ক্যামেলিয়ান ৩৪

0
1044

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৩৪

প্রচন্ড কষ্টের পর স্বস্তির অনুভূতিটা ঠিক বৃষ্টির পরের রঙ ধনুর মতো স্নিগ্ধ হয়।মাশহুদের বাবার সামনে বসে আছে মাশহুদ।ভদ্রলোকের ডান হাতটা প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল।থেরাপি এবং মেডিটেশনের সাহায্যে কিছুটা ঠিক হয়েছে। বাবার হাত ভাঙার পিছনের গল্পটাও করুণ।চেয়ার টেনে বাবার সামনে বসে মাশহুদ বলল,

“এখন কেমন আছেন?শরীর ঠিক আছেন তো?”
“আমি ঠিক আছি তবে তোমার কী হলো?”
“বাবা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।”
“বলো।”
“বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? কখনো জানার চেষ্টা করেছেন?”
“না করিনি। কিন্তু কেন?”
“বাবা আপনাকে কিছু জানানোর ছিল।কথাটা এখানে বলাটা উচিৎ হবে কী না বুঝতে পারছি না।”
“চলো তবে বাহিরে হেঁটে আসা যাক।”
“বাবা?আপনি কী এখনো মমকে ভালোবাসেন?”
“ভালোবাসার ব্যাপারটা ঠিক ঘৃণার মত একই প্রসেস।শুধু একটি কয়েনের দুটো দিক মাত্র।”
“আপনার আফসোস হয় না?এভাবে মায়ের অপেক্ষাতে পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গেল,আপনিও চাইলে সুখী হতে পারতেন অন্য কাউকে নিয়ে।”
“তোমার মা যখন তোমাকে ছেড়ে চলে যায় তখন তুমি সাত বছরের একটা নাবালক ছেলে মাত্র, আজ তুমি আটাশ বছরের এক যুবক।ঠিক একুশ বছর পূর্বে তোমার মা চলে যাওয়ার সময় আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল সে দেখে নিবে বিশ বছর পর আমি তুমি কোথায় থাকি আর তোমার মা কোথায় থাকে।আমি হেসে বিদায় দিয়েছিলাম,তোমাকে মানুষ করার নেশাটা আমার তুঙ্গে চড়ে গেল।প্যারেন্টাল ডে নয় আমিই তোমার বাবা-মা হয়ে গেলাম।আজ দেখো তুমি আমি দুজনে কোথায় আর তোমার মা কোথায়?আমাদের চারপাশে এক দল লোক থাকে যারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে এবং তারা তিল কে তাল বানিয়ে ভিক্টিম সেজে যায়।ঠিক তেমনি তোমার মা ভিক্টিম ব্লেমিং করেছিল নিজেকে।অথচ আজ কী সে সুখী?তার এত বছর চাকরি করে জমানো টাকা যখন তার স্বামী জুয়াতে হেরে গেল,মদ্যপ হয়ে তাকে মারধর করলো সেদিন কিন্তু আমার কাছেই ফিরতে হয়েছিল।ভালোবাসায় অহমিকা থাকতে নেই।কাকে ভালো বাসছো,সে কেমন,কালো না বোঁচা, লম্বা না বেঁটে কিংবা সুশ্রী না কী কুশ্রী, এসব দেখার প্রয়োজন নেই,তুমি দেখবে সে তোমার সাথে সুখী কি না,তোমাকে চায় কী না। সে যদি তোমাকে না চায়,তার মনে যদি অন্য কেউ থাকে তবে তাকে জোর করে আটকে রেখ না।এক তরফা ভালোবাসার স্বাদ মহুয়ার মতো। তুমি একাই হাসবে, কাঁদবে কল্পনায় সংসার সাজাবে কিন্তু তাকে প্রয়োজন হবে না।কষ্টটা সয়ে আসবে।”

মাশহুদ তার দিকে তাকিয়ে রইল।দুই একটা চুলে সাদা রঙ ছাড়িয়ে ভদ্রলোকের। অথচ মনে সেই ভালোবাসা রয়ে গেছে যেমনটা ছিল আজ থেকে একুশ বছর পূর্বে।ইতস্তত ভাবে সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

“যদি মম ফিরে আসে তাকে ফিরিয়ে নিবেন বাবা?”
“কখনো না।ভালোবাসাটা এক জায়গায় কিন্তু তার উপরে আত্মসম্মান। ভালোবাসা ছাড়া বাঁচা যায় আত্মসম্মান ছাড়া নয়।”

“আমার আরেকটা কথা ছিল।আপনি একটু বসবেন?”

“তোমাকে চিন্তিত লাগছে কেন?”

“আমি আজমল সাহেবের লাশের সাথে বাংলাদেশ গিয়েছিলাম”

চকিতে ভদ্রলোক বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালের ছেলের দিকে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন?”
“আমাদের সেই সব ডকুমেন্টসের ক্লু আজমল সাহেবের কাছে ছিল।সবটা জানা দরকার।”

“না যেটা হয়েছে সেটা থেকে ফিরে আসো।আমরা জানি শত্রু ঘরেই আছে।”

“কিন্তু সেখানে আমি অন্য কিছু জেনেছি।”

“কী?”

“দাদার আগের পক্ষের স্ত্রী বেঁচে আছেন।তারা যুদ্ধে মারা যায়নি এমনকি দাদার সেই স্ত্রীর পুত্র রয়েছে।তারা পরিপূর্ণ পরিবার।”

বেহুশের মতো উঠে দাঁড়ালেন আরমান সাহেব।ছেলের কাঁধে হাত রেখে সে বলল,

“তুমি কীভাবে এসব জানলে?”

“কৌতুহল বশত গিয়েছিলাম, সেখানে সবটা জানতে পারি।উনারা বেঁচে আছেন।”

“কী করে সম্ভব?কাকা যে বলেছিলেন সবাই মারা গেছে?”

“ছোটো দাদা মিথ্যে বলেছিলেন কেন জানি না তবে আপনাকে না জানিয়ে একটা কাজ করে বসেছি।”

“আবার কী করেছো তুমি?”

“আমি তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছি।”

আরমান সাহেব এবার আর উত্তেজনা সহ্য করতে পারছিলেন না।তার ছেলেটা এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী। যে কোনো সংবাদ হোক সেটা খারাপ বা ভালো খুব শান্ত ভাবে বলতে পারে।এতোটা শান্ত ভাবে বলতে পারে যেন সে কাউকে পানি খেতে বলছে অথবা জিজ্ঞেস করছে তার পোষা প্রাণীটাকে সে খেয়েছে কী না।উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকা আরমান সাহেবের হাতদ্বয় ধরে তাকে বসালেন মাশহুদ।তার বাবাকে এই মুহুর্তে জাফরিনের কথা বলা যাবে না।জাফরিনের কথাটা চেপে দিয়ে সে বলল,

“মাস খানেক সময় হলো তারা এই শহরেই আছে।”

“আর তুমি যে মেয়েটাকে নিয়ে এতোটা প্যানিক হয়ে যাচ্ছো সে কে?”

“আপনি তার কথা কীভাবে জানেন?”

“আমি তোমার বাবা এটাও মাথায় রাখতে হবে।মিস শিকদারকে বাসায় নিয়ে এসো।তোমার দাদার সাথে আমি কথা বলে নিব।”

“বাবা জানেন তো?বঙ্গ দেশের নারীর মুখে সে কি মায়া!তার সারা গা দিয়ে যেন মায়া উপচে পড়ে।আদুরে আদুরে কণ্ঠে তারা ডাকে।তাদের চুলগুলো ভীষণ কালো অথচ গা দিয়ে কেমন স্নেহের গন্ধ বের হয়।অধিকাংশ মেয়েদের আদুরে স্বভাব অথচ চরিত্রের কী তেজ! নিজেদের আত্মসম্মানের জন্য তারা কাউকে ছাড় দেয় না। মিস শিকদার সেরকম।আসবে না বাবা।”

“তুমি ওকে বিপদে ঠেলে দিয়েছো।”

“মনির চাচ্চু বলেছে শিকদার সাহেবের মৃত্যু স্বাভাবিক।”

“দেশ থেকে ফিরে এসেও এসব বলছো?তুমি যদি ভুল না হয়ে থাকো তবে এই মনির চাচ্চুর বাবার জন্যই কিন্তু দেশে থাকা মানুষের খবর পাওয়া যায়নি।আগে থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো এবার তো বুঝো।”

“আগামীকাল সব পরিষ্কার হয়ে যাবে বাবা।মাত্র কয়েকটা ঘন্টা।”

____________________________

অন্ধকার হাতড়ে জাফরিন প্রবেশ করলো নিজের ফ্ল্যাটে।সে আজ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিজে হাতে নিয়ে বেরিয়েছে হাসপাতাল থেকে।মাশহুদ তাকে আসতে দিতে চায় নি আবার নিষেধ ও করেনি।জাফরিন জানে তাকে এখানে নিয়ে আসার একমাত্র কারণ সব কিছুই তাকে দিয়ে বের করানো।এতদিনের ইদুর বিড়ালের খেলা আজ থেকে মুখোমুখি চলুক।প্রথমে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই চাবি দিয়ে সব কিছু লক করে নিলো সে।নিজের ব্যাগে থাকা অত্যাধুনিক ডিভাইসটা বের করে পুরো ফ্ল্যাটের চারপাশে রেখে দিলো চারটে।মাত্র মিনিট পাঁচের অপেক্ষা। যদি ফ্ল্যাটে কোনো হিডেন ক্যামেরা থেকে থাকে তবে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।বন্ধ হতেই ডিভাইস গুলোর নীল বাতি লাল হয়ে যাবে।ফ্রিজ থেকে পানি বের করে এক গ্লাস পানি খেল সে।মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে।বমির ভাবটা কিছুতেই কাটছে না।এই মুহুর্তে তার ঘুমের প্রয়োজন। সব কিছু ভুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে।বেশ কিছু সময় ঘুমিয়ে কাটালো।ঘুম থেকে উঠে বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিলো।কিচেনে ফিরে কফি বানালো।এক কুকারে ভাত, অন্যটায় রেডিমেড চিকেন বসিয়ে কফি হাতে বসলো ল্যাপটপের সামনে।ঘুম এবং খাওয়া দুটো ঠিক না হলে তার মাথা কাজ করবে না।ল্যাপটপ কোলে নিয়ে টুকটাক কাজ করলো।কিছু খুঁজলো না।এই ঘরটাতে সে একা তাই তাকে কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না।আসার পূর্ব সে মাশহুদের হাতের দামী ঘড়িটা নিয়ে এসেছে।রান্না হয়ে গেলে পেট ভর্তি করে খাবার খেল,চুলে বেনুনী করে বিছানায় বসলো সে।তার সামনে দুটো ঘড়ি।দুটো কাপল ওয়াচের একটা সেট।নিজের বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া ঘড়িটা পাশে রেখে খুলতে লাগলো মাশহুদের ঘড়ি।পুরো ঘড়িটা খুলে যেতেই রাগ,ক্ষোভ,বিস্ময় এবং স্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল সে।তবে কী সে পেরেছে সবটা সামলে নিতে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here