ঢেউয়ের স্রোতে নিবিড় শেষ পর্ব

0
1299

#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#অন্তিম_পর্ব

সেদিন বাসায় আসার পর নিবিড় যখন তার প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতে যাবে তখনই তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে। হালকা গোলাপি রঙের ডায়েরির পৃষ্ঠার মতো কিছু ছিলো। সে বেশ কৌতুহল নিয়ে কাগজটা খুলে দেখে। গোটা গোটা অক্ষরে এখানে কারো প্রেম নিবেদন লেখা আছে। ছাত্র জীবনে অনেক গুলো প্রেমের প্রস্তাব পেলেও কখনও চিরকুট পাওয়া হয়নি তার। কাগজটাকে স্বযত্নে ভাজ করে নিজের ওয়ালেটে রেখে দেয়। এরপর মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে ঊর্মির কিছু ছবি দেখতে থাকে। ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন বাসা থেকে বের তখন তখন তার এক কলেজ ফ্রেন্ডের কল আসে। তো সে তার বাইকটাকে সাইডে দাঁড় করিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয়। এরপর বাইক স্টার্ট দিতে গিয়ে সামনে তার চোখ যায়। কিছুটা দূরে একটা মেয়ে হাতে দুটো গোলাপ ফুল নিয়ে ছোট্ট মেয়ের সাথে হেসে এসে কথা বলছে। হাসির মাঝে গালে টোলও পড়ছে। মেয়েটার মুখপানে স্নিগ্ধতা বিরাজমান। মেয়েটাকে দেখে প্রথম দেখায় এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে নিবিড়ের। তখন সে তার মোবাইল পুনরায় প্যান্টের পকেট থেকে বের করে মেয়েটা কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। ভার্সিটি আসার পর সেই মেয়েকে দেখে তার মনে হতে লাগে মেয়েটার ইনফরমেশন নেওয়া দরকার। তাই সে একজন দপ্তরির থেকে ইনফরমেশন কালেক্ট করে জানতে পারে “মেয়েটার নাম ঊর্মি আর সে এই ভার্সিটিতেই দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।” ঊর্মির নাম জানতে পেরে সেদিন নিজের অজান্তেই তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। বাসায় এসে সে তার ফোনে থাকা ঊর্মির ছবি গুলো দেখতে থাকে। পরের দিন একাউন্টিং ক্লাসে সকলকে সে লিখতে দেয়। অবশেষে কাগজটা ঊর্মির হাতের লেখার সাথে হুবহু মিলে যায়। তারপর একদিন যখন নাজিয়া মাহমুদ নিবিড়কে বিয়ে দেবার জন্য প্রেসার দিতে থাকে তখন সে মায়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। নাজিয়া মাহমুদ ঊর্মির একটা ছবি এসে নিবিরকে দেখায়। তিনি জানান এই মেয়েটাকে উনার অনেক পছন্দ হয়েছে আর এই মেয়ের সাথে নিবিড়ের বিয়ে দেবেন উনি। ছবি দেখবে না দেখবে না বলেও দেখেই ফেলে। ঊর্মির ছবি দেখা মাত্রই মনে মনে যেন খুশি হয়ে যায় সে। এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি৷ এতোদিনে ঊর্মিকে সে একটু একটু করে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কোনো রকমের ভনিতা ছাড়াই সে বলে দেয় “বিয়ে করলে এই মেয়েকেই করবে” ছেলের কথায় নাজিয়া মাহমুদ খুশি হয়ে যান।

হুট করেই বাইরের মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। ঠান্ডা বাতাস বইছে বাইরে। ঘরের উত্তর দিকের জানালা দিয়ে হালকা মৃদু বাতাস বইছে। মুহুর্তেই ঘরটা যেন শীতল হয়ে উঠলো। নিবিড় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় ঊর্মি তার হাতে থাকা কাগজটা আগের মতোই ভাজ করে হাতের মুঠোয় রেখে দেয়। নিবিড়ের ছোঁয়ায় তার ভেতরটা ধক করে উঠলো। নিশ্বাস যেন মুহুর্তেই আটকে গেছে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করছে। নিবিড় ভেবেছিলো এভাবে জড়িয়ে ধরলে হয়তো ঊর্মি ভয় পাবে কিন্তু তার কোনো হেলদোল নেই দেখে সে তাকে নিজের দিকে ফেরায় আর বলে….

–কি ব্যাপার মিসেস? ভয় পেলে না যে!
–ঘরে কি আপনি আর আমি ছাড়া কেউ আছে, যে ভয় পেতে হবে!

নিবিড় ঊর্মিকে নিজের আরও কাছে টেনে আনে। আজ নিবিড়ের হুটহাট করে কাছে আসাটা তার সুবিধার ঠেকছে না। আবার মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। নিবিড় তার কানের কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে গভীর ভাবে চুম্বন দিয়ে ঘোর লাগা স্বরে বলে….

–যেহেতু আমরা দু’জনেই একা তাই কিছু একটা তো হতে পারে তাই না ঢেউ?

নিবিড়ের শীতল স্পর্শে ঊর্মির ভেতরে যেন ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। হৃদস্পন্দন প্রয়োজনের তুলনায় আবারও বাড়িয়ে তুলছে। অনুভুতি গুলো আরও প্রগাঢ় হচ্ছে। ঊর্মি নিবিড়কে কিছু বলতে নিবে তার আগেই দুজনের ওষ্ঠদ্বয়ের গভীর আলিঙ্গন হয়ে যায়। আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় দুজনেই। ঊর্মি শক্ত করে নিবিড়ের টি-শার্ট খামচে ধরে। ঘনিষ্ঠ স্পর্শ গুলোকে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। দুজনের মাঝে চোখাচোখি হয়ে গেলে ঊর্মি ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় নিবিড়ের থেকে। দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে গিয়ে সে অনুভব করছে তার শরীর হালকা কাঁপছে। গলা যেন শুকিয়ে আসছে। এলোমেলো স্বরে বলে…

–আ..আমার ঘুম পাচ্ছে।

নিবিড় যেন তার কোনো কথাই শুনলো না। সে গিয়ে ঘরের লাইটটা অফ করে ড্রিম লাইটের জ্বালিয়ে দিলো। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় ঊর্মির লজ্জায় বিভোর হয়ে থাকা মুখটা উপভোগ করছে সে। বড় বড় পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেলো নিবিড়। ঊর্মিকে পাজো কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে আসে। সে কিছু বলতে নিবে তার আগেই নিবিড় তাকে থামিয়ে দেয়। নিবিড় গভীর ভাবে ঊর্মিকে দেখতে লাগলো। সে লজ্জায় মুখটা অন্যদিকে করে রেখেছে। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে দুজনের মাঝেই। বাইরে ইতিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঊর্মির বরাবরই বৃষ্টি খুব প্রিয়। বৃষ্টির মাঝে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পায় সে। আর আজ তো তার পাশে প্রিয় মানুষটি আছে। পুরো ঘর জুড়ে শীতল আবহাওয়া বইছে। নিবিড় ঊর্মির কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দেয়। দুজনের বুকই ধুকপুক করছে। নিবিড় কি চাইছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে ঊর্মি। নিবিড় ধীর গলায় তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো….

–আজ আর নিজেকে আটকে রাখছি না। প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব।

লোডশেডিং হবার কারণে ঘুমের মাঝেই ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা ঊর্মির। দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছিলো। নাজিয়া মাহমুদ আর আয়শা মাহমুদ তাদের যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছেন। এই সময়টায় আনিসুল মাহমুদ আর আজিজ মাহমুদ অফিসেই থাকেন। নিবিড় বাসায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়৷ হঠাৎ করেই শরীর বাতাস লাগছে এমন অনুভব করে সে। চোখ বন্ধ করেই বিছানায় হাতড়ে যায়। কারো উপস্থিতি পেলো না সে। মুহুর্তেই চোখ খুলে ফেললো। মাথার কাছে তার পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করছে৷ ছেলেকে দেখে মুচকি হাসি দেয় সে। শোয়া থেকে উঠে বসে বললো…..

–আমার সোনা ছেলে! ঘুম থেকে কখন উঠেছো?
–গরম লাগছিলো তাই উঠে পড়েছি মাম্মা।
–তোমার গরম লাগছিলো আমাকে তো ডাকতে পারতে বাবা!

ঊর্মি মাঝে মাঝে বেশ অবাক হয়। নীড় পুরো তার বাবার স্বভাবের হয়েছে। নিবিড়ের মতোই গম্ভীর স্বভাবের। বাইরের মানুষের সাথে প্রয়োজনে খুব কমই কথা বলে। তার মুখশ্রী দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে সে নিবিড়ের ছেলে। পূর্ণ, পুষ্প এখন বড় হয়েছে। সামনে এসএসসি দিবে। ঊর্মি ঘড়ির দিকে তাকালো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। পূর্ণ পুষ্পর আসার সময় হয়ে এসেছে। ইদানীং দুজনের পড়ার খুব চাপ পড়েছে। স্কুল থেকে সোজা কোচিং করে তারপর বাসায় ফেরে। নিবিড়ই তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসে। ঊর্মি বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে যায়। ওদিকে পূর্ণ পুষ্প বাসায় এসেই আগে নীড়কে খুঁজছে। নীড় ঘর থেকে দৌঁড়ে বের হয়। ওদের দুজনকে দেখা মাত্রই সে চেচিয়ে বলে….

–ফুপিমণি!

পূর্ণ পুষ্প এসে নীড়কে জড়িয়ে ধরে। তারপর সাথে করে আনা চকলেট নীড়ের হাতে দেয়। চকলেট পেয়ে সে কি খুশি। এমনটা প্রতিদিনই ঘটে। নিবিড় এসে নীড়কে কোলে তুলে নেয়৷ পূর্ণ পুষ্প তাদের ঘরে চলে আসে। নিবিড়ও ছেলেকে নিয়ে ঘরে আসে। ঊর্মি মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। নিবিড়কে দেখে তার মুখপানে হাসি ফুটে। সে নিবিড়ের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। নীড়কে বলে “পাপা এখন ফ্রেশ হবে, তাকে বিরক্ত করবে না” নীড়ও তার মা’কে আস্বস্ত করে। ঊর্মি নিবিড়ের দিকে টাওয়ালটা এগিয়ে দেয়৷ সাথে টাওজার আর ধুসর রঙা টি-শার্ট। নিবিড় সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। নীড় বিছানায় বসে চকলেট খেতে থাকে আর ঊর্মি গিয়ে নিবিড় আর পূর্ণ পুষ্পর জন্য খাবার বাড়ে। কিছুক্ষণ পরেই ওরা এসে খাবার খেয়ে নেয়। সে এঁটো প্লেট গুলো ধুয়ে রান্না ঘরেগুছিয়ে রাখে। হাত মুছতে মুছতে ঘরে এসে বাবা ছেলের খুনসুটিময় মুহুর্ত গুলো উপভোগ করতে থাকে সে। আসলেই ভালোবাসা সুন্দর। বেঁচে থাকুক এমন হাজারো পবিত্র ভালোবাসা।

সমাপ্ত!……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here