ক্যামেলিয়ান ৩৫

0
959

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৩৫

ঘড়ির ভিতরে কিছুই নেই। কিছুই নেই মানে তার প্রয়োজনীয় কিছুই নেই।তার ঘড়িটা খুলে সে একটা মাইক্রো চিপ পেয়েছিল অথচ এটায় কিছুই নেই।মাইক্রো চিপের মধ্যে যে ফাইল রয়েছে সেটা ওপেন করার জন্য একটা পাসওয়ার্ড প্রয়োজন ছিল।ঘড়ির জোড়াটা দেখে সে খুশিতে আহ্লাদিত হয়েছিল।ভেবেছিল ঘড়িটা খুলে কিছু একটা পাওয়া যাবে।
হতাশা তাকে ঘিরে ধরল অচিরেই।তার হাতে খুব বেশি সময় নেই।মাশহুদকে সে বলে এসেছে খুব দ্রুত সে ফিরিয়ে দিবে সব তথ্য।সেই তথ্যের বিনিময়ে মাশহুদ তাকে এখানে আসতে দিয়েছে।অথচ এতোটা সময়েও সে নিস্ফল।এই মুহুর্তে তার রাগ হচ্ছে সাথে প্রচন্ড ক্ষুধাও পেয়েছে।অথচ তার মনে পড়ল মাত্র ঘন্টা খানেক পূর্বেই সে খাবার খেয়েছে। ভরপেট খাওয়ার পরেও তার ক্ষুধা কীভাবে লাগতে পারে?এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে হচ্ছে মাশহুদ আসুক,তার পাশে বসে পরম যত্নে তার মুখে তুলে দিক ঝাল ঝাল কোনো খাবার অথবা চিকেন স্যুপ।সেদিন খাওয়ার সময় কী কান্ডটাই না করে বসেছিল জাফরিন।গরম গরম স্যুপ নিজের হাতে খেতে গিয়ে জিহ্বায় লেগে গেল ওমনি সে মাশহুদের জন্য আনা কোল্ড কফিতে চুমুক দিয়ে ফেলল।ভেবেছিল লোকটা হয়তো খাবে না তার এঁটো খাবার কিন্তু মাশহুদের মুখশ্রীতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।সে স্বাভাবিক ভাবে এসে বসলো। শার্টের হাতা তখন কনুই অবধি গোটানো।তার দু হাতের শিরা, ধমনী গুলো স্পষ্ট।তার মুখের দিকে তাকিয়ে জাফরিন সেদিন ভেবেছিল,
“সুপুরুষ?তাকে কী সুপুরুষ ভাবা যায়?অবশ্যই একজন সুপুরুষ। বিশেষত তার চোখ।যেন সমুদ্রের গভীরতা রয়েছে দুই চোখে, রয়েছে অজানায় হারিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ। এই চোখের দিকে অধিক সময় তাকিয়ে থাকা যায় না।স্বল্প ভাষী এই মানুষের অনুভূতির প্রকাশ হয় তার চোখের মাধ্যমে।এমিলি কী এই দুই চোখেই ডুবে মরেছে?কেবল কী এমিলি?না কী আরো কত নারীরা তাদের ইহজন্ম দান করতে চেয়েছে এই দুচোখে ডুবে?জাফরিন জবাব পাইনি।সে কেবল জেনেছে এই দুই চোখ নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ এবং নিষিদ্ধ। তার জন্য এই দুই চোখে ডুবে যাওয়া নিষিদ্ধ। অন্তরপথে আর কারোর আনাগোনা সে হতে দিবে না।কারণ প্রেমিক পুরুষের জাতটাই তার কাছে বেঈমানের জাত।যে নারী একবার প্রেমে ঠকে যায় তার জন্য পরবর্তীতে প্রেম মানেই পাপ।

এসব চিন্তা হতেই মন আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নিশ্চয়ই বাহিরে সন্ধ্যে নেমে এসেছে।ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।তার দরজার সামনেও নিশ্চয়ই পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে।যে পাহাড়া তাকে ভাবতে বাধ্য করে ‘ কেবল মাত্র সেই ডকুমেন্টসের জন্য এতকিছু?মাশহুদ সাহেব?”

চনমনিয়ে উঠা ক্ষিধেকে আরো উস্কে দিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়াতেই দরজা খুলে প্রবেশ করল দুজন।তাদের হাত ভর্তি খাবারের ব্যাগ।ব্যাগ রেখে চলে যেতেই প্রবেশ করলো মাশহুদ।এই যুবককে দেখে আরো একটা দফা ভড়কে গেল জাফরিন।সবসময় ফর্মালে দেখা মাশহুদ দাঁড়িয়ে আছে ঢোলা টিশার্টে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে জিমে গিয়েছিল সেখান থেকে মাত্র ফিরেছে। জাফরিনের সামনাসামনি এসে বলল,

“এখন কেমন আছেন?মনে হলো একা বিরক্ত হচ্ছেন তাই চলে এলাম।”

“বিরক্ত নই আসলে রান্না করছিলাম।”

“খাবার নিয়ে এসেছি।আমি গেস্টরুমটা ব্যবহার করবো।এসে খাবার সার্ভ করছি।”

“আমি হালাল হারাম মেনে চলি।”

চকিতে মাশহুদ থামলো।ভ্রু-কুঁচকে জাফরিনের দিকে তাকাতেই ঝটপট মেয়েটা জবাব দিলো,

“খাবারের বিষয়ে হালাল,হারামটা মেনে চলি।হারাম খাবার খাই না।তাছাড়া এলকোহল!

” আমার পরিবারেও হালাল খাবারটাই খাওয়া হয়।ভয় নেই,মুসলিম শেষ রান্না করেছে।বিসমিল্লাহ বলেই আমার পরিবারের জন্য পশু জবাই হয়।খাবারটা বাসা থেকেই এসেছে।”

মাশহুদ ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলে জাফরিন খাবারের প্লেট নিয়ে আসে।অপেক্ষা করার ধৈর্য্য নেই তার।ঢাকনা খুলে দেখতে পায় গরুর মাংসের রেজালা,ঝাল ঝাল করে মুরগী ভুনা,পাবদা মাছের ঝোল এবং সরু চালের ভাত।
গরুর মাংস দেখে তার একবার হুট করেই মনে হয়,

“কত বড় পরিবার এদের?তাদের জন্য আলাদা গরু কোরবানি হয়?এদের এতো টাকা?”

পরক্ষণেই মনে হয় টাকা আছে বলেই তো এতো রহস্য।সেই রহস্যের কারণে আজ সে এখানে।মাশহুদ ফিরে এসে দেখে জাফরিন লেবু কেটে এনেছে।সে বেশ বুঝতে পারলো মেয়েটা ক্ষুধার্ত।খাবার খাওয়ার সময় জাফরিন মাশহুদকে প্রশ্ন করল,

“এসব আমার পছন্দের আপনি জানলেন কীভাবে?”

“ঠিক এখানের চেয়ারে বসেই আপনার বাবার হাতের রান্না করা এসব খাবার খেয়েছি। তখন বলতেন এসব খাবার আপনার এবং আপনার দাদীর ভীষণ পছন্দের।আপনার বড় আপা ছোটো মাছ পছন্দ করে আর মেঝ আপা কেবল গরুর মাংস আর দুধ খেতে ভালোভাবে।ডিমটাও পাতে তুলে না।”

জাফরিনের গলা ভার হয়ে এলো।সে নাক টেনে টেনে জিজ্ঞেস করল,

“আর কি বলতো?”

“ঈশানের জন্য সে খুশি ছিলেন না।অথচ আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছিলেন।”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো জাফরিনের।মাছের কাটা ফেলে সে মাশহুদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“বাবার মৃত্যুর কারণ কী মাশহুদ সাহেব?আপনার এত রহস্যের কারণ কী?আমি কেন নজরবন্দি?”

“স্যারের মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল।পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট তো তাই বলেছে।আমি ছিলাম না তখন।যখন ফিরেছি ইতিমধ্যে লাশটা পোস্ট মর্টেম করা হয়েছে।”

“লাশ নয়, আমার বাবা।”

খাবার প্লেটে হাত থেমে গেছে দুজনের।মাশহুদের ইচ্ছে হলো জাফরিনের মাথায় হাত রেখে বলতে, তাকে স্বান্তনা দিতে কিন্তু সে উঠে গেল না।প্লেটে হাত ধুয়ে উঠলো জাফরিন।টেবিলে খাবারটা ঢাকা দিয়ে রেখে এসে বসলো জাফরিনের পাশে।জাফরিন তার উদ্দেশ্যে বলল,

“বাবার সব আমাকে বলুন।আপনাদের কিসের তথ্য ছিল বাবার কাছে। নিশ্চিত থাকুন এখানে কোনো ক্যামেরা কাজ করছে না।আমি এবং আপনি আছি।আমার সবটা জানা প্রয়োজন মাশহুদ সাহেব।আমার বাবার জন্য। অন্তত আমার মনের জন্য।এই তথ্য না পাওয়া অবধি আমি আমার বাবার মৃত্যু রহস্য সমাধা করতে পারব না।”

“মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল জাফরিন।”

“সেটা সময় ঠিক করে দিবে।এবার বলুন।”

“তথ্যটা আমার কোম্পানি রয়েল’স মুনের ব্যাপারে।নতুন প্রজেক্ট চালু হয়েছিল। হুট করেই মৃত্যু হলো তিন যুবকের। এক্সপেরিমেন্টাল ছিল বিষয়টা।গোপনীয়তা ছিল কিন্তু এটার সাথে যুক্ত রয়েছে তিনটি দেশের যৌথ কাজ। আমাদের কোম্পানির নতুন ডিপার্টমেন্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট এবং আপনার বাবা আমাদের কোম্পানির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন।ইঞ্জিনিয়ার হওয়া স্বত্বেও বিভিন্ন জৈব যৌগের প্রতি বিশেষ টান।তিনিই সবটা দেখছিলেন।আপনার বাবার মৃত্যুর সাথে থেমে আছে কাজ আর এই কাজের উপর লাগানো হয়েছে আমাদের কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ার।আগামী তিন মাসের মধ্যে তথ্য না পেলে আমাদের কোম্পানি চলে যাবে বিদেশি ইনভেস্টরদের হাতে।এজন্য তথ্যটা আমাদের প্রয়োজন।”

“কেমন মেডিসিন? ড্রাগ?”

“তেমন নয় তবে অনেকটা কমও নয়।পূর্বের মমি গুলো তো এখনো আছে কিন্তু তাদের চেহারাটা কিছু বিকৃত হয়ে যায়। মৃত্যুর পর যেন চেহারা কোনো পরিবর্তন না হয় এবং লাশ সংরক্ষণ করা যায় সেই গবেষণা চলছে।”

“প্রকৃতির খেলাপ যাচ্ছেন।”

“স্বাভাবিক ভাবে আমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাচ্ছি।এতে টাকা আসবে।একজন ব্যবসায়ী হিসেবে মানুষের ক্ষতি যেন না হয় এবং আমি লাভবান হতে পারি সেটাই দেখবো।”

জাফরিন মাথা নিচু করে বসে রইল।এবার তার মাথার ঝট ধীরে ধীরে খুলছে।নিশ্চয়ই তার আশেপাশে রয়েছে সেই সব৷কিন্তু না,এটা সঠিক সময় নয়। তাকে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আগামীকালের সূর্যদয়ের জন্য।এরপর?হ্যাঁ ইউভানকে জানাতে হবে।কারণ ক্ষমা যতই মহৎগুণ হোক না কেন আমি তো প্রতিশোধ নিতেই পছন্দ করব।

মাশহুদ চলে যাওয়ার পূর্বে জাফরিনের উদ্দেশ্যে বলল,

“নিজেকে স্ট্রেস দেওয়ার মত কিছুই ঘটেনি।আমাদের হাতে সময় আছে।তাছাড়া আগামীকাল তৈরী থাকবেন।আপনাকে কিছু মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।”

“কাদের সাথে?”

“ধরে নিবেন আপনার ভবিতব্যের সাথে জাফরিন।একা একা এখানে আপনাকে রেখে আমি কিছুইতেই মন বসাতে পারি না।অথচ আমার অনেক কাজ বাকী।আপনি চোখের সামনে থাকলে অন্তত মনের মাঝের অস্বস্তিটা থাকবে না।”

মাশহুদ চলে গেছে। জাফরিন উঠে দাঁড়ালো।খাবার টেবিলে ফিরে এসে পুনরায় ভাত বেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করল সে।আজ তার হলো টা কী?এত কেন খাচ্ছে সে?

চলবে (

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here