#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#দ্বাদশ_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা
এতো মাসের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে ইরার। বুয়েটে চান্স পেয়েছে সে। শুধু পছন্দের ডিপার্টমেন্ট না পাওয়ার আফসোস হচ্ছে তার। EEE তে পড়ার ইচ্ছে ছিল। হয়তো সেই অনুযায়ী পড়া হয়নি কিংবা সে পারেনি। তাই ম্যাক্যানিকেল পেয়েছে। সেই নিয়ে প্রায় মন খারাপ করে বসে থাকে ইরা। তোহফা কয়েকবার বুঝিয়েছে ম্যাকানিকেল খারাপ না। ইরা শুধু মুচকি হাসে কিন্তু কিছু বলে না। কিই বা বলবে আর। ম্যাকানিকেল খারাপ না এটা সেও জানে কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। যেটায় পড়ার ইচ্ছে থাকে সেটা যখন হয় না তখন যার স্বপ্ন সেই বুঝে মেনে নেওয়াটা কতটা কষ্টকর। আর সেই কষ্টের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায় যখন স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে আর ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায় না। সেখান থেকেই ব্যর্থতা নিয়ে পিছিয়ে আসতে হয়। EEE এর প্রায় কাছাকাছি ম্যাকানিকেল যেটা ইরার মনের কষ্ট কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সে সন্তুষ্ট। এটাও বা কম কি? কতোজন তো পরিশ্রম করেও চান্স পায়নি সেখানে সে সেরা স্টুডেন্টদের মধ্যে আছে।
তোহফা এসে দেখে ইরা বসে আছে মন খারাপ করে। ইরার পাশে এসে বসল সে। বলল,
– “কালকে তোমাদের নবীন বরণ। যাবে না??”
– “যাব আপু।”
– “গুড। ভাবছি আমিও তোমার মত শাড়ি পরে যাব।”
– “তোমাদেরও শাড়ি পরার অনুমতি আছে?”
– “ভার্সিটি এমন একটা জায়গা যেখানে শাড়ি পরে ক্লাসও করতে যাওয়া যায়। সবারই অনুমতি আছে শাড়ি পরার।”
– “আচ্ছা আপু।”
তারপর আবার চুপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইরা বলল,
– “আপু একটা হেল্প করবে?”
– “বলো কোন বিষয়ে?”
– “আমাকে হোস্টেলে সিট ম্যানেজ করে দিতে পারবে একটা? আসলে আমি যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছিলাম।”
তখনই রুমে এলেন শাহনাজ পারভীন। ইরার মুখে এমন কথা শুনে ধমকে উঠলেন।
– “কোথাও যাওয়া চলবে না। এখানে থেকেই পড়বে তোহফার সাথে। একসাথে আসবে যাবে ভার্সিটি। হোস্টেলে দরকার নাই।”
– “আপনাদের তো এই কদিন জ্বালালাম আন্টি। এভাবে একটা বাসায় কতদিন থাকা যায়? আমি হোস্টেলে একবার থাকতে শুরু করলে আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
– “কোনো কথা শুনব না আমি। আমার কথাই শেষ কথা।”
তারপর তোহফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– “তোর মা ফোন দিয়েছে তোকে?”
– “জানি না মামী। ফোন তো দেখি নি।”
– “দিয়েছে, কিন্তু তুই ধরিস নি। তাই আমাকে দিল আর আমাদের বলেছে এখন থেকে প্রিপারেশন নিতে। আগামী সপ্তাহে চট্টগ্রাম যেতে হবে।”
অবাক হলো তোহফা। হঠাৎ চট্টগ্রাম কেনো? যদিও বাড়ি গিয়েছে সেই তিন মাস আগে ঈদের সময়। এরপরে আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু যাওয়ার দরকার হলে শুধু তাকে যেতে বলবে। মামা মামী সহ যেতে বলার কারণ কি?
– “হঠাৎ জরুরি তলব কেন মামী?”
– “সেটা তো বলল না। গেলেই জানতে পারবি।”
– “আচ্ছা।”
শাহনাজ পারভীন বেরিয়ে যেতেই করুণ চোখে তাকাল ইরা। তোহফা হেসে ফেলল। তারপর বলল,
– “মামী এমনই। যেতে দেবেন না। আমার সাথে এখানেই থেকে যাও।”
তারপর উঠে বারান্দায় চলে গেল। ফোন হাতে নিয়ে মাকে কল করল। দুবার রিং হতেই রিসিভ করলেন তোহফার মা।
– “আসসালামু আলাইকুম মা। সরি তোমার ফোন পাইনি। কেমন আছো?”
– “ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
– “জ্বি ভালো। হঠাৎ মামীর কাছে শুনলাম বাড়ি যাওয়া জরুরি। কোনো সমস্যা হয়েছে?”
– “তোমার বাবার আদেশ। এর বেশি কিছু আমি জানি না। তুমি এলে উনিই তোমায় সরাসরি বলবেন।”
– “ঠিক আছে আসব আমি।”
– “আচ্ছা। রাখছি আল্লাহ হাফেজ, নিজের যত্ন নেবে।”
তারপর কল কেটে দিলেন তোহফার মা। ভাবনায় পড়ে গেল তোহফা। কি এমন বলবে তার বাবা। বাবাকে ছোট থেকেই বেশ ভয় পায়। সে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। সেই হিসেবে অনেক আদরের। ছোট থেকে সেও একজন বাধ্য সন্তান, কখনো মা বাবার কথা ছাড়া একটা কদম দেয়নি। তার প্রতি নেওয়া মা বাবার প্রতিটা সিদ্ধান্ত সে অবলীলায় গ্রহণ করেছে। তার বাবাও তাকে সবসময় সিদ্ধান্ত জানিয়ে তার মতামত জানতে চেয়েছে। তোহফা সব সিদ্ধান্ত সবসময় মা বাবার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। কিন্তু এবার হঠাৎ এমন কি হলো বাবা কিছু না বলে সরাসরি ডেকে পাঠালেন। ভয়ে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই সুযোগও নেই। তার বাবা আর বড় চাচ্চু এই দুটো মানুষ একই প্রকৃতির। সাকিব ভাইয়া আর সাহেল ভাইয়া যেমন তাদের বাবাকে ভীষণ ভয় পায়, তোহফাও ঠিক তেমন। কিন্তু এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। যেয়েই নাহয় জেনে নিবে সব।
রুমে আসতে নিবে তখনই আবার ফোন বাজল তোহফার। তানভীর ফোন করেছে। ছেলেটার কাছে সে সময় চেয়ে নিয়েছে প্রায় দু মাস হয়ে গেছে কিন্তু এখনও কিছু জানায়নি। তানভীর তাকে আর জোর করেনি। হয়তো সময় দিচ্ছে। কিন্তু তোহফা মা বাবার সাথে কথা না বলে তানভীরকে কিছুই জানাতে পারবে না। তাই ভাবল সেই ব্যাপারে এখন একটু কথা বলে নিক।
গত দু মাসে তানভীরের সাথে কথা হয়নি তোহফার। সামিকে পড়াতে আসলে শুধু দেখাই হতো এর বেশি কিছু না। মাঝে মাঝে দেখাও হতো না। আজ অনেকদিন পর তানভীর ফোন করল। রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে তোহফা বলল,
– “হ্যালো।”
– “হেই কি খবর?”
– “আলহামদুলিল্লাহ। আপনার?”
– “আমার খবর তো সেই। স্কলারশিপ পেয়ে গেছি। আগামী মাসে সোজা ইউএসএ।”
– “ওয়াও, congratulations। কবে ফিরবেন?”
– “তিন বছর পর ইনশাল্লাহ।”
আরো কিছুক্ষণ কথা বলল দুজন। তারপর ফোন রেখে রুমে ফিরে এলো তোহফা।
___________________
অফিস থেকে ফিরতেই সাহেলের রুমে এলেন রুমানা বেগম। সাহেল তখন ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ছিল। রুমানা বেগম খাটে যেয়ে বসলেন।
সাহেল ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো রুমানা বেগম বসে আছেন। সাহেল যেয়ে সোফায় বসল। তারপর বলল,
– “কিছু বলবে মা?”
– “বিসিএস কেনো দিচ্ছিস তুই?”
অবাক হলো সাহেল। এই তার মা বোধহয় প্রথম মা যে ছেলেকে বিসিএস নিয়ে নিরুৎসাহিত করতে চাইছে। অবাক হয়েই প্রশ্ন করল সাহেল,
– “এটা কেমন প্রশ্ন মা? বিসিএসে টিকলে সরকারি চাকরিতে যেতে পারব। এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতে পারব। মন্ত্রণালয়ে যেতে পারলে তো প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়ে যেতে পারব। এইজন্যই দিচ্ছি।”
– “তুই এখন যেই চাকরি করিস সেটা খারাপ কিসে? আমার তো মনে হয় এটাই বেটার সরকারি চাকরির চেয়ে। ভালো স্যালারি, ছুটি পাওয়া যায় আরো অনেক ফ্যাসিলিটিস। সরকারি হলে তো এতো ফ্যাসিলিটিস পাবি না।”
– “উফ মা, তুমি কি এসব বলতে এসেছ এখন? তাহলে এখন যাও মা। আমি খুবই টায়ার্ড। তোমার রেডিও পরে শুনব।”
– “তোর বাবা তোর ছোট চাচ্চু আর ফুপিকে আসতে বলেছে।”
– “হঠাৎ?? সবাইকে একসাথে??”
– “তোর বাবা তোর এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখতে চাইছে। পরে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেবে। সম্ভব হলে কাবিনও সেরে রাখতে চাচ্ছে।”
– “সব তো ঠিকই আছে মা। সবারই মতামত আছে তাহলে এতো তাড়াহুড়ার প্রয়োজন তো দেখছি না বিয়ের।”
– “বিয়ে তো কেউ দিচ্ছে না। এনগেজমেন্ট করতে বলছে শুধু। আর সবাই জানে কিভাবে? তোহফা তো জানে না।”
– “সেটা তোমাদের সমস্যা মা, আমার না। আর না জানলে তোহফাকে জানিয়ে দেবে, শেষ। কিন্তু এখন আমি বিয়ে করব না।”
– “আবারও বলছি বিয়ে হবে না, শুধু এনগেজমেন্ট হবে।”
– “বিসিএস তো এট লিস্ট শেষ হতে দেবে নাকি?”
– “বিসিএস এর অপেক্ষা করতে গেলে আরো এক বছরের ধাক্কা। তোর সবে প্রিলিমিনরিতে হয়েছে। অনেক দেরি। বিসিএস শেষ হলে বিয়ে করিস।”
– “বাবার মাথায় হঠাৎ এই ভুত চাপলো কেন?”
– “তোর বাবার মাথায় চাপেনি। তোর বাবা, চাচা আর ফুপু তিনজন মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাহেল। সব কিছুতে তাড়াহুড়ো আর জোরাজুরি। এগুলোর সত্যিই কোনো মানে হয় না। সোফা থেকে উঠে গেল সাহেল। রুমানা বেগম যেদিকে বসেছেন তার বিপরীত দিকে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। তারপর মাকে বলল,
– “দায়িত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ আমি। সুতরাং যা ভালো বুঝো করো। আমাকে আর কিছু বলো না।”
তারপর ক্লান্তিতে চোখ বুজে পরে রইল।
রুমে যাওয়ার সময় ছেলের শেষ কথাগুলো শুনলেন লতিফুর রহমান। রুমানা বেগমকে বেরিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন সাহেলের এসব কথার কারণ। তখনই রুমানা বেগম সব বললেন তাকে। সব শুনে চুপ করে রইলেন তিনি। তাহলে কি সব চাপিয়ে দিচ্ছেন ছেলের উপর? কিন্তু সাহেলের মতামত ছিল বলেই তো এগিয়েছেন তিনি। তার ভাই বোনের মতামত ছিল আর তারা বলেছিল কোনো সমস্যা হবে না। তাহলে সাহেল এখন এমন বলছে কেন?
মনের প্রশ্ন মনের ভেতর রেখেই রুমে গেলেন লতিফুর রহমান। পরে ছেলের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবেন ভেবে রাখলেন।
চলবে???
বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন