তুমি নামক প্রশান্তি দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১০

0
325

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_দশ

বেলীর সম্পূর্ণ মুখশ্রী লাল হয়ে আছে। চোখ দুটো ফোলা। গালের একপাশে পানি গড়িয়ে পড়ার সরু একটা দাগ হয়েছে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। হেচকি উঠে গেছে। তবুও কান্না থামছে না। নীলাভ্রর বুকে মাথা রেখে অনবরত কেঁদে-ই চলেছে।নীলাভ্র আলতো হাতে বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ক্যানোলা লাগানো ব্যাথাযুক্ত হাতটা এবার অসার হয়ে আসছে। তবুও ছেলেটা এক সেকেন্ডের জন্য হাত থামাচ্ছে না। বুকে লেপ্টে থাকা মেয়েটা যে তার হৃদয়ের হৃদিপদ্ম। এই মেয়েটার কান্না সে কখনো-ই সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু আজ করছে। কারণ, আজ মেয়েটা একটু কাঁদুক। তার কাঁদার প্রয়োজন। মনটাকে হালকা করা প্রয়োজন। এই একটা বছর মেয়েটা অনেক কিছুর সাথে লড়াই করেছে। অনেক কিছু সহ্য করেছে। নীলাভ্র এবার একটু হাসল। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ভর করল। ঠোঁট কামড়ে হেসে, বলল,
” বইন, এইযে বার বার নাক টানছিস। চোখের জল, নাকের জল সব দিয়ে আমার জামার অবস্থা নাজেহাল করে দিচ্ছিস। তুই তো এক নাম্বার খাচ্চ°র। খাটা’°শ পোলাপাইন। সর, এক্ষুনি আমাকে ছাড়। ইয়াক!”
বেলী এহেন কথায় আহাম্মক হয়ে গেলো। নাক টানতে টানতে নীলাভ্রকে উঠে বসল। চোখের জল, নাকের জলে মেয়েটার মুখের একাকার অবস্থা। তার উপর এমন অদ্ভুত কথা শুনে, কেমন বোকা বোকা চাহনী নিক্ষেপ করে আছে। দেখতে একদম অন্যরকম লাগছে। আচ্ছা! কেমন লাগছে? সুন্দর না-কী অসুন্দর? নীলাভ্র খুঁজে পেলো না। কিন্তু মুখ ফুটে, বলল,
“তোকে না এখন দেখতে একদম গেদা বাচ্চা লাগছে। যেমন গেদা বাচ্চা কান্না করলে নাক দিয়ে আঠালো এক প্রকার…”
নীলাভ্র কথাটা শেষ করার আগেই বেলী নীলাভ্রর মুখ চে°পে ধরল। একটু চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ছি! একদম চুপ। কী সব বলছেন? আমার গা ঘিনঘিন করছে। ইয়াক! থু!”
বলেই বেলী নাক, মুখ ছিটকানো শুরু করল। তা দেখে নীলাভ্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বেলীর সত্যি সত্যি গা কেমন করছে। তাই তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে পুরো মুখ মুছে নিলো। তা দেখে নীলাভ্রর হাসি বেড়ে গেলো। বেলীর রাগে শরীর শিরশির করছে। ধুম করে কি°ল বসিয়ে দিলো নীলাভ্রর বাহুতে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
“আপনি প্রচুর খারাপ। অনেক খারাপ। খারাপের থেকেও খারাপ। খারাপের উপরে যা আছে তা সব আপনি। অভ’°দ্র, অস°’ভ্য, খা°’চ্চর, খাটা°’শ ছেলে।”
নীলাভ্র হাসতে হাসতে বেলীকে এক হাতে বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো। বেলী একটু ছোটাছুটি করতেই নীলাভ্র শীতল স্বরে বলে উঠল,
“ব্যাথা পাচ্ছি, বেলীপ্রিয়া। একটু শান্ত হয়ে থাক।”
বেলী এবার শান্ত হয়ে গেলো। এই কণ্ঠের কোনো শব্দ উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। কারোর নেই। এত নমনীয়তা কারোর কন্ঠ স্বরে কি আদৌ থাকতে পারে। ভেতর থেকে উত্তর আসলো। ‘হ্যা’ পারে। অবশ্যই পারে। মেয়েরা পুরুষের কণ্ঠ স্বরের প্রেমে পড়ে। পুরুষ কণ্ঠের মাদকের মতো নেশায় ঘায়েল হয়ে যায় এক নিমিশেই। এই কণ্ঠ স্বর শোনার নেশা যখন একবার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে, তখন পৃথিবীর কোনো নেশাদ্রব্য আর কাজে লাগে না। বেলীকে শান্ত হতে দেখে, নীলাভ্রর ঠোঁট জোড়া খুব সাবধানে বেলীর ললাট স্পর্শ করল। গভীর সেই স্পর্শে বেলী একবার কেঁপে উঠল। চোখ জোড়া আবেশে বন্ধ করে নিলো। ঠোঁট গুলো তিরতির করে কাঁপা শুরু করল। সেই দৃশ্যে চোখ যেতেই, নীলাভ্রর তৃষ্ণার্ত ঠোঁট জোড়া খুব করে উতলা হয়ে পড়ল। গোলাপি বর্ণের ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা জাগল। তবুও দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু ‘না’ কিছুতেই মনের ভেতরের সুপ্ত বাসনাটাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। যখনি নীলাভ্রর ঠোঁট জোড়া বেলীর ঠোঁটে স্পর্শ করবে, তখনি দরজার সামনে থেকে ভেসে আসল,
“এইইই! ইস! ভুল সময় এসে পড়লাম। আমি কিছু দেখিনি। একদম দেখিনি। আমার চোখ অন্ধ। আমি চোখে দেখিনা। নাকে শুনিনা। থুরি, কানে শুনিনা। তাই আমি কিছু দেখিও না।”
রাকিবের কণ্ঠে বেলী আর নীলাভ্র দুজনেই ধড়ফড়িয়ে উঠল। বেলী এক লাফে নীলাভ্রর থেকে সরে, উঠে দাঁড়াল। আর নীলাভ্র দৃষ্টি এদিক, সেদিক ঘুরাতে লাগল। মনে মনে বলে উঠল,
“আল্লাহ! মাটিকে এক্ষুনি দুই ভাগ করে দাও। আমি ঢুকে যাই।”
আর বেলীর মুখটা চুপসে আছে। রাকিবের মুখে রয়েছে দুষ্টু আছি। বেলীর দিকে চেয়ে একাধারে ভ্রু নাচিয়ে যাচ্ছে। রাকিব দুষ্টু হাসতে হাসতে এগিয়ে আসল। একটু গলা ঝেড়ে বলতে লাগল,
“আমি কিছু দেখিনি। আবার অনেক কিছু দেখেছি। আসলে সত্যিই আমি কিছু দেখিনি। শুধু দেখলাম…।”
পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই বেলী উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“ক্ষুধা লেগেছে। খেতে যাব। চল আয়। ”
বলেই রাকিবের হাত ধরে টানা শুরু করল। রাকিব আবার বলার জন্য মুখ খুলল,
“আসলে, আমি কী দেখেছি? সেটা বলতে দে।”
কিন্তু ‘না’। বেলী কিছুতেই বেচারাকে বলতে দিবে না। বাধা দিয়ে বলে উঠল,
“তুই কিছু দেখতে পাস না। তুই অন্ধ। কানা মালেক। সর্দিতে তোর নাক বন্ধ। তুই নাক বোচা সুলেমান। বাইরের কুচকাওয়াজে তোর কান বন্ধ। তুই বয়রা খালেক। এখন চল।”
বেলীর এমনসব অদ্ভুত কথায় নীলাভ্র মুখে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করল। আর রাকিব বেকুবের মতো চেয়ে রইল শুধু। ওইদিকে বেলীকে বেচারাকে গরুর মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা এমন যে, একটা গরু মাঠে যেতে চাচ্ছে। অথচ তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেলী আর রাকিব চলে যেতেই নীলাভ্র একটু শব্দ করেই হাসা শুরু করল। পরক্ষণেই মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে নিলো। কণ্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে, বলল,
“শা°লা আর আসার সময় পেলো না। কতদিন পর আমার বেলীফুলটাকে কাছে পেয়েছিলাম। আর মাঝ খান থেকে এসে সব গন্ডগোল পাঁকিয়ে দিলো।”
একা একাই কিছুক্ষণ আপন মনে বকবক করল নীলাভ্র। তারপর কিছুটা সময় চুপ থাকল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুবই শান্ত, শীতল স্বরে বলতে লাগল,
“তোকে আর হারিয়ে যেতে দিব না, বেলীপ্রিয়া। অনেক কষ্ট পেয়েছিস। এইটুকু জীবনে তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস। আর কষ্ট পেতে দিব না। কিন্তু যে আমার সাথে বেঈমানী করল। বন্ধুত্বের নামে ধোঁকা দিলো। তাকে আমি ছাড়ব না। শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। কঠিন শাস্তি।”
সাথে সাথে নীলাভ্রর চোখ মুখ লাল বর্ণ হওয়া শুরু করল। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। চিৎকার করে বলে উঠল,
“একদিনের অপমানের শোধ তুই এতটা জঘন্য ভাবে নিবি। আমি ভাবতেই পারিনি, আমিন। তোর শাস্তি পাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তোকে তো আমি ছাড়ব না। তুই আমাকে যতটা যন্ত্রনা দিয়েছিস। আমি তার দ্বিগুণ তোকে ফিরিয়ে দিব।”
বলেই চোখ বন্ধ করে নিলো। সাথে সাথে ভেসে উঠল লোমহর্ষক কিছু মূহুর্ত,
“চারদিকে গভীর অন্ধকার। রাস্তা দিয়ে শুনশান গাড়ি ছুটে চলেছে। ব্যস্ত শহরে চারদিকে সবাই ব্যস্ত। শুধু গাছের নিচে পড়ে আছে একটি দেহ। না মৃ°ত নয়। জীবত। কিন্তু দেহটার নড়ার শক্তি নেই। হাতে পায়ে বিভিন্ন আঁ°চড়। পিঠ বে°ল্টের আ°ঘাতে র°ক্তাক্ত। পায়ের পাঁচটা নখে সুঁ’ই গাঁথা। সে কী এক যন্ত্রণা!”
ভাবতেই নীলাভ্র সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলল। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ইচ্ছে করেই তখন বেলীকে সবটা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। বেলী যে এসব সহ্য করতে পারবে না। একটুও পারবে না। নীলাভ্রর চোখ দুটো হঠাৎ করেই ছলছল করে উঠল আমিনকে তো ভাইয়ের মতো দেখত। শুধুমাত্র একদিনের খারাপ ব্যবহারের শোধ এতটা জঘন্য ভাবে নিলো। ভাবতেই নীলাভ্রর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বেলী মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করেছে। আর নীলাভ্র সহ্য করেছে শারীরিক যন্ত্রনা। বন্ধুরাও শত্রু হয়। স্বার্থের পৃথিবীতে সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। নিজের স্বার্থে একবার আঘাত লাগলে বন্ধুরাও কাল সা°প হতে দুইবার ভাবে না। আজকাল চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। এই পৃথিবীতে কেউ আপন না। শুধু মাত্র আপন হওয়ার মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়ায় সবাই। কার‍ন, আপন হয়ে পেছন থেকে ছু°ড়ি মা°রাটা খুব সহজ। তাই মানুষ আগে আপন সেজে কাছে আসে। তারপর আঘাত করে চলে যায়। অথচ আমরা টের ও পাইনা। হায়! বোকা মনিষী। কবে বুঝব আমরা। আসলে কেউ আপন না। আপন হতে পারেও না। বন্ধুরাও আপন না। অথচ আমরা বিরাট স্লোগান দেই, “বন্ধু ছাড়া জীবন চলে না’। হায়! বিশ্বাস করে ঠকার মতো বাজে অভিজ্ঞতা আর নেই…

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here