অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৩২

0
513

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩২.

ঝলমলে বিহারিণী মহলে আজ আর আগের মতন শাসন শোসনের সেই উজ্জ্বলতা নেই। সাজিয়ে রাখা শখের বাগানে আজ আগাছায় ভোরে গেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল টুকটুকে ফুল গুলো অযন্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। মালি কী আর রোজ এগুলো পরিষ্কার করে না! বিহারিণী মহলের সকলেই তো প্রচুর বাগান বিলাসী অথচ তাদের প্রিয় বাগানের এই দূরাবস্থা! বাগানের কাহিল অবস্থা দেখেই আঁচ করা যায় বাড়ির ভেতরের মানুষ গুলো ঠিক কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছে। বাগানের মতনই বোধহয় মলিন অবস্থা মানুষ গুলোর! নন্দার বড়ো মায়া হলো মানুষ গুলোর কথা ভেবে। বুক ভার হলো। সবসময় বিলাসবহুল জীবন পার করা মানুষ গুলো এখন কীভাবে দিন কাটাচ্ছে! নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট হয়! মানুষ গুলো যে বড্ড আরামপ্রিয়। নন্দা হতাশায় শ্বাস ফেলে বড় গেটটা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। আজ আর অনেকগুলো গৃহরক্ষী লোহার গেটটি খুলে দেয়নি।

নিরিবিলি বাড়িটাতে প্রবেশ করতেই নন্দার শরীর সুনশান নীরবতায় শিরশির করে উঠলো। মনে হলো বহুবছর এই বাড়িটাতে কেউ থাকেনা। অযত্নে ঘুণে ধরেছে আঙিনায়। নন্দা অন্দরমহলে প্রবেশ করলো, দেখলো চারপাশে কেউ নেই। অন্যান্য সময় হলে এই অন্দরমহল জুড়ে কত দাস দাসীর আনাগোনা থাকতো! নন্দার উপস্থিত হওয়ার খবরটা মুহূর্তে ছড়িয়ে যেত পুরো বাড়িটাতে। কিন্তু আজ খবর ছড়ানোর কেউ নেই। অর্থ না থাকলে কেউ থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবুও দু একজন মায়ার টানে রয়ে গিয়েছে। অর্থের থেকেও মায়া যাদের বড়ো মনে হয়েছে কেবল তারাই।

রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুকটাক শব্দ। নন্দা সেদিকেই পা বাড়াল। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই দেখল মলিন একটি সাদা থান পরিহিতা নারী রান্না করছে। মাথা অব্দি যার ঘোমটা টানা। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। এই বাড়িতে কোনো বিধবা রান্নার বউ তো ছিল না। তবে কী নিযুক্ত করা হয়েছে নতুন! কেই-বা নিযুক্ত করবে! তার খুঁড়ো শ্বশুর! লোকটা তো বিধবা মানুষ দেখতেই পারেন না, তাহলে! নন্দার আকাশ-পাতাল ভাবনা তখন চারপাশে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়েছে। মহিলাটি কে হতে পারে জানার জন্য নন্দার কৌতূহলরা হামাগুড়ি দিয়ে পড়ছে। নন্দা তাই গলা পরিষ্কারের ভান করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল এবং পরিশেষে সে সফলও হলো। তার কণ্ঠের শব্দ পেতেই মহিলাটি ফিরে তাকাল। মহিলাটির মুখ স্পষ্ট চোখের সামনে ফুটে উঠতেই নন্দা চমকে উঠল। সদা পরিস্ফুটিত থাকা সুরবালা দেবীর পড়ণে আজ মলিন বস্ত্র! মুখের মাঝেও ক্লেশ যাতনা। সেই যাতনাকে ছোটো বলে ভাবাও যাবে না। সেই যন্ত্রণার ভার বোধহয় দীর্ঘ। যতটা দীর্ঘ হয় মাথার উপরের আকাশ, ততটা দীর্ঘ।

নন্দাকে দেখে যে তার সামনে দাঁড়ানো মহিলাও বেশ চমকেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“অলকানন্দা!”

একটি ডাকেই নন্দার প্রাণ জুড়িয়ে এলো। মনে হলো বহুদিন এই নামে কেউ তাকে ডাকে না। কালের গহ্বরে যেন হারিয়ে গেছে নামখানা। নিজের হারিয়ে যাওয়া নামখানাকে বহুদিন পর শুনতে পেয়ে নন্দার অনুভূতিরা যেন আনন্দ, উন্মাদনায় ঝলমল করে উঠলো। আটকে রাখতে পারল না নিজের অসংযত অনুভূতিকে। সে ছুটে গেল। মুহূর্তেই সকল বাধা, ব্যবধান, নিষেধ ভুলে জড়িয়ে ধরল তার এককালীন আশ্রয়কে। যে ছিল বলে আজ নন্দা জীবিত আছে। যে ছিল বলেই নন্দা আরেকবার বাঁচতে চাওয়ার সাহস করেছিল। যেখানে নিজের মা-বাবা তার দিকে দু’বার ফিরে তাকায়নি সেখানেই এই পাহাড়ের মতন সুউচ্চ নারীটি তাকে বটবৃক্ষের মতন ছায়া দিয়ে গিয়েছিল সর্বক্ষণ।

নন্দার চোখে অশ্রু টলমলে। হাসল সুরবালা। শুধাল,
“ভালো আছো?”

নন্দা কথা বলতে পারল না। ওষ্ঠযুগল প্রতিধ্বনিত করতে পারল না কোনো শব্দ। মায়ের আদুরে স্নেহেয় ভাষারাও নিরেট আহ্লাদে ঝিমিয়ে গেল। সুরবালা দেবী সকল নিরবতা ভেঙে বললেন,
“কথা বলবে না?”

গলাটা কী তার কাঁপলো! বোধহয় কাঁপলো। শব্দরা কেমন নড়বড়ে শোনাল। নন্দা উত্তর দিল,
“মা, আমাকে মনে পড়েছিল?”

“মনে পড়বে না? তোমার দুর্দিনে সাথে ছিলাম না, তাই তোমার ছায়া হারাতে না হারাতেই আমার দুর্দিন শুরু। তোমায় ভুলবো কেমন করে? তোমায় ভুললে যে আমার পাপের ক্ষমা হবে না কভু।”

নন্দা ফ্যালফ্যাল করে চাইল শাশুড়ির পানে। তার বেঁচে থাকার আদর্শ যে মানুষটা, সেই মানুষটার মলিন মুখ, ক্লান্ত কণ্ঠস্বর তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। সে আবদারের কণ্ঠে বলল,
“আমার সাথে চলুন, মা। আমার সাথে থাকবেন। আপনার এই অবস্থা যে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।”

“আমায় নিয়ে যাবে? কই নিয়ে যাবে! এই সংসারেই যে আমার খুঁটি। এই শিকড় ছিন্ন করে কোথায় যাব বলো তো!”

নন্দা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বলার ভাষা খুঁজে পেল না। নারীরা সব সময় সংসার প্রেমি। তারা সবসময়ই চায় এই সংসারে তাদের নিবিড় বসবাসটা যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই সংসারের মায়া তারা ছিন্ন করতে পারেনা এত সহজে। এই যে, এই মানুষটার স্বামী মারা গিয়েছে প্রায় বছর বিশ হবে। তারপর বহু গঞ্জনা, লাঞ্ছনা সহ্য করে সে এ সংসারে নিজের বাকিটা জীবন রেখে গেল। যত্নে কিংবা অযত্নে! কিন্তু কখনোই এই সংসার ছাড়ার ভাবনা ভাবেননি। নারী জাত সংসার ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারেন না। দিনশেষে সংসারই তাদের সবটুকু ভালো থাকা। অথচ পুরুষ! স্ত্রী মারা যেতে যেতে তারা ভেবে নেয় তাদের সংসার বুঝি নারী হীনতায় উচ্ছন্নে যাবে। আর সেই ভাবনাতেই তারা ঘরে তোলে নতুন স্ত্রী। আসলে পৃথিবীর বেশিরভাগ পুরুষ সংসার বলতে স্ত্রীর সান্নিধ্যে থাকাকেই বুঝে। তারা ভাবে স্ত্রী ছাড়া বা নারীসঙ্গ ছাড়া বুঝি কোন সংসারই হয় না। আর তাদের এই ভাবনার জন্য তারা খুব অকপটেই নিজেদের ভালোবাসা, মায়া সবকিছু ভুলে যেতে পারে। অথচ যদি কোন পুরুষ নারী ছাড়া থাকে তাদের বিশেষ কোনো লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হয় বলে আমার মনে হয় না। নারী ছাড়া পুরুষকে সমাজ ছোট চোখেও দেখেনা কিংবা অসহায় ভেবে অত্যাচারও করে না। এত সুবিধা থাকা স্বত্তেও সেই পুরুষ নারী ছাড়া থাকতে পারেনা। কিন্তু একই সমাজে একটি নারী যদি পুরুষ ছাড়া থাকতে চায় বা থাকে, তাহলে তাকে কত ধরনের বাজে পরিস্থিতি, অসহায়ত্ব পার করে যে বাঁচতে হয়, তা যেকোনো মানুষের ধারনার বাহিরে। তবুও নারীরা স্বামীর স্মৃতিকে অবলম্বন করে হাজারো অত্যাচার সহ্য করে কাটিয়ে দিতে চায়। আর সেই নারীকেই সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। সমাজ সব বুঝে কেবল প্রেম, ভালোবাসা কিংবা আবেগ বুঝে না।

নন্দা হতাশার শ্বাস ফেলে বলল
“মা, আপনাদের এই বিহারিণী মহল তো নিলামে উঠবে, তাহলে আপনারা যাবেনও বা কোথায়? কোথাও তো একটা যেতে হবে, তাই না? তাহলে আমার বাড়িতে নয় কেন? কি দোষ করেছি আমি?”

“দোষ তুমি করনি তো নন্দা, দোষ করেছি আমি। তোমাকে চিনেও, জেনেও শেষ পর্যন্ত না জানতে পারার পাপ করেছি। তোমার সবচেয়ে অসহায় সময়ে, তোমার ভয়ংকর ভবিষ্যতের কথা জেনেও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম সেই অত্যাচারের মুখে। সেদিন তুমি কতটা অসহায় হয়ে প্রাণ ভিক্ষা করছিলে।অথচ আমাদের বিন্দুমাত্র মায়া হয়নি। আমরা কতটা পাষাণ তাই না! অথচ তুমি আমদের অসহায়ত্ব দেখে পাশে দাঁড়াতে চাইছো? এত ভালো হইওনা নন্দা। ঠকে যাবে, ব্যথা পাবে আর দাঁড়াতে পারবে না। যারা তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিও না। এত মহৎ হলে যে তোমার ভাগ্য তোমার সাথে প্রতারণা করবে। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। সে ভালো থাকায় আমাদের মত কারো ছায়াও যেন না পড়ে।”

সুরবালা দেবীর চোখ-মুখ জুড়ে সেই এক দীপ্তি যেন ছড়িয়ে আছে যা বরাবর থাকতো। নন্দা আর কিছু বলতে পারল না বলার ভাষা ও খুঁজে পেল না। কেবল আফসোসে আফসোসে ভারী হলো বুক। দীর্ঘশ্বাসেরা দিল উঁকিঝুঁকি।

_

শহুরের একটি আলিশান বাড়িতেই অন্নপূর্ণার বসবাস। নন্দা আজ তাকেও দেখতে এসেছে। সে ভেবেছিল তার বোনটা হয়তো ভালো নেই। হয়তো গুমরে মরছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিল অন্নপূর্ণার চাঞ্চল্য। নন্দা বাড়িতে ঢুকলেই দেখল অন্নপূর্ণা নাচ করছে। পায়ের ঘুঙুরের শব্দ তালে তালে বাজছে।

নন্দাকে দেখে অবাক অন্নপূর্ণা। ছুটে এলো খুব দ্রুত। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বোনকে বসতেও দিল। কথা বলতে পারে না সে, তবে তার হাবভাব বুঝিয়ে দিল তার খুশির পরিমাণ। নন্দা হাসল, শুধাল,
“ভালো আছিস?”

অন্নপূর্ণা ইশারা করল, বুঝাল তার ভালো থাকার পরিমাণ কতটুকু। নন্দা বোনকে জড়িয়ে ধরল। প্রস্তাব রাখল সে এখুনি বোনকে বাড়ি নিয়ে যাবে। নিজের কাছে রাখব। অন্নপূর্ণা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। অবশেষে শহুরে এক একাকীত্ব জীবন থেকে অন্নপূর্ণার ছুটি মিলল। ছুটলো সে শিকড়ের টানে।

_

একটি মায়াবিনী নারীর হাতে দীর্ঘ চিঠি যা অযত্নে ভাঁজ হয়ে আছে। সে তাদের বাড়ির পেছনের ঘন আঁধারিয়া সেই মোহনীয় জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ-মুখে কিসের যেন একটা হিংস্রতা খেলা করছে। তার সামনেই পুকুরটার জলের রঙ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। পুকুরের ভেতর মানুষ খেঁকো মাগুর মাছ গুলো আজ মহা আনন্দে নাচছে। কত গুলো দিন পর মানুষের মাংস তাদের পেটের ক্ষুধা মনের তৃষ্ণা মেটালো। মানুষ খেঁকো মাছ গুলোর সাথে সাথে খুশি নারীটিও। সেও তো বেইমান খেঁকো মানুষ। বেইমানদের এই পৃথিবীতে কোনো ঠাঁই সে পেতে দিবে না। অসম্ভব। আকাশে-বাতাসে গম্ভীর বজ্রপাত হলো। একটি কোমল নারীর নৃশংসতায় যেন হতভম্ব সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here