আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৮

0
1149

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৮
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

বিভোর রুহির কথা শুনে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো। মুখ দিয়ে কথা আসছে না। রুহি ওকে ঠেলে বের করে দিলো ঘর থেকে। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে সোফায় বসে পড়লো। মাথা ধরে আছে রুহির। কান্নাকাটি বন্ধ করে একটা মাথাব্যথার ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। বিভোরের মুখের উপর উচিৎ কথাটা বলতে পেরে ভেতরে ভেতরে একটা শান্তির ভাব আসছে। এতো দরদ দেখানোর কোনোই রাইট নেই ডাক্তারবাবুর! তোকে যে লোকটা ছেড়ে চলে যেতে চায় তাকে তুই পাত্তা দিবিনা। বুঝুক কেমন লাগে। জাস্ট ইগনোর রুহি, ইগনোর।

এদিকে রুহির কান্ডকারখানা দেখে হতভম্ব হয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিভোর। মেয়েটা ওকে বের করে দিলো? হাও? ওই পুচকি মেয়েটাকে ও নিজে শহরে নিয়ে এসেছে আর ওর ওপরই চিৎকার করছে? আজব তো। দরজায় টোকা দিতে গিয়েও থেমে গেলো। হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইচ্ছে করছেনা। মেয়েটার আচরণ ওকে ভাবাচ্ছে, বেশ ভাবাচ্ছে। নাসিমা চৌধুরীকে ফোন করলো বিভোর।

‘ হ্যালো আম্মু!’

‘ কে?’

‘ আমি বিভোর।’

‘ হ্যাঁ বল। তুই কোথায়? কোত্থেকে ফোন করছিস?’

‘ নিচ থেকে।’

‘ নিচে থেকে মানে? বাসায় চলে গিয়েছিস নাকি?’

‘ আরে না আম্মু। আমি নিচতলায় আছি।’

‘ ওহহ। কী করিস সেখানে?’

‘ আমার ঘুম পাচ্ছে, উপরে আর যাচ্ছিনা। তোমাকে জানাতে ফোন দিলাম!’

‘ কোনো প্রবলেম হচ্ছে নাকি?’

‘ নাহ। এমনিই। এনজয় করো তোমরা।’

‘ আচ্ছা।’

বিভোর ফোন রেখে দিলো। চোখগুলো জ্বালা করছে। রুহির নখেত আঁচড় ওর হাতে ঢুকে গিয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দাগগুলো। মেয়েটা কি সাইকো? আজব! হুট করে কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করলো ওর সাথে। বিভোর ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে কাপড় পাল্টে মোবাইল স্ক্রল করলো। ওখানে করার মতো কিছু না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলো। সারা ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো। হঠাৎ করে রুহির কথা মনে হতেই ভাবলো বিভোর কীভাবে ওর জীবন শেষ করে দিলো? ও তো রুহিকে সাহায্য করতে চাইছিলো। তাহলে ওকে কেন দোষী ভাবছে মেয়েটা?

ভাবাভাবি বাদ দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আজ একটার পর একটা কাহিনী ঘটছে। সবগুলোই ওর সাথে রিলেটেড। রুহির সাথে দেখা, ওকে সাহায্য করা আবার ওর কাছ থেকে ইগনোরও হজম করতে হয়েছে। যা বিভোর মানতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে মেয়েটার কানের নিচে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে।

সকালবেলা রুহির ঘুম ভাঙলো বেশ দেরিতে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই মনে পড়লো আজ ইভার বিয়ে। বাড়িতে অনেক কাজ আছে। বড়মাকে সাহায্য করতে হবে, একা মানুষ পারবে না। বিভোরের খালা হন নাদিরা ইসলাম। এক মেয়ে ইভা-ই তার সব। স্বামী গত হয়েছেন বছর দুই হতে চললো। এখন এই সংসারে যোগ হয়েছে রুহি। তিনজনের জীবন খুব ভালো করেই চলে যাচ্ছে। যাইহোক, রুহি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বাইরে গেলো। হাতের কাজগুলো শেষ করে ছাদের গাছগুলোতে পানি দেওয়ার উদ্দেশ্য চলে গেলো। গিয়েই ওর চোখ ছানাবড়া। ডাক্তারবাবু খালি গায়ে জিম করছে। লজ্জ্বা শরম খুইয়ে এসেছেন নাকি পথের ধারে! রুহির দিকে নজর পড়তেই বিভোর এগিয়ে এলো ওর দিকে কথা বলার উদ্দেশ্যে। হাসিমুখে বলল,

‘ গুড মর্ণিং রক্তজবা!’

রুহি উত্তর না দিয়ে গাছে পানি দিতে লাগলো। বিভোর মনে মনে বেজায় রেগেছে। দুদিনের পুচকি ভাব দেখাচ্ছে ওকে।

‘ এই শুনো, আমার সঙ্গে একদম ইগো দেখাবে না।’

শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে নেমে এলো রুহি। বেশ শান্তি লাগছে ওকে ইগনোর করে। নিচে নামতেই নাদিরা এসে বলল,

‘ রুহি মা, দেখতো মিষ্টিগুলো কোথায়? তোর হাতে দিয়েছিলাম তো!’

‘ হ্যাঁ, আমি ডিপ ফ্রিজে রেখেছিলাম। নিয়ে আসছি।’

‘ তাড়াতাড়ি যা।’

নাসিমা চৌধুরী পাশ থেকে বলে ওঠলো,

‘ মেয়েটা খুব ভালো। কি সুন্দর সব কাজ করছে।’

‘ হুম, ওর মতো মেয়ে হয়না।’

বিভোরের কানে এই কথা ঢুকলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কার কথা বলছো?’

‘ রুহি।’

বিভোর চোখমুখে গম্ভীর ভাব ধরে রেখে বলল,

‘ এই মেয়েকে কোথায় পেলে তোমরা? রিলেটিভ হয় নাকি?’

নাদিরা ইসলাম বলল,

‘ নারে বাবা। ওর কাহিনী অন্যদিন শুনিস, আপাতত ওকে গিয়ে হেল্প কর।’

‘ কিসের হেল্প?’

‘ মিষ্টিগুলো ফ্রিজ থেকে আনতে গিয়েছে। একা ওইটুকু মেয়ে এতোগুলা বক্স আনতে পারবেনা। তুই গিয়ে হেল্প কর।’

বিভোর বিড়বিড় করে বলল,

‘ আমি যেন ওকে হেল্প করতেই দুনিয়ায় এসেছি।’

তারপর পা বাড়ালো। রুহি ফ্রিজ থেকে এক এক করে সবগুলো বক্স সাজিয়ে রাখলো। একসাথে সব নিতে পারবেনা, আলাদা নিতে সময় লাগবে। কাউকে ডেকে নিয়ে আসলে হতো। এমন সময় বিভোর আসলো। বলল,

‘ আমাকে দাও, নিয়ে যাচ্ছি।’

রুহি শক্ত গলায় বলল,

‘ লাগবেনা!’

‘ আরে দাও।’

‘ রুহির কারোর সাহায্য নিতে চাচ্ছেনা।’

‘ তাই নাকি? তোমার সব সাহায্য তো আমিই করে দিলাম, খালামণিও পাঠালো তোমাকে সাহায্য করতে। তোমাকে সাহায্য করার জন্যই বুঝি আমার জন্ম হয়েছিলো।’

‘ আপনার বকবক বন্ধ করুন। আর ইচ্ছে হলে নিয়ে যান এসব। দয়া করে যান!’

বিভোরের হাতে মিষ্টির বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে নিজেও নিয়ে এলো রুহি। ডাইনিংয়ে রেখে হাত ধুয়ে প্লেটে সাজিয়ে মেহমানদের দিলো। ইভা ডাকছে রুহিকে। পার্লারে যেতে হবে তাই। কিন্তু ও যেতে নারাজ। নাদিরা ইসলাম একপ্রকার জোর করে রুহিকে ইভার সাথে পাঠালো। বিভোর ওদেরকে পার্লারে ড্রপ করে দিয়ে এলো। দুজনের চোখাচোখি হলো, কিন্তু চোখের ভাষা কেউ পড়তে পারলো না। কি বিদঘুটে পরিস্থিতি।

রুহি তার ডাক্তারবাবুকে বর হিসেবে চায়। কিন্তু লোকটা বউ হিসেবে ওকে চায়না। ভালোবাসাকে না পাওয়ার মতো ভয়ংকর শাস্তি জগতে আর কি আছে?

পার্লারের সাজগোজ বরাবরই ভারী এবং বিরক্তিকর। একগাদা মেকআপ লাগিয়ে, রঙচঙ মেখে সঙ সাজতে রুহির ভালো লাগেনা। গ্রামে থাকার সময় তো ভাবতো পার্লার বুঝি মেয়েদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক একটা জায়গা, স্বস্তির জায়গা। কিন্তু এর মতো অস্বস্তিকর আর কিছু আছে কিনা কে জানে।

ইভাকে পুরাই অন্যরকম লাগছে। ব্রাইডাল মেকআপ, লাল শাড়ি, গহনা সব মিলিয়ে নিরুপমা টাইপ সুন্দরী। বউয়ের সাজ যেমন হয় তেমনই। কিন্তু রুহি নিজেকে দেখে চিনতেই পারলোনা।
সবুজ রঙের জামদানি শাড়িটাতে ওকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে ইভা অট্টহাসি দিয়ে বলল,

‘ মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। বউয়ের থেকে তার বোনকে বেশি সুন্দর লাগছে।’

‘ যাহ। তুমি এসব কি বলো আপু!’

‘ ঠিকই বলছি। তোর একটা জামাই থাকলে রে আজ হার্ট অ্যাটাক করতো!’

‘ আপু তুমি চুপ করো তো।’

‘ লজ্জ্বা পাস কেন? আমার বিয়ে আমিই লজ্জ্বা পাইনা, আর ওনি দেখো মরে যাচ্ছে৷ আরে বাপু, এতো ঢং করার কোনোই দরকার নাই!’

‘ তোমার বিয়ে, তাই তোমার উচিৎ চুপ থাকা আর লজ্জ্বাবতী হয়ে বসে থাকা। তুমি কেন এতো কথা বলছো? দেখা যাচ্ছে বিয়ে অন্য কারোর আর বউ সাজছো তুমি!’

ইভা রুহির কথা শুনে হাসলো। বাড়ি ফেরার জন্য সবাই ফোন করছে, বর‍যাত্রী আসতে বেশিক্ষণ বাকি নেই। ইভা ডায়াল করলো বিভোরের নাম্বারে, ওরই নিতে আসার কথা। ফোন রিসিভ করে বিভোর জানালো ও বাইরে ওয়েট করছে। রুহি মনে মনে ভাবলো এতো ফার্স্ট, বাহ!

এদিকে গাড়িতে উঠার পরপরই রক্তজবার দিকে নজর গেলো ডাক্তারবাবুর। মাথা পুরোই হ্যাং হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়েটা ওর দিকে তাকাচ্ছেই না, কি ইগনোর! বিভোরের মনে হচ্ছে জান্নাহ’র চেয়ে এই রুহি বেশি সুন্দর। সাজলে কোনো মেয়েকে এতো সুন্দর দেখায় জানা নেই বিভোরের। হালকা সাজে, খোলা চুলে, সবুজ শাড়িতে অপ্সরা দেখালেও কি যেন নেই, নেই লাগছে। রুহির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা বিভোর। এই প্রথম মনে হচ্ছে রুহি যদি ওর সত্যিকারের বউ হতো তাহলে জড়িয়ে ধরে ফটাফট চুমু খেয়ে নিতো। কিন্তু মেয়েটা তো সত্যিই ওর বউ!

পেছনের সিটে বসে লুকিং গ্লাসে বারবার চোখ যাচ্ছে রুহির। মনে হচ্ছে ওই শয়তান বরটা ওকে দেখছে। কিন্তু একবারও ধরতে পারলোনা রুহি। জানালা খুলে বাইরে দৃষ্টি দিলো। এই ঢাকা শহর বড়ই বিরক্তিকর। ধুলোবালি,মানুষজন গিজগিজ করছে। রুহির এসব ভিড়ভাট্টা একদম পছন্দ নয়। পাশ থেকে ইভা বলল,

‘ রুহি আয় সেলফি নিই।’

রুহি হাসিমুখে পোজ দিলো। বেশ কয়েকটা সেলফি নেওয়ার পরে বিভোর গমগমে স্বরে বলল,

‘ গাড়ি কি সেলফি তোলার জায়গা? চুপ করে বস তোরা।’

‘ বকছিস কেন ভাইয়া? আমার আজ বিয়ে, যেখানে খুশি ছবি তুলতে পারবো।’

‘ বেহায়া বউ তুই। কোথায় লজ্জামুখ নিয়ে বসে থাকবি তা না। বকবক করে মাথা খাচ্ছিস। রাবিশ।’

‘ তুই রাবিশ, তোর বউও রাবিশ।’

বিভোর বিষম খেলো। আড়চোখে রুহির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও ইভার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বিভোর হেসে ফেললো। ইভাও হাসলো। বলল,

‘ তা তোর গার্লফ্রেন্ড এর খবর কি?’

রুহির মনে হলো ওর কানে কেউ বিষ ঢেলে দিয়েছে। এই ডাক্তারের আবার গার্লফ্রেন্ড ও আছে? থাকবেই তো। এতো সুন্দর, এস্টাবলিশ একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকবে এটা তো স্বাভাবিক এবং সে রুহির চেয়ে সুন্দরী তো হবেই। ওর চোখে পানি এসে পড়লো। বিভোর হেসে বললো,

‘ কার কথা বলছিস?’

‘ মনে নাই? ভুলে গেলি?’

‘ মনে আসছেনা তো।’

‘ তোর না একটা বিদেশি গার্লফ্রেন্ড ছিলো!’

‘ ছিলো তো।’

‘ কি যেন নাম?’

‘ জান্নাহ!’

‘ বিয়ে কবে করবি তোরা? আর ও কি ডাক্তার?’

লুকিং গ্লাসে বিভোর একনজর রুহিকে দেখে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বলল,

‘ ব্রেকআপ হয়েছে।’

ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here