অভিমান পর্ব ১

0
2351

– এই যে ভাইয়া, শুনছেন? আমি আপনাকে ভালোবাসি!

কথাটা কানে যেতেই অবাক হয়ে পেছনে ফিরলো আবির। দেখতে পেল ওর ঠিক সামনেই দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। মাথা নিচু করে রাখা। মুখটা ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না তবুও ও নিশ্চিত বলতে পারবে তাকে ও চেনে না। আগে কখনো দেখেছে বলেও মনে পড়লো না। অথচ এমন এক অপরিচিত মেয়ের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনছে? ভাবতেই অবাক হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লো মেয়েটার দিকে,

– কী বললে?

– বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি…

বলেই আবারও মাথা নিচু করে ফেললো মেয়েটা। আবির অবাক চোখে তাকালো। এক পলকের জন্য ওর চেহারাটা দেখতে পেয়েছে। ফর্সা মুখে লজ্জিত লাল আভা। মুখের গঠন একেবারেই পুতুলের মতন, ভোলাভালা টাইপ। এই রকম একটা মেয়ে এসে ওকে প্রপোজ করছে? ও কী ইচ্ছে করেই করলো না কেউ জোর করে করালো? এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত কেন যেন ভেবেই পেল না। এরকম মেয়েদের কাছে প্রপোজ পাওয়া তার জন্য নতুন নয়, এর আগেও সে এমন হাজারও প্রপোজ পেয়েছে। অনেক সুন্দরী, অনেক স্টাইলিশ ধরণের মেয়ে। কিন্তু এর মতো মেয়ে এবারেই প্রথম। মেয়েটার কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট জড়তা আছে, বোঝাই যাচ্ছে সে বেশ ইতস্তত বোধ করছে।

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো আবির। মেয়েটাকে পা থেকে মাথা অবধি একবার স্ক্যান করে বললো,

– ড্রেসআপ ভদ্র ঘরের, চেহারা ভোলাভালা। তোমার মতো মেয়ের মাথায় ভালোবাসার ভুত চাপলো কী করে?… সত্যিই বলছো? না কি কেউ তোমাকে বলতে বাধ্য করেছে?.. এ ভার্সিটিতে পড়ছো কতোদিন ধরে? এর আগে তো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না!.. কীসে পড়ছো বলতো?

– ফা..ফা..ফার্স্ট ইয়ার।…

আশ্চর্য! মেয়েটা প্রপোজ করার সময় ঘাবড়ে গেল না অথচ কীসে পড়ে সেটা বলতে ঘাবড়ে যাচ্ছে? আবার ফার্স্ট ইয়ারের কথা বলছে, দ্যাট মিনস মেয়েটা নতুন। কী আশ্চর্য প্রথম দিনেই মেয়েটা এমন কেন করবে? চেহারা দেখে তো বেয়াদব বা উশৃঙ্খল ধাঁচের লাগছে না! নিজের মধ্যেই কী সব বিড়বিড় করে বললো,

– ফার্স্ট ইয়ার। তারমানে আজই ভার্সিটিতে প্রথম এসেছে?

মেয়েটা মুখে কিছু বললো না। লজ্জিত মুখে সামনে পেছনে মাথা নাড়ালো। ব্যস! যা বোঝার বুঝে ফেলেছে আবির। মেয়েটা অবশ্যই ইচ্ছে করে ওকে প্রপোজ করতে আসে নি। কারণ এই ভার্সিটির কারো এতো সাহস নেই ওকে এসে প্রপোজ করবে! সেটা ওর সম্পর্কে জেনে শুনে হোক বা না জেনে। হঠাৎ করেই মাথায় খুন চেপে গেল ওর। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?.. কে বলেছে আমাকে প্রপোজ করতে?.. তুমি নিশ্চয় নিজে থেকে আসো নি?.. ঠিক করে বলো, কে পাঠিয়েছে?

ওর ধমকে কেঁপে উঠলো মেয়েটা। কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকলো। ওর নিরবতা দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আবিরের। ইচ্ছে করছে, ঠাটিয়ে একটা চড় মারুক মেয়েটার গালে। কতবড় সাহস ওকে এসে প্রপোজ করে! আবার ভালো বুঝে যখন জিজ্ঞেস করছে কে পাঠিয়েছে তখন আবার কথা না বলে ঢং করছে? রাগী গলায় বললো,

– কথা বলছো না কেন? বলো, কে পাঠিয়েছে?

– কে.. কেউ পাঠায় নি। আমি নিজে নিজেই এসেছি। আমার আপনাকে ভালো লেগেছে তাই.. আমি আপনাকে ভালোবাসি!

– ভালোবাসো? আমায়?.. ওহ্, নো! ভালোবাসা মাই ফুট! ভার্সিটিতে প্রথম দিনে এসেই ভালোবাসা হয়ে গেছে? বাবা রে, কী স্পিড! ফোরজি নেটওয়ার্কও দেখি ফেল মারবে!.. তা কী দেখে ভালোবাসলে শুনি?

ছেলেটার ব্যঙ্গধ্বনি শুনে মাথাটা আরও নিচু করে ফেললো মেয়েটা। মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বেরোল না। তাই দেখে আবিরের যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। কিছু ভাবতে পারলো না। মুখে যা আসে তাই বলে গেল মেয়েটাকে।

– এই তোমাদের মত কিছু মেয়ের জন্য, আজ মেয়ে জাতি উচ্ছনে যাচ্ছে!.. তোমাদের মত কিছু ফাজিল, বেয়াদব, অসভ্য মার্কা মেয়েদের জন্যই মেয়েরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পায় না।.. আর তোমাদের ওই সো কল্ড ভালোবাসার জন্য হাজারও ছেলেকে বখে যেতে হয়। তোমাদের কাছে ভালোবাসার কোন দামই নেই!.. এটাকে নিয়ে যা তা বলতে তোমাদের বাঁধে না!.. কী যেন বলছিলে তুমি? আমাকে ভালোবাসো?.. বলি, ভালোবাসার মানে বোঝ তুমি?.. ফার্স্ট ডে তে এসে সিনিয়রদের সম্মান না করে প্রেমের প্রস্তাব দাও!.. হাউ শেইমলেস!.. বেয়াদব, অসভ্য মেয়ে কোথাকার!..

গড়গড় করে কথাগুলো বলে সামনে তাকায় আবির। দেখতে পায় মেয়েটার মাথা এখনো নিচু করে রাখা। আগের চেয়েও অনেক বেশি নিচু করা। ও হঠাৎ চিৎকার করে ধমকে ওঠে,

– কী হলো, এখনও দাড়িয়ে আছো যে?.. তোমার কী মান-সম্মান বোধ নেই? নাকি নিজেকে বাজারের সস্তা পণ্য বলে মনে হয়?.. এখনো দাড়িয়ে আছো কোনো সাহসে? আরও অপমান হতে মন চাইছে?.. এখনো হাতে সময় আছে, যাও,বলছি!

প্রচণ্ড জোরে ধমক দেয় আবির। মেয়েটাকে এবারে একবারের জন্য মাথা তুলতে দেখা যায়। সে রক্তিম মুখে তাকালো ওর দিকে। মুখটা ঠিক কী কারণে রক্তিম তা বোঝা যাচ্ছে না। রাগ নাকি লজ্জায়? কিন্তু মেয়েটার চোখে পানি। ছলছল করছে চোখ দু’টো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। আবির আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ উল্টো ঘুরে দৌড় দিলো মেয়েটা। প্রচণ্ড বেগে চুল গুলো উড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল কোথাও! যাবার সময় বারবার বাঁ হাতে চোখ মোছার চেষ্টা করলো। কিন্তু থামলো না। ছুটে বেরিয়ে গেল ওর দৃষ্টি কোণ থেকে!

– যত্তসব, ফাউল মেয়ে! কোথা থেকে যে আসে না এরা!.. জাস্ট রিডিউকুলাস!

বলতে বলতেই শ্বাস ছাড়ে আবির। রাগ হয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। বের করে আনে একটা বেনসনের প্যাকেট সাথে একটা ম্যাচ। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের মাঝে আটকে নেয়, ম্যাচ থেকে একটা কাঠি বের করে ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে নেয় তাতে। তারপর জ্বলন্ত কাঠিটা খুব সাবধানে ঠোঁটের কাছে এনে বের করে রাখা সিগারেটে আগুন জ্বালায়। টোকা মেরে উড়িয়ে দেয় আগুনসহ কাঠিটাকে! সেটা উড়ে গিয়ে কোথায় যে যায় সে খেয়াল আর রাখে না।

মাথা থেকে সব চিন্তাঝেড়ে ফেলে সিগারেটটা হাতে নেয়। দু আঙুলের ফাঁকে বিশেষ কায়দায় সেটাকে ধরে রেখে আবারও ঠোঁটে ছুঁইয়ে নেয়। লম্বা লম্বা টান দিতে দিতে ধোঁয়া বের করে নাক মুখ দিয়ে!

সে যে সবসময় সিগারেট খায় তা না। মাঝে মাঝে খায়। যখন প্রচন্ড রাগ আর বিরক্ত হয় কোনকিছুতে তখন। তাতে রাগ কমে বলে মনে হয় না, তবে সাময়িক কালের জন্য সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে রাগটাও উড়ে যায়! বর্তমানে সেই চেষ্টাই করছে ও। রাগটাকে দমন করতে। মেজাজটা কে স্বাভাবিক করতে। কারণ একটু পরেই ওকে পার্টি অফিসে যেতে হবে। দলের নতুন নেতা কে হবে তাই নিয়ে আলোচনা বসবে আজ। খুবই সিরিয়াস একটা বিষয়, গুরুত্তপূর্ণ আলোচনা করা হবে। এমন জায়গায় কিছুতেই মেজাজ খারাপ করে যাওয়া যায় না। দেখা গেল, একটুতেই ও ক্ষেপে গিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু বলে বসলো। ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না, তাতে নিজের ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে।

সিগারেটে টান দিতে দিতেই আনমনে হেটে যায় আবির। আশে পাশে তাকায় না। নিজের মতো করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় পার্টি অফিসের দিকে।
_________________________________

হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রাপ্তি। আজ তার ভার্সিটিতে প্রথম দিন ছিল। ফার্স্ট ইয়ারে ফার্স্ট ক্লাস। কতো আশা, কতো স্বপ্ন-সাধনা করেছিল এই দিনটার জন্য! ভার্সিটি লাইফ, স্বাধীনতার এক অন্য নাম! চিরকাল বাবা মার সাথে থেকে স্কুল-কলেজ জীবন শেষ করেছে। ধরা বাঁধা জীবন। কোত্থাও কোনো স্বাধীনতা ছিল না, মা-বাবা যা বলেছে তাই করেছে। নিজে থেকে কিছু বলবার বা করবার জো ছিল না। তাই সবসময়ই অপেক্ষা করে ছিল ভার্সিটি লাইফের জন্য। মা বলতেন আগে ভালো করে পড়ালেখা কর, ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে নে, তারপর আমি তোর সব ইচ্ছে পূরণ করবো! তখন তুই তোর ইচ্ছে মতো চলিস, আমি বাধা দেব না। প্রাপ্তি তখন হাসিমুখেই মেনে নিয়েছে সব!

অনেক চেষ্টা, খাটা-খাটনি করে চান্স পেয়েছে ঢাকা ভার্সিটিতে। ওর স্বপ্নের ভার্সিটি, স্বপ্নের সাথে পথচলার জন্য! কিন্তু প্রথম দিনেই ওর সেই স্বপ্নের সোয়া বারোটা বেজে গেছে। সিনিয়রদের পাল্লায় পড়ে শিকার হতে হলো র্যাগিংয়ের। মান সম্মানের ভয়ে যে মেয়ে জীবনে কখনো যেটা করে নি, কখন কোন ভুল হয়ে যায় এই ভেবে কখনোই কোনো ছেলের দিকে ফিরেও তাকায় নি, আজ সিনিয়রদের পাল্লায় পড়ে সেই মেয়েই কী না একটা অচেনা ছেলেকে প্রপোজ করে ফেললো! আর সেই ছেলেটা? কতো খারাপের খারাপ, কী সুন্দর করে ওকে অপমান করে ছেড়ে দিলো। বিনা হারপিকে এক্কেবারে ধুয়ে ছাড়লো!

ভেবেই বারবার কান্না পাচ্ছে ওর। মনে মনে পণ করে ফেলে, জীবনে আর কোনোদিন ওই ছেলের দিকে ফিরেও তাকাবে না। আর ওই বজ্জাত সিনিয়র গুলোর ধারে কাছেও যাবে না। যে রাস্তায় ওরা যাবে, যেখানে ওদের ছায়া পড়বে তার আশপাশেও ঘেঁষবে না! কিছুতেই না!

ওর একা একা দুঃখ বিলাসের মাঝে হঠাৎ খুব শব্দ করেই বেজে উঠলো ওর ফোনটা। কান্নাভেজা চোখে একপলক স্ক্রিনের দিকে তাকালো। লেখা ভাসছে, “আম্মু”। ফোনটা সে ধরবে না। মার উপর তার অভিমান জমেছে, ভীষন অভিমান। সে একা একা ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে, ভার্সিটিতে যাচ্ছে অথচ প্রথম দিনে তার মা তাকে কলই দিলো না? একবারও মনে করলো না যে প্রাপ্তি একা একা কী করছে? তার ভার্সিটির প্রথমদিন কেমন গেল সেটা শোনার কোনো আগ্রহই দেখালো না? কাঁদতে কাঁদতেই একবার জোরে নাক টেনে নেয় প্রাপ্তি। ইসস! সর্দি লেগে গেছে! ওর এই এক সমস্যা, একটুখানি কাঁদলেই নাক বন্ধ হয়ে আসে। নিশ্চয় সর্দি লেগে যাবে! উফ্! মন খারাপ হলে কেঁদেও শান্তি নেই!

এরইমধ্যে ফোনটা একবার কেটে গেল। কিন্তু তার প্রায় সাথে সাথেই আবারও তুমুল বেগে বাজতে শুরু করলো সেটা। ও রাগ করে কেটে দেয় কলটা। কিন্তু লাভ হয় না, সেটা আবারও বাজতে থাকে। প্রাপ্তি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ও খুব ভালো করেই জানে ও যতক্ষণ না পর্যন্ত ফোনটা রিসিভ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এভাবে ফোন বেজেই যাবে! তার মা মিসেস. মমতার মধ্যে বিরক্তি ব্যাপারটা একেবারেই নেই! কোন কাজে যখন তিনি হাত দেন, তখন সেটা যতক্ষন পর্যন্ত ঠিকভাবে সমাপ্ত না হয় ততক্ষণ পর্যন্তই তিনি ওটার সাথে লেগে থাকেন। তাতে একটুও বিরক্ত হতে দেখা যায় না কখনো! সম্ভবত তার মায়ের “বিরক্তি” নামক সিস্টেমটিই নেই!

ভেবেই একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রাপ্তি। ফোনটা রিসিভ করার আগে একটু খানি কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে। তারপর মেজাজটা কে বাজখাঁই করে বললো,

– তুমি আমাকে কল করেছ কেন, হ্যাঁ? কল দিছ কেন?.. সারাটাদিন কেটে গেল, আমি একা একা ঢাকায় এসে উঠেছি একবারও কল দিয়ে খোঁজ নিলে না তুমি, তাহলে এখন কেন কল দিয়েছ?.. এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়েছে তোমার?.. তা পড়লো কেন? না পড়লে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত?

– আরে বাবা, থাম তো!.. একেবারে এতো কথা বলিস কেন? একটু শ্বাস নে, তারপর কথা বল্!..

– কথা বলবো? কীসের কথা বলবো?.. কোনো কথা নেই তোমার সাথে, আমি আর কথা বলবো না তোমার সাথে। ফোন কেটে দাও বলছি, এক্ষুনি কেটে দাও!

– আমাকে কাটতে কেন বলিস? তোর হাত নেই? তুই কাট…

কথাটা শুনেই ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে ও। তার মা এমনই। ব্যবহারটা এমন যেন ও তার মেয়ে নয়, জিগার কি দোস্ত! শুধু ওর মা’ই নয়, ওর বাবাও ওরকম একজন মানুষ। তাদের সাথে ওর সম্পর্ক একদম বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো! কথাটা শুনে অনেকেই হয় তো চমকাবেন, কিন্তু ঘটনা আসলেই সত্যি! প্রাপ্তি আর ওর পরিবার এমনই।

ওর অভিমানকে পাত্তা দিল না দেখে আরো বেশি ক্ষেপে গেল প্রাপ্তি। দাঁত কটমট করে বললো,

– ঠিক আছে, আমিই কাটছি। আর একবারও কল দিবা না তুমি!.. তাহলে ব্লক মারবো কিন্তু, এই বলে দিলাম!..

– আচ্ছা, ঠিক আছে। আমিও আর কল দিবো না। কিন্তু দেখিস, ঝামেলায় পড়লে আবার আমাকে বলতে আসবি না!..

– যাও, যাও.. দরকার নেই তোমার। আমার সমস্যা আমিই মেটাতে পারি! হুহ্!

বলে আর একটুও সময় নেয় না ও। মমতাকে একটা কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দেয়। মার উপর অভিমান হচ্ছে খুব। মা এমন কেন? বন্ধুর মতো আচরণ না করে মায়ের মতো করতে পারে না? সবসময় ওকে এভাবেই রাগিয়ে দেয়! ভেবেই মন খারাপ করে ফোনটা বেডের দিকে ছুড়ে মারে। কান্না কাটি করে মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে। ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেশ হওয়া দরকার!

– “তুই তো আজকাল বড্ডো খারাপ হচ্ছিস, প্রাপ্তি!.. একা একা ঢাকায় গেলি, ভার্সিটিতে ক্লাসও করলি, কই একবারও তো নিজে থেকে কল দিলি না! বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় দেখলাম খুব খুশি, ঢাকায় যাচ্ছিস একলা একলা থাকতে, সেই আনন্দ তোর ধরেই না! এদিকে আমি যে মন খারাপ করলাম, সে খোঁজ নিয়েছিস? আর আজ তোকে কল করি নি বলে এত্তো অভিমান? এটা কোনো কথা বল্? নিজের বেলায় ষোল আনা, পরের বেলায় কাঁচকলা?”

ম্যাসেজটা পড়তেই খুশিতে চোখে জল এসে গেল ওর। মেসেজটা ওর মার নাম্বার থেকে এসেছে। মানে তিনি নিজে পাঠিয়েছেন। ভেবেই খুব খুশি হয়ে ওঠে ও! মায়ের অভিমান দেখে মুচকি হাসে। মনটা ভালো হয়ে গেছে তার। এতক্ষণে নিজেকে খুব ফ্রেশ লাগছে। বড্ডো শান্তি পাচ্ছে মনে! আসলে মিসেস. মমতার মমতাময় বাণীই ওর মন ভালো করে দিতে যথেষ্ট! ওর সকল অভিমান ভাঙাতেও একায় একশো!
___________________________

রাত বাজে ১: ৩৯মিনিট। এত রাতে বাড়ির দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে আছে আবির। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সুযোগ হচ্ছে না। কারণ দরজা তো বন্ধ! এতরাতে কেই বা ওর জন্য দরজা খুলে রাখবে? সবারই তো ঘুম নামক বস্তুর প্রয়োজন আছে, মস্ত প্রয়োজন। আবির চিন্তিত মুখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। একবার একবার করে কলবেলের উপর হাত রাখছে, কিন্তু সুইচ টেপার সাহস পাচ্ছে না। সুইচ টিপে দিলেই তো সর্বনাশ! মা ঠিক জেগে উঠবেন, তার পর শুরু হবে তার রাগারাগি মেগা এপিসোড! এই মাঝরাতে তার কমেডি শো দেখতে ওর একদমই ইচ্ছে করছে না। তাই কলিংবেল না বাজিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। অবশ্য দাড়িয়ে থেকেই বা লাভ কি? বেল না বাজালে বা কাউকে না ডাকলে দরজা খুলবে টা কে?

একটা কাজ অবশ্য করা যায়। আদ্রিকে কল দেয়া যায়। ও নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে না। আজকালকার মেয়েরা এতো তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না, রাত জেগে বয়ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাট করে। সারারাতে বাবু-সোনা-জান-প্রাণ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তারপর ভোরের দিকে একগ্লাস পানি খেয়ে দেয় ঘুম, (পানি খাওয়াটা অবশ্যই জরুরি, কারণ রাতভর প্যাচাল পারতে পারতে গলা শুকিয়ে যায়) সে ঘুম ভাঙে কখন কে জানে! আদ্রি অবশ্য এইসব করে না, করার চেষ্টাও করে না। তবে সারারাত জাগে, জেগে জেগে বই পড়ে। এটাই তার ওয়ান এন্ড অনলি কাজ!

দু’ বার রিং হতেই কল রিসিভ করলো আদ্রিতা। বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বললো,

– হ্যালো, ভাইয়া বল্.. আজ রাতেও কী ফিরবি না? বিছানায় কোল বালিশ চাপা দিয়ে রাখবো? শোন, মা কিন্তু তাহলে ঠিকই টের পেয়ে যাবে!.. সন্ধ্যের দিকে বেশ কয়েকবার তোর ঘর চেক করে গেছে, তোকে না দেখে মনে মনে কিন্তু ভীষণ ক্ষেপেছে!

মার রাগের কথা খুব ভালো করেই জানে আবির। হুট করে রাগারাগি করেন, যখন করেন তখন হুশ জ্ঞান থাকে না। যা খুশি তাই করেন, ইভেন এতো বড় বড় ছেলে-মেয়ের গায়েও হাত তোলেন! গায়ে হাত তোলা মানে বেশি কিছু না, শুধু দু’ একটা চড় মারা। তার ধারণা এটাতে তার বাচ্চারা অপমানিত-লজ্জিত হবে। কারণ মারের মধ্যে চড়টাই হচ্ছে সবচেয়ে অপমানকর! আর এতো বড় দামড়া বাচ্চাদের মারের ব্যাথার থেকে অপমানটা গায়ে লাগে বেশি! ওদের ভাষায় যাকে বলা হয় “প্রেস্টিজ পাংচার”!

আবার মারামারির দু এক ঘণ্টার মধ্যেই তার মন বদলে যায়। রাগ পড়ে গিয়ে নিজের কাজের জন্য শুরু হয় অনুশোচনা। তখন সেই দুঃখের ঠেলায় তার স্ট্রোকের মত হয়! যতক্ষণ পর্যন্ত না তখন ছেলেমেয়েকে আদর করে দেন ততক্ষণ পর্যন্তই তার এই স্ট্রোক স্ট্রোক ফিলিংসটা থাকে! তাই আবির – আদ্রিতা এই রাগের নাম দিয়েছে হাওয়াই মিঠাই রাগ! তার মা মিসেস.আসিয়া বেগম এরকমই!

কী যেন চিন্তা করে বললো,

– এই শোন, আমি বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি। তুই এসে দরজাটা খুলে দিয়ে যা.. আমি চুপচুপ করে আমার ঘরে চলে যাবো। মা একটুও টের পাবে না!

ভাইয়ের কথা শুনে বিরক্ত হলো আদ্রিতা। মনে মনে রাগ করে ভাবলো, তার ভাইটা বড্ডো বদ! রোজ এমন দেরি করে ফিরবে আর ওকে এসে বিরক্ত করবে! উফ্! এতো আরামের জায়গা থেকে কি ওঠা যায়? কষ্ট লাগে না বিছানা থেকে উঠতে?

– ঠিক আছে আসছি!

ঠিক দু’ মিনিটের মাথায় আদ্রিতা এসে দরজা খুলে দেয়। ওর বিরক্ত মাখা মুখটা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসে আবির। এক হাতে ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

– আমার জানটুস বোন টা! লাভ ইউ! উম্মাহ!

বলেই আর দেরি করে না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যায়। যাওয়ার আগে মায়ের ঘরে একবার উঁকি মারতেও ভোলে না। ভেতর থেকে তার বাবা মোকসেদুল সাহেবের নাক ডাকার প্যাপো আওয়াজ আসছে! তারমানে সবাই ঘুম! যাক নিশ্চিন্ত!

#চলবে—–

#অভিমান
#পর্বসংখ্যা_০১
#মৌরিন_আহমেদ

[ অভিমানী ভালোবাসার গল্প এটা, খুব একটা বড় হবে না। দ্রুতই শেষ করে দেয়ার ইচ্ছে আছে। বাই দ্যা ওয়ে, প্রথম পর্ব কেমন হয়েছে সেটা সবাই জানিও.. হ্যাপি রিডিং ?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here