ঢেউয়ের স্রোতে নিবিড় পর্ব ৩

0
1217

#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৩

সকালে কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙে নিবিড়ের। ফজরের আজান পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। সকালের এই সময়টাতে ঠান্ডা ঠান্ডা আবহ থাকে। নিজের মাঝে উষ্ণতা অনুভব করে সে। কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। পাশ ফিরেই ঊর্মির ঘুমন্ত মুখখানা দেখে৷ মানুষ ঘুমিয়ে থাকলে সবচেয়ে বেশি নিস্পাপ মনে হয়। তখন গম্ভীর, রাগী, চঞ্চলতার কোনো ভেদাভেদ থাকে না। এই মুহুর্তে ঊর্মির মুখটা দেখে কেউই বলবে না যে, এই মেয়ের মাঝে বিশাল চঞ্চলতার পাহার৷ নিবিড় তার দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় কারণ সে খুব এলোমেলো ভাবে জাপ্টে ধরেছে তাকে৷ নিবিড় তার হাতে স্পর্শ করে ডাকতে থাকে। বারকয়েক ডাকার পর ঊর্মি তার দিকে আরও জড়োসড়ো হয়ে আসে৷ নিবিড় তাকে বলে….

–এই মেয়ে উঠো!

ঊর্মি এখনো ঘুমোচ্ছে। সে স্বপ্নে দেখছে “সময়টা শীতের। ভারী সোয়েটার পড়ে সে নিবিড়ের ক্লাসে বসে আছে। সামনে মাসেই এক্সাম শুরু হয়ে যাবে। সবাই খুব মনোযোগ দিচ্ছে ক্লাসে। এক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ দিতে গেলে ঊর্মির বেশ ঘুম পায়। সে বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। এরই মাঝে নিবিড় সামনে এসে দাঁড়ায় আর রিয়া তাকে ক্রমাগত ডাকতে শুরু করে” পাশেই শুয়ে থেকে নিবিড় ঊর্মিকে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে ডাকতে থাকে…..

–উঠছো না কেন?
–রিয়া! প্লিজ ডাকিস না তো। এই ক্লাসটা করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।

ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে কথাটা বলে ঊর্মি। নিবিড় তাকে নিজের বক্ষঃস্থল থেকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে সরে এসে বলে….

–এটা তোমার ক্লাস রুম না। এটা আমাদের ঘর। এখন ওঠো ঘুম থেকে। আজ থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে।

নিবিড়ের কথা শুনে নিমিষেই ঘুম গুলো যেন উবে যায়। লম্বা হাই তুলে উঠে বসে। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে সালোয়ার কামিজের যা তা অবস্থা। এলোমেলো হয়ে রয়েছে। লজ্জায় তার মাথা কা’টা যাচ্ছে৷ এটা তার সারাজীবনের অভ্যেস ঘুমোলে তার কোনো কিছুই ঠিক হয়ে থাকে না। ঘুমের মাঝে কোলবালিশ যে কোথায় ফেলে দেয় অন্ধকারে তা হাতড়েও খুঁজে পায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে হয় অবহেলায় কোলবালিশটি মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিছানার চাদর ফ্লোরের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ করছে। নিবিড়ের কথা মনে হতেই তড়িৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসে। সে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ একেবারে ওজু করে আসে। এতোক্ষণে নিবিড় রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। ফজরের নামাজটা পড়ে জায়নামাজটাকে চেয়ারের উপর রেখে দিয়ে সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চুলটা বেধে নেয়। সেই মুহুর্তে নিবিড় নামাজ পড়ে ঘরে আসে। সকালের বিছানা এখনো আগের মতো পড়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলটা উপর থাকার সমস্ত কিছু এদিকসেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঊর্মির কালকের পড়া শাড়িটা পড়ে আছে সোফার উপর। সে মাথায় হাত রেখে বলে….

–তুমি বড্ড অগোছালো।
–আমার বাড়ির লোকও তাই বলে।

ওড়নাটা হাতের আঙ্গুলে সাথে পেচিয়ে কথাটা বললো ঊর্মি। নিবিড় তার রুমটাকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঊর্মি গালে হাত দিয়ে তা দেখছে। নিজের ঘরটা সবসময়ই অগোছালো হয়ে থাকতো। এতেই যেন তার ভালো লাগতো। গুছিয়ে রাখা বিছানা যেন সে বসলেই এলোমেলো হয়ে যেতো। নিবিড় শাড়িটাও খুব সুন্দর ভাবে ভাজ করে আলমারিতে রেখে দেয়। ঊর্মির হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসায় এবং সে দাঁড়িয়ে থেকে বলে….

–একটু একটু করে গুছিয়ে রাখবে ঘরটাকে। এটা শুধু আমার ঘর তা কিন্তু নয় এটা তোমারও ঘর। আমি জানি তুমি রান্না করতে পারো না তবে মায়ের কাছে থেকে রান্না শিখে নিতে পারো। মাঝে মাঝে নিজের হাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়াতে পারো। সবাই খুশিই হবে। হাতে হাতে মা আর ছোট মা’কে সাহায্য করবে। আগে যেভাবে চলাফেরা করেছো কোনো ম্যাটার না তবে এখন তুমি আমার স্ত্রী। কোথাও বের হলে বোরকা নেকাব পড়ে বের হবে৷ আমি চাই না আমার স্ত্রীর উপর অন্য কারো দৃষ্টি পড়ুক। আর হ্যাঁ পড়ালেখা নিয়ে কোনো অনিহা যেন না থাকে৷ বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে যে আর পড়ালেখা করা লাগবে এমন চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। মনে থাকবে কথা গুলো?
–জ..জ্বি স্যার!

শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে ঘর থেকে বের হয় ঊর্মি। বসার ঘরে জমজ মেয়ে দুটো একসঙ্গে খেলছে। খেলার মাঝেই দুজনে কিছু একটা নিজের ঝগড়া করতে শুরু করে দেয়৷ ঊর্মি তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ওদের থামায় এবং ওদের দুজনের নাম জিজ্ঞেস করে। বড় জনের নাম পূর্নতা আর ছোট জনের নাম পুষ্পিতা। সবাই ওদের পূর্ণ আর পুষ্প বলেই ডাকে৷ মেয়ে দুটো ভারী মিষ্টি আর গোলুমোলু। ঊর্মি জমজ দুটোর গাল টেনে দেয়। পূর্ন তাকে বলে….

–জানো ভাবীমণি পুষ্প কিছুক্ষণ আগে খেলায় আমার সাথে চিটিং করেছে।
–মোটেও আমি চিটিং করিনি৷ তুই করেছিস।
–তুই করেছিস।
–আচ্ছা আচ্ছা কেউই চিটিং করে নি। চলো দুজনে নাস্তা করবে৷

রান্না ঘরে নিবিড়ে মা আর ছোট মা নাস্তা তৈরি করছেন। ঊর্মি মাথায় ঘোমটা রেখেই উনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখে নাজিয়া মাহমুদ একটা মুচকি হাসি দেন। ঊর্মিকে উনি বড্ড পছন্দ করেন। নিবিড়ের ছোট আব্বু যখন ঊর্মির ছবিটা এনে উনাকে দেখিয়েছিলেন, তিনি এক দেখায় মাশাআল্লাহ বলে তাকেই ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছেন। বাড়ির সকলেরও বেশ ভালোই লাগে ঊর্মিকে৷ আয়শা মাহমুদ রুটি বেলছেন আর নাজিয়া মাহমুদ অন্য কাজ গুলো করছেন। ঊর্মি তাদেরকে কাজে সাহায্য করতে চাইলে তারা তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। তাকে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে বলে। এরপর সবাই একসাথেই নাস্তা করে নেয়। এখানেও পূর্ণ আর পুষ্প খাবার নিয়ে লড়াই করছে। এ বলছে তার নুডলস মজা হয়েছে তো ও বলছে তার স্যুপ মজা হয়েছে। আয়শা মাহমুদ চোখ রাঙিয়ে ওদের দুটোর দিকে তাকান। দুটোতে খুব ভয় পায় তাদের মা’কে। চুপচাপ নিজেদের নাস্তা টুকু খেয়ে নেয়। তারপর তিনি ওদেরকে ওদের ঘরে নিয়ে গিয়ে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দেন। নিবিড় খাবার টেবিলে সবার উদ্দেশ্যে করে তার আর ঊর্মির ভার্সিটি যাবার কথাটা বলে। এতে কারোর কোনো আপত্তি নেয়। সবাই তার কথাতে সায় দেয়। যেহেতু নিবিড় ভার্সিটি থেকে কোনো ছুটি নেয়নি তাই আজও তাকে তার কাজে যেতে হবে। সে ঊর্মিকে বলেছে বোরকা পড়ে রেডি হয়ে নিতে। সেও তার কথা মতো ঘরে এসে রেডি হয় তবে তার তো কোনো বোরকা নেই সে কি পড়বে! সে এখনো আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে। নিবিড় দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েই বলে….

–আলমারিতে তোমার জন্য নতুন বোরকা তুলে রাখা আছে।

নিবিড় ভার্সিটি যাবার জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে। রোজকার মতোই সে ফরমাল ড্রেসআপে আছে। ঊর্মি একবার আড়চোখে তাকে দেখে নেয়। নিবিড় তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে বলে চলে যায়। ঊর্মি আলমারি থেকে বোরকাটা নিয়ে পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। নিবিড়ের সাথে ভার্সিটি যাবে ভাবতেই তার মন খুশিতে নেচে ওঠে। তবে সকালে ঘটনাটা মনে পড়তেই লজ্জারা যেন জেঁকে বসে। সে যে নিবিড়কে জাপ্টে ধরেছিলো সেটা তার ভালোই মনে আছে। তবে তখন যদি সে জেগে যেত তাহলে ভারী লজ্জায় পড়তে হতো তাই সে ইচ্ছে করেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বেরিয়ে আসে। বাইকের পেছনে বসে নিবিড়ের কাধে হাত দিয়ে রেখেছে। নিবিড় খুব সাবধানেই বাইক চালাচ্ছে। ঊর্মি শুধু এটাই ভাবছে তাকে আর নিবিড়কে একসাথে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকতে দেখতে বন্ধুমহলে কি বি’স্ফো’র’ণটাই না হবে। তবে তার কিছুই করার নেই। লুকোচুরি করে তো আর সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।

চলবে?……..

আসসালামু আলাইকুম। আজকে এক্সাম নামক ঝামেলা শেষ হতে যাচ্ছে। সবাই গল্পটা পড়ে নিজের মূল্যবান মন্তব্যটি দেবেন আশাকরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here