশাস মাইন্ড একটিভ ছিল। আর মানুষ সাব কনশাস মাইন্ড এর কারণেই সাধারণত স্বপ্ন দেখে।’
নওরিন তখন বলল, ‘তুমিও কি স্বপ্নে দেখছিলে যে তুমি মারা গেছো?’
শুভ্র তখন বলল, ‘উম! আমার স্বপ্নটাতে আমি যা দেখছিলাম সেটাতে বলা যায় যে আমি মারা গিয়েছিলাম। আবার সেটা বলা যায় না।’
নওরিন বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল, ‘এতো পেচাচ্ছো কেন? সহজ ভাবে বলো। কি বললে বুঝতেই পারলাম না।’
আমি তখন আরেকটা প্রসঙ্গের কথা যোগ করলাম। আমি বললাম, ‘আচ্ছা তুমি যে এতো কিথা বলছ এটা কি ঠিক? এটা কিন্তু ঠিক না। কাল তোমার অনেক বড় একটা সার্জারি হয়েছে। কাল আমি নিজে তোমার মাথার সার্জারি করেছি। এখন কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। তোমার রেস্ট নেয়া উচিৎ। আর আমার মনের যেসব প্রশ্ন আছে সেগুলো তুমি সুস্থ হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করব। এখন তুমি রেস্ট নাও।’
তারপর নওরিনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আর তুমি এখন আমার সাথে বাহিরে যাবে। কারণ আমি নিশ্চিত তুমি এখানে থাকলে তুমি ওর সাথে খালি কথা বলতেই থাকবে আর বলতেই থাকবে। বাই দ্য ওয়ে তোমাদের দুজনের নাম কি আমি এখনো সেটাই ভালোভাবে জানি না।’
নওরিন আমার কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে রইল। শুভ্র নওরিনের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে ফেলে। শুভ্র বলল, ‘আমার নাম শুভ্র। আর আমি কথার মাঝে ওর নাম বলেছিলাম আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি। ওর নাম নওরিন। আচ্ছা আপনার সাথে আমি যে কথা বলছি এর জন্য কি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন? আমি কিন্তু জানি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না। শুধু নিজের পেশার খাতিরে আমাকে রেস্ট নিতে বলছেন। আপনার আমার সাথে আরও অনেক বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করছে। তাই বলছি আপনি এখানে বসুন আপনারও ভালো লাগবে আর আমারও ভালো লাগবে।’
দেখলাম নওরিন মাথা নিচু করে হাসছিল। বুঝলাম না কেন হাসছিল। আমি না উঠে সেখানে বসে রইলাম। শুভ্র বলল, ‘আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমি স্বপ্নে কি দেখছিলাম৷ আমি আসলে স্বপ্নে তর্ক করছিলাম।’
নওরিন বলল, ‘কার সাথে তর্ক করছিলে? আর তুমি কি রঙিন স্বপ্ন দেখছিলে নাকি সাদা কালো।’
শুভ্র তখন বলল, ‘এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পরে দিব। ভাইয়া, আপনাকে ভাইয়াই বলি সমস্যা নেই তো আপনার?’
আমি বললাম, ‘সমস্যা থাকবে কেন? আমার এমনিতেও কোন ভাই ভাই নাই। তাই তুমি ভাইয়া ডাকলে আমার ভালোই লাগবে। তুমি ভাইয়াই ডাকো।’
শুভ্রের হাসিটা প্রসারিত হলো। শুভ্র বলল, ‘আমার বা নওরিনের দুজনের একজনেরও ভাই নাই। তাই আপনি আমাদের দুজনের ভাই। যাই হোক আপনার যেমন আমার বিষয়ের অনেক প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন তেমনি আমার নিজেরও অনেক প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন আপনি কি আমাকে এ ব্যাপারে হেল্প করবেন?’
আমি একনজরে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নওরিনও শুভ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। শুরুতে বুঝতেছিলাম না কি বলব৷ কারণ নিজেও বুঝতেছিলাম না কি ধরনের সাহায্য চাইছে। তবে একটা জিনিস আন্দাজ করতে পারছিলাম যে নিজের অস্বাভাবিকতার ব্যাপারে কোন সাহায্য চাইছে। আমি বললাম, ‘তুমি কি চাইছ আমি তোমাকে মিসির আলি যেভাবে মানুষকে হেল্প করত সেভাবে হেল্প করব? আমি কিন্তু মিসির আলির মতো এতোটা বুদ্ধিমান না। আমি একজন সাধারণ মানুষ।’
শুভ্র তখন বলল, ‘মিসির আলি কে? উনি কি অনেক বেশি বুদ্ধিমান?’
আমি নিরাশ হয়ে গেলাম। নওরিন হাসছিল। নওরিন বলল, ‘মিসির আলি হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ এর একজন চরিত্র। তুমি আবার হুমায়ুন আহমেদকে চিনো তো?’
শুভ্র বলল, ‘হ্যা তাকে চিনি। কিন্তু মিসির আলিকে চিনি না। থাক আমাকে কাল্পনিক চরিত্রের মতো করে হেল্প করতে হবে না। আপনি আমাকে সাধারণ মানুষের মতো হেল্প করবেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন সেটা হচ্ছে আমাদের হাতে সময় একদম কম। যা করার এই অল্প সময় এর ভেতরেই করতে হবে।’
শুভ্র কি বলল এবারও কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘অল্প সময় মানে কি? কার হাতে সময় নেই? আর কিসের সময় নেই?’
শুভ্রের মুখে একটা অস্ফুটে হাসি দেখা। হাসিটা রহস্যঘেরা ছিল। শুভ্রকে হঠাৎ কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। ঠিক তখন আকরাম স্যার পেছন থেকে বলল, ‘লিখিল!’
আমি পেছনে ফিরে তাকাই। তখন স্যার বলল, ‘তুমি এখানে বসে আছো কেন? রাউন্ডে যাবা না?’
আমি দাড়াতে দাড়াতে বললাম, ‘জ্বী স্যার। যাব এখনই। শুভ্রের সাথে একটু কথা বলছিলাম।’
‘আসো তাহলে।’
স্যার তখন চলে গেল। আমিও বের হতে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখন শুভ্র পেছন থেকে বলল, ‘ভাইয়া, আপনি শুনবেন না কেন সময় নেই?’
আমি ঘুরে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখন থাক পরে শুনব। এখন যেতে হবে। আর তুমি রেস্ট নাও। হঠাৎ করেই মিরাকল ঘটিয়ে সুস্থ হয়েছ এর মানে এই না যে তোমাকে আর রেস্ট নিতে হবে না এটা কিন্তু না। তোমার রেস্ট নেয়া অনেক বেশি জরুরি৷ আর নওরিন শোন শুভ্র যদি কথা বলতে চায় তবুও কথা বলবে না৷ বুঝেছো?’
আমি হাসিমুখে বের হতে যাব ঠিক তখন শুভ্র বলল, ‘ভাইয়া এক মিনিটের জন্য এদিকে আসুন প্লিজ। তারপর আপনার যা ইচ্ছা আমি তাই করব। আসুন না প্লিজ। আপনাকে একটা জরুরি কথা বলার আছে।’
আমি শুভ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। শুভ্র আমার হাত ধরল। হাত ধরার সাথে আমি শিউরে উঠলাম। কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভুতি। বুঝতে পারছিলাম না এমন হচ্ছিল কেন। শুভ্র বলল, ‘আপনার হাতে একদমই সময় নেই। কারণ আপনার মৃত্যু সম্ভাবনা অনেক বেশি। আপনার সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি সেটা বুঝতে পারছি। আর স্পষ্ট ভাবেই বুঝতে পারছি।’
শুভ্রের কথা শুনে আমার রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল না শুভ্র আমার সাথে ফাযলামি করতেছে। দেখে মনে হচ্ছিল একদম নিশ্চিত ভাবে বলছে। আমার আর নওরিন দুজনের চোখেই বিস্ময়। চরম বিস্ময়! আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

চলবে…..

পরিশিষ্টঃ আগের পর্বটা একদম ফালতু টাইপের হয়েছিল। এই সিরিজের সব চেয়ে বোরিং একটা পর্ব হয়েছিল। এর জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here