ক্যামেলিয়ান ৪+৫

0
1408

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৪+৫

(১০)

ঈশানের সম্মুখে বসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে জাফরিন। স্টেজে ঈশানের পাশেই বসে আছে কাজী সাহেব।জাফরিনের দুই পাশে বসেছে তার দুই মামা।পিছনে দাঁড়িয়ে আছে দুলাভাই এবং মামাতো ভাইয়েরা। তাদের উপস্থিতিতে পরিবেশে পিন পতন নীরবতা বজায় রাখছে সবাই।
কাজী সাহেব দুজনের সম্মতি চাইলে জাফরিন বিনা বাক্য ব্যয় করে সম্মতি জানালো।তার পক্ষ থেকে ওয়ালিয়া হয়ে সম্মতি জানালো তার বড় মামা অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ ইয়াকুব।
জাফরিনের স্বাক্ষর নেওয়ার পর কাজী সাহেব তার খাতাটা এগিয়ে দিলেন ঈশানের দিকে। ইশান স্বাক্ষর করে দিতেই তাদের কাবিন বাতিল হলো।কাজী ডেকে এনে যেভাবে কাবিন করা হয়েছিল, কাজীর উপস্থিতিতেই সেই কাবিন বাতিল করলেন জাফরিনের পরিবার। ঈশানের বাবা অবশ্য গতকালকের জন্য মাফ চাইছিলেন কিন্তু তার কথায় কেউ কান দেয়নি।
কাবিন বাতিল হবার পর ইয়াকুব সাহেব তার ছেলে এবং ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

“জাফরিনকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো।”

তার রাশভারী কণ্ঠ যেন বজ্রের মতোন লাগছিল।চেয়ার ছেড়ে উঠতেই জাফরিন পুনরায় ফিরে এলো তার মামার কাছে। মামাকে কানে কানে কিছু একটা বলতেই তার মামা ঈশানের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন

“আপনি বসুন এখানে, বার বার ছেলেকে বিয়ে বাড়িতে এনে বৌ ছাড়া চলে যেতে আপনার একটুও সম্মানে লাগছে না?আপনার হয়তো সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের এলাকার, আমাদের মেয়ের একটা সম্মান আছে। আপনি আজ এখান থেকে এভাবে যেতে পারবেন না।”

“আপনি কী আমাদের জিম্মি করবেন?আমি থানায় কল দিবো।”

“আপনার দেওয়ার দরকার নেই। থানার ওসি আমার ভায়রাভাই।তাকে আমিই কল দিচ্ছি আসার জন্য।”

পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে তিনি তার ছেলেদের বললেন,

“জাফরিনের মতো এই মেয়েটাও তোমাদের বোনের মতোন।গতকাল বরযাত্রী তাকে রেখে চলে গেছে বলে তোমরা ভাইয়েরা অস্থির হয়ে আজকেই দেশে এসেছো, এটাও তোমাদের বোন।এখন তোমরা উপস্থিত, কী করবে তোমরা?”

ইয়াকুব সাহেবের বড় ছেলে বাবার সামনে মাথা নিচু করে বলল,

“বাবা, বিয়ে দেওয়া কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু বিয়ের পর এই ছেলে যে ওকে ছেড়ে দিবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয় বিয়েও করতে পারে। তবে হ্যাঁ আমরা মেয়ের পরিবারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জেনে তাদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে পারি।”

জাফরিন দাঁড়িয়ে ছিল তার ছোটো মামা এবং বড় আপার পাশে। আশার বাবা এসে তার দুই হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” মা আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ এখানে। তুই তো শহরে মানুষ। পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারিস। আমার মেয়েটা এমন না। ও এসব সইতে পারবে না।কাল সকাল হলেই যখন আশেপাশের মানুষ বলবে কাল ওর বিয়ে ভাংছে, ও মুখ দেখাতে পারবে না। ওর গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।”

মাথা নিচু করে জাফরিন কথাগুলো শুনছিল।আজ সন্ধ্যে বেলাতেও তাকে কত কিছু বলেছে এই লোকটা। আচ্ছা এরা কী কখনো বুঝতে পারবে?কষ্ট জাফরিনেরও হচ্ছে, যে মানুষটাকে সে সারা জীবনের জন্য চেয়েছিল, তাকে নিয়ে সংসার করবে বলে কতই না স্বপ্ন সাজিয়েছিল,তার নামের মেহেদী, হলুদ এখনো তার গায়ে, হাতে লেগে আছে। সেই মানুষের সাথে বিচ্ছেদে তার কেমন লাগছে?
সে নিজেও তো একজন মেয়ে।নিজের কষ্ট গুলোকে লুকাতে জানে বলেই বাইরে শক্ত আবরণ তৈরি করেছে অথচ তার নিজের অন্তর ও পুড়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো কাঁদতো, বাবার মৃত্যু বা বিয়ে ভাঙ্গার পর মানুষের কটু কথা শুনে আত্মঘাতী হওয়ার চিন্তাও করতো। কিন্তু সে এমন নয়, তার কষ্ট হচ্ছে।তবে সে এটাও মানে কান্নাকাটি করে এসবের সমাধান পাওয়া যাবে না।বিপরীতে লোকে পিছনে তাকে নিয়ে তামাশা করবে।

জাফরিন তার চাচার কোনো কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে বাড়ি চলে এলো। সে জানে আশার জীবনের সিদ্ধান্ত আশাকেই নিতে হবে। ক্ষণিকের কষ্ট না কী সারা জীবনের অপমান!

(১১)

বিয়ারের গ্লাসে এমন ভাবে চুমুক দিচ্ছে যেন সে দুধ খাচ্ছে।ছোটো বেলায় যেমন বলা হতো এক চুমুকে শেষ করবে ঠিক তেমনি ভাবে দুই বন্ধু প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ব্যালকনিতে বসে গভীর রাতের শহরকে পর্যবেক্ষণ করছিল মাশহুদ এবং কুঞ্জ ।রাতের আড্ডা জমাতেই তাদের সামনে রয়েছে লো অ্যালকোহলিক বিয়ারের বোতল।কুঞ্জ পেশায় একজন প্রোগ্রামার। যার কাজ বিভিন্ন সফটওয়্যার এবং কোডিং নিয়ে৷ তবে সে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আয়ত্তে নিয়েছে সেটা হলো হ্যাকিং। খুব দ্রুতই সে হ্যাক করতে জানে৷ তবে নিজের এই জ্ঞানের কোনো খারাপ প্রয়োগ সে করেনি।আজ তাকে এখানে নিয়ে আসার আরো একটি কারণ রয়েছে মাশহুদের কাছে৷ কিন্তু কুঞ্জ এই ব্যাপারে একদম নিস্ফল প্রমাণিত হলো।টেবিলের উপর গ্লাস রাখতে রাখতে সে বলল,

“দেখ ভাই, তুই এইভাবে মেয়েটার প্রতি ঝুকে পড়ছিস কেন?এটা কিন্তু ঠিক নয়।”

“আমি কোথায় ঝুকলাম?”

কুঞ্জ ভ্রু-বিলাস করলো। হাতের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে আয়েশ করে বসে বলল,

“মাত্র তিন ঘন্টার মধ্যে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ খুঁজে তাও আবার প্রফেশনাল, তাকে পাঠিয়ে দিলি আজমল সাহেবের বাড়িতে।শুধু মাত্র মেয়েটা আজ কী করছে এটা জানার জন্য৷ এটা কে তোর কী মনে হচ্ছে?”

“কিছুই না।তাদের খবর নিতে চাচ্ছি মাত্র।”

“আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে না।যদি এটাই হয় তবে আজকের বিয়েতে ঝামেলার কী দরকার ছিল?”

“ছিল।কারণ আমি দেখতে চাই এই মেয়েটা কতটা সহ্য করতে পারে। কতটা কষ্ট পেলে সে কাঁদবে। সে কী আদৌও যোগ্য?”

“আমরা কিন্তু এখনো নিশ্চিত নই, এই সেই ব্যক্তি যে…… ”

“আজমল সাহেবের মেইলের তথ্য রিকোভার করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, বাকীটা সেখানেই জানা যাবে।”

“কোনো একটা অদ্ভুত কারণে আমি মেইল এক্সেস করেও কিছুই পাইনি।তার মেইল বক্স ফাকা ছিল।কেন যেন মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই মেইল এক্সেস করতে দেওয়া হয়েছে।তোর প্রয়োজনীয় কিছুই এখানে নেই।”

কুঞ্জের কথায় মাশহুদের ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না।অন্ধকার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল,

“কারণ আমি নিশ্চিত, এই মেয়েটা সবটা জানে।একমাত্র এই মেয়ের কাছেই রয়েছে আমার সকল ভবিষ্যৎ।”

(১২)

প্রভাতের মখমলি সমীরণ বইছে।শরৎের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে জাফরিনের ঘরে৷ কোর-আন শরীফ তুলে রেখে বারান্দায় বেরিয়ে এলো সে।বারান্দায় বসে আছে তার মামা এবং দুলাভাইয়েরা৷ বড় আপা সবাইকে চা নাস্তা দিলেন।গতকাল রাতে পুলিশের উপস্তিতিতে আশা এবং ঈশানের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়েতে সবাইকে উপস্থিত রেখে কাবিন নামায় উল্লেখ করা হয়েছে তিনটি শর্ত

১.ঈশান কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না কিংবা তালাক দিতে পারবে না।
২.স্ত্রীর মর্যাদা এবং সকল দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৩.যদি কখনো তাকে অসম্মান করা হয় তবে ঈশানের বাবার সকল সম্পত্তি আশার নামে করে দিতে হবে।

এই তিনটে শর্ত মানা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।কারণ এই বিয়ে ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।যদি বিয়ে না করে তবে তাদের তখনি গ্রেফতার করা হতো।
বিয়ের পর যখন জাফরিনকে নিয়ে তার মামা চলে আসছিলেন তখন তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

“গতকাল যদি আমি এখানে থাকতাম তবে নিশ্চিত করতাম আপনাদের হাজত বাস। আমার ভাগ্নী কোনো খেলার পুতুল না।তার বাবা আজ নেই,চাচাদের দায়িত্ব ছিল ওদের মাথার উপর হাত রেখে তাদের শোকে কাতর মনটাকে একটু সমবেদনা জানানো।কিন্তু আফসোস এমন করেন নি।হেনস্থা করতে পিছুপা হয়নি কেউ।কেউ বুঝেনি এই এতিম মেয়েগুলোর মনের অবস্থা,সদ্য বিদবা হওয়া আমার বোনের মনের অবস্থা।”

যাওয়ার সময় ঈশানের বাবার চেহারা ছিল দেখার মতোন।মনে হচ্ছিলো তাকে নিম পাতার রস খেতে দেওয়া হয়েছে।
গত রাতেও প্রচন্ড খারাপ লাগছিল জাফরিনের। আজ তার বাবা মারা যাওয়ার তিন দিন।যদিও লাশ এখনো আসেনি, দাফন হয়নি তবুও কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্র খাওয়ানোর কথা বললো বড় আপা।সবাই সম্মতি জানালেন।

বিকেলবেলা নতুন বৌ নিয়ে বর যাত্রী পুনরায় ফিরে এলো।নিয়ম রক্ষা চলছে, আজ জাফরিনদের বাড়ি তিন দিনের জন্য এতিম বাচ্চা খাওয়াচ্ছে আর অপর দিকে নতুন জামাই আসবে বলে পিঠা পুলি বানানো হচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে ঈশান বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার সময় দেখতে পেল কয়েকটা কুকুরকে খেতে দেওয়া হয়েছে। দেখে বুঝতে পারলো এই কাজটা জাফরিন করেছে। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে ভালো ভাবে তাকাতেই দেখতে পেল প্রত্যেকটা কুকুরের গলায় ঝুলছে টাই।সেগুলো চিনতে অসুবিধা হলো না আশা কিংবা ইশানের।কারণ
এই টাই গুলো জাফরিন কিনেছিল ঈশানের জন্য। তাদের বিয়ের একটা ছোট্ট উপহার হিসেবে যে গুলো বর্তমানে ঝুলছে কুকুরগুলোর গলায়।

চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান_সুবাসিনী
#পর্ব-৫

(১৩)

আশা নিজের সুখ দেখাতে ব্যস্ত৷ কে বলবে এই মেয়েটার বিয়ে গতকাল কতই না ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিল।জাফরিনের পাশে বসে আশা শাড়ির আঁচল টেনে নিতে নিতে বলল,

“ঈশান খুব ভালো রে।গতকাল যা হয়েছে সব কিছুর জন্য সে মাফ চেয়েছে।”

প্রতিউত্তরে জাফরিন বলল,

“আচ্ছা।”

এরপর বিনাবাক্যে সে চলে এসেছিল ঘরে৷ আশা নিজে থেকেই এসেছিল তার সাথে দেখা করতে। তখন সে বারান্দায় বসেছিল।ঘরে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে।সবার সব কিছু ভুলতে আপাতত। মরহুম বাবার জন্য কিছু আমল করতে করতে হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে।

প্রভাতের মৃদু হাওয়ায় নিজেকে উজার করে দিতে ইচ্ছে করছে জাফরিনের।ফজরের নামাজ আদায় করার পর সে বেরিয়েছে বাড়ির পাশে হাঁটতে। রোদের তেজ এখনো বাড়েনি। প্রভাতের রৌদ্র বিলাশ করতে করতে এসে দাঁড়িয়েছে নিজের বাড়ির শিউলি গাছের তলায়। স্তবকে স্তবকে ফুটে থাকা শিউলি ফুলের গন্ধে বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। ফুলের ভারে গাছটা নুইয়ে পড়েছে। তার পিছন পিছন কখন যে মায়ান এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।মায়ান হচ্ছে বড় আপার বড় ছেলে। এক কথায় খালা ভক্ত ছেলে।বারো বছর বয়সেই শরীরের গড়নের দিক থেকে সে সবার থেকে ভিন্ন।উচ্চতায় প্রায় জাফরিনের সমান।খালামণির পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল,

“আতিন, শিউলি নিবে?”

“না রে। এখন কুড়াতে ইচ্ছে করছে না।”

“তবে আঁচল পেতে দাঁড়াও, আমি গাছ ঝাকি দিয়ে দিচ্ছি।”

মায়ান গাছ ঝাকি দিতেই শিউলি ফুল ঝরে পড়লো জাফরিনের ওড়নায়। নিচে পড়া ফুলগুলো মায়ান কুড়িয়ে তার আঁচলে দিতে দিতে বলল,

“তুমি কাঁদছো না কেন?”

“কেন কাঁদবো?”

” সবাই বলছে তুমি এভাবে থাকলে পাগল হয়ে যাবে।তোমার কান্না করা উচিৎ। কাঁদলে কষ্ট হালকা হবে।”

“আমার তো কোনো কষ্ট নেই মায়ান।আমার যা আছে সব নিয়তি।”

“অন্তত আমাকে মিথ্যে বলো না।তুমি কষ্ট পাচ্ছো কিন্তু নানু বা মায়ের কথা ভেবে কাঁদছো না।তারা ভেঙ্গে পড়বে বলে।”

জাফরিন হাত বাড়িয়ে ভাগ্নের মাথার চুলে লেগে থাকা শিউলি ফুল তুলে নেয় হাতে। সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এক সাথে যদি আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়ি তবে যে সমাজ,মানুষ আমাদের সুযোগ নিবে।বলবে ওদের অভিভাবক নেই,ওদের সাথে অন্যায় করলে প্রতিবাদ করবে কে?কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। আমাদের শক্ত থাকতে হবে অন্তত আব্বার লাশ দেশে আনার আগ অবধি।”

কথা গুলো শেষ করতেই জাফরিন অনুভব করলো কেউ একজন তার মাথায় হাত রেখেছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল তার মামাতো ভাই ইউভান দাঁড়িয়ে আছে।তার দিকে ফিরে তাকালো জাফরিন। ত্রিশ বছর বয়সী ইউভান বর্তমানে ইন্ডিয়াতে ডায়বেটিক ফুট জনিত বিষয়ে কোর্স করছে।বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যাটি বেশি দেখা দিয়েছে সেটা হলো ডায়বেটিক রোগীদের পায়ে নানান ধরনের সমস্যা। পা সব থেকে অবহেলিত অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হলেও যখন সেই পায়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন বুঝে আসে পা কতই গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগ তো আছে কিন্তু নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাক্তার। তাই এই বিষয়ে একটা ভারতে ডিগ্রি নিচ্ছে ইউভান।

এ সময় অবধি জানালার পাশের বিছানায় শুয়ে দূর থেকে জাফরিনের মুখের হাসি দেখছিল ঈশান।আশার ঘর থেকে ওদিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।জাফরিন সচরাচর এমন ভাবে হাসে না।তার এই হাসিতে যেন হাসতে থাকে তার পুরো মুখমণ্ডল। কিন্তু ইউভান কে দেখেই উঠে বসলো সে। জাফরিনের তথাকথিত মামাতো ভাইদের তার একটু বেশিই সন্দেহ হয়। সন্দেহ হওয়ার পিছনে কারণ অবশ্য তারা নিজেই।
আজ অবধি তো ঈশান কখনো তার নিজের ছোটো বোন, আপন বোনকে কখনো হাত খরচ দেয়নি।না দিয়েছে শখের কিছু কিনে নেওয়ার জন্য টাকা।অথচ জাফরিনের মামাতো ভাইগুলো বিশেষ করে ইউভান প্রতি মাসে তাকে কিছু না কিছু বাহানায় হাত খরচ দেয়, তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক অনলাইনে অর্ডার করে দেয়। এমনকি জাফরিনের হাতের ফোনটাও তার কিনে দেওয়া।

যেখানে মানুষ নিজের আপন বোনকে দেয় না, সেখানে কেউ ফুপাতো বোনকে এত কিছু কেন দিবে?
ক্রোধে ঈশানের হাত-পা নিশপিশ করছিল।যখন সে দেখতে পেল ইউভান মেয়েটার মাথায় হাত রেখেছে।
রাগের বশে সে আঘাত করে বসলো জানালায়। অথচ তার এমন রাগের কোনো কারণ সে নিজেও খুঁজে পেলো না।

(১৪)

ভালবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।

ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।

নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর কবিতা আপন মনেই আবৃত্তি করছিল মাশহুদ।পার্কিং এ গাড়ি রেখে প্রবেশ করলো ভিতরে। আড্ডা জমিয়েছে ভিন্ন বয়সের মানুষ। ওয়াইনের গ্লাসে চলছে চুমুকের ঝড়। প্রবেশ করতেই তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো তার দাদাসাহেব।আজ তার জন্মদিন৷ জন্মদিন উপলক্ষে তার দাদী পরেছেন জামদানী শাড়ি। অথচ আশেপাশে থাকা প্রতিটি মেয়েই প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় আছে বলেই ধরা চলে। এদের মাঝে দাদীকে এমন অবস্থায় দেখে মাশহুদের অধর প্রসারিত হলো।সে জানে আজকেও তাকে বিয়ের কথা বলা হবে।একজন ছেলে কতকাল একা থাকবে?

পিছন থেকে ছোটো একজোড়া হাত এসে আঁকড়ে ধরেছে মাশহুদের কোমড়। আধো আধো বুলিতে সে বলল,

“হে অল্ড বয়, হাউ আর ইউ?”

“আ’ম ফাইন, ইয়াং ম্যান।”

ছেলেটাকে কোলে তুলে নিতেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো জেনিফার। হালকা বাদামী চুলের এই মেয়েটা সিংগেল মাদার। এদেশে বিয়েটা এতটা প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না কেউ। কারণ প্রতিটি মানুষ এখানে আত্মনির্ভরশীল হতে চায়।জেনিফার দুঃসম্পর্কে চাচাতো বোন হয় মাশহুদের। এক সাথেই লেখাপড়া করেছিল।অথচ কে জানতো এই ফুলের মতোন মেয়েটার ভাগ্যে এতটা কষ্ট!

মাশহুদের ফোন হুট করেই বেজে উঠলো।বাচ্চাটাকে নামিয়ে দিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই অধর পুনরায় প্রসারিত হলো।কারণ স্ক্রিনে ছিল জাফরিনের নাম।

“হ্যালো।”

স্পষ্ট এবং তেজস্বী সুরে জাফরিন ইংরেজিতে বলল,

“আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি।মি.আমজল শিকদারের ছোটো কন্যা। আমি কী জানতে পারি আমার বাবার লাশ আমরা কবে ফেরত পাবো?”

জাফরিনের এমন কণ্ঠ আরো একবার মাশহুদ কে আহত করলো।সে যেন বর্ষার জলে বিলে থাকা কোনো এক সাদা বক। যার পায়ে হুট করেই লেগে গেছে অযাচিত কিছু। নিজের অস্থিরতা এবং পরিচয় গোপন করে সে বলল,

“ম্যাম,কিছু দিন সময় লাগবে।তবে আমরা দ্রুত করার চেষ্টা করবো।”

“আমার নির্দিষ্ট তারিখ জানা প্রয়োজন।”

“কিছু রুলস রয়েছে ম্যাম।সব কমপ্লিট হলেই আমরা আপনাদের জানাবো।আপনি কী মেইলের জবাব দিয়েছেন?”

“জি পাঠিয়ে দিয়েছি।”

জাফরিনের সাথে কথোপকথন শেষ করার পর বেশ সময় চুপ রইল মাশহুদ। এই মেয়েটা কেন নিজের মাঝে নিজেই এক শান্ত সাগর?যে তাকে টানছে চোরাবালির মতোন?

(১৫)

জাফরিনের প্রতি ইউভানের স্নেহ, ভালোবাসা সবটাই বোনের মতোই।কিন্তু এটাকে স্বাভাবিক ভাবে কখনোই নেয়নি জাফরিনের দাদাবাড়ির লোকজন। তারা একে অপরের সাথে আলোচনা করছিল জাফরিনের বাবা যেহেতু তাদের জন্য এত কিছু রেখে গেছে তাই তার মামাতো ভাই বা মামারা জমি,টাকা পয়সার জন্য হলেও তাকে বিয়ে করবে আর যেহেতু জাফরিনের ও তাদের প্রতি একটা আলাদা টান রয়েছে তাই বিয়েতে সে নিজেও অমত করবে না। কিন্তু এই ভাবে তার ভাইয়ের কষ্টের কামাই তো অন্যের ছেলেদের খেতে দেওয়া যাবে না।

জাফরিনদের ভালোর জন্য তারা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিলো,
জাফরিনের যে চাচাতো ভাই ক্লাস এইট পাশ করার পর থেকে বাজারে দোকান করে সেই চাচাতো ভাইয়ের সাথে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিতে হবে। এতে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে আর টাকাও। আর এতে যদি তার মামারা কোনো সমস্যা করতে চায় তবুও তারা মানবে না।প্রয়োজনে তাদের এক ঘরে করেই বিয়েটা তাদের দিবে,এবং ওটা লাশ আসার আগেই।

চলবে(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here