তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব :-১(২য় খণ্ড শুরু)

0
2567

তুমি অতঃপর তুমিই (২য় খণ্ড শুরু)
Writer Taniya Sheikh

১৯.

“আমি সর্বস্ব বিলিয়ে তোমাকে চেয়েছিলাম,শুধুই তোমাকে। না তোমাকে পেলাম আর না তোমার ভালোবাসা। সব হারিয়েছি তোমার সাথে। স্বর্বস্বান্ত আজ আমি। না তুমি নেই, না অন্য কিছু। আজ বুঝেছি। হ্যাঁ, বুঝেছি। হৃদয়হীনা তুমি। তোমার হৃদয় নেই বলেই কী আমার হৃদয়টাও এভাবে দুমড়ে মুচড়ে টেনে ছিঁড়ে ক্ষত বিক্ষত করবে? হা! দূর্ভাগ্য আমার। তবুও বলব। হাসি মুখে বলব। ভালো থেকো প্রিয়তমা। অনেক ভালো। কভু সামনে এসো না ফের। ভালোবাসারা তো নিষ্প্রাণ আজ। যদি তোমাকেও নিষ্প্রাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠি? না! এসো না ফের।।”

চারবছর পর একই রকম ঝড় উঠেছে বহুবার। এই যে আজও তো প্রবল ঝড়ে অশান্ত প্রকৃতি,অশান্ত মন। শান স্থির চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি এনে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাতাস। ওদের প্রতি শানের তবুও কোনো অনুরাগ,অনুযোগ নেই৷ এই অশান্ত প্রকৃতির সাথেই তো ওর নিবিড় মিতালি। আজ চারবছর, তিনমাস, আঠারো দিন গত হলো ইমা নেই তার জীবনে। সময়ের সাথে সাথে নাকি মানুষ সব ভুলে যায়,মানিয়ে নেয়। কই শান তো পারছে না৷ কিছুতেই সে পারছে না৷ বরঞ্চ ইমা নামক মানবী অশরীরী হয়ে প্রতি মুহূর্ত তাকে অনুসরণ করে। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা তাকে দেখতে পায় শান। শুধু ছুঁতে গেলেই হারায়। বুকে অসহনীয় এক ব্যথা সর্বক্ষণ পীড়িত করে। একাকিত্বের যন্ত্রণা নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীর রিক্ত হৃদয়ে ক্রমশ ঘুমের অতলে ডোবে। সেখানেও ইমার বিচরণ। অতীতের কিছু মধুর স্মৃতিচারণ।

কিছুদিন ধরেই দেশের সংবাদ মাধ্যমে একটা বিষয় নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ দেশের মানুষ সহজে চিন্তিত হলেও ঘাবড়ে যায় না। ইমার মনে হচ্ছে এবার এর ব্যতিক্রম ঘটবে। সুদূর চীন দেশে এক ভাইরাস ছড়িয়েছে। যার ধাক্কা পুরো পৃথিবীতে লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মৃতের এবং আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আক্রান্ত দেশগুলোতে। গত কয়েকদিন ধরে ফ্যাক্টরিতে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সবাই বলছে, এই ভাইরাস বাংলাদেশে ছড়ালে এ দেশের মানুষ অনাহারে,বিনা চিকিৎসায় মরবে। উন্নত দেশগুলোর মত আটকে থেকে খাদ্যসংস্থান সম্ভব নয়। এ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের কী হবে? তারা তো দিন আনে দিন খায়। গৃহবন্দী হয়ে থাকলে খাদ্য পাবে কোথা থেকে? ওদের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথাও স্মরণ হয় ইমার। পুরো দেশে কারফিউ জারি করলে তার অবস্থা তো শোচনীয় হবে। এই সামান্য বেতনের চাকরীটাও যদি না থাকে তবে না খেয়ে মরতে হবে তাকে। ইমার ভেতরে অস্থিরতা বাড়ে। এই অস্থিরতা চরমরূপ ধারণ করে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ঘোষণায়। ফ্যাক্টরিতে তার মতো বাকি লেবাররাও চিন্তিত। ফ্যাক্টরি এমনিতেও বন্ধ হওয়ার পথে ছিল। এসব কারনে মালিক যেন একেবারে মুষড়ে পড়লেন৷ ভেতরে ভেতরে কানাঘুষা চলছে অতি শীঘ্রই ফ্যাক্টরি বেঁচা হবে৷ সেদিন ফ্যাক্টরির কাজ শেষে ফেরার পথে রাহেলার সাথে কথা হলো। রাহেলা ওর সহকর্মী। গত তিনবছর ওরা একসাথেই এই বুটিকের ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে এবং রুম শেয়ার করে থাকছিল। মাস দুই হয়েছে রাহেলা আরেক সহকর্মী ইকবালকে বিয়ে করে আলাদা বাসায় উঠেছে। ইমার তাতে অসুবিধায় হয়েছে বলা যায়। এখন একাই পুরো বাসা ভাড়ার খরচ তাকে বহন করতে হচ্ছে। মাসের শেষে আগের মতো টাকা জমানো হয়না৷ তার উপর আসন্ন এই করোনা ভাইরাসের থাবা! রাহেলা ইমাকে ওর সাথে নতুন কাজে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিল। কাজটা হলো মানুষের বাসায় পার্মানেন্ট কাজের লোক হয়ে থাকা। এই যেমন,মালি, ঝাড়ুদার। এদের জন্য ধনীদের বাড়ির পেছনে ছোটো ছোটো রুমও করা আছে। রাহেলার কথা, টাকা না হোক দু’বেলা খেয়ে পড়ে তো বাঁচা যাবে এর মধ্যে। আর যদি ভাইরাস তেমনভাবে না ছড়ায় তবে আবার এই জীবনে ফিরে আসবে ওরা। বুদ্ধিটা খারাপ না৷ ইমার মনে ধরে রাহেলার বুদ্ধি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কর্মস্থল ঢাকায়। অনাহারে মরে যাবে তবুও ঢাকা যাবে না ইমা৷ রাহেলা ইমার অতীত কিছুটা হলেও জানে। এই অনাথা মেয়েটার প্রতি ওর দরদও খুব৷ একসাথে এতটা দিন থেকেছে, খেয়েছে একটা মায়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে। পরদিন স্বামীর সাথে কথাবার্তা বলে ইমার জন্য ঢাকার বাইরে আশুলিয়ায় কাজ ঠিক করে। তবে সেখানে কিছু শর্ত থাকবে। সেটা কী, রাহেলা বা যে ব্যক্তি কাজ যুগিয়ে দিচ্ছে সেও জানে না৷ ইমা একবার ভেবেছিল নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে যাবে না৷ কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে দেখে রাজি না হয়ে পারল না সে। অবশেষে তিনজন দ্রুত ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে, বাড়িওয়ালার ভাড়া চুকিয়ে রওনা হলো ঢাকা এবং আশুলিয়ার উদ্দেশ্যে। এই চেনা স্থান ছেড়ে যেতে কষ্ট হলো খুব ইমার৷ ওর মা মরেছে এই শহরেই। মায়ের কবরটাও এখানে। শেষবারের মতো মায়ের কবরটা দেখতে গিয়েছিল ইমা। কবরস্থানের অদূরে দাঁড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরিয়ে দোয়া করে মায়ের জন্যে। ইমা এবং রাহেলাদের গাড়ি আলাদা হলো। ইমার ভেতরকার শূন্যতা জানান দেয় সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত তার কেউ নেই। আশুলিয়াগামী বাসের জানালার পাশের সিটে বসেছে ও। শোঁ শোঁ করে জনপদ,প্রান্তর, গঞ্জ আড়াল হচ্ছে। চেয়ে চেয়ে শুধু সেই সামান্য কিছুক্ষণ স্থির স্থানগুলো দেখছে ইমা। দুপুর হয়ে এলো। অভুক্ত পেটটা বিদ্রোহ শুরু করেছে। ইমার সাথে বিদ্রোহ করে তারা কখনোই পেরে ওঠেনা৷ বিশেষ করে গত চার বছরে। ইমা চুপচাপ বসে আছে। বাস কয়েকস্থানে থামল। আশুলিয়া কি’না জিজ্ঞেস করতেই হেল্পার বলল,

” আপা, চিন্তা কইরেন না। আপনার সাথে যারা ছিল তারা কইছে আশুলিয়া আইলে আপনেরে যেন নামাই দেই।”

ইমা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বসল। কয়েক রাতের অপরিণত ঘুম কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতা ভেঙে নেমে আসে। বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনা বাইরের রৌদ্র তাপের কারনে। তাছাড়া পাশ থেকে মানুষের ঘামের উৎকঠ গন্ধ নাকে এসে লাগতেই পেট গুলিয়ে যাচ্ছে। বমি বমি ভাব আসছে ইমার৷ হিজাবের উপরে হালকা হাত চেপে বসে রইল। এভাবে আরও ঘণ্টাখানেক সময় অতিবাহিত হতেই হেল্পার আশুলিয়া,আশুলিয়া বলে গলা ছাড়ে। বাসের গতি তখনো চলন্ত। ইমা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায়। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে পায়ের কাছের বড়ো দু’টো ব্যাগ আর জিনিসপত্রের বস্তাটা টানাটানি করে এগিয়ে সিটের বাইরে রাখে। বাস থামতেই একে একে সব নেমে যায়। এতোগুলো ব্যাগ দেখে হেল্পার এগিয়ে এসে বস্তা আর ব্যাগ নামাতে সাহায্য করে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আলেয়া খালার জন্য। এই আলেয়া খালায় কাজ যুগিয়ে দিচ্ছে ওদের। কড়া রোদ মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে ইমা। ক্ষুধার্ত পেটটায় ইতোমধ্যে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। সব উপেক্ষা করে পাশের বড়ো গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। চার্জ না থাকায় মোবাইলটাও বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর নির্ধারিত স্থানে এসে চোখ বুলিয়ে নেয় আলেয়া বেগম। এতো মানুষের মধ্যে অদূরে দাঁড়ান খয়েরী রঙের চেক বোরকা পরা মেয়েটির তার চোখ এড়ায় না৷ ছবিতেও একই বোরকা পরা ছিল বলেই সহজে চিনে যান আলেয়া বেগম। এতোক্ষণের কুঞ্চিত ভ্রু এবার স্বাভাবিক হয়। সামনের দোকান থেকে একটা খিলিপান কিনে মুখে পুরে নেন। তারপর হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যান মেয়েটির দিকে। ক্লান্ত,অবসন্ন ইমা সম্পূর্ন শরীরের ভর মেহগনি গাছটার সাথে দিয়ে আবছা চোখে চেয়ে আছে। চক্ষু জ্বলছে কড়কড়ে রোদে। আলেয়া পাশ থেকে এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলে,

” ইমা?”

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা ইমা সচকিত হয়ে তাকায়। আলেয়া বেগমের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে সহসা সকল ক্লান্তি দূরীভূত হলো। নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বলল,

” জি, আপনি আলেয়া খালা? ”

” হ, তোমার শরীর কী খারাপ? মনে হইতাছে অসুস্থ তুমি।”

” না, খালা। আসলে এভাবে জার্নি করার অভ্যাস নেই তো তাই কিছুটা ক্লান্ত লাগছে।”

” তাই কও। আমি তো ডরাই গেছিলাম গা। বুঝোই তো দিনকাল ভালা যাইতাছে না। কিছু মনে করছনি আবার?”

” না।” ইমা মাথা নেড়ে বলে। আলেয়া আগের মতো হেসে হেসে নিচ থেকে বস্তা আর ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়। যেতে যেতে বলে,

” রাহেলা আমার দূর সম্পর্কের বোনঝি লাগে। সম্পর্ক দূরের হইলেও আমরা ঘনিষ্ঠ। ঐতে তোমার কথা কইল,তুমি নাকি ঢাকা যাইবার চাও না। সত্য কথা বলতে আমি তোমার কাম জুটায় দিতাম না৷ কেমনে দিতাম কও? কী আইতাছে জানোয় তো। শুনছি সাংঘাতিক ভাইরাস নাকি সেইটা। তা হোক। আমরা গরিব, আমাগো কোনো ভাইরাস ভুইরাসে ধরত না৷ ওসব বড়োলোকি ভাইরাস বড়োলোক গো অয়। আর তোমরা তাগো কাছেই থাকতে যাইতাছ। এইডা কোনো বুদ্ধির কথা অয়ল? আমি তো সাফ মানা করছিলাম কিন্তু রাহেলা ছেরিডাই শুনল না। না শুনলে কোনো জোর আছে? নাই। তুমি ভাইব না তোমার উপকার করতাছি। উপকার আমি আলেয়া নিজের ছাড়া কারো করি না। এই যে যেহানে তোমারে লইয়া যাইতাছি হেই বাড়ির লোক কামের বেডি লাগব,কামের বেডি লাগব কইয়া কান খাইয়া ফালাইছে আমার৷ ছেরি নিজে হইল ডিরাইভারের বউ। আর কথাবাত্তা শুনলে মনে অয় হেইতেই বাড়ির মালকিন। আমার তো রাগ লাগে কিন্তু গরিবের রাগের মূল্য কয় আনা? সিকি আনাও না৷ এই যে তোমারে কাম ঠিক কইরা দিমু বিনিময়ে হাজার খানেক টাকা দিব কইছে।” টাকার কথা মনে পড়তেই আলেয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়।পেছনে তাকিয়ে ইমার দিকে চেয়ে বলে,

” ভালা কতা, আমার পাওনা কহন দিবা তুমি? অহন না মাস শেষের টাকা পাইলে। আমার মনে অয় অহন দিলে ভালা হইব।”

” এখনি দিচ্ছি।” ইমা হ্যান্ডব্যাগের চেন খুলতেই আলেয়ার চোখ চকচক করে ওঠে। তারপর এদিক ওদিকে তাকিয়ে মানুষজন দেখে মুখ কালো করে বলে,

” অহন থাক৷ ঐ বাড়ি পৌছায় গেলে দিয়ো।”

আবার দুজনে হাঁটতে থাকে। এভাবে কিছুদূর গিয়ে ওরা অটোতে ওঠে। অটো এসে পৌঁছায় বাজার মতো আরেকটি স্থানে। সেখান থেকে ওরা ভ্যানে চড়ে বসে। পিচ রাস্তা শেষ হয়ে ইট বিছানো রাস্তা ধরে ভ্যান এগোয়। দু’পাশে সবুজ ক্ষেত,পতিত জমি, মাঝে মাঝে ইটের দেয়াল দেওয়া কয়েকটি স্থান। ভ্যান যত এগোচ্ছে ততই ইমা বুঝতে পারছে তারা লোকলয় থেকে দূরের কোনো জায়গার দিকে যাচ্ছে। আগের ইমা হলে প্রশ্ন করত। এই ইমা নির্বিকার। ঘণ্টার দুই পরে ওরা এসে হাজির হলো একটা বড়ো দ্বিতল পুরোনো খামারবাড়ির বাড়ির গেটের সামনে। এই বাড়িটা ছাড়া আশেপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই৷ ইমার বুক দুরুদুরু করতে লাগল আশেপাশের তাকিয়ে। মাঝ বরাবর সরু রাস্তা চলে গেছে এঁকেবেকে। দুপাশে যতদূর চোখ যায় আবাদি এবং কিছুটা অনাবি জমি। লোকালয়ের কোলাহল,কৃত্রিমতা ছাড়া সবই আছে। ইদানীং কালে মানুষের মাঝে এক টুকরো প্রকৃতি খুঁজি আমরা। এখানে যেন তার ভিন্ন চিত্র। প্রকৃতির মাঝে মানুষ খুঁজে ফিরতে হবে। আলেয়া খালা বাড়ির দারোয়ানকে কী যেন বললেন দূরে দাঁড়িয়ে। ইমা এতোদূরে দাঁড়িয়ে তাদের কানাকানি শুনতে পেল না। মনটা কেমন আনচান আনচান করছে এমন অদ্ভুত রকমের জায়গায় এসে। যদিও অদ্ভুতের সাথে সৌন্দর্য কথাটা না বললেই নয়। সবুজের এই সমারোহে তাকিয়ে ভাবতে বাধ্য হয় পৃথিবী এতোসুন্দর না জানি স্বর্গ কত সুন্দর! অদেখা স্থানটার প্রতি বুঝি এভাবেই টানটা বাড়ে মানুষের। প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে এর বেশি প্রকৃতি প্রেম ইমার আর হলো না। তৃষ্ণায় জিহ্বা অসাড় হয়ে আসে। গেটের একটু দূরে বসার জন্য বেঞ্চি বানানো। ইমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বসবে বলে সামনে এগোতেই আলেয়া হাত টেনে ধরে।

” যাও কই?”

ইমা নিস্প্রভ চাহনীতে আলেয়ার দিকে চেয়ে বলল,

” না, কোথাও না।” মিথ্যা বলল ইমা। নিজের দূর্বলতা ফের আর প্রকাশ করতে চায় না সে।

” চলো, ভেতরে যাই।”

” জি।”

গেটের ভেতর প্রবেশ করতেই চক্ষু চড়কগাছ। বাইরের নির্জনতা একেবারেই ভেতরটা ছুঁতে পারেনি। আলিশান বাড়ির অদূরের ডানদিকে হাস,মুরগির ফার্ম, গোরুর গোয়াল,ঘোড়ার আস্তবল। সেখান থেকে ভেসে আসছে সেসবের ডাক। বাড়িটিকে ঘিরে কৌতূহল যেন বেড়েই যাচ্ছে। ঠিক যেন রূপকথার কোনো খামার বাড়ি। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি করে সাজানো গুছানো সব। এ বাড়ির পাশের নানান বাহারী ফুলের সুবাস দখিনা বাতাস সঙ্গে করে উড়ছে। ক্ষুধার্ত ইমার অর্ধপেট তাতেই যেন ভরে গেল সেই মুহূর্তের জন্য। ইমার ঘোর কাটে অচেনা মেয়েলী গলার স্বরে।

” খালা, এতোদিন বাদে কী মনে করে?”

ইমার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রমণীটি এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। ভেজা হাত দু’টো ওড়নার আঁচলে মুছতে মুছতে ইমার ভারী ভারী ব্যাগ আর বস্তার দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

” এসব কী?”

আলেয়া বিগলিত স্বরে বলে ওঠে,

” ঐ দেহো, তুমিই না কইছিলা তোমাগো সাবের জন্য কামের বেডি লাগব।তাইতো নিয়া আইলাম।”

রমণী এবার বেশ চমকিত চোখে তাকাল ইমার দিকে। আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে আলেয়ার বাহু টেনে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। ইমা ওদের ফিসফিসের মধ্যে কিছু ভাঙা শব্দ শুনতে পেল। এসব শব্দ এক করলে দাঁড়ায়, ইমা যুবতী, তার সাহেব যুবতী কাজের লোক চায় না। আলেয়া ইমার অনাথা হওয়ার ঘটনার সাথে নতুন করে মিথ্যা কতগুলো ঘটনার সংমিশ্রণ করে রমণীটিকে দয়াপরবশ হতে বাধ্য করল। এই রমণীর নাম আসমা বলে সম্বোধন করে আলেয়া। আসমার মনে ইমার জন্য দয়া হলেও সে নিশ্চিয়তা দিতে পারল না। সাহেবকে বুঝাতে সমর্থ হলেই ইমার চাকরী ওকে। নয়তো ইমাকে ফিরে যেতে হবে। এই জনপদ বিচ্ছিন্ন বাড়িতে থাকতেও মন সায় দিচ্ছেনা ইমার, কিন্তু এই কাজ ছেড়ে যাওয়া মানেই যে পথে নামা। মনটা উদ্বিগ্ন ভীষণ ইমার। আসমা নামক রমণীটি আলেয়াকে আগামীকাল আসতে বলে বিদায় করে। আলেয়া যেতে যেতে ইমাকে অভয় দেয় সাথে কানেকানে বলে যায় তার পাওনা সে আগামীকালই এসে নেবে। যেই ভ্যানে এসেছিল তাতে করেই আলেয়া চলে গেল। সরাসরি এই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি কারো নেই। দারোয়ান ডেকে ইমার মালপত্র পাশের ছাউনির নিচে রাখা হয়। আসমা ইমাকে সাথে করে নিয়ে চলল তার নীড়ে। যেতে যেতে ইমা আরো অনেক কিছু দেখল। এই বাড়ির পেছন দিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এই প্রাচীরের পাশ দিয়ে টাইলসের রাস্তা ধরে ওরা হাঁটছে। ঐতো আরেকটা কটেজ মতো ছোট্ট বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ইমা খেয়াল করেছে এই বাড়িগুলো এদেশীয় স্টাইলে বানানো না। কিছুটা পাশ্চাত্য ধাঁচের। সামনের কটেজটিও ঠিক তেমনই। যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে শিশুর কান্নার শব্দ। পাশে হাঁটতে থাকা আসমার সেটা কর্ণগোচর হতেই ছুটে গেল ভেতরে। ইমা কটেজের সামনের উঠোনে দাঁড়ানো। পায়ের নিচে মাটি নয়, এখানেই টাইলস। ইমার ক্রমেই মনে হচ্ছে এই সম্পত্তির মালিক কোনো বিদেশী। স্বদেশী হলেও সে উচ্চবিলাসী,দুর্নীতিবাজ। একদিকে মানুষ না খেয়ে মরে আর অন্যদিকে কেউ কেউ স্বপ্নের অট্টালিকা গড়ে। ইমার দীর্ঘশ্বাস আটকে আসে সামনে দাঁড়ানো আসমার কোলের বাচ্চাটি দেখে। গুমরে মরা মাতৃত্ব ফের জেগে ওঠে। আজ ওরও এমন একটা সন্তান থাকার কথা ছিল। একটা ছোট্ট প্রিন্স অথবা প্রিন্সেস। বর্তমান ভুলে কলের পুতুলের মতো এগিয়ে গেল ওদের দিকে। দু’হাত মেলে ধরতেই বাচ্চাটি কিছুক্ষণ অশ্রুভেজা চোখে চেয়ে নুয়ে এলো ওর দিকে। বাচ্চার মা বাধা দিল না এই দুই অপরিচিতের মায়ার আলিঙ্গনে। ইমা যখন আপন সন্তান মনে করে বাচ্চাটিকে আদর করছিল তখনই আসমা বলে ওঠে,

” আলেয়া খালা বলল আপনি অবিবাহিতা কিন্তু আমার মনে হচ্ছে,, ” আসমার কথা থেমে যায় ইমার অশ্রুছলছল দু’চোখের চাহনীতে। ইমা আরেকবার বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে আসমার কোলে তুলে দেয়। হঠাৎ যেন প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করে সে। এলোমেলো পায়ে সামনের চেয়াটায় বসে বলে,

” আমাকে একটু পানি দেবেন?”

আসমা কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল ইমার দিকে চেয়ে। সে নিশ্চিত এই মেয়ে অবিবাহিতা নয় আর যদিওবা হয় তবে সে সতী নয়। এমন একটা মেয়েকে কাজে রাখা কী ঠিক হবে? অনিচ্ছা মনে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। পানি পান করার সময়ই ইমার মুখটা দেখতে পায় সে। চেহারাটা চেনা চেনা লাগছে। কোথাও কী দেখেছে এই মেয়েকে? মেয়েটির শুকনো,মলিন মুখটা বলছে অনেকক্ষণ যাবত সে অভুক্ত। কোলের মেয়েটা কান্না জুড়ে দেওয়া এসব উপেক্ষা করে ভেতরে চলে গেল আসমা। মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে গেল ছেলের রুমে। মোবাইলে গেমস খেলতে খেলতে ছেলেটাও ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলের গায়ে চাদর টেনে বেরিয়ে এসে দেখল অচেনা মেয়েটা চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে দু’হাত পেটের উপর রেখে। মৃদু গলা ঝেড়ে আসমা বলল,

” নাম কী আপনার?”

আসমার গলার স্বরে চকিতে সোজা হয়ে বসল ইমা। লজ্জিত চোখে বলল,

” ইমা।”

” ইমা!” চমকিত হয়ে ইমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল আসমা। ক্ষুধার্ত ইমার মাথা কাজ করছে না। ঝাপসা চোখে সে তাকিয়ে আছে নিরুপায় হয়ে। সামনের মেয়েলোকটির বিস্মিত গলার স্বরে তার মধ্যে কোনো হালচাল ঘটল না। দূর্বল শরীর বার বার শক্ত করার চেষ্টা করতে ব্যস্ত ইমা। সে খেয়ালই করেনি বিস্মিত মুখে মহিলার ছুটে রুমে চলে যাওয়া। বিরবির করে নিজের বোকামিকে দুষছে। এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে খেলেও তো একটু বল পেত। আশেপাশে এখন দোকানের বালাইও নেই। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাৎ মাথা ঘুরে পড়বে। সামনের টেবিলে ফল সাজান। মন বলছে, একটা খাই, একটা,না হয় এক কামড়। ইমা মনের কথা শোনা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। দু’চোখ বন্ধ করে আগের মতো বসে রইল।

স্ত্রীর মুখে ইমা ভাবীর নাম শুনে ছুটে এসেছে মোবারক। ঘণ্টার রাস্তা সে কয়েক মিনিটে শেষ করেছে। তার জন্য বরাদ্দ শানের এই পৈতৃক কটেজের সম্মুখে থমকে দাঁড়ায় সে। ঐতো চেয়ারে বসা ইমা ভাবী। মোবারকের চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে পুরোনো স্মৃতি। ইমা ভাবীর সেই দস্যিপনা, খুটশুটি আর শান স্যারের রগচটা মেজাজ। কত বদলে গেছেন ইমা ভাবী। এখন আর সেই পুরুষালি পোষাক পরনে নেই। তার বদলে পুরোপুরি মেয়েলী পোষাক। হঠাৎ কী মনে করে মোবারক আবার গেটের কাছে ফিরে আসে। স্ত্রীকে কল করে ডেকে আনে সেখানে। এতোক্ষণ ইমার সাথে থাকা রমণীটিই মোবারকের স্ত্রী আসমা আক্তার। শান আগামীকাল ফিরবে। ততক্ষণে কিভাবে ইমাকে এ বাড়ি রাখতে হবে মোবারক স্ত্রীকে সব বুঝিয়ে বলে। সাথে এও বলে দেয় এসবের কিছুই যেন ঘুর্ণাক্ষরেও টের না পায় ইমা। মোবারকের স্ত্রী আসমা স্বামীর সব কথা মেনে আবার ফিরে আসে। ইমাকে বলে, সে সাহেবের সাথে কথা বলেছে। তার চাকরি এখানে কনফার্ম। ইমাকে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসতে বললে ইমা আগে খেতে চায়। আসমার মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে ইমার করুন দশা দেখে। কোনোমতে হাত ধুয়ে চাট্টিখানি খেয়ে পেটটা শান্ত করে ইমা। তারপর আসমা তাকে সাথে করে নিয়ে আসে তার কর্মস্থানে। যা হওয়ার ছিল তার সংসার কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ হয়ে গেল কাজের স্থান। গৃহকর্ত্রীর বদলে হয়ে গেছে গৃহকর্মী। সদর দরজা খুলতেই এই বাড়ির কারুকার্য শৈলীর সৌন্দর্য্য ইমার চোখে পড়ে। বিমুগ্ধ হয়ে যায় সে। লিভিং রুম পেরিয়ে ওরা চলে আসে একটা রুমের সামনে। রুমটাতে ইমাকে থাকতে দেওয়া হয়। আসমা যাওয়ার আগে বলে যায়, সাহেব আজ আসবে না। তাই ইমা যেন আজকের দিনটা বিশ্রাম করে নেয়। কাল সাহেব এসে নিজেই সব কাজ বুঝিয়ে দেবেন। আসমার কথা মতো সদর দরজা বন্ধ করে ইমা নিচতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখে। ভেতরের আসবাবপত্রেও বাঙালিয়ানার ছাপ নেই বললেই চলে। সব আসবাবপত্রই বেশ পুরানো হলেও তাতে নতুন করে বার্নিশ করা হয়েছে। মনে হচ্ছে এই ঘরের জন্য পুরোনোই ঠিক নতুন ততটা মানানসই হতো না। লিভিং রুমের এক পাশে কিচেন, অপরপাশে দু’টো রুম, যার একটাতে জায়গা হয়েছে ইমার। লিভিং রুম থেকে সামনের সুইমিংপুল দেখা যাচ্ছে। ইমা সেদিকে গেল। সুইমিংপুলের চারপাশে উঁচুু প্রাচীরে ঘেরা। কিছুক্ষণ সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে রুমে ফিরে আসে। বোরকা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়া যায়। আজ বহুদিন পরে সে শানকে স্বপ্নে দেখছে। ঘামছে সমস্ত শরীর। ঘৃণায় ঘুমন্ত মুখটা বিকৃত হতে লাগল ইমার। বিরবির করে বলল,

” নিষ্ঠুর, বর্বর,বিশ্বাসঘাতক। আমি তোকে ঘৃণা করি,ঘৃণা করি।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here