তুমিময় আমি,পর্ব:১৮

0
522

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৮।

খালিপায়ে পিচঢালা রাস্তার উপরে আলতো পা ফেলে হাঁটছে নিহান। জুতোজোড়া হাতে। রাস্তার পিচ, রাতের শিশির, কুয়াশায় ঘেরা ল্যাম্পপোস্টের নিভু নিভু আলো। জীবনের গ্লানি মেনে নিতে এইটুকু প্রকৃতির সঙ্গই বোধহয় যথেষ্ট। নিহানের চোখ মুখে মুগ্ধতা। চোখ কুচকে, ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে। মাঝে মাঝে রাস্তার উপরেই খালি পায়ে লাফাচ্ছে। আবির মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দিকে। নিহানের দেখাদেখি তার জুতোজোড়াও হাতে। আজ প্রথম দেখেনি তাকে এভাবে। আত্মীয়তার সুবাধে ছোটবেলা থেকেই নিহানের এসব পাগলামির সাক্ষী সে। বিদেশের মাটিতেও অজস্রবার তাকে এইরূপে দেখে এসেছে। শত রূপে শত বার তার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু তাও প্রতিবার তার চোখ মুখে চিক চিক করে মুগ্ধতা। তার প্রতিটা জিনিস প্রতিবারই সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অবলোকন করে। মেয়েটাকে এইরূপে দেখে কেউ বুঝবেনা তার কথার ধাচ ঠিক কতোটা ধারালো। ভালোবাসা কী না বুঝেই এই মেয়েটার সঙ্গ চেয়েছে সে। ভালোবাসা বুঝতে শেখার পর আরো বেশি চেয়েছে। কিন্তু তার ঝুলির ভালোবাসা মানুষটাকে উৎস্বর্গ করার পূর্বেই সে অন্যকারো রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছিল। তখনো হাসি মুখে তার খুশির প্রার্থনা করেছে। ভালোবাসা ভালো থাকলে, জীবন অনায়াসে সামলে যায়।কিন্তু জীবন তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। আর স্বর্ণ সুযোগ বার বার আসে না।

” ডাঃ আবির। ”

নিহানের ডাকে তার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে। নিহানের থেকে খানিকটা দূরত্ব দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। নিহানের ডাকে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পুনরায় দুজনে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করে। বিরামহীন পথচলা।

” কিছু বলার ছিলো নিহান। ”

” বলুন ডাঃ আবির। ”

” তুমি আমায় আবির নামেও সম্বোধন করতে পারো। ”

” আম নট ইন্টারেস্টেড। ”

ডাঃ আবির নিঃশব্দে হাসল। কতশতবার একই কথা শুনেছে সে। তবু শুনতে ভালো লাগে। বিরক্তি আসে না। মানুষটা যখন অতীব পছন্দের, তখন তার সবই ভালোলাগে। পরক্ষণেই নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল,

” আমি তোমার জীবনে থাকতে চাই নিহান। ”

নিহান ফিরে তাকায়। সরোচ দৃষ্টিতে আবিরের আদলে চোখ ভুলায়। নিহানের উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে সে। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে সামনে পা বাড়ায়।

” এখন কি আকাশে আছেন? ”

” নিহান, তুমি অবুঝ নও। ”

” অবুঝতো আপনিও নন। ”

” তুমি কি এখনো হৃদয়ের জীবনে ফিরতে চাও? ”

” তার জীবনে ফিরতে চাই কি না সিদ্ধান্তটা পরের। কিন্তু আপনার জীবন যেতে চাই না, এটা নিশ্চিত। ”

” কেন নিহান? ”

” সচরাচর আমার ব্যক্তিগত জীবন কিংবা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমি কাউকে জানাতে পছন্দ করি না ডাঃ আবির। সে আমার জীবনে নেই বলে কিংবা সে অন্যকারো প্রিয়তম বলে, আমি নিজেকে অন্যকারো সাথে জড়িয়ে ফেলব? এমন ভালোবাসতে আমি শিখিনি ডাঃ আবির। ভালোবাসা প্রথম পরিবার থেকে শেখায়। আর পারিবারিক ভালোবাসায় স্বার্থ থাকে না। স্বার্থ থাকলে একজন মা এত কষ্ট, নিজের সৌন্দর্যের বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতো না। ”

” তাই বলে এই অপূর্ণ অতীত নিয়ে পড়ে থাকা বোকামি নয়? ”

” ভুল বললেন ডাঃ আবির। পরিস্থিতি অতীত হয়, ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা কখনো পুরনো হয় না। ভালোবাসা অপূর্ণও হয় না। ”

” তোমার ব্যাখিত এই ভালোবাসা হাজারো প্রাণ নাশের কারণ। ”

” মৃত্যু এই অস্থায়ী পৃথিবীর চিরন্তন সত্য। হায়াত ফুরালে মালাকুল মউত আসবেই। নিজ কর্ম দোষে কেউ নিজের আয়ু কমিয়ে নিলে এতে কার কি করার থাকতে পারে? এই যে আজকাল চারদিকে এত অপ্রাপ্তির আহাজারি, এতো চাওয়ার। ভালোবাসারতো নয়। মানুষ এখন দু’দলে বিভক্ত। কেউ বলছে এসব অসময়ের ভালোবাসায় জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে আবার কেউ বলছে জীবন গড়ে দিচ্ছে। প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা সাজিয়ে যায়, অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তিতে মেলায়। নিজেকে চিনতে শেখায়।
তবে আজকাল ভালোবাসা নামক প্রেম প্রেম খেলাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রথমে সবটুকু আবেগ ঠেলে দেয়, তার সামনে বাবা- মাকেও ক্ষুদ্র মনে হয়। অতি তাড়াতাড়ি সে আবেগ ফুরিয়ে যায়। আবেগ শেষ, বিচ্ছেদ। সম্পর্ক শেষ।
ভালোবাসার মানুষকে সবাই চায়। তাই বলে না পেলে মরে যেতে হবে কিংবা জীবন এলোমেলো করে ফেলতে হবে এটাতো নয়। তার অপ্রাপ্তিতে কষ্ট হয় ভীষণ। তিমিরের মাঝে কলিজা ছিঁড়ে কেউ নৃত্য করে। আহত জখমে মরিচ ছেটানোর মত জ্বালা। তাই বলেকি গহীন অন্ধকার শেষে ভোর আসে না? সময় ঠিকই জখমে মলম হয়। শুধু প্রয়োজন একটু ধৈর্য, একটু আত্মবিশ্বাস। মানুষটা হারিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসাতো হারিয়ে যায়নি। ভালোবাসাকে দুর্বলতা নয়, শক্তি করে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আত্ম উন্নয়ন এবং নিজের আপনজনদের উন্নয়নে কাজ করা উচিত। আপনাকেই ভাবুন। ভালোতো আমায় সে কবে থেকেই বাসেন। তাই বলে কি আমার অপ্রাপ্তিতে বাঁচতে ভুলে গেছেন? সে তোমার আত্মার অংশ ছিলো না তাতে কি! ভালোবাসাতো ছিলো। সে ভালোবাসা তোমারি আছে এবং তোমারি থাকবে। তারপর একসময় তোমার আত্মার অংশ ঠিকই তোমার কাছে ধরা দেবে। তাকে তুমি আগের মানুষটার জায়গায় বসাতে পারবে না। কেউ তোমাকে বসাতেও বলেনি। সে নিজ মহিমায় অতি সন্তপর্ণে তোমার অন্তরে জায়গা করে নেবে। কারণ কেউ কারো মত হয় না। সকলের জায়গাটা ভিন্ন। ”

আবির অধৈর্য হয়ে বলল,
” তাহলে আমায় কেন তোমার করে নিচ্ছো না। ”

” ঐ যে বললাম। আমি আপনাকে চাই না। ”

আবির হতাশ। প্রথমবারের ব্যর্থতা সহজে সয়ে গেলেও বার বার হাতের নাগাল থেকেই বেরিয়ে যাওয়া সুযোগ মেনে নিতে কষ্ট হয়। প্রচন্ড কষ্ট হয়।

—————————–

জুঁইয়ের সামনে বসে আছে আবির নিহান। পাশেই নির্মলতা খুব মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছে। এই মুহুর্তে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর তার কাছে নেই। রাউজানের একটা ছোট একতলা বাসায় মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকে সে। পরিবারের উপর বোঝা হয়ে থাকা তাকে মানায় না। খুব একটা যোগাযোগ করে না সে। অভিমানে নাকি লজ্জায়? নাকি দুটোই? বিষয়টা পরিষ্কার নয়।

” নিহান, আবারো কেন এসেছো? তোমার ক্লান্ত লাগে না? এত এত অপমান তোমার গায়ে লাগে না? ”

নিহান নিঃশব্দে হাসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে নির্মলতার গালে একটা ছোট চুমু এঁকে দিলো। নির্মলতা মাথা তুলে তাকে দেখে চোখ মিট মিট করে একগাল হাসলো। পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে পড়ল। জুঁই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকিয়ে। নিহান পুনরায় নিজের স্থানে এসে বসল।

” তোমার মনে হয় না আপুই নির্মলতার একটা পরিবার প্রয়োজন? তারও সকলের ভালোবাসায় বড় হওয়ার অধিকার আছে? ”

” নির্মলতার কাউকে প্রয়োজন নেই। তার জন্য তার মা একাই যথেষ্ট। ”

” এখন সে অবুঝ বলে তুমি তা বলছো। কিন্তু যখন সে বুঝতে শিখবে, তোমায় প্রশ্ন করবে। কেন তার একটা পরিবার নেই? তখন কী বলবে? ”

” বলারতো কিছু নেই। কত অনাথ বাচ্চাইতো পরিবার ছাড়া বড় হয়। সেখানে ওরতো তাও মা আছে। এটাই যথেষ্ট নয়? ”

” না যথেষ্ট নয়। তুমি সিঙ্গেল মাদার হতে চাইছো। হতেও পারবে। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছো, নির্মলতার উপর কী প্রভাব পড়বে? এই সমাজ তাকে ছেড়ে দেবে না। আজ সে ছোট। একসময় বড় হবে। বিয়ে দেবে। তখন বার বার তাকে পিতৃ পরিচয়হীন বলেই সম্বোধন করবে। ”

” সমাজ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। কে এই সমাজ? যখন দিনের পর দিন নিজের বৈধ স্বামী আমায় মানসিকভাবে নির্যাতন করেছিলো তখন কোথায় ছিলো এই সমাজ? স্বামী পর নারীতে আসক্ত জেনে রাতের পর রাত গুমরে গুরমে মরেছি, কোথায় ছিলো এই সমাজ? নিজের স্বামীকে অন্যকারো সাথে দেখার যন্ত্রণা বুঝে এই সমাজ? সমাজতো শুধু আঙুল তুলতে জানে। না জেনে অপবাদ দিতে জানে। আর ভিক্টিম মেয়ে হলেতো কথাই নেই। ”

” সমাজের সবার কথা ভেবে যেমন চলা যায় না। তেমনি সমাজ ছাড়াও চলা যায় না। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের উর্ধ্বে নয়। আমরা জীবনটা যতোটা সহজ ভাবি জীবন ততোটা সহজ নয়। আবার কঠিন কিছুও নয়। তোমরা বাঁচবে, নির্মলতাও বাঁচবে। কিন্তু বাঁচার সুযোগটা যেখানে ভালোভাবে পাচ্ছে সেখানে বাঁচবে না? ”

” আমি এতকিছু বুঝতে চাই না। তুমি বেরিয়ে যাও। ”

নিহান নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ। আবিরও উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। নিহান না থাকলে এদের ভাই বোনেকে সে দেখে নিতো। ম্যানারলেস!

” তুমি যে ভয় পাচ্ছ তা অযথাই। আমার পরিবার তোমার উপর আঙুল তুলবে না। বরং নির্মলতাকে পেয়ে খুশিই হবে। আর আমার ভাই তোমায় ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে। আর আমার মা আমাদের যেমন ভালোবাসতে শিখিয়েছে, তেমন আগলে রাখতেও শিখিয়েছে। ”

জুঁই অবাক দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকিয়ে। চোখ উপচে কিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে। খুশি? নাকি করুণা? নিহান আর দাঁড়ায় না। হাসিমুখেই ঘর ত্যাগ করে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here