তুমি নামক প্রশান্তি দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১১+১২

0
275

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_ (এগারো + বারো)

“তোর চোখে চেয়ে আমি অনায়াসে কয়েক যুগ পার করে দিতে পারব, বেলীপ্রিয়া।”
হঠাৎ করে নীলাভ্রর এমন কথায় বেলী ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নীলাভ্রর মুখটা হাস্যজ্বল। চোখে, মুখে রয়েছে প্রশান্তি। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি। অনেকদিন পর ছেলেটাকে আজ প্রাণবন্ত লাগছে। বেলী শুধু এক পলক নীলাভ্রর মুখ পানে তাকিয়ে থেকে বলল,
“ইস! একটু বেশিই ঢং!”
বলে লাজুক হাসি দিয়ে পুনরায় মাথা রাখল নীলাভ্রর কাঁধে। রাতের কলকাতা শহরের সৌন্দর্যটা উপভোগ করে যেন শেষ করা যাবেনা। আর সাথে যদি সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রিয় মানুষটা থাকে, তাহলে তো আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কৃত্রিম লাইটের আলোয় চারদিক জ্বলজ্বল করছে। শুনশান গতীতে ছুটে চলেছে ব্যস্ত যানবাহন। এই ব্যস্ত শহরে মানুষগুলো যেন রোবটের মতো ছুটে চলেছে। যে যার মতো ব্যস্ত। ডান-বামে তাকানোর উপায় নেই। ফুটপাতের ল্যাম্পপোস্টের নিচে দুজন প্রেমিক যুগল বসে আছে। আজ এক সপ্তাহ হলো নীলাভ্র হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখন অব্দি হাঁটা চলা করতে প্রচন্ড কষ্ট হয়ে ছেলেটার। তবুও হসপিটালের চারদেয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে দিশারা হয়ে আছে। চেন্নাই থেকে কলকাতা নীলাভ্রর এক বন্ধুর বাসায় উঠেছে। নীলাভ্রর বাবা আর রাকিব দেশে ফিরে গিয়েছে। শুধু নীলাভ্র আর বেলী থেকে গেছে। নীলাভ্র সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া অব্দি এখানে-ই থাকবে। আজ প্রায় অনেক মাস পর ছেলেটা একটু বাইরের হাওয়া-বাতাস পাচ্ছে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করার নেশায় দূর্বল শরীর নিয়েই বেড়িয়েছে দুজন। বেলী অবশ্য অনেকবার বারণ করেছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা? অনেকক্ষণ দুজনের মাঝে নিরবতা বয়ে গেলো। নিরবতা ভেঙে নীলাভ্র বলে উঠল,
“আজ কতদিন পর আমি হসপিটালের চার দেয়াল থেকে মুক্তি পেয়েছি। খোলা আকাশের নিচে মন ভরে নিশ্বাস নিতে পারছি। তোকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারছি। তোর হাতে হাত রাখতে পারছি। এর চাইতে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে বল?”
নীলাভ্রর কথা শুনেও বেলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। উত্তর দিলো না৷ তারপর শান্ত, শীতল স্বরে প্রশ্ন করল,
“আমাদের জীবনে এত ঝড়, এত দুঃখ কেন আসে বার বার? মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে, জীবন মানে কী? জীবনের আসল স্বার্থকতা কোথায় গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে।”
নীলাভ্র বোধহয় কিছুক্ষণ উত্তর ভাবল। তারপর বলতে শুরু করল,
“জীবন মানে কী? আমি জানিনা। তবে জীবন হলো উপরওয়ালার দেওয়া সবথেকে বড় উপহার। এ জীবনে বাঁচতে হলে, প্রতি পদে পদে কষ্টের মোকাবিলা করতে হবে। কষ্ট সহ্য করতে হবে। কষ্টের সময়ে ভেঙে পড়া যাবে না। হতাশ হওয়া যাবে না। ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’ এই কথাটার উপর বিশ্বাস রেখে, সেই সময়টাকে উপভোগ করতে হবে। কোনো কিছুর সাধ গ্রহণ করতে হলে, তাকে উপভোগ করতে হবে। কষ্ট আছে বলেই আমরা সুখের সময়টাকে উপভোগ করি। কষ্ট না থাকলে সুখের সাধ কী তা আমাদের অজানা থেকে যেত। উপর ওয়াল যেমন কষ্ট, দুর্দশা দিয়ে বান্দাকে পরিক্ষা করে। তেমনি, কষ্টের পর সুখ দিয়ে সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। প্রত্যেক কষ্টের পরেই স্বস্তি থাকে। তাই সুখ, দুঃখ মিলিয়ে যেই আনন্দটুকু আমরা উপভোগ করি, তাই জীবন। যখন তুই সব দুঃখ, কষ্ট, হতাশাকে পায়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাবি, তখন বুঝবি জীবনের স্বার্থকতা ঠিক কোথায়? বুঝলি?”
বেলী খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনল। তারপর হুট করেই শীতল স্বরে শুধাল,
“ভালোবাসি! অনেক বেশি ভালোবাসি!”
নীলাভ্র একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠল। চোখ জোড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল। বেলীর নমনীয়তায় ভরা কণ্ঠে এই নিঃসংকোচ ভালোবাসার আবেদন যেন প্রশান্তির বার্তা নিয়ে আসল। কর্ণকুহরে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা পৌঁছাতে-ই সর্বাঙ্গে শীতল বাতাস বইতে শুরু করল। বেলী পুনরায় সেই কণ্ঠে বলল,
“আপনার সাথে ঘর বাঁধার ইচ্ছেটা আমাকে দিন দিন বড্ড তৃষ্ণার্ত করে তুলছে, নীলাভ্র ভাই।”
নীলাভ্র এবার বিস্তর হাসল। এক হাতে বেলীকে এবার বুকে জড়িয়ে নিল। বেলীর কপালে চুমু খেয়ে, বলল,
“তোকে কাছে পাওয়ার তীব্র নে’শায় তো আমি বহুকাল আগে থেকেই অস্থির হয়ে আছি। ”
বেলী একটু লজ্জা পেল। একটু গুটিশুটি হয়ে নীলাভ্রর বুকে মুখ লুকাল। নীলাভ্র তা বুঝতে পেরে ঠোঁট চে°পে হাসল। তারপর বলল,
“এবার আর ছাড় দেওয়া যাবে না, মেরি হাফ বউ। এতদিন আমাকে কষ্ট দেওয়ার সব হিসাব গুনে গুনে নিব। তৈরি হয়ে নাও।”
বেলী ‘হাফ বউ’ কথাটা শুনে একটু অবাক হলো। প্রশ্নটা জমিয়ে না রেখে করেই ফেলল,
“হাফ বউ, হলাম কী করে?”
নীলাভ্র চটপট উত্তর দিলো,
” ও মা! তোর সাথে শুধু আমার কবুল বলা হয়নি। তা ছাড়া তো সব রিচুয়্যালে-ই হয়েছিল। তাহলে তুই তো আমার হাফ বউ। কবুল বলার পর ফুল বউ হয়ে যাবি।”
নীলাভ্রর এমন যুক্তি শুনে বেলী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। বেলী দুই হাতে নীলাভ্রর গলা জড়িয়ে ধরল। শুধাল,
“আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান। আমি যে আপনার ফুল বউ হওয়ার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। অনেক তো গেল ঝড়ঝাপটা। এবার না হয় আমরা একটু আমাদের মতো করে বাঁচব। দুজন একসাথে, হাতে হাত রেখে চলব। নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করব। ছোট্ট একটা সংসার হবে আমাদের। আপনি, আমি, মামা, মামি আর…।”
এইটুকু বলে থেমে গেল বেলী। লজ্জায় বাকিটুকু বলতে পারল না। নীলাভ্র বেলীর থেমে যাওয়া দেখে বাকি কথাটুকু অনায়াসে বুঝে ফেলল। বেলীর অসম্পূর্ণ কথাটা সম্পূর্ণ করে বলল,
“আর থাকবে আমার আরেকটা ছোট্ট বেলীফুল।”
বেলী বুঝল কথাটার অর্থ। সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বলে উঠল,
“একদম না, আমার ছোট্ট একটা নীলাভ্র চাই। একদম নীলাভ্রর কপি। এমন নাক হবে, এমন চোখ হবে, এমন চুল হবে। মোট কথা একদম নীলাভ্রর ডুপ্লিকেট কপি লাগবে আমার। বুঝতে পেরেছেন মশাই?”
বলেই নীলাভ্রর নাক টেনে দিল হালকা। তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। তারপর একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তটা সুন্দর। ভালোবাসায় ইচ্ছেটা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইচ্ছে ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব না। ইচ্ছে শক্তির চাইতে বড় শক্তি নেই। ইচ্ছা আর চাওয়াটা সঠিক হলে স্বপ্ন একদিন বাস্তবে রুপ বেশি সময় লাগে না।

রুমে আসতেই দেখল, হেলেনা ওদের দুজনের খাবারটা রুমে ঢেকে রেখে গেছে। বেলী ফ্রেশ হয়ে এসে নীলাভ্রকে বলল,
“এবার খেয়ে নিন। রাত হয়ে গেছে। সময় মতো ঘুমাতে যেতে হবে তো। একদম অনিয়ম করা যাবে না।”
নীলাভ্র ভ্রু যুগল কুঁচকে বলল,
“একদম পাকা গিন্নির মতো কথা বলছিস, দেখি।”
বেলী সাথে সাথে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে জবাব দিল,
“দুদিন পর তো, আপনার গিন্নি হয়ে যাব। তাই আগে থেকে-ই প্রাকটিস করে নিচ্ছি। বুঝলেন?”
নীলাভ্র বেলীর হাত ধরে কাছে টেনে এনে, পাশে বসাল। নিজেই উঠে গিয়ে খাবারের প্লেটটা এনে বেলীর হাতে দিতে দিতে বলল,
“আমাকে খাইয়ে দিবি। সাথে নিজেও খাবি।”
হঠাৎ এমন আবদারে বেলী মুচকি হাসল। তারপর যত্ন সহকারে ভাত মেখে নীলাভ্রকে খাইয়ে দিতে লাগল। নীলাভ্র খাচ্ছে ঠিক-ই কিন্তু দৃষ্টি বেলীতেই সীমাবদ্ধ। বেলী খাবারের শেষ লোকমা’টা নীলাভ্রর মুখের কাছে নিতেই, নীলাভ্র হাত ধরে ফেলল। তারপর নিজেই বেলীর হাত ধরে খাবারটা বেলীর মুখে তুলে দিয়ে, বলল,
“আমার সবকিছুর শুরুতে তোর না থাকলেও চলবে, আমি মানিয়ে নিব। কিন্তু শেষে তোকে থাকতেই হবে। কারণ ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ কথাটায় আমি প্রবল বিশ্বাসী।”
বেলী উত্তর দিল না। শুধু হেসে মনের ভাব প্রকাশ করল। হাত ধুয়ে নিয়ে একটা টিস্যু দিয়ে নীলাভ্রর মুখ মুছিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, নীলাভ্র বেলীর ওড়না টেনে ধরল। শান্ত স্বরে শুধাল,
“আমার গিন্নির ওড়না থাকতে আমি কেন টিস্যু ব্যবহার করব?”
বেলী কিছুক্ষণ চোখ, মুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। তারপর দুজনেই একসাথে হেসে দিলো। ওষুধগুলো খুলে নীলাভ্রর হাতে দিল। এমন সময় হঠাৎ বেলীর ফোনটা বেজে উঠল। ফোন স্কীনে ‘বড় মামি’ নামটা ভেসে উঠল। ঘড়ির কাটায় এগারোটা বাজে। এত রাতে হঠাৎ কল দেখে বেলী একটু ঘাবড়ে গেল। অজানা ভয়ে বুকটা ধক করে উঠল। কিন্তু মুখে চিন্তিত ভাবটা আসতে দিল না। নীলাভ্রকে বলল,
“আপনি ওষুধটা খেয়ে নিন। আমি দেখছি।”
বলে ফোন রিসিভ করে প্রথমেই সালাম দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“ভালো আছেন বড় মামি? বাসার সবাই ভালো আছে? এত রাতে ফোন দিলেন যে? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
বেলীর এতগুলা প্রশ্ন শুনে, ওপাশ থেকে সীমা শান্ত স্বরেই জবাব দিল,
“আরে বোকা মেয়ে! এত চিন্তা করার কিছু নেই। আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস?”
বেলীর ভয়টা দূর হলো। উত্তর দিল,
“আমরাও ভালো আছি মামি।”
বলে চুপ হয়ে গেল। আর কিছু প্রশ্ন করল না। আজকাল সীমা আর আগের মতো ব্যবহার করে না। খুব ভালো ব্যবহার করে বেলীর সাথে। প্রতিদিন নিয়ম করে বেলীর খোঁজ-খবর নিতে তার একদম ভুল হয় না। ছেলের খোঁজ না নিলেও বেলীর খোঁজ তা নিতেই হবে। সীমার এই ব্যবহারে বেলী কিছুটা স্বস্তি পায় এটা ভেবে যে, এখন আর বেলীকে মেনে নিতে তার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে সীমার বদলে যাওয়া রুপ। মেনে তো আগেও নিয়েছিল। আবার বদলেও গিয়েছিল। আবার যদি এমন হয়। এই ভয়টা বেলীর মনের থেকে কিছুতেই দূর হয় না। সীমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলে উঠল,
“একটা খারাপ খবর দেওয়ার আছে রে, বেলী।”
হঠাৎ করে বেলীর কানে কথাটা যেতেই বেলীর হার্টবিট বেড়ে গেল। আঁতকে উঠে একটু জোরেই প্রশ্ন করল,
“কী খারাপ খবর মামি? কার কী হয়েছে? মা, মামা, আফু সবাই ঠিক আছে তো? বলুন না কী হয়েছে?”
আজকাল বেলী একদম খারাপ খবর সহ্য করতে পারে না। সবসময় বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ের আশাঙ্কায় চুপসে থাকে। বেলীর আঁতঙ্কিত চেহারাপানে তাকিয়ে নীলাভ্র উঠে দাঁড়াল। প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে? এভাবে হাত কাঁপছে কেন তোর?”
বেলী নীলাভ্রর কথায় কান দিল না। পুনরায় প্রশ্ন করল,
‘বলুন না, কী হয়েছে মামি? কিসের খারাপ খবর?”
সীমা এবার শান্ত স্বরে বলল,
“নীলাভ্রর বন্ধু আমিন আছে না? তুই কী চিনিস তাকে?”
‘আমিন’ নামটা শুনতেই বেলীর মনে এক রাশ ঘৃণা এসে জমাট হলো। এই একটা মানুষের জন্য দুজন মানুষ এতগুলো মাস কষ্ট পেয়েছে। বন্ধুত্বের নামে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পেছন থেকে ছু°ড়ি মে°রেছে। নীলাভ্রর বলা প্রত্যেকটা কথা কানে বেজে উঠল। সেই সাথে ভেসে উঠল আমিনের জঘন্য রুপ। এইসব হঠাৎ করেই বাদ দিয়ে মস্তিষ্ক প্রশ্ন করল, ‘হঠাৎ আমিনের কথা কেন জিজ্ঞেস করছে মামি?” প্রশ্নটা জমিয়ে রাখল না। ভয়টা কেন যেন কে’টে গেছে। কারণ বেলী বুঝতে পারল, সীমা হয়ত আমিনের বিষয় কোনো খবর দিবে। তাই বলল,
“হ্যাঁ, চিনি। নীলাভ্র ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড।”
সীমা এবার সাথে সাথে আফসোসের স্বরে বলে উঠল,
“আমিন আজ সন্ধ্যায় গাড়ি এক্সিডেন্টে মা°রা গেছে।”
কথাটা বেলীর কানে যেতেই বেলী জোরেই বলল,
“কী? কী বলছেন? কী করে হলো? কখন হলো?”
সীমা বলল,
“আসলে নীলাভ্রর ফোন তো নেই। তাই ওর বন্ধুরা মাঝে মাঝেই তোর মামার ফোনে ফোন করে, খোঁজ নেয়। কিছুক্ষণ আগে ওদের মধ্যেই একজন ফোন করে বলল তোর মামাকে। খবরটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলে বেলী। আমার ছেলেটাকেও অনেকদিন দেখতে পাইনা। কবে আল্লাহ আমার বুকে আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিবে, সেই অপেক্ষায় আছি। তোরা একটু সাবধানে থাকিস, মা। আর কোনো আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার।”
সীমা কেঁদে উঠল এবার। মুহূর্তেই বেলীর মনটা বিষাদে ভরে উঠল। নীলাভ্র বেলীর বিষন্ন চেহারা দেখে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে? ”
বেলী ইশারা করল। অর্থাৎ ‘বলছি’। তারপর সীমাকে শান্ত স্বরে বলল,
“আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে মামি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা খুব শিঘ্রই ফিরে আসব। আপনি শুধু মন ভরে দোয়া করবেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। আমি কাল সকালেই আবার ফোন দিব।”
বলে রেখে দিল ফোনটা। নীলাভ্র অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমাকে বলবি কী হয়েছে? সবাই ঠিক আছে তো? কিসের খারাপ খবর দিলো, মা? ”
বেলী নীলাভ্রর হাত ধরে খাটে বসাতে বসাতে বলল,
“আপনি একদম হাইপার হবেন না। বাসার সবাই ঠিক আছে।”
নীলাভ্র পাল্টা প্রশ্ন করল,
“তাহলে খারাপ খবরটা কিসের?”
বেলী চুপ থাকল। আপনা-আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। বিষন্ন কণ্ঠে বলল,
“জানেন তো, নীলাভ্র ভাই। আল্লাহ ছাড় দেন। কিন্তু ছেড়ে দেন না। সবাই তার পাপের শাস্তি একদিন না একদিন পেয়ে যায়। পার্থক্য শুধু একটাই, কেউ ইহকালে শাস্তি পায় আর কেউ পরকালে।”
হঠাৎ বেলীর এমন কথা নীলাভ্র বুঝল না। প্রশ্নোত্তর চোখে বেলীর দিকে তাকিয়ে রইল। নীলাভ্রর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বেলী, বলে উঠল,
“আমিন ভাইয়া আজ এক্সিডেন্ট করে মা°রা গেছে।”
কথাটা শুনেই নীলাভ্র ‘কি’ বলে দাঁড়িয়ে গেল। সাথে সাথে বেলী নীলাভ্রকে একটু শক্ত স্বরে বলল,
“আপনি এভাবে বার বার জোর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন কেন? সমস্যা হবে তো। এখানে শান্ত হয়ে বসুন। আমি সবটা বলছি।”
নীলাভ্র নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বেলীকে বলল,
“তুই মজা করছিস?”
বেলী মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘না’। তারপর নীলাভ্রকে হাত ধরে নিজের পাশে বসাল। আলতো করে নীলাভ্রর গালে হাত রাখল। বলতে লাগল,
“আমি জানি, আপনার কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার কষ্ট পাওয়া উচিত না। তার জন্য তো একেবারেই না। বেঈমান, বিশ্বাসঘাতকদের জন্য কখনো কষ্ট পেতে নেই। আপনাকে সে অন্যায় ভাবে আঘাত করেছিল। শুধু আঘাত করেই থামেনি, যখন জানতে পারল আপনি মারাত্নক রোগে আক্রান্ত তখন আপনাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছল। ঠিক কতটা পা°ষাণ হলে মানুষ এমন কাজ করে, একবার ভেবে দেখেছেন? আপনি তাকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে গেলে তার আর আপনার মধ্যে তফাত থাকত না। সবসময় আমাদের উচিত সবকিছুর বিচার উপরওয়ালার কাছে দিয়ে। ধৈর্য নিয়ে বসে থাকা। উপরওয়ালা সময় মতো ঠিক বিচার করবেন। দেখলেন, তো আজ আমিন ভাইয়া তার পাপের শাস্তি ঠিক পেয়ে গেল। আমার শুধু তার জন্য আফসোস হচ্ছে, বেচারা তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার শেষ সুযোগটাও পেল না।”
নীলাভ্রর চোখ থেকে অবিশ্রান্তভাবে পানি ঝড়ছে। বেলীর কথাগুলো ঠিক। কিন্তু কোনো একসময় তো তারা দুজন একসাথে ছিল। বন্ধু ছিল। দুজন দুজনের পাশে ছিল। পরিস্থিতি এখন সব পাল্টে দিয়েছে ঠিক। কিন্তু কষ্টটা তো দমিয়ে রাখা যায় না। নীলাভ্র চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। হুট করে বেলীকে জড়িয়ে ধরল নীলাভ্র। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল,
“আমার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সবাই হারিয়ে গেছে, বেলীপ্রিয়া। অনেকটা সময় হারিয়ে গেছে অবেলায়। চাইলেও সেই সময়গুলো ফিরে পাওয়া সম্ভব না। আমি ওইসব মনেও রাখতে চাইনা।।যা হারিয়ে গেছে তা নিয়ে আফসোস ও নেই। আমি শুধু ওইসব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই। তোকে আঁকড়ে ধরে। তুই যে আমার মানসিক শান্তি। আমার প্রশান্তি। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। তোকে আমি হারাতে পারব না। হারাতে চাইনা। প্লিজ, তুই আমাকে ছেড়ে দিস না কখনো। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, বেলীপ্রিয়া। আমি আগের মতো নেই বিশ্বাস কর। আমি অনেক দূর্বল হয়ে গেছি। চাইলেও শক্ত হতে পারিনা এখন। আমাকে ছেড়ে যাবি না। আমি সামলাতে পারব না। আমি কিছু মানিয়ে নিতে পারব না। প্লিজ ছেড়ে যাবি না।”
নীলাভ্র পা°গলের মতো কথাগুলো বলে উঠল।বেলীর চোখও অশ্রুসিক্ত। ছেলেটা কষ্ট পেতে পেতে এখন সত্যিই দূর্বল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দুজন চুপ হয়ে রইল। তারপর বেলী নীলাভ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল,
“আপনাকে ছেড়ে দেওয়া মানে তো, নিজেকে হারিয়ে ফেলা। আর মানুষ কী নিজেকে হারিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, নীলাভ্র? আপনাকে আমি কখনো যাব না। এইযে এভাবেই শক্ত করে ধরে রাখব। একবার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলেন। আর কখনো হবেন না। আমি হতে দিব না। ওইসব পুরনো ব্যাথা ভুলে যান তো। আমরা দুজন এবার থেকে একসাথে বাঁচব।”
নীলাভ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের চোখের পানিগুলো মুছে নিলো। বেলীকে ছেড়ে ঠোঁটে হাসি ফুটাল। বেলীর হাত জোড়া তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে, বলে উঠল,
“ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া। এভাবেই ভালোবাসতে চাই। আজ থেকে সব পুরনো ব্যাথা ভুলে আমরা নতুন করে সব শুরু করব।”
বেলী চোখে পানি নিয়েও হাসল। স্নিগ্ধ সেই হাসি। নীলাভ্র নিজ হাতে বেলীর চোখের পানি মুছিয়ে দিল। শীতল স্বরে শুধাল,
“তুমি নামক প্রশান্তিতে আমি আজীবন ডুবে থাকতে চাই, বেলীপ্রিয়া।”

#চলবে

[আর এক পর্বে শেষ হবে ইন শা আল্লাহ। কালকেই পাবেন। শেষ সময়ে অন্তত এক লাইনের একটা মন্তব্য করুন। আমার ভুল ত্রুটি গুলো দেখিয়ে দিন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here