#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#দশম_পর্ব (বোনাস)
#মাহজাবীন_তোহা
পেরিয়ে গেছে অনেক দিন। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় চলছে। বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হঠাৎই বৃষ্টির ছাট মুখে পড়ায় জেগে গেল তোহফা। ঘড়িতে সময় দেখল দুইটা ত্রিশ। উঠে বারান্দার দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করল ইরা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছে। জানালা আর বারান্দার দরজা লাগিয়ে ইরার কাছে গেল সে। ইরার কোনোদিকে মনোযোগ নেই। তোহফা বলল,
– “রাতে ঘুমাওনি?”
কারো শব্দ পেয়ে চমকে পাশে তাকাল ইরা। তোহফাকে দেখে হেসে বলল,
– “না আপু, একবারে সেহরি খেয়ে ঘুমাব।”
– “এতো রাত জেগে পড়লে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে।”
– “ঈদের ছুটিতে তো কিছুদিন এর মধ্যেই বাড়িতে চলে যাব মা বাবার কাছে। সেখানে খুব বেশি পড়াশোনা হবে না। তাই এখন বেশি করে এগিয়ে রাখছি। ঈদের পর পরই তো পরীক্ষা হয়ে যাবে।”
– “ঠিক আছে পড়।”
তারপর বিছানায় গেল তোহফা। কিছুক্ষণ পরেই সেহরি খেতে হবে তাই আর ঘুমোবে না এখন। ফোন হাতে নিল কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করবে বলে।
ইরার পরীক্ষার পরেই ঢাকা নিয়ে এসেছিল তোহফা। মেয়েটা তাকে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে অ্যাডমিশন এর গাইডলাইন দেওয়ার জন্য। তাই ঢাকায় উদ্ভাসে ভর্তি হতে বলেছে সে। কিন্তু ঢাকায় ইরার কেউ না থাকায় আর মামার বাসা মতিঝিল হওয়ায় মামাকে বলে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে ইরাকে। মামা মামীর কোনো মেয়ে নেই বলে আত্মীয় বা প্রতিবেশী যেকোনো মেয়েকে নিজের মেয়ে বানিয়ে ফেলেন উনারা। তোহফা প্রথমে ভেবেছিল নিজেই উটকো ঝামেলার মতো পরে আছে যদিও মামা মামীর ইচ্ছাতে, সেখানে আবার ইরাকে আনাটা কেমন দেখায়। কিন্তু মামীকে একবার বলতেই মামী খুশিমনে ইরাকে নিয়ে আসতে বলেছেন এবং এটাও বলেছেন ইরা বুয়েটে চান্স পেয়ে যাওয়ার পরেও যদি এখানে থাকে তিনি খুশিই হবেন। মামা সকালে অফিসে চলে যান আর সামি স্কুল, কোচিং এসব করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। একা একা থাকতে উনিও বোর ফিল করেন তাই বাসায় মানুষ আসলে উনি খুশিমনে গ্রহণ করেন তাদের।
এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই তোহফা লক্ষ্য করেছিল সে তার মামীর সাথে যতটা মিলেমিশে থাকত, ইরা তার চেয়ে বেশি মিলেমিশে গিয়েছে। মেয়েটা মিশুক প্রকৃতির এটা তোহফা জানত কিন্তু তার মামীর সাথেও যে এত দ্রুত মিশে যাবে এটা বুঝেনি সে। মামীকে হাতে হাতে কাজ করে দেয়, পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলে মামীর সাথে গল্প করে। শাহনাজ পারভীনও ইরাকে নিজের মেয়ের মত যত্ন করে আগলে রেখেছেন। এসব দেখে শাহনাজ পারভীনের প্রতি শ্রদ্ধা কয়েকগুণ বেড়ে যায় তোহফার। এমন মানুষ এখনও পৃথিবীতে বেঁচে আছেন বলেই হয়ত কোনো না কোনোদিক থেকে পৃথিবী এখনও সুন্দর।
ফোন নিয়ে ওয়াইফাই অন করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নোটিফিকেশন আসল। তানভীর মেসেজ দিয়েছে,
– “এখনও জেগে আছো??”
অবাক হলো তোহফা। এই ছেলে কি তোহফা কখন অনলাইন হয় সেই অপেক্ষায় বসে থাকে নাকি!! নেট অন করতে দেরি হতে পারে কিন্তু মেসেজ আসতে দেরি হয় না। তোহফা লিখল,
– “মাত্র উঠলাম।”
– “আচ্ছা সেহরি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ো।”
– “আপনিও।”
তারপর আবার নেট অফ করে উঠে পড়ল। সেহরি আজ সে রেডি করবে। প্রায় প্রতিদিন মামী করে। আজ নিজে করলে মন্দ হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে হাত খোঁপা করে রান্নাঘরের দিকে গেল তোহফা।
খাবার রেডি করে টেবিলে আনতে আনতে তোহফা ইরাকে বললো মামা, মামী আর সামিকে ডেকে তুলতে। ইরাও তাই করল। সামি ঘুমুঘুমু চোখ নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে খেতে বসলো। শাহনাজ পারভীন ধমক দিলেন তোহফাকে তাকে না ডেকে নিজে নিজে কাজ করার জন্য। তোহফা মিষ্টি হেসে বলল,
– “সবসময় তো তুমি কর মামী। আজ আমি করলাম।”
আর কিছু বলল না কেউ। এরই মাঝে ইরা সাইমুম সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– “আংকেল আমি কালকে চট্টগ্রাম চলে যেতে চাচ্ছি। টিকেট কিভাবে নিবো যদি বলে দিতেন। আসলে আমি জানি না তো তাই বললাম।”
– “কালই চলে যাবে? ঈদের তো এখনও প্রায় দশ দিন বাকি।”
– “আসলে ক্লাস অফ হয়ে গিয়েছে। তাই ভাবলাম চলে যাই। অনেকদিন মা বাবাকে দেখা হয় না।”
– “ঠিক আছে চিন্তা করো না। কালকের টিকেট পাওয়া যাবে না যেহেতু ঈদ মৌসুম। তবে আমি দেখি পরশুর বাসের টিকেট ম্যানেজ করা যায় নাকি।”
সাইমুম সাহেবের কথা শুনে তোহফা বলে উঠল,
– “মামা, তাহলে আমার জন্যেও দেখো। আমিও চলে যাব ইরার সাথে একবারে। আমারও তো বন্ধ। যদিও আরো আগেই যেতাম ইরার জন্য থেকে গেলাম।”
শাহনাজ পারভীন এবার মন খারাপ করে ফেললেন। বললেন,
– “তুইও চলে যাবি?”
– “তোমরাও তো চলে যাবে মামী মামার ছুটি হলে। আমি তোমাদের সাথেই যেতাম কিন্তু যেহেতু ইরা একা যাবে তাই ভাবলাম একসাথেই চলে যাই।”
আর কিছু বললেন না শাহনাজ পারভীন। আসলেও প্রায় এক বছর হলো মেয়েটা বাড়ি যায়নি। ঈদ ছাড়া যাওয়া হয় না। খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে রুমে গেলো তোহফা আর ইরা। দুজনেই নামাজ পড়ে ঘুমোতে চলে গেল।
___________________________
ঈদের দিন ইরা সাহেলদের বাড়িতে বেড়াতে আসল। অদ্ভুতভাবে ইরা লক্ষ্য করল সাহেল তার সাথে আর আগের মত মজা করছে না। তাকে যে লজ্জা দিত কথায় কথায় সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। দুইয়েকটা সৌজন্যমূলক কথা ছাড়া কোনো কথাই বলেনি আর। ইরা এই ব্যাপারটা ঢাকা যাওয়ার আগেই লক্ষ্য করেছে। ঢাকা যাওয়ার পর থেকে সাহেল তার সাথে যোগাযোগ করেনি। ইরার সাহেলকে কল দিতে লজ্জা লাগত তাই দিত না বেশি। মাঝে মাঝে যখন লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে দিয়েও ফেলত তখনও সাহেল তেমন কথা বলার ইন্টারেস্ট দেখাত না। খালি বলত ভালোমত পড়াশুনা কর। আর কিছু বলত না। অ্যাডমিশন এর আগে পড়াটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তাই সেও আর সাহেলের সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিত না।
সবাই যখন একটু অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখনই বাড়ির পেছনের দিকের পুকুরঘাটে এল ইরা। সাহেল পুকুরঘাটের সিড়িতে বসে ফোনে গেমস খেলছে। ইরা যেয়ে বসল সাহেলের পাশে। আগে সাহেলের সামনে আসতেও লজ্জা পেত সে। এই ছেলেটাই তার লজ্জা এর জড়তা কাটিয়ে দিয়েছে আর এখন তাকেই ইগনোর করছে। কারণটা কি? সব ভাবনা চিন্তা সাইডে রেখে ইরা বলল,
– “আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?”
সাহেল ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
– “না তো। রেগে থাকব কেনো?”
– “কেমন ইগনোর করছেন মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। আগে তো আমাকে লজ্জায় ফেলতে ভাবতেন না দুবার। এখন তো ঠিকমত কথাও বলেন না।”
– “তুমি তখন ছোট ছিলে। কদিন পরেই ভার্সিটিতে উঠে যাবে। এখন আর বাচ্চাদের মত তোমায় রাগাতে যাব কেন?”
সাহেলের কথার জবাব দিলো না ইরা। ছেলেটা তাকে ছোট বলে রাগাত শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। আর যদি ছোট বলে রাগায়ও এক বছরের মাথায় কি সে বুড়ি হয়ে গেছে নাকি যে আর রাগানো যাবে না? আগে রাগালে বিরক্ত হত সে কিন্তু এখন খুব মিস করছে। ইরাকে চুপ থাকতে দেখে সাহেল বলল,
– “কি এত ভাবছেন বিয়াইন আপা? আর এভাবে নির্জন জায়গায় এসে পাশে বসেছেন যে ভয় করছে না?”
মূলত রসিকতা করে কথাটা বলল সাহেল। কিন্তু রসিকতায় ইরার কোনো ভাবান্তর হল বলে মনে হল না। সে তখনও চুপ। তাই সাহেল আর ঘাটাল না।
প্রায় আধঘন্টা পর গেমের মিশন কমপ্লিট করে বসা থেকে দাড়িয়ে গেল সাহেল। এতক্ষণ ইরা চুপ করে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে বসেছিল। ইরার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল মনোযোগ সহকারে পানিতে বিশেষ কিছু দেখছে সে। সাহেল যখন বাড়ির দিকে পা বাড়াল তখনই ইরা বলে উঠল,
– “আমি আপনাকে ভালোবাসি সাহেল।”
ইরার এই একটা লাইন শুনেই থমকে দাঁড়ালো সাহেল। কিন্তু কিছু বলল না। ততক্ষণে ইরা উঠে এসে সাহেলের সামনে দাড়িয়েছে। সাহেলের চোখ মুখ দেখে তার অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছে সে। সাহেলের চোখ মুখ দেখে ইরা সাহেলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে কিন্তু ঠিক সফল হতে পারছে না। সাহেলের মাঝে বিস্ময়, খুশি, দুঃখী কোনো কিছুরই যেন অস্তিত্ব নেই। সে নির্বিকার ভাবলেশহীন দাড়িয়ে আছে, ভাবখানা এমন যে এমনটা হবে এটা তার আগে থেকেই জানা ছিল তাই কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। সাহেলের ভঙ্গি দেখে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল ইরার। এতক্ষণ পাশে বসেছিল তখনও দিব্যি ইগনোর করে গেছে। এখন তাকে ভালোবাসার কথা বলল এখনও ইগনোর করছে। এই ছেলের সমস্যাটা কি? তার ভালোবাসা প্রকাশ করার পরেও এই ছেলের কোনো ভাবান্তর হল না। তার অনুভূতিগুলো কি সাহেল বুঝে না? সাহেলকে কিছু বলতে না দেখে করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল ইরা। তারপর বলল,
– “আপনি কিছু বলবেন না?”
– “কি বলব?”
– “মানে? আপনি আমাকে রীতিমত ইগনোর করেছেন এতদিন। আজ আপনার কাছে আমার মনের কথাগুলো প্রকাশ করার পরেও ইগনোর করছেন। সত্যিই কি আমার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে?”
উত্তর দিলো না সাহেল। ইরাকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল সে। ইরা ওখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইল একইভাবে।
চলবে??
বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন