তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব:- 2

0
2142

তুমি অতঃপর তুমিই
Writer Taniya Sheikh

২০.

করোনার আশঙ্কায় দেশে লকডাউন দেওয়ার সম্ভবনা প্রবল হওয়ায় সেদিন রাতেই ফিরে আসে শান। রাত তখন আনুমানিক একটা। দারোয়ান গেট খুলতেই শানের গাড়ি ঢুকল। দারোয়ান মতিন শানের বিশ্বস্ত লোক। শানের কথার বাহিরে একটা কথাও সে বলে না,একটা কাজও করেনা। এই যে এতো রাত করে বাড়ি ফিরল দারোয়ান চাচ্ছিল মোবারকে খবর দিতে কিন্তু দিল না। শান যেহেতু বলেনি সুতরাং ঐকাজ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দারোয়ান করবে না। এমনকি বাসায় যে নতুন মেয়েলোক ঢুকেছে সেটাও তার মুখ দিয়ে বের হলো না৷ নত মুখে গেট লাগিয়ে ফিরে গেল তার ছোট্ট কুটিরে। এখান থেকে বাইরেটা ভালোভাবেই নজর রাখতে পারে সে।

শান গাড়ি গ্যারেজে রেখে চাবি হাতে সদর দরজার সামনে এলো। দরজা কয়েকবার নাড়াচাড়া করেও খুলতে ব্যর্থ হয়ে ফের ডাকল দারোয়ানকে। তখনই দুপুরে আগত কাজের মেয়েটি সম্পর্কে বলল মতিন। শান মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হয় মতিনের উপর। কোনোকিছুই অতিরিক্ত ঠিক না৷ হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা প্রভু ভক্তি। বিবেক বর্জন করে নত হওয়ার মধ্যে কেবলই গ্লানি, আত্মসম্মানহীনতা থাকে। মতিনকে বিদায় করে শান পেছনের সিকিউরিটি ডোর খুলে ভেতরে ঢোকে। এতোপথ জার্নি করে রাত দুপুরে এসব ঝামেলার কারনে মেজাজ তুঙ্গে শানের। রুমে ঢোকামাত্রই গায়ের ব্লেজার ছুঁড়ে ফেলে কাউচে বসে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে সোজা চলে আসে উপরের রুমে। লম্বা একটা শাওয়ার শেষে বার্থরোব গায়ে, নগ্ন পদে নামে নিচে। গোসল করায় অবসন্নতা খানিকটা কেটে গেছে। শ্রান্ত শরীরে ঝটপট কর্ণ স্যুপ তৈরি করতে লেগে গেল এক কাপ কবোষ্ণ কফিতে চুমুক দিতে দিতে। এক কাপ উষ্ণ কফি শরীরটা চাঙা করতে যথেষ্ট। স্যুপ রেডি, স্যালাড চপিং করে সামান্য অলিভ ওয়েলে মাখিয়ে বসল কাউচে। সামনের টিভিটা অন করল। সাথে সাথে টিভিস্ক্রিনে ভেসে ওঠে হরর মুভির কিছু ভায়োলেন্ট দৃশ্য । স্যুপ গলায় আটকে যায় ঘটনার আকস্মিকতায়। কাশতে কাশতে কিচেনে ছোটে।

বাইরের টুংটাং আওয়াজে ইমার ঘুম ভেঙে যায়। টিভি চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। কেউ কাশছে! কে? আসমা নামক মেয়েটি তাকে বলল সাহেব আজ ফিরবে না। তাহলে? চোর! ইমা দ্রুত বিছানা ছেড়ে সতর্ক পায়ে বেরিয়ে এলো। হাতে নিয়েছে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার হাতিয়ার একটা ছোট্ট ছুরি।এটা সবসময়ই কাছে রাখে সে। লিভিং রুম ছাড়া সম্পূর্ণ নীচতলা অন্ধকার। লিভিং রুমের টেবিলটায় খাবার ভর্তি বাটি ছাড়া আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। টিভিতে এখনো চলছে মুভিটা। দৃশ্য পটে এডাল্ট সিন চলছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সে দৃশ্য দেখে। লজ্জায় অবনত হতেই আবার শব্দ শুনতে পেল৷ এবার শব্দের উৎস রান্নাঘর। ইমা পা টিপে টিপে সেদিকে গেল। শোকেজের পাশ থেকে উঁকি দিতেই বার্থরোব গায়ে একজন লম্বাটে, বলিষ্ঠ দেহের পুরুষকে দেখল। ঝুঁকে ঘুরে দাঁড়ানোয় কেবল পেছনটায় দেখতে পাচ্ছে ইমা৷ সে কিছুক্ষণ ভাবল, এই লোক কে হতে পারে? বেশ পোশাকে চোর তো লাগছে না মোটেও। তবে? এই বাড়ির মালিক নয় তো! ইমার গলা শুকিয়ে এলো ভয়ে। এই এত বড়ো বাড়িতে কেবল ওরা দু’টো প্রাণী। তার উপর এই লোক ঐসব বাজে মুভি দেখছিল। আচ্ছা, সদর দরজা তো বন্ধ করেছিল ঘুমানোর আগে। এই লোক ঢুকল কী করে? ইমার ভেতরে ভয় ভয় করলেও ইমা তো ইমায়। তার অতীত ম্লান হলেও পুরোপুরি মুছে যায়নি। সেই সাহস,চঞ্চলতা আজও আছে গুমোট মেরে। ইমা ঘুরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে রুমে ফিরে আসে। দরজা ভালো করে বন্ধ করে ছুরিটা বালিশের তলে লুকিয়ে রাখে। বালিশে মাথা রেখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে,

” আসুক না ছুঁতে। ছুড়ি ঢুকিয়ে ব্যাটার ভুঁড়ি বের করে দেবো না। ইমাকে চেনে না তো!”

কথার জোরে সাহস বাড়েনা। ছুরিটার কারনে অতিরিক্ত ভীতও হয়না। সে রাতটা ওভাবেই চিন্তায় চিন্তায় পার করে আধোঘুমে। ভোরের আজান দিতেই অযু করে নামাজ পড়ে নেয়। যেই পাপ ইমা না চাইতেও করেছে তার ক্ষমা চায় প্রতি প্রার্থনায়। দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।

টিভি দেখতে দেখতে রাতে কাউচেই ঘুমিয়ে পড়েছিল শান। খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস ওর। স্বভাবতই সঠিক সময়ে ঘুম ভাঙল। উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নামল নিচে। পরনে কালো জগিং স্যুট। লিভিং রুম পার হতেই থমকে দাঁড়ায়। পাশের রুম থেকে পায়ের শব্দ শুনে এগিয়ে গেল সেদিক। রাতে বলা দারোয়ানের কথা মনে পড়তেই বুঝল এই রুমেই হয়তো গৃহকর্মী মেয়েটা আছে। শান দরজায় কড়া নাড়ে। বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে কেঁপে ওঠে ইমা। রক্ত হিম আসে। দ্রুত বালিশের নিচ থেকে ছুরিটা বের করে হাতটা পেছনে লুকিয়ে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। বার কয়েক দরজা নক করে শান বলে ওঠে,

” আপনি কী জেগে আছেন?”

চার বছর কেন? চার সহস্র বছর পার হলেও এই গলার স্বর চিনতে ভুল করবে না ইমা। সমস্ত শরীর জমে গেল ওর। অবশ অবশ অনুভূতি হতে লাগল। দরজার ওপাশে ধীরে ধীরে আগের মতো নিস্তব্ধতা নামে। ইমার ক্রমেই মনে হলো ওর ভ্রম ছিল। গতকাল শানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতেই হয়তো এমনটা হয়েছে। ঘৃণার আবরণে আজও যে প্রবল ভালোবাসা সুপ্ত। ভ্রম না সত্যি যাচাই করার জন্য ইমা নিজেকে সামলে দরজা খোলে। ভ্রম হলেই খুশি হবে ইমা। শানকে সে দেখতে চায়না আর। পেছনে লুকানো ডান হাতটায় এখনো ছুরি ধরা। এবার লক্ষ্য শান। সত্যিই যদি শান হয়, এই ছুরির ফলা তার বুকে গেঁথে দেবে। তারপর নিজের বুকে। আজ সকল জ্বালা যন্ত্রণার অবসান ঘটাবে সে। লিভিং রুমের দিকে কয়েক পা এগোতেই পেছনে শুনল সেই সে গলার স্বর,

” এক্সকিউজ মি.” শান সু কেবিনেটে ময়লা দেখে সেটা পরিষ্কার করতে লেগে গিয়েছিল। এই বাড়ির সমস্ত কাজ সে একাই করে। তবে মাঝে মাঝে শানের নিষেধ উপেক্ষা করে মোবারক এসেও সাহায্য করে কাজে। গত দুই দিন বাসায় না থাকাতেই ময়লা জমেছে সু কেবিনেটে। ইমা যখন পা টিপে টিপে লিভিং রুমে উঁকি দিচ্ছিল শান সেটা সদর দরজার পাশে বসে দেখতে পায়। তবে ওটা যে ইমা সেটা শান টের পায়না। ইমা ছুরিসহ হাতটা সামনে নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোনোদিন শান তার ভালোবাসার মানুষ ছিল সেই মুহূর্তে ইমা ভুলে বসে। মনে থাকে কেবল শানের দেওয়া ধোঁকা আর নিষ্ঠুরতা। ক্ষুব্ধতায় রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে।

ওদিকে বার বার প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ায় শান। লিভিং এরিয়ায় নেমে টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে এক পা এক পা করে এগোয়। যত এগোচ্ছে ততই যেন এই রমণীর শারীরিক গঠন তাকে অন্য কারো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ইমা, ইমা! অস্ফুটে উচ্চারণ করে ঠিক ইমার পেছনে দাঁড়ায়। দুজনের দূরত্বের তফাৎ মাত্র কয়েক ইঞ্চি। এই ইঞ্চি পরিমাপ অতিসত্বর কমে আসে ইমা ঘুরে দাঁড়াতে। ক্ষুব্ধ ইমার ছুরি সহ হাতটা তড়িৎ গতিতে ছুটে আসে শানের দিকে। ঘোর কাটতে শানের সময় লাগল। এই কালক্ষেপনের সুযোগে ধেয়ে আসা ছুরিটা ঠিক বুকের নিকটে এলো চলে। শত্রুকে পরাস্ত করতে তার জুড়ি নেই। আর সেই শত্রুটি যদি হয় পরম ভালোবাসার মানুষ, তবে তো শান আরও এক কদম এগিয়ে এতে। আজ হয়তো অবলীলায় প্রিয়তমার ছুরি বুকে পেতে নিত।কিন্তু ঐ মিথ্যা অপবাদের কী হবে? এই স্বেচ্ছায় মৃত্যু তাকে সত্যিই বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করবে। যা আদৌতে সে নয়। বা’হাতের ছুরির ফলা ধরে ফেলল শান। ততক্ষণে ছুরির ফলার সামান্য অংশ বুকে গেঁথে রক্তাক্ত অবস্থা। গত চার বছর ধরে যে দাবানল বুকে চেপে আছে, আজ ইমাকে কাছে পেয়ে কিছুটা হলেও শান্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলো উল্টো, সেটা অবশ্যই ইমার এহেন আচরণে। ইমার হাতটা সজোরে মুড়ে ধরতেই ছুরি নিচে পড়ে যায়। পায়ের সাহায্য সেটা ঠেলে ফেলে আরও দূরে শান। হাতের ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ইমা। চেঁচিয়ে বলে,

” হাত ছাড় বলছি, বর্বর, বিশ্বাসঘাতক।”

শেষের শব্দ দু’টো শানের মগজ পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়। পেছনে মোড়া হাতটা সহ ইমাকে একদম নিজের কাছে টেনে আনে। ইমার অবগুন্ঠন আগেই মাথা থেকে সরে ঘাড়ের কাছে পড়েছে। অবিন্যস্ত চুল সরিয়ে মুখ নামিয়ে আনে শান। কাঁধে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে ইমা। ঐ ঠোঁটের স্পর্শ কাঁধে পড়তেই শিওরে ওঠে সর্বাঙ্গ। দু’চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সর্বশক্তি দিয়ে শানের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছা হলো ওর। ঠিক তখনই সেই ইচ্ছার উপর ভর করে গত চার বছরের সকল কষ্ট। আপন সহোদর ও পিতৃ হত্যাকারী এই বর্বরকে এককালে ভালোবাসত ভাবতেই ঘৃণায় বিষিয়ে উঠল সারা দেহ। নিজেকে ছাড়ানোর সকল চেষ্টা করে একসময় ক্লান্ত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,

” আমাকে ছেড়ে দিন।”

এই কাতর কণ্ঠ শান উপেক্ষা করতে পারল না। ভুলে গেল সকল মান,অভিমান,যাতনা। হাত ছেড়ে দিতেই ইমা আসল রূপে ফিরে আসে। ঘুরে দাঁড়িয়ে শানের ডান গাল বরাবর কষিয়ে দেয় এক চড়। রাগে কাঁপছে ইমার শরীর। শান বিস্মিত,ক্ষুব্ধ চোখে ইমার দিকে তাকাতেই দেখল সামনে অগ্নিবিচ্ছুরিত দু’টো চোখ। এই চোখেই একদিন ছিল অপার ভালোবাসা, অপত্য মায়া। চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে ইমার বাহু চেপে ধরে। ইমার চোখে ভালোবাসা খোঁজে। কিন্তু কোথায় ভালোবাসা! এ যে কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা। বিরহে ব্যাকুল শান আর্তচিৎকারের সাথে প্রশ্ন করে,

” কেন এমন হলে তুমি ইমা? কী দোষ আমার? এই নিষ্ঠুরতা কোন পাপে? খুলে বলো আমাকে। সত্যিই আমি দোষী হলে নিজের জীবন নিজে শেষ করে ফেলব। একবার শুধু বলো আমাকে।”

ক্রোধে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে ইমার। ঘৃণা ভরা তীক্ষ্ণ চাহনীতে শানের চোখে চোখ রাখে।এভাবে কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ রইল। শান দু বাহুতে পরম ভালোবাসায় ইমাকে বেষ্টন করে নেয় সেই সুযোগে। ধড়া গলায় বলে,

” আমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতগতা করিনি ইমা। বিশ্বাস করো তুমি।”

ঘৃনার পাথরে খোদাই করা ইমার মন,চোখ সেকথা বোঝে না, শোনে না। দুহাতে শানের রক্তাক্ত বুকটায় আঘাত করে দূরে ঠেলে দেয়।

” বিশ্বাস! আর তোকে? একবার করেছিলাম তো। তার শাস্তি আজ পর্যন্ত পাচ্ছি। এই ইমা মরে যাবে তবুও তোর মতো শয়তানকে বিশ্বাস করবে না।” ইমা ছুটে চলে যায় রুমে। শান হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী অপরাধ না জেনেই শাস্তি পাচ্ছে সে। এই শাস্তি যে মৃত্যুর যন্ত্রণা সম। ইমা ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখল শান বুকে হাত দিয়ে ঝুঁকে বসে আছে। ঘৃণা পারেনা ভালোবাসা রুখতে। সে আপন শক্তিতে ঠিকই প্রকাশিত হয়। এই যেমন এখন হলো ইমার দু’চোখ বেয়ে। যে হাতে ছুরি বসিয়েছিল সেই হাতটা এতো জোরে মুষ্টিবদ্ধ করে যে,রগে রগে টান ধরে যায়। এই হাতকে ইমা যোগ্য শাস্তি ঠিক দেবে। তার আগে এখান থেকে বেরোতে হবে তাকে। তা না হলে ঘৃণার আগুনে ভালোবাসা জ্বলবে। ঝলসে যাবে ভালোবাসার মানুষটা। শানের চোখে পড়ার আগেই বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয় সে চেষ্টা। মিথ্যা অপবাদের আঘাত ছুরির আঘাত থেকেও বহুগুণ বেশি ছিল শানের জন্যে। সে ইমার কাছে স্পষ্ট জবাব চায়। হয় মরণ নয় জীবন! অনেক হয়েছে সহ্য। শান ইমাকে টেনে ধরে কাউচে বসায়। ইমার ওড়না দিয়েই ওর দু’হাত বাঁধে। অঙ্গশক্তি যখন বেষ্টনে আবদ্ধ ইমার কণ্ঠধ্বনিই তখন ভরসা। চেঁচিয়ে, তিরস্কার করে একাকার করে সে। অগত্যা শানকে ওর মুখে টিস্যু গুঁজে দিতে হয়। ক্রোধে লাল হয়ে ওঠে ইমার মুখ। শান ঝুঁকে ইমার চিবুক ধরে বলে,

” তোমার রাগ কমানোর ওষুধ শান নিহান খান বেশ ভালোভাবেই জানে।” এক চোখ টিপে উঠে দাঁড়ায় শান। এক টানে গায়ের জগিং টিশার্ট খুলে ফেলতেই ইমা চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে। শান ভ্রু নাচাতেই বড়োসড়ো ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ভেতরে ভেতরে একধরনের শিহরণ অনুভব করে ইমা। সেটা সহসায় কমে আসে শানের প্রস্থানে। শান সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পর সে ফিরে আসে একটা কাগজ হাতে। ইমার সামনের টেবিলে ফেলে মুখোমুখি বসে বলে,

” সাইন ইট।”

ভ্রুকুটি করে কাগজটার দিকে তাকায় ইমা। ইংলিশে লেখা পুরোটায়। কপাল কুঁচকে শানের দিকে তাকাতেই শান ঝুঁকে ওর মুখের টিস্যু ফেলে দেয়। মুখ ঝেড়ে ইমা রাগত স্বরে প্রশ্ন করে,

” এটা কী?”

” কাগজ।”

” ফাজলামি করবি না আমার সাথে। ঠিক করে বল এটা কী?”

” আমার বাসায় আজীবন কাজ করার এগ্রিমেন্ট। সাইন ইট।”

” ওরে মোর আল্লাহ, সাইকোর বাচ্চা সাইকো, বদের বদ, তোর ঘটে বুদ্ধি কম? তুই ভাবলি কী করে এই কাগজে ইমা সাইন করবে?”

” উফ,আপনার এই ভাষা মিসেস নিহান। আই রিয়েলি মিস ইট।”

ইমা আবার বকবে বলে মুখ খুলতেই শানের উৎসুক চাহনী দেখে থেমে যায়। স্পষ্ট ভাষায় বলে,

” দ্যাখ শান নিহান খান, ভালোয় ভালোয় বলছি আমাকে যেতে দে। আমি এই কাগজে মরে গেলেও সাইন করব না।”

” ওহ, রিয়েলি। আর যদি পুলিশে দেই? ওহ! আমিও কী বোকা। মৃত্যুর কাছে পুলিশে ধরা কোনো ফ্যাক্ট হলো। আচ্ছা যাও, যাও।” ইমা পুলিশের কথা শুনে থ মেরে বসে থাকে।শান ওর অলক্ষ্যে মুচকি হাসে। ইমার দু’হাতের বাঁধনের এক গিঁট খুলে শান পুনরায় চাপা স্বরে বলল,

” বুকে ফের ছুরি বসানোর ইচ্ছা নেই তো?”

ইমার চোখ শানের দৃষ্টি থেকে ক্ষত বুকের উপর পড়ে। এখনো সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। বুক বেয়ে সেই রক্ত ধারা ক্রমশ নিচে নামছে। শান এতোক্ষণ যা খুঁজছিল এবার সেটা পেয়ে গেল। ইমার ঐ চোখে ভালোবাসা। নিজেকে যেন কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারল না। শুষ্ক ঠোঁট বহুদিন পর যথার্থ অর্থেই সতেজ হলো। রাগ,অভিমান, ক্রোধ কিছুক্ষণের জন্যে আড়াল হয়ে সেখানে জায়গা করে নিল তৃষ্ণিত হৃদয় তিপ্ত করার আকুলতা।

ক্রোধ, ঘৃণা মানুষকে সহজেই নিষ্ঠুর করে তোলে। ইমার অবস্থাও কিছুটা তাই। হঠাৎ সে কামড়ে ধরল শানের ঠোঁট। ব্যথায় সরে বসে শান। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। না,ব্যথায় নয়। বার বার ইমার ঘৃণার সম্মুখীন হয়ে। চুলের মুঠি টেনে ধরে বলে,

” এতো ঘৃণা আমার প্রতি, কিন্তু কেন? জবাব দাও ইমা, জবাব দাও।”

মুখ সরিয়ে নেয় ইমা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

” কেন? কেন! এই কেনর জবাব আমি কোনোদিন দেবো না। কেন দেবো না জানিস? কারণ তুই সব জানিস। জেনেশুনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আমার সর্বনাশ করেছিস তুই, আবার বলছিস কেন? লম্পট, ধোঁকাবাজ,সন্ত্রাস।” অপবাদের তীর বিদ্ধ শান হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ইমার চুল ছেড়ে ফের ইমাকে দু বাহুতে জড়িত ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,

” এমন অপবাদ দিও না ইমা। এরচেয়ে ভালো ছিল তখন তোমার হাতের ছুরি বুকের হৃদপিণ্ড ছেদ করত। আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো তুমি। আমি এমন কিছুই করিনি যার কারনে তুমি কষ্ট পাবে। তুমি তো আমার স্ত্রী, আমার আভূষণ৷ তোমাকে কষ্ট দেওয়া আর নিজেকে দেওয়া একই কথা। আমি জেনেশুনে এমন কিছুই করিনি, না করব। তবুও যদি ভুল করে থাকি, একবার বিশ্বাস করে খুলে বলো আমাকে সব। প্লিজ ইমা। আমি সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি আছি।” ইমার মনকে এই কাতরতা নাড়া দিলেও প্রভাবিত করতে পারেনা৷ ধাক্কা দিয়ে শানকে নিচে ফেলে ফের চেঁচিয়ে বলে,

” ছুবি না আমাকে। একদম ছুবি না। আমাদের মধ্যে শত্রুতা ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। তোর এসব নাটকে ইমা এবার ভুলবে না। পুলিশের ভয় কেন ফাঁসির ভয় দেখালেও আমি এখানে থাকব না। এক মুহূর্তের জন্যেও না।”

ইমা উঠে দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। দু’চোখ খিচে বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় শান। উচ্চৈঃস্বরে বলে,

” ইমা, আমি যদি কিছু করে থাকি তার শাস্তি আমাকে যথাযথ প্রমাণের সাথে দিয়ে তবেই যাবে তুমি। আর তা যদি না করো তবে আমার সাথে যা করেছ গত চার বছরে এবং আজ, তার শাস্তি পাবার জন্য হলেও তোমাকে এখানে থাকতে হবে।”

ইমা ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে,

” যদি না থাকি? যদি কেন বলছি। ইমা থাকবেই না এখানে। যা করার কর তুই। আমি কাওকে ভয় পাই না।”

শানের অশ্রুসিক্ত রক্তবর্ণের দু’চোখে শয়তানি হাসি ফুটে ওঠে দু ঠোঁটের সাথে তাল মিলিয়ে। এক পা এক পা করে ইমার দিকে এগোতে এগোতে বলে,

” তুমি ভালো করেই আমাকে চেন মাই লাভ। আমি কী করতে পারি, আর না পারি সেটা তোমার চেয়ে ভালো কে জানে বলো? আমার অপরাধের কারণ বলবে, নয়তো এক একটা সেকেন্ড তোমার জন্য যন্ত্রণাময় দিনের সমতুল্য হবে৷ আমি এও জানি তুমি সহজে বলবে না। আর তুমি ভালো করেই জানো, শান জেনেই ছাড়বে। তারজন্য যদি শত আঘাত সহ্য করা লাগে করব, শত আঘাত আঘাতে তোমাকে জর্জরিত করা লাগে সেটাও করতে বাধ্য হব। আমার তোমাকে চাই তোমার শত্রুতা নয়।”

ইমা ঘাবড়ে যায় শানের শ্যেন দৃষ্টি দেখে। বের হবার জন্য ছুটতেই শান ধরে ফেলে। দু’হাত পেছনে মুড়ে নিজের দেহের সাথে চেপে ধরে ইমাকে। ছটফট করছে ইমা। কামড় দেওয়ার জন্য মুখ এগোতেই শান অন্যহাতে ওর মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে। একদিকে দেয়াল অন্যদিকের শানের শরীরের সম্পূর্ণ ভরে ইমার দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিছু বলবে সে উপায়ও রাখেনি শান। ইমার কানে আলত কামড় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

” অনেক তো ভালোবাসা দেখলে এবার ভালোবাসার অত্যাচার দেখার জন্য রেডি হও ,মাই বিলাভড এনিমি।”

ইমাকে জোরপূর্বক এগ্রিমেন্টের কাগজে সই করিয়ে ইমরোজকে কল করে শান৷ ইমার নামে জিডি করতে বলে ইমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। জিডির কথা শুনে ইমা মুষড়ে পড়ে ভেতরে ভেতরে। মোবাইলের ওপাশে ইমরোজের সবকিছু বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। ইমাকে শান পেয়েছে এই খুশিতে সে লাফিয়ে ওঠে। শেষে শানের ইঙ্গিতেপূর্ণ কথায় নিজেকে সামলে নেয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে বন্ধুর সব কথায় সায় দেয় সে। এখান থেকে ইমার যাওয়া পথ একপ্রকার রুদ্ধ। এই এতপথ হেঁটে জনপদে যাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। পথটাও চেনা না। আসার পথে নির্জন প্রান্তর,বন পার হয়ে এসেছে। কিন্তু যাওয়ার পথে পায়ে হেঁটে একা কী করে ফিরবে যাবে? সেটারও না হয় একটা ব্যবস্থা করতে পারত কিন্তু এই শান। এ তো বাড়ির বাইরেও পা রাখতে দিচ্ছে না। না, একটু সময় নিয়ে ভাবতে হবে ইমাকে। ইমা এমন ভাবে বসে রইল যেন সে হার মেনে নিয়েছে। শান দূর থেকে সেটা দেখে মুচকি হেসে বিরবির করল,

” একবার যখন পেয়েছি আর ছাড়ছি না ইমা। কী কারনে আমাকে এতোটা বছর নির্বাসিত জীবন কাটতে হলো এর জবাব আমার চাই। যত খুশি ঘৃণা করো,আঘাত করো;কিন্তু দিনশেষে এই শানের বুকেই তোমাকে আসতে হবে। আমিও দেখব কে জেতে,তোমার ঘৃণা নাকি আমার ভালোবাসা?”

চলবে,,,

এই গল্পটায় বাস্তবতা কম কাল্পনিকতা বেশি। অতি সিরিয়াল আসক্তদের চোখে সিরিয়াল টাইপ মনে হলে জাস্ট ইগনোর ইট। আমি কখনোই বলিনা আমি আনকমন লিখি। বলি,যেন কারো গল্পের থিমের সাথে না মিলে যায় তেমন লেখার চেষ্টা করি। সুতরাং গল্প কমন হয়ে গেল, এই টাইপ কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকবেন। আর হ্যাঁ শান ইমা মানেই ক্যাটফাইট। ভালো লাগলে ওকে নয়তো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here