তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব:-১৭

0
2488

তুমি অতঃপর তুমিই
৩৫
Writer Taniya Sheikh

একরাশ অবসাদ মনে ব্যালকনিতে বসে আছে ইমরোজ। একদৃষ্টে চেয়ে আছে শূন্যে। সামনে রাখা কাপের চা ঠাণ্ডা হয়েছে বহুক্ষণ আগে। সেটাই আনমনে ঠোঁটের আগায় নিয়ে চুমুক দিতেই হুশ ফেরে। বিষাদে ভরে ওঠে চোখ-মুখ। মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটাই বিষাদে আচ্ছন্ন। ওভাবেই কাপটা হাতে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ডাইনিং এ ফিরে আসল। চায়ের কাপটা রাখতেই পাশ এসে দাঁড়াল ইমা।

” আজও চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল!”

ইমরোজ লজ্জিত চেহারায় মুখ নামিয়ে নেয়। ইমা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। বিষন্ন মুখে বলে,

” আপনার বন্ধু আমাকে গতকালও কল করেনি ইমরোজ ভাই।”

” তাই নাকি! আচ্ছা আমি দেখছি।” ইমরোজ চট করে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে শানকে কল করলো। কয়েকবার রিসিভ হতেই ওপাশে নারী কণ্ঠ শুনতে পেল ইমা,ইমরোজ। ইমার চোখে যেন আগুন বের হচ্ছে তাতেই। ইমরোজ সংকোচে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,

” কে বলছেন?”

” সামিরা।” স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর সামিরার। পাশ থেকে শানের অস্পষ্ট গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন কাওকে ধমকাচ্ছে সে। ইমার মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করে ইমরোজ বলে,

” সামিরা,আমি ইমরোজ বলছি। শানকে মোবাইলটা দাও।”

” সরি, ইমরোজ। শান এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। আমাকে বলেছে কেউ কল করলে কেটে দিতে।”

” বাট সামিরা,,,!” সামিরা কল কেটে দেয়। ফর্সা চেহারা রাগে লাল হয়ে গেছে ইমার। ইমরোজ বুঝাতে গেলে হাত উচিয়ে বলে,

” বুঝাতে আসবেন না। ধৈর্য্য, ধৈর্য্য এইতো। এটাই এখন আমার একমাত্র কাজ। আপনার বন্ধু যা ইচ্ছে হয় করুক। আমি ধৈর্য্য ধরব। ঠিক আছে না ইমরোজ ভাই।” শেষ কথাটা বলতেই গলা ধড়ে আসে ইমার। তাড়াতাড়ি চলে যায় রুমে। ইমরোজ কী করবে বুঝতে পারে না। রুমে ফিরে এলো ভাবতে ভাবতে। অনেক ভেবে স্থির করলো শানের সাথে দেখা করবে। কতদূর কী এগোলো সাক্ষাতে জানবে। আলমারি থেকে শার্ট বের করতেই চিঠিটা চোখে পড়ল। কাপড়ের ভাঁজের এককোনে পড়ে আছে সেটা। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও মৌ-কে ভোলেনি ইমরোজ৷ কিছু মানুষ জীবনে আসে যাদের সহজে ভোলা যায় না। মৌও তেমনি। ইমরোজের বাসায় বিয়ের তোড়জোড় চলছে। পাত্রী আগেরজনই। ইমরোজ অনিচ্ছা মনে সব মেনে নিয়েছে। বাবা-মায়ের খুশির উপরে কিছু নেই৷ চিঠিটা হাতে নেয়। এই ক’মাসে কতবার পড়া হয়েছে তার হিসেব নেই। আজ আবার পড়ল চিঠিটা। গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে কিভাবে ওর বোন উচ্চ বিলাসী জীবন যাপনের লোভে অল্প বয়সে ঢাকা আসে। ফাঁদে পড়ে বার ডান্সার হয়। তারপরে মাহিবের সাথে পরিচয়,মাহিবের প্রলোভনে পড়ে সম্পর্কে জড়ায়, অন্তঃসত্ত্বা হয়। একসময় মাহিবের মন উঠে যায়। মেরে ফেলে ওর বোনকে। এলাকায় দূর্নাম রটিয়ে দেয়। ওর বাবা- মা লজ্জায়- অপমানে আত্মহত্যা করে। বেঁচে থাকে তো কেবল মৌ। চোখের সামনে সব শেষ হতে দেখে আগুন জ্বলে ওর মধ্যে। সেই আগুনে নিজের পবিত্র স্বত্বাকে পুড়িয়ে এই শহরে ফেরে। মাহিবের সম্পর্কে খবরা-খবর নেয়। বার ডান্সার হয়ে মাহিবের বিছানা সঙ্গী অতঃপর বিশ্বস্ত সহচরী। কেউ জানে না,শামীমকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পেছনে মৌ-য়ের হাত ছিল। মৌ জানত মাহিবের ক্ষমতা,দাপট,অপকর্মের ডান হাত এই শামীম। পিতার মৃত্যুর পর মাহিব আরও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। মঈন খানের দাপটে গড়া অপরাধের শক্তি তার মৃত্যুর পর ক্ষীণ হয়ে যায়। এখন আর শান নেই আর না মঈন খান। ভয় পাবার মতো আছে কে তাহলে! মাহিব? সে তো নেশা,নারীতে ডুবে থাকা এক নরপিশাচ। সেই দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল মৌ৷ ইতিহাস সাক্ষী লোভ,লালসা কখনো কাওকে ছেড়ে দেয়নি। নিয়ে ডুবেছে। মাহিবেরও পরিণতি শেষমেশ তেমনই হয়েছে। নারীই ওর সর্বনাশের কারণ হয়েছে। পঙ্গু মাহিবকে একা বাসায় তিলে তিলে মারে মৌ। তার আগে অবশ্য মাত্রারিক্ত চেতনানাশক সেবন করিয়ে নিয়েছিল মাহিবকে। তাইতো সহজে কাবু করতে পেরেছে মৌ। একদিন ওকে যারা ভালোবাসত তাদের মাহিব নিজে হাতে শেষ করেছিল। সময়ের পরিক্রমায় সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হয় উল্টো ভাবে। ভালোবাসায় ধোঁকা খেলে কেমন লাগে শেষ সময় বুঝেছে মাহিব। চোখের জলে হৃদয়ভাঙার ব্যথা ধুয়েছে। জীবন সবাইকে পূর্ণতা দেয়না,দ্বিতীয়বার সুযোগও সবসময় পায় না।যে বিষ একটু একটু করে দেহে ধারণ করেছিল মৌ। তাই সব গ্রাস করলো শেষে।

শানের দেখা পায়নি ইমরোজ৷ দারোয়ান বলেছে গত পরশু থেকে সে বাসায় ফেরেনি। ইমরোজের এবার চিন্তা হতে লাগল। ওর পরামর্শেই শান এই রিস্ক নিয়েছে। সামিরাকে দিয়ে সত্যিটা কনফেশ করাতে না পারলে শানকে এরেস্ট করবে পুলিশ৷ ইমরোজ জানে শান পারবে তবুও কেন যেন সামিরাকে নিয়ে ওর ভয় হয়। এই মেয়েটা সাংঘাতিক রকমের ধূর্ত। ঘূর্ণাক্ষরেও যদি কিছু বুঝতে পারে তবে শানকে ও মারার চেষ্টা করবে। বন্ধুর জন্য চিন্তা হতে লাগল। এদিক ওদিক ঘুরে থানায় ফিরে গেল। পৌঁছাতেই মা কল করে জানাল আগামী সপ্তাহে ওর আকদের ডেট ফিক্স করেছে। ঠিক তার এক মাস পর বিয়ে। ইমরোজ “হু” ছাড়া আর কোনো কথায় বলল না। আমেনা বেগম হতাশ হন ছেলের উদাসীনতায়। তবে তার বিশ্বাস বিয়ের পর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। রাত্রি মেয়েটা কাঁদা মাটিতে গড়া। ইমরোজের ওমন ব্যবহারের পরও মেয়েটি কোনো অভিযোগ করেনি। আজ কালকার মেয়েদের মতো হলে তো মুখের উপর না করে দিত৷ যাক! মনের মতো বউ পেয়ে আমেনা বেগম খুশি৷

আকদের তারিখ যত এগিয়ে আসছে রাত্রির মনের অস্থিরতা ততই বাড়ছে। বাবা-মাকে সে সাহস করে বলতেও পারছে না এই ছেলেকে ওর ভালো লাগেনি। এমন রূঢ় ব্যবহার করা ছেলের সাথে সারাজীবন কী করে কাটাবে! রাত্রির শুধু কান্না পায়। বোবা প্রাণীর মতো নিজেকে অসহায় ভাবে ও। বাবাকে খুব ভয় রাত্রির। বাবার কথার উপর কথা তো দূর, বাবার চোখে চোখ রাখতেও ভয় পায়। এমনিতেই ঐ ঘটনায় বাবা রাগারাগি করেছে। সাবধান করেছে বিয়ের আগে যেন কোনো কথায় না বলে রাত্রি। রাত্রির বয়েই গেছে কথা বলতে ঐ রূঢ়ভাষী লোকটার সাথে৷ রাগ হয় ইমরোজের উপর ওর। মনে মনে ভেবে নিয়েছে বিয়ের পর কোনো কথায় বলবে না৷ যদি লোকটা ধরে নেয় ও বোবা তবে তাই। গায়ে পড়া মেয়ে মানুষ বলেছে তো! বেশ। রাত্রি বুঝিয়ে দেবে আসলে সে কি।

দু’দিন বাদে রাত আনুমানিক একটার দিকে শানের দরজায় কলিং বেল বেজে ওঠে। কপালে হাত রেখে কাইচে আধশোয়া হয়েছিল শান৷ একটু আগেই ফিরেছে। সারাদিন সামিরাকে নিয়ে ঘুরতে হয়েছে এখানে -ওখানে। ক্লান্ত শরীর তাই তাড়াতাড়ি অবসন্ন হয়ে পড়ে। কলিং বেলের আওয়াজেও ওঠে না। বিরক্ত হয়। ভাবে আবার বুঝি সামিরা এসেছে। শান কানে হাত দিয়ে বসে থাকে। না,থামছেই না। বরং দরজায় ধুমধাম লাথি, থাপ্পড় পড়ার আওয়াজ শুনতে পেল কান থেকে হাত সরাতেই। সামিরা এটা কখনো করবে না। তাহলে কে! ইমা! শানের সকল ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যায়। ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই আগাগোড়া কালো বোরখায় আবৃত ইমাকে চিনতে ওর কষ্ট হয়না। এই ক’মাসে গত চারদিনই গেছে ইমার সাথে দেখা তো দূরের, কথা বলারও অবসর পায়নি। ইমা শানকে ঠেলে ভেতরে ঢোকে। শান দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে,

” এতো রাতে তুমি এখানে?”

ইমা কোনো কথা বলে না। চুপচাপ গিয়ে বসে কাউচে। হাঁফাচ্ছে সে। শান পাশে বসতেই বাড়ন্ত পেটটা ধরে উঠে দাঁড়ায় ইমা। শান খেয়াল করে ইমার হাত কাঁপছে। চোখ বড়ো বড়ো করে ইমার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ইমার নেকাব খুলে ফেলতেই চোখে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বেহাল অবস্থা ওর মুখের৷ সঙ্গে সঙ্গে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলায় শান।

” আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আমি একটুও সময় পাইনি।”

” আমি পানি খাব শান। আমার খারাপ লাগছে।” ইমার শরীর কাঁপছে থরথর করে। একা এই অবস্থায় এখানে এসে কয়েক মিনিট ধরে দরজায় ধুমধাম লাথি,থাপ্পড় দিয়ে ক্লান্ত ইমা। ভয়ও পেয়েছে খুব৷ শান ওর গা থেকে বোরখা খুলে বাতাসে বসায়। পানি এনে নিজ হাতে পান করিয়ে চোখ মুখ মুছে মৃদু ধমকে বলে,

” এভাবে আসতে কে বলেছে তোমাকে? বিশ্বাস নাই আমার উপর তাই তো?”

ইমা ছলছল চোখে তাকিয়ে আচমকা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে শানকে। ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে,

” আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল বিশ্বাস করুন। আপনার খোঁজ না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই আর থাকতে পারিনি।” মুখ তুলে শানের ডান হাতটা বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বলে,

” দেখুন কী অবস্থা! আপনাকে না দেখতে পেয়ে মরে যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল।”

সত্যিই ইমার বুক ধুকপুক করছে খুব। ক্রমাগত হাঁফাচ্ছে।

” হুশশ! কী বলো এসব? কিছুই হবে না তোমার।” ইমাকে বুকে টেনে নেয় শান। সে রাতটা ওদের এক সঙ্গেই কাটে৷ পরদিন সামিরাকে বহুকষ্টে বুঝায় সে আশুলিয়া গেছে। সামিরা বিশ্বাস করল কি’না জানেনা তবে কল কেটে দিয়েছে। ইমাকে নিজের কাছে পেয়ে শান প্রাণবন্ত। ইমার শরীর আজকাল ভালো যাচ্ছে না৷ প্রেগন্যান্সির শেষ দিকের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে খুব তাড়াতাড়ি। শানের ইচ্ছে হয় সর্বক্ষণ ইমার পাশে পাশে থাকার৷ এই সময়টাকে আরও স্মরণীয় করে রাখার। কিন্তু পারছে না ভেবে খারাপ লাগল। ইমা যা খেতে চেয়েছে শান নিজ হাতে তৈরি করেছে আজ। পাশে শুয়ে,বসে দিনটা খুব ভালোভাবে কাটে ওদের। সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে গিয়ে বসে,সেই দোলনার উপর। নতুন করে অনুভব করে সেই রোমান্টিক সকাল। রাতে শানের বুকের মাথা রেখে শান্তির ঘুম নামে ইমার চোখে। মাথার পাশের জানালা দিয়ে রাতের আকাশ দেখা যায়। চাঁদ উঠেছে। গোল থালার মতো একখানা চাঁদ। যার আলো ঠিকরে পড়ছে এসে ইমার মুখের উপর। শান সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ইমাকে দেখতে লাগল। কতটা দুশ্চিন্তায় না কাটছে সময়, অথচ এই সময়টাতে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার কথা ইমার। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ জন্মে। ইমার জীবনের এতো দুর্ভোগ সব ওরই কারনে। কবে সুখী করবে ইমাকে? কবে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারবে একসাথে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শান। ইমার মুখ দেখে দেখে রাত গভীর হলো। ঘুমাতে মন চাইছে না ওর। হতাশা ঘিরে ধরেছে। তারমধ্যে মন বলছে ইমার মুখটা দেখে দেখে রাত্রি ভোর হোক। একসময় নিরাশার মেঘ সরে দুষ্টু বুদ্ধির উদয় হয় শানের মনে। ঠোঁট সরু করে ফু দেয়, ইমার চিবুক থেকে আস্তে আস্তে সেটা উপরে ওঠে। ঘুমের মধ্যেই শিহরিত হয় ইমা। ঠোঁট নড়ে ওঠে, চোখের পাতা কাঁপে। অস্ফুটে বিড়বিড় করে,

” আহ! শান,ঘুমাতে দিন না।”

মুখটা ইমার কানের কাছে এনে আলতো চুমু দিয়ে, ধীরে ধীরে গ্রীবাদেশে নামে। ইমার ঘুম ভেঙে যায়। শানের চুল মুঠ করে ধরে ঘুম জড়ানো চোখে তাকায়। কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ওরা। দু’জন দুজনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যেমন করে স্বর্ণলতা বৃক্ষ, গুল্মকে। ভোরের আলো পৃথিবীর বুকে পড়ার আগেই শান বিছানা ছাড়ে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ে জরুরী কাজে। যাওয়ার পূর্বে চিরকুট রেখে যায়। শান যখন ফেরে তখন সকাল। ইমার পছন্দের নাস্তা কিনে বাসায় ফেরে। নাস্তা টেবিলের উপর রেখে ইমাকে ডাকে। একবার,দু’বার এমন করে আরও কয়েকবার ডাকে। ইমার সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে ঢুকে দেখে রুমটা সাজানো,গোছানো। পুরো ঘর খুঁজেও ইমাকে পেল না। টেনশন হতে লাগল শানের। ইমরোজকে কল করে জানতে পেল ইমা মামার বাসায় গেছে। শান চিন্তামুক্ত হলো কিছুটা। তবুও মনে সংশয় রয়ে গেল,ইমা হঠাৎ করে কেন চলে গেল এখান থেকে? ইমরোজকে জানাতে পারল তবে তাকে কেন নয়? মনটা অশান্ত হয়ে উঠল কেন যেন। পুরো ঘরময় সবকিছু স্বাভাবিক। সন্দেহের কিছুই চোখে পড়ল না। শানের ভাবনা ছেদ হয় সামিরার কল পেয়ে। সামিরার ব্যবহারে স্পষ্ট শানের প্লান কাজ করছে। আজকালের মধ্যে একটা উপায় বের করে সামিরার মুখ দিয়ে সব কথা উগলাতে হবে। মাহিব তো মরে বেঁচেছে, সামিরাকে শান ছাড়বে না। ইরার মৃত্যুর জন্য দায়ী, গত চার বছর যে কষ্ট বয়ে বেরিয়েছে সে তারও কারন এই সামিরা। ওকে জেলে না পাঠালে শানকে জেলে যেতে হবে। আগের শান হলে এসবের পরওয়া করত না,কিন্তু এই শান সুন্দর, স্বাধীন,সম্মানের জীবন আশা করে। এজন্যই এই কষ্ট সে মেনে নিচ্ছে। শান তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল সামিরার বাসার উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে অবাক হলো। কিছুটা সন্দেহও হচ্ছে ওর কেন যেন। সামিরা ক্যান্ডেলা লাইট ডিনারের আয়োজন করেছে। ওর সাথে বসে এক গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছুক নয় শান,সেখানে এতো কিছু। এদিকে সামিরাকে আপাতত নারাজ করা চলবে না। অনিচ্ছায় সামান্য খেলো। আজ বেশ আনন্দিত মনে হলো সামিরাকে। শানকে সিডিউস করার চেষ্টাও সে করে কয়েকবার। সামান্য ডিঙ্ক করলো খেতে খেতে সামিরা। তারপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ। নেশারঝোঁকে সব বলতে লাগল সামিরা। প্লান মাফিক সেসব মোবাইলে রেকর্ড করতে ভুললো না শান। সামিরা অচেতন হতেই বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।শানের মুখে বিজয়ের হাসি। এতো সহজে সাফল্য আসল ভাবতেই কেমন যেন অনুভূতি হলো। মাথা থেকে সকল চিন্তা,সংশয়,সন্দেহ ঝেড়ে ফেলে একপ্রস্ত হাসল। সে জানে না এ হাসির স্থায়িত্ব স্বল্প সময়ের জন্য। শান সোজা চলে এলো ইমরোজের থানায়। সামিরার কনফেশন রেকর্ড ইমরোজের হাতে তুলে দিয়ে হাফ ছেড়ে বলল,

” এখন আমি ইমাকে নিয়ে সোজা আশুলিয়া চলে যাব। তারপর আর কোনো বাধা আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”

” হুম, চল আমিও তোর সাথে যাই ভাবিকে আনতে। তার আগে হাতের কাজটা শেষ করে নেই দাঁড়া।” ইমরোজ হাতের কাজ কমপ্লিট করে শানের গাড়িতে চড়ে বসল।

” আগামীকাল রেকর্ডটা সিনিয়র অফিসারের কাছে দিয়ে তবেই শান্তি আমার।”

শান মুচকি হাসি দিল ইমরোজের দিকে চেয়ে। মনটা ভীষণ ভালো এই মুহূর্তে ওর। গাড়ি স্টার্ট দিতেই ইমরোজের মোবাইলে কল আসে। মা কল করেছে। আমেনা বেগম ইমাকে নিয়ে চিন্তিত। গত পরশু রাত থেকে ইমার কোনো খোঁজ না পেয়ে শেষমেশ ছেলেকে জানাতে বাধ্য হলেন। ইমরোজ চমকে ওঠে,

” গত পরশু রাত থেকে মানে কী মা? তুমি তো বললে ভাবি গতকাল তার মামাবাড়ি গেছে।”

” আসলে ইমাই আমাকে এমনটা বলেছিল। একটু আগে আশা বলল ইমাকে নাকি বিড়বিড় করতে শুনেছিল সে শানের ফ্লাটে যাবে। আশা নিষেধ করলেও ইমা শোনেনি। কেমন বেক্কল মেয়ে পেটে ধরছি বোঝ। এতোক্ষণে এসব বলল আমাকে। আমার চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য। শানকে একটু কল করে জিজ্ঞেস কর তো বাপ।”

গাড়ি থামিয়েছে আগেই শান। কল কেটে ইমরোজ শানের দিকে ফিরে তাকায়। শান অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। হৃদপিণ্ডটা মনে হলো সজোরে চেপে ধরেছে কেউ ওর। হাড়ে হাড়ে ব্যথা অনুভব করছে। কিছু সময়ের জন্য নড়নচড়ন ভুলে গেল। ইমরোজ প্রশ্ন করলেও জবাব দিল না। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে যেন শানের। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটে আসে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও ইমাকে পায় না ওরা। শক্তি -সাহস হারিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। চোখের কোনে জল বাড়ে। কণ্ঠরোধ হয়ে আসে হাজারটা দুশ্চিন্তায়। কিছু বলতেও পারেনা,ভাবতেও পারেনা শান। ঐ অবস্থায় হঠাৎ আশার সঞ্চার হয় ইমরোজের কথায়। ওরা বেরিয়ে পড়ে ইমার মামার বাড়ির উদ্দেশ্য। যেতে যেতে ইমরোজ নুসরাতকে কল করে। নুসরাত জানায়, ইমা গত চারবছরের মধ্যে এখানে একবারও আসেনি। গাড়ির ব্রেক ফেল হয় সেকথা শান শুনতেই। ইমরোজ সামান্য আঘাত পেলেও শান বেশ আহত হয়। সেখানেই অচেতন হয়ে পড়ে থাকে সে। দু’জনকেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ইমরোজ ঐ অবস্থায় যথাসাধ্য চেষ্টা চালায় ইমাকে খুঁজে বের করার। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ মেলে না। একটা মানুষ হঠাৎ যেন হারিয়ে গেল হাওয়ার মতো,,,,

চলবে,,,

এই পর্ব পর্যন্ত কারো মনে কী কোনো প্রশ্ন আছে,যা আমি মিস করে গেছি বলে মনে হচ্ছে আপনাদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here