অসময়ের বৃষ্টিফোঁটা পর্ব ৯

0
312

#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#নবম_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা

শাহনাজ পারভীনের প্রতি তানভীরের শ্রদ্ধাবোধ দেখে সেদিন বেশ ভালো লেগেছিলো তোহফার। সে তানভীরকে যতোটা খারাপ ভেবেছিলো ততটা খারাপ না ছেলেটা। আগে শুধুমাত্র ভার্সিটির সিনিয়র হিসেবে কথা বললেও কিংবা শ্রদ্ধা করলেও এখন একদম মন থেকেই কথা বলে তোহফা। সাধারণভাবেই ব্যবহার করে যেটা দেখলেই বুঝা যায় মেকি না।

তানভীরের প্রতি তোহফার আচরণের পরিবর্তন তানভীর বুঝতে পেরেছে কয়েকদিনের মধ্যেই। আগে যেমন একটা এড়িয়ে চলা ভাব ছিলো সেটা এখন আর নেই। এখন বেশ হাসিমুখেই কথা বলে তার সাথে। তানভীরেরও ভালো লাগে মেয়েটার সাথে কথা বলতে। যেদিন মেয়েটাকে বিয়েতে ওভাবে কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো সেদিন একজন বড় ভাই মনে করেই কাজটা করেছিলো। যদিও বড় ভাই হিসেবে টেনে নিয়ে যাওয়াটা বিব্রতকর। কিন্তু ভরা মানুষের সামনে কথা বললে তোহফা ঝামেলায় পড়তে পারে সেটা চিন্তা করেই এমন করেছিল সে। সাহেলের কাজিন তোহফা এটা জানতো তানভীর। তাই এমন করেছিলো কিন্তু মেয়েটা তাকে কি না কি ভেবে বসেছিলো আল্লাহ মালুম!!

এরপরে যখন বাইক রাইড করেছিলো তোহফাকে নিজের পেছনে বসিয়ে তখনও দায়িত্ববোধ থেকেই করেছিলো। তখনও সবকিছু স্বাভাবিক ছিলো তার কাছে। তবে একটা কথা সত্য তোহফাকে প্রথম দিন দেখে থমকে গিয়েছিলো তানভীর যদিও সেটা প্রখর ছিলো না। কিন্তু ইদানিং তানভীরের মনে হচ্ছে এতোদিন তোহফার প্রতি তার ব্যবহারগুলো স্বাভাবিক একজন মানুষ হিসেবে থাকলেও সেটা এখন আর স্বাভাবিক নেই। সে তোহফাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু সে ঠাহর করতে পারছে না ঠিক কবে থেকে আসলে ভালোবাসাটা এসেছে। প্রথমদিন থেকেই কি এসেছিলো যখন সে তোয়াক্কা করেনি নাকি এসেছিলো যেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ঢুকেছিলো তোহফা সেদিন??

ভাবনাগুলো যখন মস্তিষ্কে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিল তখনই কেউ তানভীরের নাম ধরে ডাকলো। তানভীর দাড়িয়ে পেছনে তাকালো। তোহফা হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে দেখতে। হঠাৎ তানভীর খেয়াল করলো তোহফা আজকে একটা শাড়ি পড়েছে। সবুজ কালার শাড়ি। শাড়িটা বেশ মানিয়েছে তাকে। কিন্তু শাড়ি পড়ার আসল কারণটা বুঝতে পারল না তানভীর।

তানভীরের সামনে দাড়িয়ে তোহফা জিজ্ঞেস করল,
– “কেমন আছেন ভাইয়া?”
– “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
– “ভালো আছি। শুনেছি মেলা বসেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির সামনে। আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। আপনি তো জানেনই ভার্সিটিতে আমার তেমন কোনো ফ্রেন্ড নেই যাদের সাথে যাব। আপনি আমায় নিয়ে যাবেন? ফ্রি আছেন?”
তোহফার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল তানভীর। তার সাথে মেয়েটা একটু ফ্রি হয়েছে এটা ঠিক কিন্তু কোথাও যাওয়ার মত ফ্রি হয়েছে এটা জানত না তানভীর। নিজের এক্সাইটমেন্টটাকে দমিয়ে রেখে বলল,
– “যাওয়া যায়। আমি ফ্রি আছি আজকে। এখন যাবে?”
– “হ্যাঁ চলেন যাই।”
মুচকি হাসলো তানভীর। তরপর বলল,
– “চলো।”

__________________________
ইরার এইচএসসি পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আর দুটো পরীক্ষা বাকি। এই পুরো মাস পুরোদমে পড়াশুনা করেছে সে। পরীক্ষার আগে একদম পড়াশোনা হয়নি তার। সাহেল তার মাথার ভেতর এমনভাবে সেট হয়ে গেছে যা আর সরানো সম্ভব হচ্ছে না। ইরা এখন আর পছন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে। কেনো যেনো মনে হয় সাহেলও তাকে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলে, হুট করেই দেখা যায় ইরার কলেজের সামনে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু সরাসরি তো কিছু বলে না। ইরা একটা মেয়ে হয়ে নিজ থেকে ভালোবাসার কথা বলবে কিভাবে? অসম্ভব ব্যাপার। দেখা যাক সাহেল সরাসরি কিছু বলে নাকি।

ইরা ম্যাথ সলভ করছিলো বসে বসে আর তখনই ফোনটা এলো। বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে ফোন রিসিভ করতে গেল সে। ফোনের উপর সাহেলের ছবি ভাসছে। মুহূর্তেই বিরক্তি সরে গিয়ে চোখে মুখে লজ্জা এসে ভর করল। আগেও সাহেলের সামনে গেলেই সে লজ্জায় পরে যেত, এখনও পড়ে যায় কিন্তু তখনের লজ্জা পড়া আর এখনের পরা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ফোন রিসিভ করতেই সাহেল বলল,
– “পড়াশুনা করছিলেন বিয়াইন আপা??”
ইরা বুঝতে পারে না বিয়াইন এর সাথে আপা কেমনে হয়? কিন্তু কখনো জানতে চায়নি। এবার জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
– “বিয়াইন এর সাথে আপা কেমনে হয়? দুইটা তো আলাদা জিনিস।”
– “এটা আমার আবিষ্কার, আপনি বুঝবেন না।”
– “আমি আপনার আবিষ্কার বুঝি না আর আপনি আমার মনের কথা বুঝেন না।”
– “সরি? কিছু বললা??”
ভড়কে গেল ইরা। ইশ কি বলে ফেলল আনমনে। তাই তাড়াতাড়ি বলল,
– “ইয়ে না না কিছু বলিনি। আমি আসলে ম্যাথ করছিলাম। পরশু ম্যাথ এক্সাম। তাই ফোন ধরতে দেরি হল।”
– “আচ্ছা আচ্ছা পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?”
– “আলহামদুলিল্লাহ ভালো হচ্ছে।”
– “অ্যাডমিশন কি ইঞ্জিনিয়ারিং এ নিবা না মেডিকেল?”
– “যেটা কপালে আছে সেটায় হবে।”
– “আজব!! কোনো ইচ্ছা নাই?”
– “নাহ। যা আছে তাই হবে।”
সাহেল বুঝলো ইরা বলতে চাইছে না। তাই আর ঘাটাল না। বলল,
– “আচ্ছা পড়াশুনা করো। আমি রাখছি।”
– “আপনি কেনো ফোন দিয়েছেন?”
– “ফোন দেওয়া বারণ নাকি?”
– “ধুর, সবসময় উল্টো অর্থ খোঁজেন কেন? বললাম আপনি কি কোনো কিছুর জন্য ফোন দিয়েছেন নাকি এক্সামের ব্যাপারে জানতেই ফোন দিলেন?”
– “তোমার এক্সাম শুরু হওয়ার পর থেকে আমি তোমাকে ফোন দেইনি। আমারও এক্সাম ছিলো, কাল শেষ হয়েছে। কাল সারাদিন চিল করেছিলাম। আজ ফোন দিলাম, ভাবলাম দেখি আমার একমাত্র বিয়াইন আপার পরীক্ষা কেমন হল।”
ইরা মন খারাপ করে বলল,
– “ও আচ্ছা।”
সাহেল বুঝলো ইরা মন খারাপ করেছে। তাই দুষ্টুমি করে বলল,
– “আপনি কি অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলেন আপা??”
থতমত খেয়ে গেল ইরা। আমতা আমতা করে বললো,
– “আমি আবার কি শুনতে চাইবো, আচ্ছা রাখছি এখন। অনেক পড়া বাকি আছে আমার।”
আর কিছু বলার সুযোগ দিল না সাহেলকে। তার আগেই ফোন কেটে দিয়েছে ইরা। তারপরই ভাবল “ছেলেটা এই জন্মে আমাকে বোধহয় বুঝবে না। আর মাত্র কয়েকটা মাস। ভালো কোথাও চান্স পেলে আমিই বলে দেব তাকে আমি ভালোবাসি। যদিও বিষয়টা কেমন দেখায় কিন্তু সমস্যা নেই। সবসময় ছেলেরাই ভালোবাসার আবেদন করে, আমি নাহয় একটু ব্যতিক্রম হলাম। ক্ষতি কি??

ইরা মেয়েটাকে সরাসরি বুঝতে পারে না সে। সে তো ভাবির ছোট বোন হিসেবে ট্রিট করে কিন্তু সাহেলের মনে হয় একেক সময় ইরা তাকে একেকভাবে ট্রিট করে। কখনো বোনের দেবর হিসেবে আবার কখনো নিজের পছন্দের মানুষ হিসেবে। কিন্তু মেয়েটা তার প্রতি ঝুঁকে গেলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। সে তো কখনো অন্য কোনো মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারবে না। ইরা সরাসরি যদি তাকে কিছু বলত তাহলে সে ঘটনা ইরার কাছে বিস্তারিত বলতে পারত কিন্তু ইরা যেহেতু কিছু বলে না সে নিজ থেকে যেয়ে কিছু বলাটা বেমানান। কিন্তু মেয়েটা অনেক বেশি ঝুঁকে পড়লে বড় সমস্যা হয়ে যেতে পারে। মেয়েরা একদম মোমের মতো হয়। শক্ত থাকে ঠিকই কিন্তু আঘাত পেলে একদম নরম হয়ে গলে যায়। ইরা যদি আবার সাহেলের প্রতি বেশি ইন্টারেস্টেড হয়ে যায় আর ব্যপারটা অনেকদূর গড়িয়ে যায় তখন তো ব্যপারটা সেনসিটিভ হয়ে যাবে। কিন্তু সাহেলই বা কিভাবে বোঝাবে ইরাকে যে তার পক্ষে কাওকে নিজের জীবনে জড়ানো সম্ভব না??

________________
হঠাৎ তোহফার হাতে এক ডজন গাঢ় সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি ধরিয়ে দিল তানভীর। তোহফা চুড়ি নিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল তানভীরের দিকে। তোহফার দৃষ্টি দেখে তানভীর হেসে বলল,
– “তোমার শাড়ি সবুজ রঙের তাই আনলাম। পছন্দ হয়েছে?”
– “জ্বি। খুব পছন্দ হয়েছে।”
তানভীর তাকে দিল এখন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখাটা বেমানান। এই ছেলে তো আবার প্রায় সময় ভেবে বসে তোহফা তাকে ইগনোর করছে। তাই প্লাস্টিকের মোড়ক থেকে চুড়িগুলো বের করে তানভীরের হাতে দিল সে। তারপর অল্প অল্প করে নিয়ে একহাতে সবগুলো চুড়ি পরল। আরেক হাতে আগের থেকেই ঘড়ি ছিল। এখন দুহাত পূর্ণ হয়েছে।

তানভীর চুড়িগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ফর্সা হাতে গাঢ় সবুজ রঙের চুড়ি এত সুন্দর দেখায় জানা ছিল না তার। তোহফার হাতগুলোতে কাঁচের চুড়িগুলো বেশ মানিয়েছে।

তানভীরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তোহফা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কি দেখছেন? ভালো লাগছে না?”
– “খুব সুন্দর লাগছে।”
তানভীরের বলার ধরণ দেখে তোহফা হেসে ফেলল। তারপর বলল,
– “এখানেই দাড়িয়ে থাকবেন? চলুন সামনে যাই।”
– “চলো।”
তোহফা মেলায় ঘুরে ঘুরে এটা ওটা দেখছিল। তিন জোড়া ঝুমকা কিনল, দুটো ব্রেসলেট কিনল, সামি, মামা আর মামীর জন্য টুকটাক কিছু জিনিস কিনল। তারপর ফুচকা, মুড়িভর্তা, পিঠা খেল। এরপরে আরো কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করার পর বাসায় ফিরল।

তানভীর আর তোহফা আজ এতো সুন্দর কিছু সময় কাটাল যার জন্য দুজনের মনের মাঝেই এক ধরনের সুন্দর অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দুজনের অনুভূতি দুই রকম। একজনের অনুভূতি গুলো নিজের প্রিয়তমার সাথে এত সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য আর আরেকজনের অনুভূতি গুলো অনেকদিন পর মন খুলে কোথাও ঘুরতে পারার জন্য।

তানভীর যদিও ওদিক থেকে হলে ফিরে যেতে পারত তবুও সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তোহফাকে বাসায় পৌঁছে দিল। তোহফার বাসার দুই গলি আগেই রিকশা থেকে নেমে গেল তানভীর। কেউ দেখে ফেললে আবার খারাপ কিছু ভেবে না বসে তাই। রিকশা থেকে নামার সময় তোহফা তার হাতে একটা ওয়ালেটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই বলতে গেলে, যে কয়জন আছে সব মেয়ে। তাই ছেলেদের গিফটের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তবে বান্ধবীদের দেখেছি নিজেদের ভাই, বন্ধু কিংবা প্রেমিককে শার্ট, পাঞ্জাবি এসব গিফট করে। আমি ভিন্ন কিছু চেষ্টা করলাম। আপনার পছন্দ হবে কিনা জানি না। তবে আশা রাখছি খারাপ লাগবে না। আসছি, সাবধানে যাবেন।”
রিকশা চলে গেলেও তানভীর দাড়িয়ে রইল সেখানে। আজ যেনো তার অবাক হওয়ার দিন। সকালে তোহফার এসে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলা, সারাদিন তার সাথে নিঃসংকোচে ঘোরাঘুরি করা, শেষে তাকে ওয়ালেট গিফট করা সব যেনো তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। মেয়েটা আসলেই অন্য সবার চেয়ে আলাদা। ওয়ালেটটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তানভীর। তারপর হলে যাওয়ার জন্য রওনা হলো।

চলবে??

বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here