তুমিময় আমি,পর্ব:১৭

0
472

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৭।

সূর্যরশ্মি কাচের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে তীর্যক তীক্ষ্ণ রেখার। কাচের জানালার উপর ডান হাত রেখে একমনে বাইরে তাকিয়ে নিহান। দৃশ্যপটে দূরের পাহাড়। সূর্যরশ্মিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। কিছু সময় পূর্বেই নিহান এসে পৌছেছে চট্টগ্রাম। এই বাড়িটা প্রতিটা কোণা তাকে চিনে। আসলেও কী চিনেন?
‘ স্বল্প সময়ে সবার সাথেতো সখ্যতা হয়ে ওঠে না।পরিস্থিতি আবেগ বুঝে না। ‘
বাড়ির কিছুই পাল্টে যায়নি। পাঁচ বছর পূর্বে এখানে সে যতোটা আন্তরিকতার মাঝে ছিলো আজও আছে। কিন্তু বদলেছে মাঝের সময়। সম্পর্কের মাধুর্য। আত্মার টান। বাড়ি ফিরতেই ফুফি তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করেছে। কত আদর! অথচ, এই মহিলাটি তার মায়ের অপমান করেছিলো। তথাপি, আজও সে জবাব দিতে পারেনি। মায়ের শিক্ষা তাকে কঠোর হতে দেয় না, মায়ের অপমান তাকে কোমল হতেও দেয় না। ভেতরে ক্ষোভ চেপে কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলা বড্ড অশান্তির। মস্তিষ্ক তেজে ওঠে। দপাদপ করে।
তার এলোমেলো ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে জুমা।

” আমি জানতাম তুমি আসবে। ”

জুমার কন্ঠ পেয়ে ফিরে তাকায় নিহান। ধীর পায়ে বিছানায় এসে বসে। চোখের খেলায়, ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,

” আসতেই হতো। বেইমানি আমাদের রক্তে নেই যে। ”

জুমা থমথম খেয়ে যায়। শান্ত ঢুক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে। নিহান বাঁকা হেসে জুমাকে বসতে ইশারা করে। জুমা বাধ্য মেয়ের মত চুপচাপ বসে পড়ে। নিহান চরম উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,

” তুমি কি কাজটা ঠিক করেছো? ”

জুমা নিহানের চোখের দিকে তাকায়। কোথায় দুঃখবোধের চিহ্ন নেই। বরং বিশ্বাসহানী তাচ্ছিল্যের হাসি। পরক্ষণেই দৃষ্টি নত করে জবাব দেয়,

” ভুল কিছুও করিনি। ”

” সেজন্য আমার ভাইয়ার ভালোবাসাকে ব্যবহার করেছো? ”

” আমি আমার ভাইয়ের খুশিটাকেই আগে দেখব। ”

” কারো দুর্বলতায় আঘাত করে প্রাপ্তি,
জয়ের নাকি মূল্যবোধ ক্ষয়ের? ”

” তোমার যা ভাবতে ইচ্ছে করে। তোমার ভাই তোমার জন্য জীবন দিতে পারে। আমি নাহয় আমার ভাইয়ের জন্য একটা অন্যায়ই করলাম। ”

জুমা সশব্দে উঠে দাঁড়ায়। সামনে পা বাড়ায়। পরিস্থিতি সে সামলে নিলো না বিগড়ে দিলো বুঝতে পারছে না। এরকম দ্বিধা দ্বন্দ্বে দিন কাটানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।

” তোমার মনে হয়, তোমার এই ছোট্ট শর্ত আমায় বাঁধতে পারবে? ”

জুমা থমকে দাঁড়ায়। নিহানের আদলে চোখ বুলায়। ঠোঁটে তীর্যক হাসি। চোখে রহস্যের খেলা। আবার কী করবে নিহান? কিন্তু এখানে প্রশ্ন করা বেমানান। দীর্ঘশ্বাস ফেলেই জুমা ঘর ত্যাগ করে।

—————-

জুঁই বসে আছে শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের শহীদ মিনার চত্বরে। পাশের দীর্ঘ পুকুর, মহিলা হোস্টেল তার সম্মুখে। শীতের তীব্র বাতাসে প্রকোপে পুকুরে গাঢ় সবুজ পানি দোল খাচ্ছে। একমনে সে তাকিয়ে।
‘ আত্মকথন ‘ নামক সংস্থা পরিচালিত হয় তার দ্বারা। সংস্থার কিছু কাজেই সে কলেজ পরিদর্শনে এসেছে। তার এবারের কাজ কলেজ শিক্ষার্থী নিয়ে। এই বয়সে ছেলে মেয়েদের মাঝে দেশ, জাতির জন্য কিছু করার যে তীব্র ঝোঁক থাকে। পরবর্তীতে তা ফিকে হয়ে পড়ে। এই ঝোঁকটাকে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও জাতির দ্রুততম কল্যাণ সম্ভব। পরিকল্পিত কাজ শেষ করে সে বসে আছে এখানে। পাশেই তার দুজন সহকর্মী দাঁড়ানো। মাঝে মাঝে ক্লাসরুমের ভেতর থেকে কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখছে। ব্যাপারটা নজরে পড়লে, মস্তিষ্কের নিউরনে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি। তার এভাবে বসে থাকা বেমানান। তাতে কী! তার জীবনে মানানসই কী এমন হয়েছে যে আজ হতে হবে! সীমাহীন তিক্ততায় বিষিয়ে জীবন। তার সুন্দর জীবনটা তো সে বহু পূর্বে পেছনে ফেলে এসেছে। তার জীবনের স্বর্ণযুগ। যেখানে সে বাবার রাজকন্যা ছিলো। রাজকন্যা আর রাণীর মাঝে বিশাল ফারাক। রাজকন্যার কোনো দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু রাণীর উপর গোটা রাজ্যের দায়িত্ব। আর রাজাহীন রাণীতো অসহায়। কিন্তু সে অসহায় না। তারও একটা রাজকুমারী আছে। ছোট দুটি কোমল হাতের ছোঁয়ায় তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। পাশে তাকাতেই নজরে পড়ে হলুদ ফ্রকে দুই ঝুটি করা তার হলদে টিয়া পাখি। চোখে কালো চিকন ফ্রেমের চশমা। দাঁত বের করে হেসে তার গালে হাত ছুঁয়িয়ে রেখেছে। জুঁই প্রশান্তির রেখা টেনে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। পাশের সাদা রঙের এপ্রোন জড়ানো মানুষটির দিকে তাকাতেই বিরক্তিতে তার ভ্রু কুচকে আসে। তেজ দেখিয়ে মেয়েকে নিয়ে সামনে পা বাড়ায়। কিন্তু মেয়ে কথায় তার গন্তব্যে ব্যাঘাত ঘটে।

” আম্মু, তুমি বাবাকে ফেলে চলে যাচ্ছ কেন? ”

জুঁই সরোচ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায়। প্রচন্ড রাগ হলেও নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। আড়ষ্ট গলায় বলে,

” তোমার বাবা কে? ”

নির্মলতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আর মা তার বাবাকে চেনে না জেনে যেন সে খুব মজা পেয়েছে। জুঁই প্রচন্ড রেগে, মেয়েকে পাশের সহকর্মীর কাছে রেখে বড় পা ফেলে নোবাইদের
সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তেঁতে ওঠে বলে,

” আপনাকে কতবার বলেছি, ‘ আমার মেয়ের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু ঢুকাবেন না। ‘ ”

” আমাদের মেয়ে। ”

” নির্মলতা শুধু আমার একার মেয়ে। ওর না কোনো বাবা ছিলো, না আছে, আর না ভবিষ্যতে থাকবে। ”

” নির্মলতা বাবা অতীতে ছিলো কি না তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। বর্তমানে আমি ওর বাবা। আর ভবিষ্যতেও আমি থাকব। ”

” কেন করছেন এসব? দয়া দেখিয়ে? আমার অসহায়ত্ব নিয়ে উপহাস করছেন? অবশ্য আপনারা ভাই বোনরা এরচেয়ে বেশি কী পারেন! অসহ্য এক বোন আপনার। অসহ্যকর আপনি। ”

” জুঁই, সাবধন! আমায় যা খুশি বলো, আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমার পরিবারকে টানবে না। ”

” টানব। হাজারবার টানব। আপনারা পরিবার আপনায় শিক্ষা দিতে পারেনি। কোনো সুশিক্ষিত ছেলে, এক বাচ্চাসহ নারী পেছনে ঘুরবে না। ”

নোবাইদ নিঃশব্দে হাসল। পরক্ষণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে চোখে জল এসে পড়েছে।

” একটা কথা কী জানো জুঁই? তোমরা আমাদের উপহাসেরও যোগ্য না। যাদের শিক্ষা নিয়ে তোমরা প্রশ্ন করো না, দিনশেষে তারাই তোমাদের জীবন সাজিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ”

নোবাইদ আর দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। পেছনে ছেড়ে গেল জুঁই নাকি তার অপমান? জুঁই দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহকর্মীসহ মেয়েকে নিয়ে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্য পা বাড়াল।

—————————–

হৃদয় ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে ছিলো। জুমা তাকে জানানোর পরেও সে আসতে পারেনি। হুট করে সব ছেড়ে আসা যায় না। সবকিছু গুছিয়ে সে এসেছে দুদিন পর। প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে উৎসুক হয়ে বাড়ি ফিরে সে হতাশ হয়েছে। নিহান বাসায় নেই। জরুরি কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেছে। হৃদয় কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। সে নিজেও বেরিয়ে পড়ল নিহানের খোঁজে। গন্তব্যহীন চলা। কিন্তু পথিমধ্যে তার গন্তব্য নিজেই তার কাছে ধরা দিলো। হৃদয় নিহানের দিকে তাকিয়ে বার কয়েক আশেপাশে তাকাল। জীবন তাকে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় কেন দাঁড় করায়? সর্বনাশা স্কুলের গলি আবার তার থেকে সবকিছু কেড়ে নিতে চাইছে? হৃদয় এগিয়ে গেল। ফুচকার স্টলে বসে, নিহান আবির ফুচকা খাচ্ছিল। নিহান হৃদয়কে দেখেও যেন দেখল না। হৃদয়ের ভেতরের দাবানল আরেকটু আশকারা পেল।

” এখানে কী করছো? ”

নিহান আবিরের সাথে কথা বলছে। ফাঁকে ফাঁকে ফুচকা খাচ্ছে। হৃদয়ের কথা আদৌ সে শুনতে পেয়েছে কি না সন্দেহ!
হৃদয় প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বলল,
” আমি কিছু বলেছি। ”

” শ্রবণ ইন্দ্রিয় থাকার বদৌলতে আমিও শুনেছি। তবে আপনার বোধহয় দর্শন ইন্দ্রিয় নেই। ”

হৃদয় নিঃশব্দে নিহানের হাত ধরে তাকে দাঁড় করাল। সামনে পা বাড়াল। পরমুহূর্তেই নিহান নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।

” জোর করার অধিকারটা আপনার নেই। স্পর্শ করাটা বেয়াদবি। ”

হৃদয় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মানুষটা নিজের জেনেও যখন তার উপর অধিকার থাকে না, তখনই হয় নিকৃষ্ট যন্ত্রণা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here