তুমিময় আমি,পর্ব:১০

0
510

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১০।

ফ্লোরে লাফালাফি করছে হলুদ বর্ণের দুটো ভিন দেশি মাছ। অ্যাকোরিয়ামের ভাঙা অংশ সারা ঘরময় ছড়িয়ে। পানিতে ফ্লোর চপ চপ। বুকের উপর গিটার, বাম হাতের মুঠোয় ঘড়ি আকড়ে রেখে ফ্লোরে পড়ে আছে হৃদয়। ডান হাতের পাতায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। চোখের পাতা বন্ধ। জেগে আছে না ঘুমিয়ে বুঝা যাচ্ছে না। আপাতত দৃষ্টিতে অজ্ঞান বলেই মনে হচ্ছে। চারদিকের উজ্জ্বল আলো জানান দিচ্ছে সকালের। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল জুমা। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে ঠুকরে কেঁদে উঠল। পাশে বসে বাহুতে হাত রাখতেই হৃদয় চোখ মেলে তাকাল। গাঢ় বাদামি রঙের চোখজোড়া বেদনায় লাল হয়ে আছে। কান্নারত কন্ঠে বলল,

” ভাবীকে আমি কখনো ক্ষমা করব না, ভাইয়া। কখনো না। ”

হৃদয় উঠে বসল। কান্নারত জুমাকে আলতোভাবে আলিঙ্গন করে নিলো।
” এভাবে বলতে নেই। এসবের জন্য আমি নিজেই দায়ী। আমি পাখি পোষ মানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বনের পাখি যে পোষ মানে না। ”

” এবারে আর কত ভাইয়া? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ, কী অবস্থা করেছ নিজের? ”

” ওর কী একবার জানতে ইচ্ছে করে না ? আমার হাস ফাঁস লাগে। দম বন্ধ লাগে। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। সবকিছু কেমন নিরেট অন্ধকারে তলিয়ে আছে। কোথাও একটু আলোর চিহ্ন নেই। আমি মরে যাচ্ছি, শেষ হয়ে যাচ্ছি। ওর কি একবার ফিরে তাকানোর ইচ্ছে জাগে না? ”

” সবকিছুতো ঠিক ছিল। তাহলে এমন কেন হলো, ভাইয়া? ”

” আমি জীবনটাকে কখনো এমন ভাবিনি। ভাবিনি বলেই এমন হল, ভাবলে হতো না। কারণ মানুষ যা ভাবে তা হয় না।
আমি সবসময় ওকে আহ্লাদী বলে বেড়িয়েছে অথচ, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখিনি। ওর মতোই আহ্লাদে বড় হয়েছি আমি। জীবনে দুঃখের ছোঁয়াটুকু লাগতে দেয়নি কেউ। তাইতো ও আমায় দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেল। বাবা- মায়ের উচিত ছিল ছোটবেলা থেকে কষ্ট দিয়ে আমায় বড় করা। তাহলে হয়তো আজকের এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার থাকত। ওকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। ও কি বুঝেনা? একটু কি করুণাও হয়না আমার প্রতি। ছেড়ে যাবার হলে ভালোবাসায় কেন বাঁধল? ”

” ভুলে কেন যাচ্ছ না ভাইয়া? ”

” চাইলেই কি ভুলা যায়? মাঝ সমুদ্রের নাবিক আমি আর ও আমার সেই জাহাজ, যা ছাড়া আমার কখনো তীরে ওঠা হবে না। আমি নিজেকে তো ভুলতে পারি কিন্তু ওকে নয়। ”

বাম হাতে চোখের কোণা মুছে দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল হৃদয়। ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ওকে বেরুতে হবে। জুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। কাজের লোক ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করতে বলল। গত পাঁচ বছর ধরে এমনই চলে আসছে। আজ হৃদয়ের জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে কেউ শুভেচ্ছা জানালেই ভাংচুর শুরু করে। পরিবারের সবাই সে ভয়ে ভুল করেও তাকে তার জন্মদিনের কথা স্মরণ করায় না। কিন্তু বাইরের মানুষদের তো আটকানো যায় না।

হৃদয় দেয়ালে টানানো বড় ছবিটার দিকে তাকিয়ে। কী সুন্দর হাসি! হৃদয় ডান হাতের দু আঙুলে ছবিটার উপর হাত বুলায়।

” তুমিতো চলে গেছে, তাহলে স্মৃতি কেন নিলে না? এই স্মৃতি আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছে না। ”

হালকা হেসে হৃদয় হাতের পাঁচ আঙুলই ছবিতার উপর রাখল। রাশভারি কন্ঠে বলল,

” তুমি আমার খোলা অলিন্দ, ছেড়ে গেছো আমায়।
হৃদয়ে ভুল বুঝাবুঝির ব্যথাতুর কাঁপন।
ঘোলাটে ধোঁয়া, তামাটে আমি, বদ্ধ ঘর আমার এখন। ”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ব্লেজার হাতে নিয়েই হৃদয় বেরিয়ে গেল। তার বিশেষ জায়গায় যাওয়ার আছে। জুমা পেছন থেকে বার বার ডাকলেও সাড়া দিলো না।

——————————-

হৃদয় বসে আছে নোমানের কেভিনে। নোমান মিটিংয়ে ব্যস্ত। খানিকবাদেই কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে নোমান। হৃদয়কে দেখেই ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” তুমি এখানে কী করছো? ”

হৃদয় হালকা হেসে উঠে দাঁড়ায়। হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করে,

” কেমন আছেন, ভাইয়া? ”

নোমান নিঃশব্দে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। হালকা হেসেই চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।

” আমি কেমন আছি তা জানতে নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম থেকে ১৬৭ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে কুমিল্লা আসোনি! ”

হৃদয়ও হালকা হেসে কেভিনে রাখা অতিরিক্ত সোফায় বসে পড়ল।

” আমি কেন এসেছি কারণটা আপনার অজানা নয়। ”

” উত্তরটাও তোমার অজানা নয়। ”

” আর কত ভাইয়া? সবাই বিশ্বাস করলেও আমি এটা বিশ্বাস করি না জান কোথায় আছে তা আপনি জানেন না? ”

” সে তোমার ব্যাপার। তোমার বিশ্বাস- অবিশ্বাসের উপর তো আমার জোর নেই। ”

” প্লিজ ভাইয়া বলুন না জান কোথায়? ”

” আমি তোমাকে এর পূর্বেও বহুবার বলেছি, আমি জানি না। জানলে, তোমার না জানালেও নিশ্চয়ই নিজের পরিবারের কাছে গোপন করতাম না। ”

” আপনার দ্বারা সবাই সম্ভব ভাইয়া। নিজের বোনের জন্য সবই করতে পারেন আপনি। ”

নোমান সশব্দে উঠে দাঁড়াল। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল,

” জানো যখন জিজ্ঞেস করছো কেন? তোমার কী মনে হয়, তোমার এই অসহায় ফেস দেখে আমি সব ভুলে যাব? ভুলে যাব, কীভাবে তোমার প্রতারণার স্বীকার হয়ে দিনের পর দিন কষ্ট পেয়েছে আমার বাবুই?
যেদিন প্রথম আমায় কল করে বলেছিল, ‘ তোমার আহ্লাদী বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে ভাইয়া। একা থাকতে শিখে গেছে। জনশূন্য বাড়িতে সে একা থাকতে পারে। ‘ সাথে তার ফোফানোর শব্দ। এপাশ থেকে আমার তখন কেমন লাগছিলো তুমি জানো? ইচ্ছে করছিলো সব ছেড়ে ছুড়ে তার কাছে চলে যাই। বুকে আকড়ে ধরে বলি,
‘ কিছু হয়নি বাচ্চাটা, ভাইয়া আছে তোর পাশে। ‘ কিন্তু সেদিন আমার ইচ্ছেটাকে কবর দিয়েছিলো, কুমিল্লা চট্টগ্রামের মাইল কয়েকয়ের দূরত্ব। ”

” আমি বার বার ক্ষমা চেয়েছি ভাইয়া। ”

” তোমার ক্ষমা চাওয়াতে আমার বাচ্চাটা ফিরে আসবে না। পারবে তার বিসর্জনকৃত অশ্রু ফিরিয়ে দিতে? পারবে সেই অন্ধকার সময়গুলো মুছে ফেলতে? জানি পারবে না। আর আমার কাছেও কিছু পাবে না। তাই এখানে তোমার সময় নষ্ট না করে, এসো। ”

” ভাইয়া, পুরনো অতীত আমি মুছে ফেলতে পারব না। কিন্তু নতুন করেতো সব সাজাতে পারি? ”

” তোমার উপর দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করার মত বোকামি আমি আর করব না। তুমি নিজে বেরুবে, নাকি আমি সিকিউরিটি ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব? ”

হৃদয় দীর্ঘশ্বাস টেনে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। কিছু জানা, অজানা ভুল সবার জীবন কেমন এলোমেলো করে রেখে গেছে।

—————————–

নোমান রেস্টুরেন্টের কাচের টেবিলে সামনে আয়েশ করে বসে আছে। সামনে বসেই জুমা রাগে ফুসছে।

” তুমি কেন বলছো না জান ভাবী কোথায় আছে? ”

” আমি জানি না। ”

” আমি জানি তুমি জানো। বল কোথায় আছে? ”

” আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমি জানি না। ”

” আমি বিশ্বাস করি না। তুমি জানো, ইচ্ছে করে বলছে না। ”

” তোমাদের এই দুই ভাই বোনের বিশ্বাস নিয়ে আমি কী করি বলোতো? একটু আগে তোমার ভাইও একই গীতা পাঠ করে গেল। শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে আমার। ”

নোমানের গলায় বিদ্রুপ।

” তোমার বোনের ন্যাকামির জন্য কতগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে তুমি বুঝতে পারছো না? ”

” জুমা মুখ সামলে। ”

” কেন? তোমার বোন বোন, আমার ভাই কিছু না? তার কষ্ট কারো নজরে পড়ছে না?
জুমা থামল। লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
দেখো নোমান, শেষবার জিজ্ঞেস করছি, ভাবী কোথায়? ”

” আমি জানি না। ”

” নোমান তুমি না বললে, আমি এখানেই আমাদের সবকিছু শেষ করতে বাধ্য হব। ”

” কী বললে? ”

” আমি এমন কারো সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না, যে স্বইচ্ছায় আমার পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছে। ”

” তাহলে তুমি আসতে পারো। ”

” নোমান! ”

” আমি আগেও বহুবার বলেছি, আমার বাচ্চাটার বিরুদ্ধে যে একটা শব্দ উচ্চরণ করবে, তার আমার জীবনে থাকার কোনো অধিকার নেই। ”

জুমা ছলছল নয়নে ওঠে দাঁড়াল। টেবিলের উপর থেকে নিজের পার্স, মোবাইল তুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। নোমান এক দৃষ্টিতে জুমার গমন পথে তাকিয়ে। জুমা চলে যাওয়ার পর সে ও উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বলে উঠল,

” তোমরা ভাই-বোন সব একরকম জুমা। অন্যরা বিষ, স্বার্থ নিজ নিজ। ”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here