আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৩০

0
984

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৩০
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

হসপিটালের একঘেয়ে দিনগুলো কাটিয়ে রুহি ফিরে এলো বাসায়। নাদিরা, ইভা ওর খেয়াল রাখছে। বিভোর হসপিটালের কাজে, বিভিন্ন কনফারেন্সে ভীষণ ব্যস্ত। তবুও সর্বক্ষণ ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে। রুহির চাকরিতে যাওয়া মানা। সুস্থ না হওয়া অবধি বাসা থেকে বের হওয়ায় পারমিশন নাদিরা-বিভোর কেউই দেয়নি।

কুয়াশাঘেরা এক গোধূলি বিকেল। হলদে আলোয় ছেয়ে আছে পুরো ব্যলকনি। রুহি বসে বসে বই পড়ছিলো। ইভা ওর মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে সবেমাত্র গোসল সেরেছে। আজকাল ওর মেয়েটা বড্ড চঞ্চল হয়েছে। সাত মাসের বাচ্চাটা দাঁড়ানো শিখেছে, হাঁটতে চায়। আবার দুটো দাঁতও ওঠেছে। একদম রাতুলের কার্বন-কপি যেন। এরকম মিষ্টি একটা বাচ্চাকে রুহি সারাক্ষণ কোলে নিতে চায়। কিন্তু ইভা ওর এই বদঅভ্যাসের জন্য ভীষণ রকম বকাবকি করে। নিজের জান নিতেই নড়তে পারেনা, তার উপর বাচ্চা নিয়ে লাফালাফি। রুহি মুখ ভার করে বসে থাকে। ওকে বই পড়তে দেখে পাশের চেহারায় বসলো ইভা। রুহি একনজর দেখে আবারও মনোযোগ দিলো বইয়ে। ইভা বলল,

-কথা বলতে চাসনা আমার সাথে? রাগ করেছিস?

রুহি মাথা নাড়িয়ে অভিমানী গলায় বলল,

-হুম। মিষ্টিটাকে একটু কোলে নিলে কী এমন হতো?

-আরে, তুই তো এখনো পুরোপুরি ঠিক হসনি রে বোন।

-আমি একদম ঠিক আছি।

-তা তো থাকবিই। ডাক্তারের বউ বলে কথা!

রুহি বিড়বিড় করে বলল,

-ডাক্তার না ছাই৷ আমাকে কতশত রুটিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।

-এটাই দরকার তোর৷ ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিসনি এখন ফল ভোগ কর।

রুহি ভেঙচি কেটে বলল,

-তোমার ভাই আস্ত একটা শয়তানের নানা।

ইভা হেসে বলে,

-তোর বরের কাছে ফোন দিয়ে এসব কথা না জানাইলে আমিও রাতুলের বউ না।

-আপু প্লিজ। তোমার ডাক্তার ভাইটুর কথা বাদ দাও।

-কেন রে?

রুহি মুখ ফুলিয়ে বলল,

-সুযোগ পেলেই আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আধমরা করে ফেলে।

ইভা বলল,

-আর তুই যে এতোদিন ডুবে ডুবে জল খেলি তা কিছুনা?

-ডুবে ডুবে জল খেলাম মানে? কীসের কথা বলছো?

রুহির কথা শুনে ইভা হাসলো। হাসিটা চেপে রেখে গলাউ গাম্ভীর্য এনে বলল,

-বাহ! এখন তো তুই ধোয়া তুলসীপাতা। কিছুই জানিস না। তোর সাথে যে আমার ভাইয়ের ইটিশপিটিশ চলে তুই আমাদের কাছে একবারও বললি না!

-কই ইটিশপিটিশ করলাম? কোনোদিন দেখেছো?

ইভা ভ্রু কুঁচকে বলল,

-না দেখিনি।

-তবে বললে কেন?

ইভা মুখটা বাঁকা করে বলল,

-বলবোনা? কি বলিস রে তুই? আমার ভাইয়ের বউ। ছয়বছর হতে চললো তোদের বিয়ে হয়েছে। অথচ দুজনের কাউকে দেখেই আমরা তা বুঝতে পারিনি। আসলে তোরা বুঝতে দিসনি। আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে দিলি। এটা কী ঠিক হলো? আমরা কি তোর পর ছিলাম? বোনের মতো ভালোবাসিনি তোকে?

ইভার কথা শুনে রুহির মুখে ছায়া নেমে এলো। প্রাণবন্ত মুখটা মুহূর্তেই অস্বস্তি আর লজ্জায় নুইয়ে নিলো। ইভা কী ওকে সুবিধাবাদী, লোভী মেয়ে ভাবছে? ভাবাটা স্বাভাবিক। কারণ রুহি নিতান্তই এই বাড়িতে আশ্রিতা। যতই ওরা ভালোবাসুক, তবুও সত্যটা তো আর পালটে যাবেনা। নিজের জীবনের প্রতি বড্ড বিতৃষ্ণা নেমে এলো হঠাৎই। হায়, ওর এখন কি করা উচিৎ!
ইভা ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ দেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। আচমকাই ওর পা জড়িয়ে ধরলো রুহি। তারপর কান্নারত কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘আমাকে ক্ষমা করে দিও আপু। আমি স্রেফ পরিস্থিতির শিকার। ওনারও কোনো দোষ নেই। দোষ সব বোধহয় আমার কপালের। সারাটাজীবন আমার সাথে ভালো কিছুই হয়নি। আমার জীবনের গতিপথ উল্টাপাল্টা। তোমাদের কখনো এই বিষয়টি জানাতে পারিনি, কিন্তু জানানো আমার উচিৎ এবং কর্তব্য ছিলো। তোমাদের নুন খেয়েছি, অথচ তার চেয়ে বেশি কষ্টও দিয়েছি। এখন তোমরা যদি বলো তাহলে আমি ওনার থেকে দূরে চলে যাবো, চিরদিনের জন্য…’

ইভা ওর এমন কান্ডে হতবাক। ও তো শুধু মজা করছিলো, রুহিটাও না! ভাবলো সত্যিই বুঝি কিছু একটা হয়েছে। ইভা ওকে কাছে টেনে নিলো। তারপর হাসতে হাসতে খুন হওয়ার ভঙ্গি করে বলল,

‘বোকা মেয়ে। আমিতো মজা করলাম। তোর সাথে আমি বা আম্মু কেউ কখনো এরকম করতে পারি? তোর জীবন সেটা তোকেই ভাবতে হবে৷ আমরা তো তোর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, যদিও দূরে করতে চাইনি তোকে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথেই যখন এক সুতোয় বাধা পড়লি তখন আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। এবার নাচতে নাচতে তোর বিয়ে খাবো।’

রুহি চোখমুখ মুছে ইভার দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘নাচতে নাচতে বিয়ে খাবে মানে?’

‘মানে তোর বিয়ে। আগামী মাসের পাঁচ তারিখ। হাতে আর পনেরোদিন বাকি।’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘এটা কখন ঠিক হলো? জানিনা তো।’

‘সারপ্রাইজ। তোর ডাক্তারবাবু নিষেধ করেছিলো। নিষিদ্ধ কথা আমি বাপু বলিনা।’

রুহি হেসে ফেললো। ইভা মুগ্ধ হয়ে তার বোনটাকে লক্ষ্য করলো। ওর চোখে পানি এসে গেলো। মেয়েটার জীবনে এবার সুখপাখিরা ধরা দেবে তো? হঠাৎ মনে পড়ায় ইভা জিজ্ঞেস করলো,

‘বাড়ি যাবি রে রুহি?’

‘আমার বাড়ি?’

‘হুম। তোর গ্রামে, তোর বাড়িতে?’

‘না।’

‘কেন?’

‘আমার পরিচিত কেউ নেই ওখানে। সাত বছর আগে যে গ্রাম ছাড়তে আমি বাধ্য হয়েছিলাম সেখানে গিয়ে আমি আর কি পাবো বলো তো, ইচ্ছে হয়না যে তা নয়। কিন্তু ওই অসভ্য, নোংরা, স্বার্থপর মানুষদের আমার প্রচন্ড ভয় লাগে। দ্বিতীয়বার ওদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো শখ বা ইচ্ছা আমার নেই।’

‘তার মানে পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দিলি নিজের আসল পরিচয় আর অস্তিত্ব?’

‘নাহ। ইচ্ছে করলে ঠিকই যাবো। শেকড়ের টান বলে একটা কথা আছে জানোতো, ওই টানে টান দিলে তবেই যাবো। আমায় জন্মদানকারীদের বাস ছিলো, আছে তো ওই গ্রামে। যেতে তো হবেই।’

ইভা ওর কথা শুনলো। তখন শহরের আকাশ আঁধারে ঢেকে গেছে। হাজারো কৃত্রিম আলোতে ঝলমল করা শহরটা এভাবেই তার রুপের বর্ণনা করছিলো। কোথায় সেই নির্মলা বাতাস, সোদা মাটির ঘ্রাণ আর জোনাকিদের খেলা? কোথায়? নেই কোত্থাও…

বড্ড বেশি ব্যস্ত আছে বিভোর ওর কাজকর্ম নিয়ে। আজ তিনটে ওটি, কনফারেন্স, অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত একটা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে ওকে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। তার উপর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়াসহ আরও টুকটাক কাজে ভীষণ ব্যস্ত সে। নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। একবার ফোন করে রক্তজবার খোঁজটা অবধি নিতে পারলোনা। রাগে,দুঃখে নিজের কেবিনে এসেই হোয়াইট এপ্রোনটা ছুঁটে ফেললো সোফার উপর। মাঝেমধ্যে মনে হয় ডাক্তার না হয়ে রিকশাওয়ালা হলে ভালো ছিলো। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে করলে রিকশা করে বাড়ি চলে যেতে পারতো, টুকটুকে বউটার দেখাশোনা কর‍তে পারতো। সেখানে কোনো নিয়ম মানতে হতোনা, যখন ইচ্ছা রুহিকে আগলে ধরে বসে থাকতো। এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিতেই ফোন বেজে উঠলো। চোখদুটো নিবদ্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলো। কানে ঠেকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল,

‘কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে সুধাময়ী রক্তজবার কন্ঠ শুনতে পেয়েই এক নিমিষে পনেরো বছরের কিশোর আবেগ গ্রাস করলো ওকে। বলল,

‘তুমি জানো আজ সারাদিন কত খাটুনি গিয়েছে আমার? শুধু মনে হচ্ছিলো একটাবার তোমার কন্ঠ শুনতে পেলে সব খাটুনির কষ্ট ভুলে যেতাম। এখন শুনলাম আর মনে হচ্ছে তুমি আমার পাশেই আছো।’

রুহি বিব্রত হয়ে বলল,

‘তো কান্নাকাটির কী হলো?’

‘কাঁদছিনা তো।’

‘আপনার কন্ঠ কান্না কান্না শুনাচ্ছে।’

‘ওফ, এটা কান্নাকান্না কন্ঠ নয়। এটা হচ্ছে আবেগ। যে আবেগে মিশে আছে তোমাকে না দেখার একবুক কষ্ট, যন্ত্রণা।’

‘এতো কষ্টিত হওয়ার কিছু হয়নি। সারাদিন তেমন কিছইই করেননি আমি জানি। সো কিপ…’

‘তুমি মজা করছো?’

‘না।’

‘বুঝি আমি।’

রুহি ওকে চমকানোর জন্য বলল,

‘আমাদের বিয়ে তো পনেরোদিন পর। জানেন তো?’

কিন্তু বিভোর চমকালো না। হাসিহাসি কন্ঠে বলল,

‘সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?’

‘বাজে, খুব বাজে।’

বিভোর মৃদু হেসে বলল,

‘আর কতকাল থাকিবে দূরে
আসতে হবে আমারই বুকে!’

বিভোরের কথা শুনে একরাশ লজ্জা নিয়ে ফোন কাটলো রুহি। মুখে লজ্জ্বামিশ্রিত আভা ছড়িয়ে পড়লো। আহা! রং লেগেছে বুঝি চারপাশের প্রকৃতিতে। হ্যাঁ, অবশেষে সবকিছু রুহির হতে চলেছে। হ্যাঁ পৃথিবী! তাঁর ভালোবাসার মানুষটা তাঁর হতে চলেছে। এতো সুখকে কোথায় বন্দী করে রাখবে সে? কিন্তু সুখকে কি আদৌ বন্দী করা যায়?

ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। মন্তব্য জানাবেন আপনাদের।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here