ঢেউয়ের স্রোতে নিবিড় পর্ব ২

0
1487

#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-২

আজ ভার্সিটিতে বসন্ত উৎসব পালন হচ্ছে। রিয়া সেই সকাল সকাল সেজেগুজে চলে এসেছে। ঊর্মির ঘুম ভাঙলো কিছুক্ষণ হবে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় চোখ মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে ওয়াশরুমে চলে যায়৷ রিয়া বিছানায় বসে তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে৷ বিছানার উপরে বাসন্তী রঙের শাড়ি, ম্যাচিং অর্নামেন্টস আর সাদা রঙের আর্টিফিশিয়াল গাজড়া তার জন্য রেখে দিয়েছে৷ ঊর্মি বের হতেই তাকে শাড়িটা পড়ে নিতে বলে রিয়া। শাড়ি তো কোনো কালেই পড়তে পারে না ঊর্মি। বারবার পড়তে গিয়ে পেচিয়ে ফেলছে সে। তার এমন অবস্থা দেখে রিয়া হাসতে হাসতে বিছানার উপর বারবার ঢলে পড়ছে। সে তখন কাঠকাঠ গলায় বলে….

–পেত্নীদের মত দাঁত না কেলিয়ে আমাকে সাহায্যও তো করতে পারিস!
–আয় আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।

ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে চারিদিকে যেন প্রণয়ের হাওয়া বইছে। ছয় ঋতুর মাঝে বসন্ত কাল ঊর্মির বড্ড প্রিয়। গাছগাছালি থেকে শুকনো পাতা গুলো ঝরে যায় আবার পুনরায় নতুন পাতায় ভরে ওঠে৷ রিকশায় বসে রাস্তার আশপাশ তাকিয়ে দেখছে সে। রাস্তায় একপাশে দশ এগারো বছরের একটা মেয়ে বিভিন্ন ফুল আর ফুলের মালা বিক্রি করছে। ঊর্মি রিয়াকে বসিয়ে রেখে রিকশা থেকে নামে। মেয়েটার কাছে গিয়ে দুটো লাল গোলাপ হাতে নেয়। মেয়েটা তাকে দেখে বলে….

–আপা ফুলটা কানের পিছে লাগাইলে আপনেরে মেলা সুন্দর দেহাইবো৷
–তোমার নাম কি মিষ্টি পাখি?
–আমার নাম খুশবু।
–তোমার নামটা তোমার মতোই খুব মিষ্টি। বাসায় কে আছে তোমার?
–আমার আম্মা আছে। আম্মার অসুখ তাই আমি ফুল নিয়া আইছি।

মেয়েটাকে দেখে খুব খারাপ লাগতে শুরু করে ঊর্মির। এমন অনেক বাচ্চাই আছে যাদের টাকার অভাবে খাবার টুকু খেতে পারে না, পড়ালেখা তো দূরের কথা। অভাবের তাড়নায় তাদের জীবন যু’দ্ধে নামতে হয়। ঊর্মি তার পার্স থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে মেয়েটাকে দেয়৷ মেয়েটা টাকাটা দেখে বলে….

–আপা আমার কাছে তো খুচরা নাই।
–তুমি সবটা নিয়ে নাও।

মেয়েটা হয়তো টাকাটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। মুখে লেগে আছে অমলিন হাসি। ঊর্মি পলকবিহীন তাকিয়ে থাকে মেয়েটার নিস্পাপ মুখ পানে। রিকশা থেকে রিয়া তাকে ডেকে বলে…

–তাড়াতাড়ি আয় ঊর্মি। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে৷

ঊর্মি মেয়েটাকে আসছি বলে রিকশায় এসে বসে৷ রিয়ার হাতে একটা ফুল দিয়ে দেয় আর নিজেরটা স্বযত্নে ক্লিপ দিয়ে কানের পাশে আটকে নেয়। রিকশা তার আপন গতিতে চলতে শুরু করে। ভার্সিটি ক্যাম্পাস খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্টুডেন্ট এবং টিচাররা প্রত্যেকেই এখানে উপস্থিত আছে। ছেলেরা পাঞ্জাবি পড়েছে আর মেয়েরা পড়েছে শাড়ি। ঊর্মি আর রিয়া গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পায় শাওন, নির্ঝর আর রাহাত ওদের জন্যই অপেক্ষা করছে। দুজনে ওদের দিকেই এগিয়ে যায়। রাহাত ওদের দুজনকে দেরি করে আসতে দেখে বলে….

–ময়দা সুন্দরীদের আসতে এতো সময় লাগে?
–আরে আটা ময়দা মাখতে তো সময় লাগে তাই না? বলল শাওন…
–আমরা মোটেও আটা ময়দা মাখি না।

ভেংচি কেটে কথাটা বললো রিয়া। ঊর্মি তার পাশেই দাঁড়িয়ে। কিছুটা ভাব নিয়ে বলে….

–হ্যাঁ আমরা ময়দা সুন্দরী! হিংসে হয় তোদের? আমাদের মতো হতে চাস? চাইলে বলতেই পারিস, দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি!
–স্যরি বোন তোর সাথে আমরা তর্ক করতে চাই না। ক্ষান্ত হ।

দুপুরে রোদের প্রখরতা বেশি হলেও দমকা হাওয়া বইছে চারদিকে। কপালের উপর থাকা ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসে হাল্কা এলোমেলো করে দিচ্ছে। ওরা পাঁচজনে এখনো ক্যাম্পাসেই আছে। নির্ঝর চুপ করে ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে পলকবিহীন তাকিয়ে আছে ঊর্মির দিকে৷ রিয়া তার সামনে হাতের তুড়ি বাজিয়ে বলে….

–তোর মুখে কি সুপার গ্লু লাগিয়েছিস?
–কেন?
–কথা বলছিস না যে!
–দেখছি।
–কি দেখছিস? বাই দ্য ওয়ে! বসন্ত উৎসব ভালোই লাগছে তাই না রে?
–সে পাশে থাকলে প্রত্যেকটা ঋতুই বসন্তের সমতুল্য।
–সে টা কে?

রিয়া কথাটা বলে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নির্ঝরের দিকে। শাওন, রাহাত আর ঊর্মিও যে ওর কথা শুনে অবাক হয়ে তা ওদের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রাহাত তো রীতিমতো হা করে আছে। ঊর্মি রাহাতের পেটে খোচা দিয়ে বলে….

–এভাবে হা করে থাকিস না, মুখে মশা মাছি ঢুকে যাবে।

ঊর্মির কথাটা শুনে রাহাত মাথা চুলকে হেসে দেয়। ক্যাম্পাসে আরও কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করে ওরা। হঠাৎ ওদের থেকে কিছুটা দূরে ঊর্মির তথাকথিত ক্রাশ নিবিড় স্যারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। রোজকার মতো আজও ফর্মাল গেটআপে আছেন তিনি। শ্যামরঙা বলিষ্ঠ শরীরে সাদা রঙের শার্ট জড়িয়ে রেখেছে। হাল্কা রোদের ঝলকানি পড়ছে যার দরূন নিবিড়ে চোখ মুখ বারংবার কুচকে আসে। নাকে ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। হাতে সোনালী রঙের ঘড়িটা রোদের আলোতে জ্বলজ্বল করে উঠছে৷ ঊর্মি মুগ্ধ হয়ে দেখছে নিবিড়কে। নির্ঝর মলিন মুখে তাকে দেখছে। ঊর্মি তাকিয়ে দেখলো নেহা ম্যামের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে নিবিড়। ভেতরে ভেতরে খুব ঈর্ষান্বিত হচ্ছে সে। বারবার তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে৷ তার তাকানো দেখে শাওন বলে….

–আর কত ক্রাশ খাবি রে বইন?
–এই একটা মানুষের উপর আমি ক্ষণে ক্ষণে ক্রাশ খেতে পারি৷ এটা আমার ক্রাশগত অধিকার! আর আমার হয়ে চিরকুট সা’প্লা’ই করা তোর জন্মগত অধিকার।

ঊর্মি তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট চিরকুট বের করে। শাওন আবার এইসব কাজে খুব এক্সপার্ট। এর আগেও দুবার ঊর্মির কাছ থেকে নেওয়া চিরকুট যথাস্থানে প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। তাই ঊর্মি আজও এই চিরকুটটা তার হাতেই ধরিয়ে দিয়েছে৷ শাওন সেটা খুব সাবধানে নিবিড় স্যারের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। চিরকুটটা আজও নিবিড়ের পড়েছে বা দেখেছে কি-না সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই ঊর্মির৷

হুট করে কারো ডাকে গভীর ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে ঊর্মি৷ সামনেই তার স্বামী বসে। অতশত ভাবনার মাঝে কখন যে তার ঘোমটাটা পড়ে গেছে সেদিকে ঊর্মির কোনো খেয়ালই নেই৷ হঠাৎ করে সামনে বসে থাকা লোকটাকে দেখে বিষ্ময়কর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়৷ লোকটাকে দেখা মাত্রই তার যেন সারা শরীর অসার হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর ফ্যানটা ক্রমাগত ঘুরছে তবুও সে যেন ঘামতে থাকে। “এই ঘরে তো তার স্বামীর থাকার কথা তাহলে নিবিড় স্যার এখানে কি করছে? বাই এনি চান্স উনার সাথেই তার বিয়ে হয়ে যায়নি তো?” মনে মনে কথাটা আওড়াতে গিয়ে ঊর্মির হেঁচকি শুরু হয়ে যায়। নিবিড় দ্রুত বিছানার পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। ঊর্মি পুরোটা পানি খেয়ে নেয়। এতোক্ষণ এরই প্রয়োজন ছিলো তার। সে ফ্যালফ্যাল করে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে…..

–স্যার আপনি এখানে?
–বাড়ি আমার, রুম আমার এমনকি বউটাও আমার। তাহলে আমার কোথায় থাকা উচিত?
–তারমানে আপনি…
–হ্যাঁ আমি। তুমি আমাকে দেখে যতটা অবাক হয়েছো আমিও ঠিক ততটাই অবাক হয়েছিলাম যখন মা তোমার ছবিটা আমাকে দেখায়। ছাত্রীকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে ছিলাম আমি। কিন্তু কি আর করার বলো! আল্লাহ চাইলে আমরা আটকানোর কে?

এতোক্ষণে নিবিড়কে হারিয়ে ফেলার বিষন্নতা মন থেকে একেবারেই মুছে গেছে। ভেতরে ভেতরে তো ঊর্মির মনে লাড্ডু ফুটছে। এতোদিন যাকে মন থেকে চাইতো তার সাথে আল্লাহ তায়ালা তার পরিণয় লিখে রেখেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে সে। মনে মনে ভেবে নেয় নফল নামাজটা আদায় করে নেবে। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই নিবিড় বলে….

–ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করবো।

বেশ কিছুক্ষণ পর ঊর্মি শাড়ি পাল্টে সালোয়ার কামিজ পড়ে ওজু করে আসে। এরপর দুজনেই নামাজটা পড়ে নেয়। নিবিড় বিছানার মাঝখানে একটা বড় কোলবালিশ রেখে একপাশে শুয়ে পড়ে।

চলবে?………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here