তুমিময় আমি,পর্ব:৯

0
532

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ৯।

সময় বারোটার ঘরে। সেকেন্ডের কাটা পাল্লা দিয়ে ছুটছে। হৃদয় অধীর আগ্রহে বসে। কখন তার প্রিয় মানুষটার ক্ষুদ্র একটা বার্তা তাকে চমকে দেবে। টুং করেই আওয়াজ হলো। তড়িঘড়ি করে মোবাইল হাতে নিয়েই হতাশ হলো সে। আবারো আওয়াজ, কিন্তু ফলাফল শূন্য। মুহুর্তের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো ফোনের নোটিফিকেশন বিরতীহীন বেজে চলছে। হৃদয় প্রতিবার এক বুক আশা নিয়ে চেক করছে। আর সময় প্রতিবারই তাকে নিরাশ করছে। রাতের দুটো অবধি অপেক্ষা করেও কোনো লাভ হলো না। ফোনটা পাশে রেখে দিলো। অনেকটা রাগ, খানিকটা অভিমান আর এক বুক অভিযোগ নিয়েই শুয়ে পড়ল সে। করবে না, সে আর অপেক্ষা করবে না।

জুঁইয়ের বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই জান কোচিনের জন্য নিজের বাসায় ফিরে গেছে। ততদিনে জানের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক অনেকটা আগের মতোই স্বাভাবিক। মাঝখানের বিয়ে নামক বিষয়টা কর্পূরের মত উবে গেছে। অজানা কারণেই বেড়েছে হৃদয়ের অস্থিরতা, অন্তরের ধুকপুকানি।

সকালের সূর্যের জ্বলমলে আলো চোখে লাগতেই ঘুম হালকা হয়ে এলো। আলস্য ভঙ্গিতে চোখ খুলে উঠে বসল সে। প্রথমে নজর দিলো ফোনের স্কিনে। কিন্তু ফলাফল শূন্যের ঘরেই আটকে রইল। হৃদয় অলস পায়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। আজকের সকালটা কেমন কেন গুমোট। বর্ষণের পূর্বের পরিবেশের মত। আসলে এটা পরিবেশের দোষ নাকি তার মনের ঠিক বুঝা গেল না। হৃদয় ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই জুমা জড়িয়ে ধরল।

” হ্যাপি বার্থডে, ভাইয়া। ”

হৃদয় বিরস মুখে মুচকি হাসল। একে একে সবাই শুভেচ্ছা জানাল। ইতিমধ্যে বাসায় অনেকে চলে এসেছে। বিশেষ করে যারা কাছের। বাসায় বেশ তোড়জোড়। নূরজাহান আহমেদ রান্নাঘরে ব্যস্ত। ছেলের প্রিয় খাবারে ডালা সাজাবেন তিনি আজ। সকল কিছু একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু হৃদয়। প্রতিবছরই বেশ আয়োজন করে তার জন্মদিন উদযাপন হয়। দুই বোনের এক ভাই হওয়ায় আদর, যত্নটা বরাবরই একটু বেশি। তবে তার ভালো লাগছে না। গতরাত থেকে পরিচিত, অপরিচিত অনেকেই তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করছে। প্রিয় মানুষের শূন্যতা।

জান আর হৃদয়ের বিয়ের পরে হৃদয়ের প্রথম জন্মদিন আজ। অথচ, মেয়েটা একবার কল করেও তাকে শুভেচ্ছা জানায়নি। হয়তো বেমালুম ভুলে বসে আছে। বিজ্ঞানের ছাত্রীদের মাথায় এসব তুচ্ছ বিষয় থাকে না। তাদের মাথায় সারাক্ষণ ঘুরে রসায়নের বিক্রিয়া, পদার্থের সূত্র, জীবতত্ত্ব। সেখানে তার জন্মদিন তুচ্ছ। হৃদয়ের এসব শোরগোল ভালো লাগছে না। তার খুশিতো আটকে আছে অন্যকারো মাঝে। যে যাওয়ার সময় প্যাকিং করে তার খুশি নিয়ে গেছে, রেখে গেছে এক বুক শূন্যতা। চুপচাপ কার্টুনের মতো সোফায় বসে রইল। নজর ফোনের স্কিনে। ভুল করেও যদি মেয়েটা নক করে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রত্যাশা হার মানতে রাজি নয়। সারাদিন সকলের সাথেই কেটে গেল হৃদয়ের। সারাটা সময় ছটফট করেছে। ভেবেছে এই হয়তো জান মিষ্টি কন্ঠে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার রাগ ভাঙিয়ে দেবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি।
সন্ধ্যার পর হঠাৎ বিরতীহীন বাসায় কলিং বেল বাজতে লাগল। হৃদয় নিজের ঘরে ছিলো। কলিংবেলের শব্দে বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে এলো।বসার ঘরে জুঁই, জুমা, বাবা-মাসহ আরো অনেকেই উপস্থিত। অথচ, কলিং বেল নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সবাই নিজ কাজে ব্যস্ত, যেন তারা কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। হৃদয় বিরক্তি নিয়েই এগিয়ে গেল সদর দরজার দিকে। দরজা খুলতেই অবাক। কেউ নেই। তার রাগ হলো প্রচুর। এমন ফাজলামির কোনো মানে হয়! দরজা বন্ধ করায় উদ্ধৃত হতেই পায়ে কিছু লাগল। একটা পার্সেল। পার্সেলের উপরে বড় বড় অক্ষরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো। হৃদয়ের বিরক্তির মাত্রা বেড়ে গেল। ‘ যার জন্য এত অপেক্ষা তার খবর নেই, বাকিরা আলগা পিরিত দেখাতেই ব্যস্ত।’ হৃদয় পার্সেলটা তুলে হাতে নিতেই, পার্সেলের কোণায় একটা চিরকুট দেখতে পেল।

‘ দেরিতে শুভেচ্ছা জানানোর অপরাধ, মিঃ হ্যাসবেন্ড মার্জনা করবে কি! ‘

হৃদয় হেসে ফেলল। এইতো তার খুশি, গত রাত থেকে যাকে হণ্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে। বাক্স বন্দি হয়ে তার হাতে ধরা দিয়েছে। হৃদয় পার্সেল হাতে ঘরে চলে গেল। পার্সেল ওপেন করতেই বেরিয়ে এলো চিরকুটসহ সাদা পাঞ্জাবি, আর একটা ছোট্ট বক্স। হৃদয় চিরকুটসহ পাঞ্জাবিটা হাতে তুলে নিলো। চিরকুটে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,

” আপনাকে আপ্পির বিয়ের দিন সাদা পাঞ্জাবিতে দেখেছিলাম। প্রচন্ড স্নিগ্ধ লাগছিলো। তাই দ্বিতীয়বার দেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না। ”

ছোট্ট বক্সটা ওপেন করতেই নজরে এলো সাদা স্টোনের একটা ঘড়ি, সাথে ভাজ করা নীল চিরকুট। হৃদয় চিরকুটের ভাজ ছাড়িয়ে পড়তে লাগল।

” ঘড়িটা আপনি কখনো পড়তে পারবেন না। যতবার পড়বেন, ততোবার শাস্তি পাবেন। আই সয়ার।
কেন জিজ্ঞেস করবেন না? জানতে হলে নিচের ঠিকানায় আসতে হবে আপনাকে। কেউ আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ”

হৃদয়ের চোখমুখে খুশি উপচে পড়ছে। অভিমান, ভলোলাগার সংমিশ্রণে তৈরি রঙিন অনুভূতি। এই অনুভূতি স্বাদ কেবল সেই পায়, যে গভীররূপে অভিমান আকড়ে ধরতে পারে। পাঞ্জাবি গায়ে ঝটপট তৈরি হয়ে গেল সে। ঠিকানা অনুযায়ী রওনা হলো।

হৃদয় দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার মহামায়া লেকের সামনে। নামের মতোই মায়া উপসে পড়ে এই লেকের জ্বলে। একমনে জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে জ্বালা ধরে। জলের গভীরতা, সবুজের সমারোহ এক অন্য জগতের ভাবনায় ভুলিয়ে রাখে। রাত হলেও চাঁদের আলোয় লেকের পানি জ্বল জ্বল করছে। হৃদয় আশেপাশে চোখ বুলালো। কিন্তু কোথাও জানের টিকিটিও নজরে এলো না। হৃদয়কে দাঁড়ানো দেখেই একজন লোক এগিয়ে এলো। লুঙ্গি, ফতুয়া গায়ে মাথায় ঘামছা বাঁধা। হৃদয়ের বুঝতে অসুবিধা হলো না সে মাঝি। হৃদয়ের হাতের ভাজে চিরকুট গুঁজে দিয়ে হাসিমুখে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। হৃদয় অবাক হয়ে চিরকুটের ভাজ ছাড়াল।

” চাচার সাথে চলে আসুন মিঃ হ্যাসবেন্ড। আমি অপেক্ষা করছি তো। ”

হৃদয় মাঝিটির দিকে তাকাতেই সে সামনে চলতে ইশারা করল। হৃদয় একটু এগিয়ে যেতেই আলোয় জ্বলমল একটা ডিঙি নৌকা নজরে এলো। নৌকার একপাশে প্রদ্বীপের সাহায্য কিছু লিখা। কাছে যেতেই লেখাটি স্পষ্ট হলো।

” জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা, মিঃ হ্যাসবেন্ড। ”

হৃদয় হাসিমুখে লাফিয়ে নৌকার একপাশে চড়ে বসল।

” চাচা, দ্রুত চলুন। কেউ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ”

পানিতে বইঠা পড়তেই ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে নৌকা তীর ছাড়িয়ে লেকের গভীর যেতে লাগল। কিছুদূর যেতেই নজরে এলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। চারদিকে প্রদ্বীপ সাজিয়ে, শাড়ির আঁচল মেলে নৌকার মাঝে বসে আছে এলোকেশী। হৃদয় কাছাকাছি পৌছে সাবধানে নিজের নৌকা ছাড়িয়ে জানের নৌকায় পা রাখল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানের দিকে। কালো শাড়ি, খোলা চুল, নাকে নোজ পিন, কানে স্টোনের ছোট দুল। মুখে কোন প্রকার প্রসাধনী ছাড়াও মেয়েটাকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। বিয়ের পড়ে এই প্রথম তাকে নোজ পিন পড়তে দেখল। পরিপূর্ণ বউ লাগছে। মেয়েটা আসলেও মায়াবতী নাকি তাকে সম্মোহনীর নজরে দেখে বলে এতোটা মায়াবি লাগে? চাঁদের আলো আর প্রদ্বীপে আলো একসাথে হয়ে সৌন্দর্যের এক অনন্য উপমা দাঁড় করিয়েছে। সারাদিনের হতাশা, বিষণ্ণতা যেন লেজ গুটিয়ে পালালো। হৃদয় হাত বাড়িয়ে দিলো। জান হৃদয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। কানে ফিস ফিস করে বলল,

” শুভ জন্মদিন মিঃ হ্যাসবেন্ড। ”

মুহুর্তেই অভিমান এসে হানা দিল অন্তরে। বিরস মুখে বলল,

” না জানালেও চলবে। ”

জান সশব্দে হেসে উঠল।
“নতুন একটা জন্মদিন মানে মৃত্যুর আরো একটু কাছে। এ নিয়ে আয়োজন ব্যক্তির অপমানের কাতারেই পড়ে। ”

হৃদয় সরোষ দৃষ্টিতে জানের দিকে তাকিয়ে। জান পুনরায় হেসে উঠল।

” তবে প্রিয় মানুষকে একটু অপমান করা যায়। কী বলেন মিঃ হ্যাসবেন্ড? ”

জানের কন্ঠে রসিকতা। হৃদয় অভিমানী গলায় বলল,

” শুভেচ্ছা না জানালেও চলত। ”

” আপনার চলত, আমার নয়। আপনিতো জানেন, আপনাকে অপমান করার কোনো সুযোগ আমি হাত ছাড়া করি না। উপহার পছন্দ হয়েছে? ”

” সবচেয়ে বড় উপহারতো তুমি, আমার সামনে।জান, তাও শাড়ি পড়ে? আমি এতোটাও আশা করিনি। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি নোজ পিন দেখে। তবে আমায় সাদা পাঞ্জাবি দিয়ে, তুমি কালো শাড়ি পড়ে বসে আছো। এটা কিন্তু ঠিক না। ”

” সব ঠিক হতে হবে কেন? মাঝে মাঝে অনিয়ম হওয়া ভালো। স্বাভাবিক নিয়মেই বিপরীত ধর্মে আকর্ষণ বেশি। ঘড়িটা কেন পড়তে নিষেধ করেছি জানতে চাইবেন না? ”

” তুমি জানাতে চাইলে, আমি শুনতে প্রস্তুত। ”

” আসলেও এই ঘড়ি আর পাঞ্জাবিটা আমার নিজের টাকায় কেনা৷ আমার প্রথম উপার্জন। হোস্টেলে থাকতে বাড়ির সবার অলক্ষ্যে টিউশনি করেছিলাম। একদিন হুট করেই শপিং গিয়ে এই ঘড়ি আর পাঞ্জাবির উপর নজর পড়ে। তখন অবশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে কিনিনি। কিন্তু এখন কাজে লেগে গেল। ঘড়িটার দাম কম হলেও এটা আমার কাছে ভীষণ দামি। এতোদিন আমি যত্নে রেখেছি, এখন আপনায় দিলাম যত্নে রাখার জন্য। তবে কখনো এর থেকে দামি কিছু পেলে, আমি নিজের হাতেই ঘড়িটা আপনার হাতে পড়িয়ে দেবো। ”

” কেন, আমি দামি নই? ”

” আপনি কোন বস্তু নন। আপনি আমার কাছে অমূল্য বলেই নিজের মূল্যবান জিনিসটা আপনার কাছে গচ্ছিত রাখলাম। ”

হৃদয় জানকে আলিঙ্গন করে নিলো। এই মেয়ের মাঝে সকলকে আপন করে নেওয়ার এক আলৌকিক ক্ষমতা আছে। বাইরেটা লোহার আস্তরণে মোড়ানো হলেও, ভেতরা গোলাপের মতোই কোমল।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকাঁবাকা লেকটির মাঝে ভাসছে একজোড়া সুখি দম্পতি। জলধারের চারপাশে দেখলে মনে হয় সবুজের চাদর বিছানো। কোনো এক শিল্পীর আঁকা সুনিপুণ ছবি। হঠাৎই জান ফিসফিস করে বলে ওঠল,

” ভালোবাসি। ”

হৃদয় চমকে মুখ তুলে তাকাল। অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কী বললে? ”

জান দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
” ভালোবাসি। ”

সে শব্দ পাহাড়ের গায়ে বাঁধা পেয়ে পুনরায় প্রতিধ্বনি হতে লাগল। হৃদয়ের কান শির শির করতে লাগল। সারা শরীরে কেউ যেন মরণ বিষ ঠেলে দিয়েছে। প্রিয় মানুষটার মুখে প্রথমবার ‘ ভালোবাসি ‘ শুনলে বোধহয় সবার এমনি লাগে।মুগ্ধ হয়ে সে শব্দে নিজেকে বিলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই জান হৃদয়ের বুকে মুখ গুঁজল। হৃদয় দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। বিরবির করে বলল,

” আর কিছু বলোনা প্লিজ। আমার দম বন্ধ লাগছে। নির্ঘাত মরে যাব। ”

সদ্য প্রেমে পড়া দম্পতি নিজের অনুভূতি আদান-প্রদানে ব্যস্ত। চোখে চোখে হাজারো অভ্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ। সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে জলধারা, মাতাল হাওয়া, সবুজ প্রকৃতি আর উজ্জ্বল চাঁদ। হাস্যোজ্জ্বল দম্পতির প্রফুল্লতা তারা ধরে রাখবে কি!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here