তুমি নামক প্রশান্তি দ্বিতীয় খন্ড বোনাস পর্ব

0
297

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#বোনাস_পর্ব

ভরা রাস্তায় একটা মেয়ে কয়েকটা ছেলেকে বেধড়ক পি°টিয়ে যাচ্ছে। আর রাস্তার পাশে মানুষ ভীড় করে সিনেমা দেখছে বোধহয়? মেয়েটার কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালের চোখ দুটো হিংস্র হয়ে আছে। মুখে সে কী রাগের তেজ! যেমন সূর্য নিজের সবটুকু তেজ পৃথিবীতে ঢেলে দেয়। তেমন করে মেয়েটা তার সবটুকু তেজ ছেলেগুলোর উপর ঢালছে। আজকাল সমাজে এমন দৃশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছু না। কারণ আমাদের সমাজের মেয়েরা এখন কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নয়। মেয়েটা এবার হাতে থাকা মোটা লা°ঠিটা ফেলে দিলো। তারপর মাঝের ছেলেটার কলার চে°পে ধরে হুংকার ছেড়ে বলল,
“রাস্তায় বের হলেই মেয়েদের ইভটিজিং করতে মন চায় তাইনা? বাবা-মা তোদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে? আমি চাইলে এক্ষুনি তোদের পি°টিয়ে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করাতে পারি। কিন্তু তোদের মতো নরপি°শাচকে মে°রে শুধু হাত নোংরা করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। কারণ কু°ত্তার লেজ কখনো সোজা হয় না। আর কি যেন করেছিলি? আমার ওড়না ধরেছিলি। দাঁড়া, এক মিনিট।”
বলেই নিজের গায়ের ওড়নাটা খুলে ছেলেটার গলায় সুন্দর করে প্যাঁচিয়ে দিলো। ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে ছেলেটার দিকে হাত বাড়াতেই, ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে নিলো। গর্জন করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেয়েটা ছেলেটার একটু কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
“চারপাশে কত মানুষ দেখছিস? এদের যদি আমি একবার আদেশ করি তোকে পিটা°নোর জন্য, তাহলে কী হবে ভাব একবার? বেঁচে থাকবি তো?”
বলে অন্য ছেলে গুলোর দিকে নজর দিতেই তারা এক দৌড়ে হাওয়া। শুধু মাত্র সামনের ছেলেটার চোখ দিয়ে আ°গুন ঝরছে। চারদিকে নজর দিতেই শান্ত হয়ে গেলো। আপনা-আপনি মেয়েটার হাত ছেড়ে দিলো। মেয়েটা এবার একটু বাঁকা হাসল। তারপর সুন্দর করে ছেলেটার ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দিলো। বুকে হাত গুঁজে একবার আপাত মস্তক ছেলেটাকে দেখে নিলো। খুব হাসি পেলেও ঠোঁটে ঠোঁট চে°পে আটকে নিলো। তারপর দাঁতে দাঁত চে°পে হাসিমুখেই বলল,
“ওয়াও! একদম জোস লাগছে! তোকে না ছেলে থেকে মেয়ে রুপেই বেশি দারুন লাগছে! তুই না একটা কাজ করতে পারিস। রাস্তায় এভাবে ঘুরাঘুরি না করে ওইযে রাস্তায় হি°জ°ড়া গুলো আছে না? তাদের সাথে যোগ দিতে পারিস। এতে তুই তোর আসল জায়গাটাও পেয়ে যাবি। আবার কিছু ইনকাম ও হবে। আইডিয়াটা কেমন বল, তো?”
রাগে, অপমানে ছেলেটার চোখ দুটো ভয়ঙ্কর লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়েই গিলে খাবে মেয়েটাকে। শুধু মাত্র চারপাশের মানুষজনের ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। তবুও গলা উঁচু করে বলে উঠল,
“এই মেয়ে, তো…।”
ছেলেটার থেকে দ্বিগুণ জোরে মেয়েটা বলে উঠল,
“এই চুপ! একদম চুপ! কিছুক্ষণ আগের মা°রের কথা ভুলে গেলি, না_কি? যদি হাত-পা ঠিক রাখতে চাস। তাহলে, এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।”
ছেলেটা এবার গলা থেকে ওড়নাটা এক টানে খুলে ফেলল। হাতের মধ্যে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিছু বলবে তখনি শুনতে পেলো কেউ একজ৷ পেছন থেকে মেয়েটাকে ‘বেলী’ বলে ডেকে উঠল। বেলী পেছনে ফিরে রাকিবকে দেখে জোরেই বলে উঠল,
“আরে দোস্ত, তুই কোথায় ছিলি? সার্কাস মিস করে গেলি তো। এখনো দেখ জোকারটা আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।”
বলে হা হা করে হেসে দিলো। আর রাকিব একবার বেলীর দিকে আরেকবার সামনে থাক ছেলেটার দিকে তাকাল। ছেলেটার সাথে যে কি হয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না। শুধু একটু মেঁকি হেসে ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“তুই আসলে ছেলে তো না_কি আবার হি…। থাক বললাম না। যা ভাগ।”
বলেই রাকিব আর বেলী একসাথে হেসে উঠে হাই ফাইভ করল। তা দেখে ছেলেটা এক পা রাকিবের দিকে এগিয়ে এসে,আঙ্গুল তাঁক করে বলে উঠল,
“এই মুখ সামলে কথা বল। নয়তো…?”
ছেলেটার কথা শুনে। বেলী রাকিবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বুকে হাত গুঁজেই বলল,
“নয়তো, কী করবি তুই? ভয় দেখাচ্ছিস? তাহলে শোন, বেলীপ্রিয়া কাউকে ভয় পায় না। আর অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না। তাই ভালো মুখে বলছি, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা। নাহলে, এমন জায়গায় মা°রব যে, তুই কাউকে দেখাতেও পারবি না।”
এবার আর ছেলেটা কিছু বলল না। যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দুই কদম এগিয়ে থেমে গেলো। পেছন ঘুরে বেলীর দিকে তাকিয়ে শয়°তানি হাসি দিয়ে উঠল। শান্ত স্বরে বলল,
“তোকে আমি দেখে নিব।”
বলেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো ছেলেটা। আর বেলী হেসে উঠে জোরে চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগল,
“পারলে দেখে নিস। আমি এখানেই থাকি। ওইযে সামনের রোডের পাঁচ নাম্বার বাড়ির দ্বিতীয় তলায় আমার বাসা। তোর দাওয়াত রইল। আসিস, কিন্তু।”
রাকিব বেলীর কথা শুনে মিনমিন করে বলতে লাগল,
“আচ্ছা আগে হুনছি মানুষ বা°ঘের থেকে বিলাই হয়। আর এই মাইয়া তো দেখতাছি বিলাইয়ের থেকে বা°ঘ হইয়া গেলো। এটাকে সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব না। কবে না জানি আমার নাকটা এক ঘু°ষিতে বোচা বানাইয়া দেয়। আল্লাহ তুমি রহম কইরো।”
কথাটা বলে একটু কল্পনা করল। রাকিব কি যেন ভুল করেছে। তার জন্য বেলী এক ঘু°ষিতে রাকিবের নাক বোচা করে দিয়েছে। নাকে ব্যান্ডেজ নিয়ে বেচারা সারা এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সবাই হাসাহাসি করছে। কল্পনা করেই রাকিব নাক ধরে জোরে ‘আল্লাহ গো না’ বলে চিৎকার করে উঠল। আচমকা রাকিবের চিৎকারে বেলী আহাম্মক হয়ে গেলো। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তোকে কি কেউ মেইন পয়েন্টে লা°থি মে°রেছে?”
রাকিব প্রশ্নটা না বুঝেই। মাথা ঝুলাতে লাগল। অর্থাৎ ‘হ্যা’। পরক্ষণেই যখন প্রশ্নটা বুঝল। সঙ্গে সঙ্গে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“এহহ না। কার এত সাহস রে। আমাকে লা°থি মা°রবে।”
বেচারা রাকিবের মুখখানা দেখে বেলীর খুব হাসি পেলো। তবুও হাসি আটকে গম্ভীর স্বরে বলল,
“তাহলে হঠাৎ এমন চ্যাঁচিয়ে উঠলি, কেন”
আমতা আমতা করে রাকিব জবাব দিলো,
“ইয়ে মানে? কিছুনা। তুই চল। দেরি হইয়া যাইতাছে।”
বলেই হাঁটা শুরু করল। বেলী আর কিছু বলল না। শুধু মুচকি হেসে রাকিবের পেছনে হাঁটা শুরু করল। একটা সি এন জি ডেকে দুজনেই উঠে বসল। কিছুক্ষণ পর একটা আশ্রমের সামনে এসে গাড়ি থামল। বেলী নেমেই ভেতরে হাঁটা শুরু করল। আর রাকিব মুখটা কালো অন্ধকার করে ওয়ালেট বের করে ভাড়া মিটিয়ে, মিন মিন করে বলতে লাগল,
“এই মেয়েট আমাকে ফকির বানাইয়া দিব। আজ আমার মতো একটা অবলা, অসহায় বাচ্চাকে একলা পাইয়া অত্যা°চার করছিস তো? শুধু একবার নীলাভ্র ভাইকে খুঁইজা লই। সব সুধে-আসলে ফেরত নিমু।”
বেলী দূর থেকে দাঁড়িয়ে জোরে বলল,
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিবাস্বপ্ন না দেখে এখানে আয়। আর আমাকে যদি আসতে হয় তাহলে…”
“আরে, আরে, আইতাছি। খালি কথায় কথায় ভয় দেখায়। লাগে যে আমি ভয় পাই। সর যামু না তোর লগে। বাড়ি যামু গা। তোর কাম তুই কর।”
বলেই উল্টো পথে পা দিতেই, বেলী আবার বলল,
“তুই আইবি তোর ঘাড়েও আইব।”
রাকিব পেছন ফিরে উত্তর দিলো,
“তাইলে বইন, এক কাম করো। আমার ঘাড়টারেই লইয়া যা। তবুও আমি যাইমুনা।”
এবার বেলী গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলো,
“তুই জানিস, আমি সময় অপচয় করা পছন্দ করি না। দুই মিনিট সময় দিলাম। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”
বেলীর গম্ভীর স্বর শুনে রাকিবের কলিজা শুকিয়ে গেলো। মুখটাকে ছোট করে হাঁটা ধরল বেলীর পেছন পেছন।


বেলী সিড়ি বেয়ে উপরের তলায় আসতেই একটা মেয়ে এসে বেলীর পা জড়িয়ে ধরল। আচমকা এহেন কান্ডে বেলী ঘাবড়ে গেলো। সাথে সাথে বলে উঠল,
“একি? কি করছেন আপনি? পা ছাড়ুন। কে আপনি? পা ছাড়ুন, প্লিজ।”
মেয়েটা পা না ছেড়েই কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
“ম্যাডাম, আমারে একটু থাকার জায়গা দিবেন। আমি বাড়ি গেলে আমার স্বামী আমারে মে°রে ফেলব।”
বেলী এবার মহা বিপদে পড়ল। তবুও মেয়েটাকে ধরে উঠাতে উঠাতে বলল,
“তুমি আগে আমার পা ছাড়ো৷ আর উঠে দাঁড়াও। মাথা উঁচু করো।”
বলে মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে পাশের একটা বেঞ্চে বসালো। তারপর কাউকে আদেশ বাক্যে বলে উঠল,
“কে আছো? এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। তাড়াতাড়ি।”
মেয়েটা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। চেহারায় কয়েকটা মা°রের দাগ স্পষ্ট। মুখটা অসহায় লাগছে খুব। কেন যেন মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তানিশার কথা মনে পড়ে গেলো। বেলী খুব যত্ন করে মেয়েটার চোখের পানিটুকু মুছে দিলো। মেয়েটার গালে পরম আবেশে আদুরে হাত রেখে বলতে লাগল,
“শোনো মেয়ে, দেখে মনে হলো তুমি আমার ছোট। তাই তুমি করেই বলছি। আমি জানিনা তোমার জীবনে কি হয়েছে? কিসের এত সমস্যা? তবে আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন? কখনো কারোর কাছে মাথা নত করবে না। মাথা উঁচু করবে বাঁচবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। মুখ বুঝে কিছু সহ্য করবে না। আর এইযে এখন আমার পায়ে যেমন করে পড়লে। এই ভুলটা আর দ্বিতীয় বার করবে না। নিজের জায়গা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। অন্য কেউ তোমাকে জায়গা তৈরি করে দিবে না। কেউ তোমাকে অন্যায় ভাবে একটা আ°ঘাত করলে। তুমি তাকে দশটা আ°ঘাত করবে। চুপ করে থাকবে না। আমি এত বছর চুপ করেই দেখেছি। কেউ মূল্য দেয়নি। বরং আ°ঘাতের পর আ°ঘাত দিয়ে গেছে। তাই তো এই এক বছর ধরে নিজেকে তিলে তিলে পা°থর বানিয়েছি। শক্ত হয়েছি। এখন শত আ°ঘাতেও আমাকে কেউ ভা°ঙতে পারেনা। দূর্বল করে দিতে পারেনা। যাইহোক, তোমার সাথে কি হয়েছে সেটা পরে শুনব। এখন তুমি একটু রেস্ট নাও।”
বলেই অন্যে একজন মেয়েকে ডেকে। ওই মেয়েটাকে রুমে পাঠিয়ে দিলো। মেয়েটা চলে যেতেই বেলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সময় সময়ের গতিতে চলে যায়। ঠিক তেমনি সেদিনের পর কে°টে গেছে প্রায় এক বছর। এই এক বছর শুধু ঘড়ির কা°টা আর ক্যালেন্ডারের পাতা বদলায়নি। বদলে বেলীর জীবন। আগের বেলী আর এখনের বেলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ- পাতাল তফাত। এখনের বেলীর সাথে কেউ কথা বলতেও দুইবার ভাবে। বেলী এখন একটা বড় আশ্রম চালায়। যেখানে শহরের অলিগলিতে নির্যাতিত নারীর বসবাস। কিন্তু পুরনো সব ক্ষত ভুলে গেলেও নীলাভ্রকেও আজো ভুলতে পারেনি বেলী। আজো বেলী বিশ্বাস করে নীলাভ্র বেঁচে আছে। এই শহরেই আছে। কিন্তু বাকি সবার কাছে নীলাভ্র মৃত। কারণ, সবাই নাকি নীলাভ্রর লা°শ চোখের সামনে দেখেছে। কিন্তু বেলী বিশ্বাস করে না। বেলী এখনো প্রতিদিন এই শহরের অলিগলিতে নীলাভ্রকে খুঁজে বেড়ায়। বিশ্বাস করে একদিন নীলাভ্র ফিরবে। বীরের বেশে ফিরে আসবে। নীলাভ্রকে যে ফিরে আসতেই হবে। কারণ বেলীর যে অনেক হিসাব মেলানো বাকি। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি। সব কথা ভেবে বেলী আনমনেই বলতে লাগল
“আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, নীলাভ্র ভাই। আপনাকে ছাড়া আর বাঁচতে পারছি না। শক্ত থাকতে পারছি না। প্লিজ, ফিরে আসুন না। প্লিজ…।”
বলতে বলতে টের পেলো গাল বেয়ে অশ্রু কণা বেয়ে পড়ছে। এত কিছুর মাঝেও মন বলছে খুব শিঘ্রই নীলাভ্র ফিরবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। অগোছালো জীবনটা গুছিয়ে দিতে নীলাভ্র ফিরবে…।

#চলবে

[বোনার্স পার্টের কিছু না বুঝলেও পরের পর্ব সব বুঝে যাবেন। অসুস্থ থাকায় কাল দিতে পারিনাই ক্ষমা করবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here