তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব :-৩

0
2213

তুমি অতঃপর তুমিই
Writer -Taniya Sheikh

২১.

অনেক ভেবে ভেবেও এখান থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজে পেল না ইমা। বাধ্য হয়ে শানের সাথে এই বাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নিল। স্থায়ী নয় অস্থায়ী ভাবে। সুযোগ পেলে ঠিকই চলে যাবে এই ঘৃণিত মানুষটার সান্নিধ্য ছেড়ে। ততদিনে সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে হবে ইমাকে। নিজের আবেগ,অনুভূতির ছিটেফোটাও প্রকাশ করা যাবে না এই শানের সামনে। দু’হাতে কাউচের গদি খামচে ধরে শক্ত হয়ে বসে। কিছুক্ষণ পর ফার্স্ট এইড বক্স হাতে শান নিচে এলো। পাশে বসতেই ইমা সরে বসে। আড়চোখে সেটা খেয়াল করে মৃদু হাসে শান। ঘুরে বসে বলে,

” নাও ব্যান্ডেজ করো।”

অপ্রস্তুত হয়ে তাকায় ইমা। ভ্রুকুটি করে চেয়ে বলে,

” কী?”

” বাংলায় তো বললাম। আজকাল বাংলা বুঝতেও খুব সমস্যা হয় নাকি?”

” বলেছি না আমার সাথে ফাজলামি করবি না।” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে ইমা। শান চট করে ঝুঁকে আসতেই হেলে পড়ে খানিকটা।

” স্বামীর সাথে তুই তোকারি করা বেয়াদবী। তওবা করো।”

ইমা মুখ বাঁকিয়ে সরে বসতেই শান হাত ধরে কাছাকাছি বসায়। পুনরায় বলে,

” ঘা যখন তুমি দিয়েছ, মলমও তুমিই দেবে।”

” কোনোদিন না।”

” আচ্ছা!” শান মোবাইল হাতে তুলতেই ইমা কটমট করে তাকিয়ে শানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে,

” করছি।”

আঘাত করার সময় মাথা ঠিক ছিল না ইমার। ক্রোধান্বিত সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল সে’সময়। ক্রোধ বশতঃ নিষ্ঠুর আচরনের কারনে অনুতাপ হচ্ছে ইমার। আর সেই অনুতাপ বড়োই যন্ত্রণার। ভেতরটা অসহনীয় পীড়ার ভারে ভারী হচ্ছে সামনে বসা মানুষটার বুকের দিকে তাকিয়ে। জমাট বেঁধে আছে শানের বুকের রক্ত। সেটা পরিষ্কার করে ক্ষত স্থানে মেডিসিন লাগাতে লাগাতে অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে নোনাপানি পড়ল। নীরবে শুধু দেখছে শান। বুকের ক্ষতে এতোক্ষণ ততটা ব্যথা অনুভব করেনি যতটা এই মুহূর্তে ইমার মুখটা দেখে হচ্ছে। শানের ইমা বদলে গেছে। গত চার বছর ইমাকে বদলে দিয়েছে। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল চার বছর পূর্বে? যার কারনে ভালোবাসা আজ ঘৃণিত! শান স্থির, শীতল দৃষ্টি মেলে ইমাকে দেখছে। মলিনা চেহারার সুশ্রী মেয়েটি তারই স্ত্রী। তার সম্পদ। সেই প্রিয়তমা স্ত্রীকে সে নিজের অগোচরেই আঘাত করেছে। কেড়ে নিয়েছে ঐ গোলাপ রাঙা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি। বিষন্নতার নৌকায় দুলে দুলে মাঝ সমুদ্রে ভাসছে শান। ইমাকে শান চেনে, এতো সহজে সবটা ওর কাছ থেকে জানতে পারবে না। তার জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। ভালোবাসলে ধৈর্য্য রাখতে হয়। ইমা আড়চোখে তাকানোর পূর্বেই দু’চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয় শান। সেই সুযোগে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখছে ইমা। এতোদিনের তৃষিত চক্ষু একটু একটু জলে ভরে ওঠে। শূন্যতা পূর্ণতা পায় কেবল চাহনিতেই। তবুও এই পূর্ণতার মাঝে সেই সুখ নেই, যে সুখ চার বছর আগে ছিল। এই এতো কাছে থেকেও সহস্র, অযুত মাইলের দূরত্বের অবসান ঘটেনি। একে কি পাওয়া বলে? শানের অর্ধনির্মীলিত নয়ন দেখে সামনে বসা রমণীর চোখের জল। ভরা প্লাবনের ধারার মতো অবিরাম ঝরছে। সমস্ত মলিনা মুখশ্রী জুড়ে কী এক পীড়িত ভাবের প্রকাশ!

“কিসের কষ্ট তব বক্ষপিঞ্জরে? কিসের লাগি এই বক্ষআঘাত? আমি তো কারণ খুঁজে খুঁজে হয়রান আজি। তোমার বদলে যাওয়ায় হতবুদ্ধি হয়ে করি গড়াগড়ি।”

শান যাই করুক কিন্তু তার জন্য এমন করে আঘাত কেন করতে গেল ইমা? বয়সের সাথে সাথে ধৈর্য্য, প্রত্যুৎপন্নমতিতা মোটেও যেন বাড়েনি। তারই ফল বুঝি আজকের এই অঘটন। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়াতেই আচমকা হাত টেনে ধরে শান৷ কিছুটা বেসামাল হয়ে ওর বুকের উপরে আছরে পড়ে ইমা। এক হাতের ভর অসতর্কে চেপে ধরে সদ্য ব্যান্ডেজ করা স্থানটার উপর। যা হবার তাই হলো- ব্যান্ডেজ খুলে ফের রক্তক্ষরণ। মুভির মতো লা,,লা,, ব্যাকগ্রাউন্ড বাজল না মোটেও। বরং একরাশ বিরক্তি আর রাগে চোখ দু’টো লাল হয়ে ওঠে ইমার। মুভি,সিনেমা তো জীবনেরই প্রতিরূপ। কাছাকাছি এসে একেবারেই যে অনুভূতিহীন ছিল তা নয়। দু’জনের বুকের ভেতরটা আন্দোলিত হয়েছে। কিন্তু ঐ যে ইমার হাতে লাগা রক্তটা- ওতেই যেন সব অনুভূতি ভেস্তে গেল। চটজলদি নিজেকে তুলে উঠে দাঁড়াতে চাইল ইমা। বাধা পেল আবার। দু’হাতে সজোরে চেপে ধরেছে ইমার বাহুদ্বয় শান। নির্বাক,স্থির সে। যেন কারো হুকুম তামিল করছে এভাবে ধরে রেখে৷ এই কেউ টা হলো হৃদয়! মন বলে, না যেতে দেবো তোমায়। এই তো পেলাম এক্ষণে। এক্ষুণি কেন যেতে চাও দূরে। থাকো না প্রিয়া এমন করে আরেকটু ক্ষণ, কয়েকটি প্রহর।

” ছাড়ুন বলছি।”

নিশ্চুপ, মৃদু হাসি দু-ঠোটের কোনে শানের। ওদিকে ইমা নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রক্ত রঞ্জিত হাতটার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের সকল চেষ্টায় ক্ষান্ত দিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,

” আমাকে ছাড়ুন,প্লিজ।”

শান এবারও ছাড়ল না, জবাবও দিল না। ইমা কান্না থামিয়ে নত মুখে বলল,

” প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন, আপনার ব্লিডিং হচ্ছে আবার।”

ইমাকে দু’হাতে বুকের মাঝে নিয়ে সোজা হয়ে বসল শান। অবনত মুখে তখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে ইমা। ওর লজ্জা হচ্ছে। নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। নিজ হাতে বক্ষছেদন অতঃপর আহা! আহা নাটক। শান ডান হাতে জড়িয়ে ধরে, বা’হাতে ইমার মুখের সম্মুখের অগোছালো চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

” খুব কষ্ট হচ্ছে? কষ্ট পেয়ো না। তোমার আমার বিয়েতে তো মেহেদী পরোনি। এটা না হয় তাই হলো।” আলতো করে ইমার গালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একদন্ড সেখানে না থেকে চলে যায় উপরে। অপরাধীর মতো মুখ করে স্তব্ধ ইমা বসে রইল। এই রক্ত ওর হাতের মেহেদী! এর চেয়ে এ হাত কেটে যেত।হাতটা ওড়না দিয়ে মোছার চেষ্টায় অপর হাতটাতেও রক্ত লাগিয়ে ফেলল। শব্দ করে কেঁদে ওঠে নিচে উপুড় হয়ে ইমা।

মোবারক গ্যারেজে গাড়ি দেখে শানের সাথে দেখা করতে এলো। এসে দেখল শান ঘর মুছছে কানে হেডফোন লাগিয়ে৷ মোবারককে দেখেই চিরাচরিত মুচকি হাসি দেয়। হাতের কাজটা সেরে দু’জনে সুইমিংপুলের পাশের চেয়ার দুটোয় বসল। শানের মুখের দিকে আড়চোখে চেয়ে মোবারক বলল,

” স্যার,কিছু হয়েছে কী?”

” তোর কী মনে হয় মোবারক?” সামনে ঝুকে বসে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সুইমিংপুলের নীল জলের চেয়ে রয় শান। মোবারক কথা খুঁজে পায় না। আসার পর কয়েকবার উঁকি ঝুকি মেরে ইমাকে খুঁজেছে সে। কিন্তু দেখা মেলেনি। দু’জনে চুপচাপ কিছুসময় বসে থাকে। নীরবতা ভেঙে একসময় মোবারক তোতলাতে তোতলাতে বলে,

” ভাবি ঠিক আছে তো স্যার?”

” তোর কী ধারণা তাকে আমি কিছু করব?”

” না, আমি সেটা বলতে চাইনি। আসার পর থেকে তাকে দেখছি না তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।” মোবারক থেমে লম্বা শ্বাস নিয়ে গতকাল ইমার এখানে আসার ঘটনা খুলে বলে। শানকে কয়েকবার কল করেও পাওয়া যায়নি বিধায় সে জানাতে পারেনি। বলা শেষ হতেই কিছুটা ভীত দেখা যায় তাকে। শান নির্বিকার বসে আছে। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বিস্মিত হলো মোবারক। সভয়ে বলল,

” স্যার, ভাবির উপর রাগ করে থাকবেন না। আপনি তো জানেন বয়স অপেক্ষা তার মধ্যে ম্যাচুরিটি কম। একটু হট মেজাজি। সেই তুলনায় আপনি বুঝদার বেশি। ছাড় দেন এবারের মতো। ক্ষমা করে দেন স্যার। একজনকে তো একটু ছাড় দিতেই হয়।”

” মোবারক, সংসার, সম্পর্ক একজনের কম্পোমাইজে টেকে না৷ দুজনকেই দু’দিক থেকে অবদান রাখতে হয়। সবসময় আমি ছাড় দেবো, আমিই বুঝব আর সে? তুই বলছিস ওর ম্যাচুরিটি কম। আমি মানলাম, কিন্তু এর মানে এই নয়, বার বার করা ওর আঘাত আমি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেব। ওর অবিশ্বাস, অপবাদ কী করে মানবো? যাচাই -বাছাই ছাড়া অবিশ্বাস করে আঘাতের পর আঘাত করে যাওয়াকে যদি তুই ইম্ম্যাচুরিটির নাম দিস, তবে আমি শান, সেটা কিছুতেই মানবো না৷ ইমা হয় এবার আমাকে বুঝবে নয়ত ভবিষ্যতে খুঁজবে। সেদিন হাতের লাগালে আর পাবেনা আমাকে ও।” চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে শানের। শ্বাস ভারী হয়। ইমার আচরণ তাকে কতটা আঘাত করেছে কেবল সেই জানে। চোখের কোনের পানিটুকু সাবধানে লুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে মোবারকও। সে বলে,

” কী করবেন তাহলে এখন?”

” ভাবিনি। ভাবতে চাইওনা। শুধু দেখে যাব, যখন যেটা জরুরি মনে হবে সেটাই করব।” ওরা পাশাপাশি হেঁটে এগোয়। মোবারক কিছুক্ষণ চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

” আল্লাহ পাক আপনাদের পথটা মসৃণ করে দিন। এই কঠিন সময়টা যেন সহজ হয়ে যায় সেই দোয়া করি।”

শান মৃদু হেসে মোবারকের কাঁধে হাত রাখে। দুজনে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায়। মোবারক বিদায় নেবে ঠিক সেসময় শানের মোবাইল বেঁজে ওঠে। মোবাইলের ওপাশে ইমরোজ। সে ইমা-শানের মধ্যেকার সমস্যা মিটেছে কিনা জানতে চায়। মোবারককে যা বলেছে -তাই ঘুরে ফিরে বলল শান। ইমরোজ বেশ চিন্তিত ওদের নিয়ে। এ সময় এতোদূরে আসতেও পারছে না সে। শানকে বুঝাতে লাগল। যদিও জানে এসবে কাজ হবেনা। শানের মনে যা আছে সে তাই করবে। কথা বলার মাঝে হঠাৎ ইমরোজ মাহিবের নাম উচ্চারণ করে। শান এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই ইমরোজ জানাল -নেশায় বুঁদ মাহিবকে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে। শানের কাছে বিষয়টা কমন। ইমরোজ একদৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে আছে। অবাক হলো মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটি দেখতে একদম সাধারণ পরিবারের ভদ্র, সুশীলা মেয়েদের মতো। গায়ের কাপড়ে তো তাই বলছে। ইমরোজ দ্রুত কথা শেষ করে। তারপর পিছু নেয় মাহিবের গাড়ির। বন্ধুর শত্রু মানে নিজেরও শত্রু। তার উপর এই মেয়েটাকে ফাঁদে ফেলছে কি’না সেটাও জানা জরুরি। বাইক ছুটিয়ে মাহিবের গাড়ি অনুসরণ করে ইমরোজ।

” মাহিব স্যারের কোনো উন্নতি হলো না। আজ তো বড়ো স্যারের মিলাদ ছিল। আজকের দিনেও তিনি নেশা আর মেয়ে নিয়ে আছেন! এমন সন্তানের বাপ হওয়ার চেয়ে নিঃসন্তান থাকা ভালো।” কথাটা বলেই জিহ্বা কাটল মোবারক। সলজ্জে সামনে তাকায়। শান এমনভাবে বসে আছে যেন মোবারকের কথা সে শোনেইনি। শানের এই নির্লিপ্ত ভাবের পেছনের কষ্টটা কেবল মোবারক জানে। মোবারক আর কোনো কথা না বলে বিদায় নিল। আধশোয়া হয়ে নির্নিমেষ চোখে শূন্যে তাকিয়ে আছে শান। একটু একটু করে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার অতীত। ছোট্ট শান, বয়স সবে এক বছর। প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার নাফিস খান ও কুসুম আহমেদের প্রথম সন্তান। নাফিস খান ছিলেন মঈন খানের সৎ ভাই। নাফিস এবং তার মা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চেয়েছিল। সেই মতেই নাফিসের মা নাহার স্মাগলার স্বামীকে ছেড়ে চলে আসেন আশুলিয়া, নাফিসের নানাবাড়ি। নাফিসের নানাজান ভালো লোক ছিলেন৷ জ্বামাতার অবৈধ কাজকে তিনি অপছন্দ করতেন,জ্বামাতাকেও। সুতরাং মেয়ে যখন ছেলের হাত ধরে স্বেচ্ছায় চলে এলো -তিনি খুশিই হলেন। অনেক মামলা-মোকদ্দমা করে মেয়েকে ছাড়িয়ে আনেন। তারপর বিয়ে দেন সুইডেন প্রবাসী এক ছেলের সাথে। নাফিস মায়ের সাথে সুইডেন চলে যায়। এরপর পার হয় বহুবছর। নাহার আগের স্বামীর সাথে কোনোরকমের সম্পর্ক রাখেনা কিংবা ছেলেকেও রাখতে দেয়নি। হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে কল গেল। নাফিসের নানাজান ভীষণ অসুস্থ। শেষ সময়ে মেয়ে,জ্বামাতাকে দেখতে চান। ফিরে এলো ওরা। ততক্ষণে নানাজানের মৃত্যু হয়েছে। নাহার পিতার মৃত্যু শোকে শয্যা নিলেন। ওরা ফিরে যেত কিন্তু হঠাৎ যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সাজানো, গুছানো ওদের জীবনে নেমে এলো আরেক দূর্ঘটনা। নাফিসের সৎ পিতা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলেন। এই শোক কাটাতে সময় লাগল ওদের। মা একেবারে প্যারালাইসিস হয়ে গেল। একমাত্র ছোটো বোনটাকে নিয়ে তাই আর ফেরা হলো না নাফিসের। যুবক নাফিস তখনো জানত না ওদের জীবনে পরপর ঘটে যাওয়া এই দূর্ঘটনা কাকতালীয় ছিলনা। পুরোটাই ছিল তার আসল পিতার নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র। নাফিসের মায়ের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছিলেন তিনি। এরপরের টার্গেট ছিল নাফিসের বোন। নাফিসের ক্ষতি তিনি করতে চাননি। হাজার হোক ঔরসজাত সন্তান তো! ছোটো বোন, অসুস্থ মাকে দেখাশোনার জন্য একজন মেয়েলোকের প্রয়োজন দেখা দিল। দূরসম্পর্কের এক বিধবা ফুপুকে এক কন্যা সহ ঘরে আশ্রয় দিল নাফিস। ধীরে ধীরে এই আনকোরা স্থানে নাফিস মানিয়ে নিতে শিখল। বহু ঘাত-প্রতিঘাত ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে সে। আশ্রিত ফুপুর মেয়েটিকে বিয়ে করে ফের সপরিবারে চলে আসে সুইডেন। এদিকে নাফিসের বাবা চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেওয়ার পূর্বেই আততায়ী হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। নাফিস এসবের কিছুই জানত না। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল আসল পিতার কথা। বিয়ের বছরখানেক বাদে নাফিস পুনরায় দেশে ফেরে। স্ত্রীর নামে জমি খরিদ করে জনপদ থেকে দূরের এই স্থানে। দিনরাত এক করে তৈরি করে খামার বাড়ির আদলে অনিন্দ্য সুন্দর রিসোর্ট। রক্ত কথা বলে। দু’দিন আগে হোক কিংবা দু’দিন পরে। মঈনের বিছানো জালে সে নিজের সততা বেঁচে দেয়। এই বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির পেছনে যে টাকা এসেছিল তার একটা বৃহৎ অংশ ছিল অন্যায় পথে। নাফিস সেটা প্রথমে বোঝেনি। যখন বুঝতে পারল তখন সেই বোঝাটা অর্থহীন। মায়ের শেষ সময়ের অনুরোধ রক্ষার্থে হোক অথবা বিবেক যাতনায়। নাফিস মঈনের মুখোমুখি হয়। সে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য পুরোপুরি তৈরি ছিল। কিন্তু মঈন খানের প্লান ছিল ভিন্ন। পৈতৃক সম্পদ এবং এই অনিন্দ্য সুন্দর বাড়ির প্রতি তার লোভ জন্মায়। তাছাড়া সৎ মায়ের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। মঈন খানের ধারণা নাফিসের মায়ের কারণেই তার মা অবহেলিত ছিল পিতার কাছে। যা সত্যি ছিলনা। এই ঘৃণার বশবর্তী হয়ে নাফিসকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। নাফিস যাদের সাথে কাজ করছিল কিংবা বলা যায় মঈন কাজ যুগিয়ে দিয়েছিল, ওরা ছিল অপরাধ জগতের স্থায়ী বাসিন্দা। নাফিসের প্রায়শ্চিত্তের অর্থই ওদের জন্য বিপদ। মঈন খানের মিথ্যা আশ্বাস এবং ভরসায় নাফিস নিজের পাপমোচনের পথে এগোতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে মরতে হয় তাকে। ভাগ্যক্রমে একটুকরো কাপড়ের তলে পড়ে বেঁচে যায় ছোট্ট শান। সেও হয়তো একা একা এই মৃত্যু পুরীতে শেয়াল,কুকুরের খাদ্য হয়ে যেত৷ কিন্তু মঈন খানের দয়া হলো ওর উপর। সৎ ভাইয়ের পরিবারের পরিণতি নিজ চক্ষে দেখতে এসে শানকে পায়। ফেলে রেখে এসেছিল এতিম খানায়। ক্রমেই তার মনে হতে লাগল একটা ডান হাতের প্রয়োজন। যাকে ঢাল করে এগিয়ে যাওয়া যাবে। সেই ভাবনায় মহৎ সেজে তুলে আনলেন শানকে। গোলাম ধীরে ধীরে আপন হয়ে উঠল। শানের গোলামিতে মঈন খান খুশি হলেন। প্রিয় ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠল তার কাছে শান। মাঝে মাঝে ভয়ও হতো। যে সিংহ তিনি বানিয়েছেন। অতীত জেনে তার এবং তার উপর না ঝাঁপিয়ে পড়ে! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ভয়ে কাটিয়েছিলেন। তিনি জানতেনই না সিংহটি তার জীবিতকালেই সব জেনে গিয়েছিল। সত্য চাপা থাকে না। সে আপন রশ্মিতে ঠিকই জ্বলে ওঠে৷ নিজে জ্বললেও এই প্রতিশোধ তাকে জ্বালায়নি শান। যাকে বড়ো বাবা বলে পিতার স্থানে বসিয়েছিল তাকে মারতে পারেনি সে। ভালোবাসার কাছে প্রতিশোধ হেরে যায়। সবাই এক পথে চলে না। শান সেই ভিন্ন পথের পথিক। সে হারিয়ে কষ্ট পেতে রাজি, সেই কষ্ট অপরকে দিতে রাজি নয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here