আলেমের বউ পর্ব ১+২

0
1000

#আলেমের_বউ (পর্ব-১+২)


মিসেস ফাতেমা বেগম আর মো.আরিফুর রহমানের ঘরে আলো নিয়ে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে একটা মেয়ে!
আদর করে নাম দিয়েছে নাজিফা।
নাজিফা নামের অর্থ পবিত্র।
আরিফুর রহমান খুব ছোটকালে মা হারিয়েছেন!তাই তিনি তার মেয়েকে মামুনি বলেই ডাকেন!মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলে ও তাদের পরিবারের কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি!
নাজিফাকে ও মাত্র চার বছর শেষ না হতেই গ্রামের স্কুলে ওয়ানে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়!বাবার হাত ধরে ঘুটি ঘুটি পায়ে ছোট নাজিফা স্কুল গেটে পা রাখে!
আজ নাজিফার স্কুলের প্রথম দিন!
প্রধান শিক্ষক এর কক্ষে গিয়ে ছোট্ট নাজিফাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন,ওয়ানের ক্লাসের সামনে দিয়ে বাবা বিদায় হয়।এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে নাজিফা ক্লাসের মাঝে!অজানা ভয়,অনেক গুলো ছেলে মেয়ের কোলাহলময় পরিবেশে চুপচাপ একটি টেবিলে বসে পড়ে নাজিফা!আপন মনে ছেলে মেয়ে গুলো খেলা করছে!নাজিফা হা করে তা তাকিয়ে দেখছে!ক্লাসে নাজিফা নতুন!কারণ সবার শেষে নাজিফাই ভর্তি হয়েছে!ক্লাস শেষ করেই বের হলে দেখা মিলে নাজিফার মা মিসেস ফাতেমা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন!
মায়ের হাত ধরে বাসায় ফিরে নাজিফা!
ক্লাসে কয়েক দিনের মাঝেই অনেক গুলো মেয়ে নাজিফার খেলার সাথী হয়ে পড়ে!দশটায় ক্লাস জেনেও নাজিফা নয়টায় চলে আসে স্কুলে খেলা করার জন্য।


এমনি এক সকালে খেলছিলো নাজিফা।দশটায় বেল পড়লে দৌড়ে ক্লাসে আসে নাজিফা!এসে দেখে তার সব বই-খাতা আর কলম নিচে পরে আছে!নাজিফা তাড়াতাড়ি তা হাতে তুলে নিলো!আর নিজের সিটে বসতে যাবে ঠিক তখনি খেলো বড় জোরে এক ধাক্কা!ঢাল সামলে নিয়ে নাজিফা চোখ তুলে তাকালো!নাজিফার বয়সী ফুটফুটে একটা মেয়েই এমন করেছে!নাজিফা এই প্রথম মেয়েটাকে দেখেছে!হ্যাঁ এই মেয়েটা ভর্তি হবার কয়েক দিন পর থেকে আর আসেনি!আজ প্রথম এসেছে!নাজিফা আবার ও বসতে যাবে তখন মেয়েটি নাজিফার হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে পিছনের একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে বলল,”আজ থেকে তুই এখানে আর আমি ঐ প্রথম বেঞ্চে বসবো!ছোট্ট লোকের মেয়ে সামনে বসার সাহস হয় কি করে?উওরের অপেক্ষা না করেই চলে যায় মেয়েটি!নাজিফার ও তো ছোট্ট,এমন কথার উওর তার থেকে নেই!ছোট্ট লোক আর বড় লোকের মানে এখন ও নাজিফা বুঝেনা! এমন হচ্ছে এই প্রথম ঘটনা,ভয়ে চুপসে গেছে নাজিফা!মন খারাপ করে বসে রইলো শেষ বেঞ্চের মাঝে!স্যার ক্লাসে এসে গেছে,ক্লাস শেষ করে মন খারাপ করেই নাজিফা বাড়ি ফিরে যায়!

ছোট্ট এই মনে এমন আঘাত নিতে পারছিলো না নাজিফা!মাকে প্রশ্ন করলো,”মা আমরা কী ছোট্ট লোক?
মিসেস ফাতেমা বেগম মেয়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন!কি উওর দেবেন তিনি মেয়েকে!হয়তো তার থেকে কোনো উওর ছিলোনা!কথা অন্যদিকে নিয়ে গেলেন ফাতেমা বেগম!
পরের দিন আবার ও প্রথম বেঞ্চে বসে গিয়ে নাজিফা!আজ ও সেই ফুটফুটে মেয়েটি নাজিফাকে তুলে দেয়!নাজিফা চলচল চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে!মেয়েটা অট্র হাসি দিয়ে বলে,তুই এই বেঞ্চে কখন ও বসতে পারবিনা!এই বেঞ্চটা শুধু আমার!এবার নাজিফা মুখ খুলে বলল,
তোমার বেঞ্চ হয় কী করে?এটা সবার জন্য!মেয়েটা আরো জোরে হেসে বলল,তুই কেরে!আমাকে চিনিস?আমার আব্বু এই স্কুলের মেনেজিং কমিটি!আমি চাইলে তোকে স্কুল থেকে বের করে দিতে পারি আব্বুকে বলে!স্কুল থেকে বের করার কথা শুনে নাজিফার গলা শুকিয়ে ঢোক গিলা শুরু হয়ে যায়!চুপচাপ গিয়ে শেষ বেঞ্চে বসে থাকে, কি আর করার আছে,হয়তো এটাই ছোট্টলোকদের সাথে হয়!বুঝে নেয় এটাই হয় তো ছোট্টলোকদের সাথে হওয়া উচিৎ,যা মেয়েটা করছে!কিন্তু মেয়েটা কী জানে ছোট্টলোক কী?নাকি সে ও আমার মত জানে না!কিন্তু তাহলে বলল কেমন করে!নিজের মাঝেই সব প্রশ্ন বাসা বাঁধে!
ধীরে ধীরে নাজিফা বড় হয়ে উঠে!মায়ের কাছের থেকেই নাজিফার আরবী শিক্ষা নেওয়া হয়!ছোট্ট মেয়ে স্কুলের অনেক পড়ার চাপ পড়ে যায়!সব মিলিয়ে ঐ পরিবেশটাকেই নাজিফা আপন মনে করে বেড়ে উঠে!
যৌথ পরিবারেই ছিলো নাজিফার বসবাস!নাজিফার বাবার আরো তিন জন বড় ভাই আছেন!তাদেরে বউ আর ছেলে মেয়ে!নাজিফার বাবার ছোট্ট একটা দোকান ছিলো
তা দিয়েই চলতো তারা!অল্প বয়সেই নাজিফা বুঝে যায় যে তাকে কী করে চলতে হবে!নাজিফা নিজেকে ঐ ভাবেই পরিচালিত করেই বেড়ে উঠে!মাত্র ক্লাস ফাইভ এ নাজিফা!
প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় স্কুল থেকে বাড়ি চলে আসে নাজিফা!ডাক্তার এর কাছে গেলে ডাক্তার কিছু ঔষধ লিখে দেয়!কিন্তু তাতে নাজিফার ব্যাথা আরো বাড়তে থাকে!পরে আরো ভাল ডাক্তার দেখানো হয়!ডাক্তার কিছু টেস্ট করতে দেয় নাজিফার!টেস্ট রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলল,”নাজিফার মাথায় টিউমার হয়েছে!
ওভারিয়ান টিউমার!
যত দ্রুত সম্ভব হয় অপারেশন করিয়ে নেবার কথা বলা হয়!
একদিকে ছোট্ট নাজিফার জীবন মরনের প্রশ্ন!অন্য দিকে অপারেশনের জন্য এতগুলো টাকা কোথায় থেকে পাবে!নাজিফার বাবা আরিফুর রহমান তার বড় ভাইদের কাছে টাকা ধার চাইলে তারা দিতে রাজি হয়নি!নানা কথা বলে অজুহাত দেখিয়ে না বলে দেয়!এই দিকে
মেডিকেল বেডে এর মাঝে শুয়ে প্রচন্ড ব্যাথায় ছোট্ট নাজিফা চাপা কাঁন্না করেই যাচ্ছে!নাজিফা অদ্ভুত রাত শেষ হবার প্রহর গুনছে।মাথা এতটা ব্যাথা করছে।সব কিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে নাজিফার!মনে হচ্ছে কেউ তাকে ডাকছে!প্রচন্ড ব্যাথায় সব উল্টা পাল্টা বকছে নাজিফা!মাঝ রাতে হঠাৎ আবার কারেন্ট চলে গেছে নাজিফার ভিতরে এখন আরো বেশি ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে।ঝাপসা আলো সবাই ঘুমাচ্ছে……
মাথাটা ঝিমঝিম করছে।তাও জোর করে চোখ খুলে বসে আছে,,
খেয়াল করল দরজা কে যেন খুলছে ছায়ার মতো কারা যেন ঢুকছে দেখতে অর্ধটা
মানুষের মতো আর অর্ধটা জানি না…..
নাজিফা চিৎকার দিয়ে উঠলো!কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না!
নাজিফা তার মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না শুরু করে দেয়!মেয়েকে হারানোর ভয়ে মা ও মেয়েকে জড়িয়ে কাঁন্না শুরু করে দেয়!এতে করে পাশের সিটের মহিলার ঘুম ভেঙ্গে যায়!মহিলাটি রেগে গিয়ে জোরে জোরে বকা শুরু করলেন,”মা মেয়ে মিলে কী ঢং শুরু করলেন,সিনেমা হচ্ছে নাকি?কোথায় থেকে আসে এইসব পাগল-ছাগল!
নাজিফা আর নাজিফার মা চুপ হয়ে যায়!
মহিলাটি আবার ঘুমিয়ে পড়েন!
নাজিফার মাথায় হাত বুলিয়ে মিসেস ফাতেমা বেগম ঘুম পাড়িয়ে দেয়!
ফজরের আজান বেসে আসলে কানের মাঝে উঠে গিয়ে অজু করে নামাজ পড়ে মেয়ের জন্য দোয়া করেন আল্লাহ্ কাছে!
এই দিকে নাজিফার বাবা মানুষের কাছে টাকা ধার চেয়েই যাচ্ছে!কিন্তু কেউ দিতে রাজি না!



চলবে….

লিখা: শারমিন সুলতানা সালমা

#আলেমের_বউ (পর্ব-২)



নাজিফার মামা কিছু টাকা দিলে ও অপারেশনের জন্য আরো অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো!
অবশেষে টাকার মিল না পেয়ে নাজিফার বাবা আরিফুর রহমান তার ছোট দোকান বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে পড়েন!দোকান বিক্রি করে টাকা নিয়ে মেডিকেল চলে আসেন!ডাক্তারের হাতে টাকা তুলে দিলে ডাক্তার তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন নাজিফার অপারেশনের!অপারেশন সাকসেসফুল হয়।প্রায় ছয় ঘণ্টা পর নাজিফার জ্ঞান ফিরে!
সেই দিন নাজিফাকে আর কেবিনে আনা হয়নি পরের দিন আনা হয়!

কাঁথা গায়ে দিয়ে গভীর ঘুমে
নাজিফা।মাথার তালুতে একটা নরম স্পর্শ টের পাচ্ছিলো।চোখ মেলে তাকাতেই না আবার চোখ বন্ধ করে নেয় নাজিফা,নরম আদর নিচ্ছে।বুঝতে পারছে এটা মায়ের হাত।মায়ের আঙ্গুল গুলো পিয়াজের মত পলি পলি করে খাজ কাটা। কপালে যখন মা হাত দিচ্ছিল স্পষ্টই আঙ্গুলের খাঁজ কাটা জায়গাতে খস খস সূক্ষ আওয়াজ তুলছিল।কম করে হলেও গত দশ বছর তিনি তার এই আঙ্গুলের ডগা দিয়ে গাজর, মুলো,আলু,পটল, পিয়াজ কেটেছেন।সময় সুযোগ বুঝে দা’ ও তার প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। নিত্যদিন কাটাকাটির ঘর্ষণে মায়ের আঙ্গুল গুলো এখন ফালা ফালা হয়ে আছে।সেই জায়গাগুলো কুচ কুচে কালো।
আমি ভাবি- একদিন আমার মায়ের হাত ও ছিল লাঊ ডগার মতোন।তার আঙ্গুলের সাদা চামড়ার নিচেও একদিন রক্তরা খেলা করছে দেখা যেত, এখন সেসব জায়গা কালো।
-নাজিফা মা উঠনা!আর কত ঘুমাবি?
-হুম উঠছি মা!

কয়েক দিন পর নাজিফাকে মেডিকেল থেকে
বাড়ি নিয়ে আসা হয়!


নাজিফার বাবার দোকান না থাকায় কাজের খোঁজে শহরে চলে যায়!
ব্যস্ত নগরীতে নাজিফার বাবা এগিয়ে যায় কাজের সন্ধানে!কয়েক দিন পর একটা কাজ পেয়ে যায় নাজিফার বাবা!



নাজিফার ক্লাস ফাইভ এর ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া শেষ!অন্যদিক নাজিফার মা মিসেস ফাতেম বেগম আবার ও মা হতে চলেছেন!
প্রচন্ড প্রসব ব্যথায় তিনি বেকুল হয়ে যায়!ছোট্ট নাজিফা তার বড়মা মেঝোমা এবং সেঝোমা কে ডেকে বলে”মা জানি কেমন করছে!তোমরা দেখে যাও!
নাজিফার বড়মা নাজিফাকে ডেকে বলল,”তোর নানার বাড়িতে ফোন দেয়!তাদের আসতে বল!আমরা কী করবো,তোর মাকে ডাক্তার এর কাছে নিতে যেতে হবে!


ছোট্ট নাজিফা তাড়াতাড়ি নানার কাছে ফোন দেয়!কিন্তু কাঁন্নার জন্য কথা বলতে পারেনা!শুধু বলে তোমরা তাড়াতাড়ি আসো!মা কেমন জানি করছে!
নাজিফার ফোন পাওয়ার পরেই গাড়ি নিয়ে আসে নাজিফার মামা,নানা,নানি আর মেঝো খালামনি!
নাজিফার মাকে মেডিকেল নিয়ে যাওয়া হয়!


কন্ডিশন খুব একটা ভাল না।বলে দেয় ডাক্তার!ডাক্তার এর কথা শুনে নাজিফার মামার মাথায় যেন বাজ পড়ল।ঢোক গিলে বলল,
-এর চিকিৎসা তো আছে না? নাকি অন্য কোথায় ও নিয়ে যেতে হবে?
-ডাক্তার ফারহানা কবির বলল,” না,কোথাও নিতে হবে না।আজ রাত থেকেই প্লাটিলেট দেওয়া শুরু করতে হবে।আপনারা বরং যত দ্রুত সম্ভব প্লাটিলেট ম্যানেজ করে ফেলেন।
সাথে সাথেই নাজিফার মামা তার বন্ধু
ডাক্তার আজাদকে কল দিলেন।ও বলল,
-তুই কোন চিন্তা করিছ না, আমি এক্ষনি আসতেছি,সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।মামার বন্ধু
আজাদ তড়িঘড়ি করে আসলো তার হাতে দুই ব্যাগ প্লাটিলেট।মামার দিকে আসতে আসতে বলল,
-ভাগ্য ভাল,দুই ব্যাগ রেডি প্লাটিলেট পাওয়া গেছে!প্লাটিলেট দেওয়ার পর মায়ের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিকের দিকেই যাচ্ছে।হঠাৎ করেই আবার অবস্থার উল্টো দিকে মোড় নিল।ডাক্তার ফারহানা কবির এবং আরও কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার মিলে সিদ্ধান্ত নিল আজকেই অপারেশন করতে হবে!

সাথে সাথে বাবাকে ফোন করে মেডিকেল আসতে বলাম!কিছু সময়ের মাঝেই বাবা চলে আসেন!
ডাক্তার দের কথা শুনে বাবার মাথায় এবার আকাশ ভেঙে পড়ল।এসব কি কথা বলছে ডাক্তাররা! গর্ভের বাচ্চার বয়স মাত্র সাড়ে আট মাস। এখনও তো অনেকটা সময় বাকি! তাহলে এখনই কেন অপারেশন করা লাগবে!বাবাকে শান্তনা দিয়ে মামা বললেন,”নাজিফার বাবা দেখেন বড় আপার কিছু হবেনা!একটু মাথা ঠান্ডা করে শুনেন।এখন বড় আপার যে অবস্থা, এ অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করে ডাক্তার বাচ্চার জীবন বাচানোর চেষ্টা করতে পারেন!বাবা দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন,মানে! বাচ্চার জীবন মানে কি?তাহলে আমার নাজিফার মা…!
আমি আঁৎকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম বাবাকে?
-মায়ের কিছু হতে না তো বাবা!
বাবার উওরের আগেই ডাক্তার ফারহানা কবির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-আপনার স্ত্রীর জীবন এখন যথেষ্ট সংকটাপন্ন!আল্লাহ্‌কে ডাকেন,আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করব!ইনশাআল্লাহ্।



আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,ডাক্তাররা এই সব কি বলছে!এত ছোট্ট মেয়ে হয়ে বুঝা সম্ভব ও না!আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছি।মাকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে ঐ দিকে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলাম।প্রথমবার ব্যর্থ হলাম, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।মেঝো খালামনি আমার পাশেই বসে ছিল, ও আমকে ধরে নিয়ে আসলো।
কেন জানি আমার মনে হল,পায়ে কোন জোর পাচ্ছি না।ব্যাপারটাকে পাত্তা দিলাম না।খালামনিকে বললাম,
-খালামনি মা কে কোথাও কি আরও ভাল চিকিৎসা হবে?
-খালামনি বলল,” না রে মা!কোথাও গিয়ে কোন লাভ নেই।এখানেই সর্বোচ্চটাই চেষ্টা করা হবে।তুই এত ভাবিস না তো,আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।

মাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।আমি কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।আমার দুচোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে।বাবার ও পড়ছে!কিন্তু বাবা তা লুকানো মিথ্যা চেষ্টা করে যাচ্ছে!কারণ পুরুষ মানুষদের যে কাঁন্না মানায় না!চোখের পানি এমন করে ফেলতে নেই সেটা আমি জানি কিন্তু আজ হাজার চেষ্টা করেও যেন তা থামাতে পারছি না,বাবা-মেয়ে সাথে নানি এবং খালামনি।
মাকে হুইল চেয়ারে বসানো হল।আমি,বাবা আর খালামনি পেছন থেকে হুইল চেয়ার ঠেলছি আর নিজের চোখের
পানি লুকানোর চেষ্টা করছি।তিনজনেই চুপচাপ,কেউ কোন কথা বলছি না।অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে মা নীরবতা ভেঙে বাবাকে বলল,
-কোন অন্যায় করে থাকলে ক্ষমা করে দিও,আমার নাজিফাকে দেখে রাখিও আর যে আসছে দুনিয়াতে তাকেও!

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কেউ কিছুই বলেনি মাকে।প্লাটিলেট লেভেল কমে যাওয়া,জরুরী অপারেশন, বাচ্চা-মায়ের জীবনের ঝুঁকি এসবের কিছুই বলেনি মাকে।সব গোপন করা হয়েছে!যদি মা সহ্য করতে না পারে তাই।তাহলে কি নিজে থেকেই কিছু আন্দাজ করে নিয়েছে মা!অজানা শংকায় আরেকবার আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল।

মাকে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে নিয়ে গেল।আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। কাছে থাকা বেঞ্চে এ বসে পড়লাম।মা যে আমার জীবনের সব।বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা।আজ মায়ের অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের ছুরির নিচে,অথচ মা রক্ত আর কাটা ছেড়া একদম দেখতে পারতো না খুব ভয় পেতো।মায়ের পেটে ৮ মাস ১৭ দিন বয়সী সন্তান। আমি আর ভাবতে পারছিলাম না।ভয়ে আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল।মাথাটা আস্তে আস্তে ভারী হয়ে আসছিল।এমন সময় পাশে থেকে নিঃশব্দে কেউ আমার মাথায় হাত রাখে, আশির্বাদের হাত।
স্বপ্ন ভেবে পরক্ষণেই আমার ভুল ভাঙল,আমার নানি। আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।নানিকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।নানি আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বললেন,
– আল্লাহ্‌র উপর ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রায় চারঘন্টা হয়ে গেল আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
আরও আধাঘণ্টা পরে ডাক্তার ফারহানা কবির বের হয়ে বললেন,”sorry,আমরা অনেক চেষ্টা করে ও মাকে বাঁচাতে পারিনি!ছেলে সন্তান হয়েছে।কিন্তু পরিপূর্ণ বয়স হবার আগে হয়েছে বলে তাকে পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে রাখতে হবে বলে চলে গেলেন!


মাকে অপারেশনের রুম থেকে বের করা হলো!দৌড়ে গিয়ে কাছে গিয়ে থেমে গেলাম!সাদা কাপর দিয়ে মুখটা ঢাকা!না
এটা আমার মা হতে পারেনা!মুখের কাপড় টেনে দেখার সাহস পাচ্ছিলাম না!বাবা ও সাথে এসে থমকে দাঁড়ালেন!কাঁপা হাতে আস্তে করে কাপড়টা মুখের থেকে হালকা সরিয়ে দিলেন!বুকটা পেটে যাচ্ছিলো মায়ের মুখটা চোখের সামনে ফুটে উঠে!
মায়ের মুখটা দেখার পর পর নাজিফা জ্ঞান হারিয়ে মেডিকেলের ফ্লোরে পড়ে যায়!



চলবে,
লিখা:শারমিন সুলতানা সালমা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here