ঢেউয়ের স্রোতে নিবিড় পর্ব ৮

0
898

#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৮

রিয়া আর নির্ঝর পাশাপাশিই বসে আছে। বর বউ সাজে দুজনকে বেশ ভালোই মানিয়েছে। ঘরোয়া ভাবেই রিয়া আর নির্ঝরের বিয়েটা হয়েছে। এই বিয়েতে দুটো পরিবারই বেশ খুশি। ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হলেও নির্ঝরের মা আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেননি। আত্মীয়স্বজন বলতে উনাদের তেমন কেউ নেই। নির্ঝরের সব বন্ধুদের পরিবার সব তিনি আমন্ত্রণ করেছেন৷ ঊর্মি নির্ঝরের ভাবীর সাথে কথা বলছে। মেয়েটা বেশ মিশুক। মুখে তার অমায়িক হাসি লেগে আছে। ঊর্মির আর রিয়ার থেকে বড়জোর দুই তিন বছরের বড় হবে। এর আগেও একবার রিয়া, শাওন, ঊর্মি আর রাহাত এসেছিলো নির্ঝরদের বাসায়। তখন নির্ঝরের ভাবী তার বাপের বাড়ি ছিলো৷ তাই আজই তাদের প্রথম দেখা হলো৷ সবাইকে একসঙ্গেই খাবারের টেবিলে বসিয়ে দেওয়া হয়। খাবার খাওয়া শেষে নিবিড় ঊর্মিকে ডাক দিতেই সে তার কাছে যায়। তাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো। নিবিড় একটা প্যাকেট তার হাতে ধরিয়ে দেয়। রাহাত আর শাওন একটা বড় বক্স হাতে নিয়ে রিয়া আর নির্ঝরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ওদের হাতে তুলে দেবার প্রহর গুনছে। রাহাত আর শাওন বক্স হাতে নিয়ে মিটমিট করে হাসছে, দূর থেকে ঊর্মি তা দাঁড়িয়ে দেখছে। সবার সামনেই রাহাত সেই বক্সটা রিয়ার হাতে তুলে দেয়। ঊর্মি একবার নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওদের কাছে যায়। শাওন রিয়াকে বলছে এক্ষুনি বক্সটা খুলে দেখতে। ঊর্মিও ওদের সাথেই তাল মেলায়। রিয়া বেচারি সরল মনে বক্সটা খুলে।

গিফট দেখে নির্ঝরের মাথায় হাত। ঊর্মির তো হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবার উপক্রম। ভাগ্যিস তার বিয়েতে এই বিচ্ছুর দল ছিলো না। তা নাহলে কি পচানি-টাই না দিতো, যেটা এখন রিয়া আর নির্ঝরকে দিয়েছে৷ তখন ঊর্মির কথায় রিয়া সকলের সামনে সোনালী কাগজে মোড়ানো বক্সটা খুলেছিলো৷ ভেতরে এত্তো এত্তো জিনিস একত্রে রেখে দেওয়া আছে। রিয়া একটা একটা করে জিনিস গুলো বের করে। শাওন সামনেই দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে। নির্ঝর বারবার দুটোর দিকে চোখ রাঙাচ্ছে। ঊর্মি বেশ এনজয় করছে ব্যাপারটা। সেও তাল মিলিয়ে শাওনকে বলে “সুন্দর ভাবে ভিডিও কর শাওইন্না” ওদের কথাবার্তার মাঝেই নির্ঝরের ভাই ভাবীও ওদের পাশেই এসে দাঁড়ায়। শাওন আর রাহাতের দেওয়া ঐতিহাসিক উপহার গুলো একে একে বের করে রিয়া। প্রথমত ফিডার, বাচ্চাদের তোয়ালে, বেবি সু, ডাল ঘুটনি, খুন্তি। তারপর আরও দুটো প্যাকেট বের করে সেখান থেকে। প্যাকেটের ভেতর নির্ঝর আর রিয়ার জন্য কাপল সেট শড়ি আর পাঞ্জাবি ছিলো। রিয়া যখন এগুলো খুলে বের করছিলো তখন বাকিরা মিটমিট করে হাসছিলো৷ রিয়া শাওন আর রাহাত দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে….

–তোদের মতো বিচ্ছু আমি আর দুটো দেখিনি!

রাহাত হাসতে হাসতে রিয়ার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলে….

–আমরা এক পিস করেই আছি শুধুমাত্র তোদের মতো দুটো সুন্দরী বান্ধুবীর জন্য। ঊর্মির বিয়েটা তো হুট করেই হয়ে গেলো তাই ভাবলাম তোর বিয়েতে একটু মজা-মাস্তি করি।
–তোরা দুই বান্ধুবী তো মিঙ্গেল হয়েই গেলি শুধুমাত্র আমরাই সিঙ্গেল রয়ে গেলাম।

শাওনের কথার প্রত্যুত্তরে ঊর্মি বলে…

–তোরা যা দুষ্টু। তোদের কপালে বউ আছে কি-না সন্দেহ।
–তবে যাই বলিস, একদিন আমিও কাউকে পটিয়ে ফেলবো। বলল রাহাত….
–তোরও কি রিয়ার মতো গিফট লাগবে?

শাওন কথাটা সবার সামনেই বলে ফেলেছে। নিবিড় ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে লেগে আছে অমলিন হাসি৷ ঊর্মি নিবিড়ের দিকে তাকাতেই কিছুটা লজ্জা পায়। নির্ঝরের ভাইয়া ভাবীও এখানেই আছে। সে শাওনকে বলে….

–বেয়াদব ছেলে তোর কপালে পেত্নী জুটবে।
–বান্ধুবী যখন বলেছে তবে তাই হোক।

এরপর ওরা নির্ঝরের ঘরটাকে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেয়। রিয়া আর নির্ঝরের জন্য আনা উপহারটা ঊর্মি নিজ হাতের তুলে দেয়। নিবিড়কে সঙ্গে নিয়ে সে নিজে পছন্দ করে কিনেছে। এরপর নির্ঝরকে তার ঘরে পাঠানো হয়। সে দরজা লক করে বিছানায় বসে থাকা তার বউয়ের দিকে তাকায়। এরই মাঝে রিয়া কখন তার শাড়ি পাল্টালো সেটাই ভাবছে সে। রিয়ার কাছে এসে তার হাতটা ধরতে চায় কিন্তু রিয়া হাতটা সরিয়ে নেয়। নির্ঝর ভাবে হয়তো রিয়া তার উপর অভিমান করে আছে। তাই সে বলে…..

–তোমাকে ওই অবস্থায় হসপিটালে দেখে জানো আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? আমার তো তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো যা আমি এখনো তোমাকে বলিনি। খুব ভালোবাসি তোমাকে আমি।
–আমিও যে তোমাকে খুব ভালোবাসি স্বামী।
–তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
–কেমন শোনাচ্ছে স্বামী?

বলেই রাহাত এই লম্বা ঘোমটা খানা তুলে নেয়। ঘরের মধ্যে রাহাতকে দেখে নির্ঝর একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে৷ যেন সে ভয়ংকর ভূত দেখে ফেলেছে। বুকে হাত দিয়ে রাহাত একপলক দেখে নেয় সে। ঘরের বাইরে থেকে হাসির রোল পড়ে গেছে। নির্ঝর বিছানা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে দরজাটা খুলে দেয়। রিয়া, ঊর্মি আর শাওন বাইরের দাঁড়িয়ে আছে। সাথে নিবিড়ও আছে। ওরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেও নিবিড় বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। যতই তারা তার শালা-শালী হোক তবুও কেমন একটা জড়তা কাজ করছে তার মাঝে৷ তাদের সাথে তো তার আরও একটা সম্পর্ক আছে। আর সেটা হলো টিচার স্টুডেন্ট এর সম্পর্ক। নির্ঝর রাহাতের কান ধরে বলে….

–তোদের মতো বিচ্ছু বন্ধু থাকলে শত্রুর কি প্রয়োজন!
–আমিও যে তোমাকে খুব ভালোবাসি স্বামী।

ওদের কথা শুনে বাকিরা হাসতে থাকে। আজ বেশ জ্বালাতন করেছে রাহাত আর শাওন। এখন একটু ক্ষান্ত হওয়া প্রয়োজন। ঊর্মি বলে….

–অনেক রাত হয়েছে আমাদের এবার যাওয়া উচিত। শাওন, রাহাত বের হ ওদের ঘর থেকে। হ্যাপি ফাস্ট নাইট।

বলেই দুটোর হাত ধরে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে আর বাইরে থেকে দরজাটা কিছুটা চাপিয়ে দেয়। ওরা নির্ঝরের মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার মতো বাসায় চলে যায়।

রাতে অনেক ক্লান্ত হয়ে ঊর্মি আর নিবিড় বাসায় ফেরে। ঘরের ভেতরে আসতেই সে আগে এতোক্ষণ পড়ে থাকা শাড়িটা পাল্টে নেয়৷ মেরুন রঙা শাড়িটা কালই নিবিড় তাকে কিনে দিয়েছে। শাড়িটা ড্রেসিং টেবিলের চেয়ারের উপর রেখে দেয় সে। তখনই বিছানার পাশের টেবিলের দিকে চোখ যায় তার। টেবিলের উপর নিবিড়ের ওয়ালেটটা পড়ে আছে। একটা হালকা গোলাপি রঙের ডায়েরির পৃষ্ঠার মতো কিছু একটা যার কিছু অংশ বের হয়ে আছে। সে সেটাকে ওয়ালেটের ভেতর রাখতে যায় তখনই তার মনে পড়ে এটা তো তারই ডায়েরির পৃষ্ঠা। এমন একটা কাগজেই তো বসন্ত উৎসবের দিন সে নিবিড়ের জন্য চিরকুট লিখেছিলো। তবে এটা যে নিবিড়ের কাছে এখনো থাকবে তা সে ভাবতে পারেনি। সে ভেবেছিলো হয়তো এমন এলোমেলো চিরকুট নিবিড় ফেলে দেবে। ওয়ালেটের ভেতর একটা ছবি দেখে ঊর্মি বেশ অবাক হয় কারণ এই ছবিটা তার অগোচরেই তোলা হয়েছে। বসন্ত উৎসবের দিন সে যখন খুশবু নামের বাচ্চা মেয়েটার থেকে দুটো গোলাপ হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে কথা বলছিলো তখনকার ছবি এটা। তবে এই ছবি নিবিড় কোথায় পেলো সেটাই সে ভাবছে। সে চিরকুটটা আবারও খুলে দেখে।

প্রিয় শ্যাম পুরুষ

❝আপনাকে এতো সুন্দর কে হতে বলেছে? নিশ্চয়ই আল্লাহর সৃষ্টি সকল কিছুর উর্ধ্বে তা-না হলে আপনাকেই কেন কারো চোখে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর পুরুষ মনে হবে! অন্য মেয়েরা কেন আপনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে? কেউ একজন যে আপনাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটায় সেটা কি আপনি ঘুনাক্ষরেও টেন পান? আপনাকে দেখা মাত্র কারো হৃদস্পন্দন প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়! অনুভূতির প্রলয়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। আপনি কি জানেন কেউ একজন আপনার কাছে প্রেম নিবেদন করতে চায়। তবে লজ্জা আর ভয় নামক অনুভূতি গুলো তাকে আটকে দেয় বারংবার৷ সামনা-সামনি বলা হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু কেউ একজন আপনাকে আড়ালে আবডালে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে।❞

আপনার প্রণয়িনী

চলবে?…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here