অভিমান পর্ব ৪

0
1188

#অভিমান
#পর্বসংখ্যা_০৪
#মৌরিন_আহমেদ

আজ ভার্সিটিতে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সে উপলক্ষ্যে খুব সাজগোজ করে এসেছে প্রাপ্তি। সে সচারাচর এসব ফাংশনে আসে না। কিন্তু আজ এসেছে। বেশ ভালো করেই সেজে গুজে এসেছে। পরনে তার অফ হোয়াইট রঙের সুন্দর একটা শাড়ি। লম্বা লম্বা চুলগুলো শক্ত করে পেঁচিয়ে খোঁপা করে রাখা। তার সিল্কি চুলে সহজে খোঁপা আটকে না। তাই এ ব্যবস্থা। সে খোঁপার একপাশে গুঁজে রাখা তাজা একটা লাল গোলাপ। মুখে কোনো বিশেষ সাজ নেই। চোখে আইলাইনার আর ঠোঁটে হালকা করে লিপগ্লোজ লাগানো। মুখে সামান্য ফেস পাউডার। ব্যস! খুব সামান্যই সাজ তার। তবুও এ সামান্য সাজে তাকে অপ্সরীর মতো সুন্দর লাগছিল! যেন পরীর দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া পরী রাজকন্যা!

স্টেজে উঠে কী একটা নিয়ে স্পীচ দিচ্ছিল আবির। দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করলো প্রাপ্তি। আড়চোখে খেয়াল করলো ওর সুন্দর বাচনভঙ্গি! কী সুন্দর হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে, আহ্! তার সৌন্দর্য যেন তীর, বুকে এসে বিঁধে! ভাবতে ভাবতেই কখন যে বুকের উপর হাত রেখে ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেটা নিজেও জানলো না। যখন হুশ হলো তখন যেন চমকে উঠলো! একি প্রাপ্তি, এ তোর কী দশা? ওই ছেলের উপরেই কিনা শেষমেষ ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়ে বসলি? এখনই উগলে ফেল, ছেলেটা মস্ত খারাপ! তার নমুনা তুই আগেই পেয়েছিস!

নিজের ভুল বুঝতে পেরে জায়গাটা ছেড়ে চলে যায় প্রাপ্তি। সে চায় না ওই ছেলেটার মায়ায় জড়াতে! কারণ সে যে ওর জন্য শুভকর কেউ নয়, তা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিল। এরপর বিভিন্ন অকেশনে, কারণে-অকারণে ওর সাথে দেখা হয়ে যেত প্রাপ্তির। আবিরের বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্য বরাবরই মুগ্ধ করতো ওকে। কিন্তু ও তো সে মায়ায় জড়াবে না। কিছুতেই না!

কিন্তু সর্বনাশ যখন অবশ্যম্ভবী তখন কি আর কোনো কিছু করেই তাকে ঠেকানো যায়? প্রাপ্তির সর্বনাশ লেখা হয়ে গেছিল আবিরের নামেই। তার চোখেই নিজের সর্বনাশ প্রত্যক্ষ করেছিল প্রাপ্তি! কিন্তু ঠেকাতে পারে নি। কারণ প্রেম নামক রোগে সে তখন মারাত্মক ভাবে সংক্রমিত! কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় নি “আবির ইশতিয়াক” কে!

ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত আবিরই জিতে গেছে। শুধু জিতেছে তা নয়, সামিনকে লেজে গোবরে করে হারিয়েছে। সামিন যতই ফটর ফটর করে সে নিজেও জানতো এবার অবশ্যই আবির জিতবে! যাই হোক, এটা নিয়ে সে নতুন করে কোনো ঝামেলা পাকায় নি। কারণ তাতে তার ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি ছিল, সেটা ও নিশ্চয় জানতো! আর নিজের ভালো পাগলেও বোঝে!

আজকাল মাথায় আর নতুন কোনো চিন্তা নেই আবিরের। খুব চিল মুডে আছে সে। তাই হয় তো প্রেম নামক রোগটা তাকে এসেও আঘাত হানলো! সুখে থাকতে ভুতে কিলানোর মতো তার ঘাড়ের উপরও প্রেম ভুত এসে ভর করলো। ভুতের নাম প্রাপ্তি!

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন প্রথম ওই মেয়েটার রূপ মাধুর্যে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল আবির। কিন্তু পুরোনো ঝগড়া-ঝাটির রেশ টেনে আর নতুন করে কিছু করতে মন সায় দেয় নি। এরপর আবারও দেখলো ওকে অন্য রূপে, অন্য রকম ভঙ্গিতে। যতবারই দেখে ততবারই মুগ্ধ হয়! বুকের বাঁ পাশে অনুভব করে চিনচিনে ব্যাথা। কই আগে যখন দেখতো তখন তো এমন হতো না! তখন তো কোনো ফিলই আসে নি। এখন কেন হয়? তাহলে কি এটা অন্য কোন সংকেত দিচ্ছে ওর হৃদয়ে? জীবনে বসন্ত আগমনের জানান দিচ্ছে? জানে না, আবির। তবে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে ওই মেয়েটাকে না হলে ওর আর চলছে না। কিছুতেই না। কী মেয়েটাকে জীবনে দরকার পরেছে খুব!

__________________________

বর্তমানে আবিরের সামনে দাড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। লজ্জায় তার মাথা নামিয়ে রাখা। আবির তাকিয়ে আছে তার দিকে। দুজনই চুপচাপ। মুখে রা’ টা নেই। ভাবছেন, এদের আবার কী হলো? আসল ঘটনা কী? দাড়ান বলছি….

গত দু’ তিনদিন আগে আবিরের ঠিকানায় একটা চিঠি আসে। সুন্দর হাতের লেখার সুন্দর একটা প্রেমপত্র। পত্রের ভাষা আনাড়ি, তবে তাতে রসবোধের কমতি নেই। চিঠিটা অনেকটা এমন,

” তুমি কি জানো, তোমার চেহারার বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করে? তুমি কি জানো, তোমার হাসিটা দেখলে আমার বুকে ব্যাথা শুরু হয়? অবাক হচ্ছো, তোমায় তুমি করে বলছি বলে? অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভালোবাসার মানুষকে আপনি করে বলতে হয় না, তাই আপনি ছেড়ে সোজা তুমিতেই নামলাম। তুমিও আমায় তুমি করে বলবে, ঠিক আছে? কেন বলবে? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার প্রেমে আমি পড়েছি। তোমার প্রেম নামক রোগটা আমায় ভীষন ভাবে সংক্রমন করে ফেলেছে। আমি বাঁচতে পারছি না এর থেকে। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই, মুক্তি চাই এর থেকে। সেটা করতে পারবে তুমি! শুধু তুমি! প্লিজ আমাকে বাঁচাও! নইলে তোমার প্রতি মাতাল প্রেম যে আমায় ছন্নছাড়া, পাগল করে তুলছে! প্লিজ, বাঁচাও!”

— প্রাপ্তি

যথেষ্ট সুন্দর এবং সাবলীল ভাষায় লেখা সে চিঠিটা এসেছে প্রাপ্তির কাছ থেকে। আর মূলত একারণেই ওকে এমন জরুরি তলব কর ধরে আনা হয়েছে! চিঠি আসার পরে ক’দিন ভার্সিটি হন্নে হয়ে খুঁজেও ওর দেখা মেলেনি। সম্ভবত সে ইচ্ছে করেই আসে নি। চিঠিটা পড়ে আবিরের কী রিয়েকশন হবে সেটা ভেবেই হয় তো আসার সাহস হয় নি!

– কী হলো কথা বলছো না যে?

চুপ করে থাকে প্রাপ্তি। মাথা নিচু করে রাখে। সে লজ্জা পাচ্ছে। ভয়ংকর লজ্জা! ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে, “হে মাটি, তুই দু ফাঁক হয়ে যা, আমায় লুকোনোর জায়গা করে দে!” এ লজ্জা সে কোথায় রাখবে? এই মুহূর্তে তার কাছে মনে হচ্ছে সে যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম লজ্জাবতী কন্যা! ইসস, যদি লজ্জা পাওয়া নিয়ে কোনো অ্যাওয়ার্ড দেয়া হতো! ও নিশ্চিত সে অ্যাওয়ার্ড টা ওর নামেই অ্যানাউনস করা হতো!

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে অধৈর্য হয়ে উঠলো আবির। তবুও নিজেকে সামাল দিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,

– কিছু একটা বলো!

– আমার কিছু বলার নেই। যা বলার ছিল বলে ফেলেছি! এখন আপনিই বলবেন।

– চিঠিতে তো খুব তুমি তুমি করেছো, এখন আপনি করে বলছ কেন ?তুমিটাই তো মানাচ্ছিল বেশ!

সে কথার প্রতি উত্তর করলো না প্রাপ্তি। অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো। আবির হাসলো। মিষ্টি করে হেসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

– প্রেম রোগটা ছোঁয়াচে, মারাত্মক ছোঁয়াচে! কারো হৃদয়ে একবার দোলা লাগিয়ে দিলে সে হাওয়া এসে অন্য আরেকজনকেও দোলা দিয়ে যায়। তোমার হৃদয়ের দোল খাওয়া প্রেম কিন্তু আমার হৃদয়েও আঘাত হেনেছে!… তাল সামলাতে না পেরে এই মাসুম হৃদয়টাও প্রেমে পড়ে গেছে তোমার। প্লিজ, একটু খানি তুলে ধরো! আমি উঠতে পারছি না!

আবিরের ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলে প্রাপ্তি। আগের লজ্জা, দ্বিধা সব কেটে যায়। এই ছেলেটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে! যা সে পারে না। ও এগিয়ে এসে আবিরের মুখোমুখি দাড়ায়। মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বললো,

– যদি টেনে না তুলি, খুব কি ক্ষতি হবে?

– উহুম!.. একটুও না। কারণ তোমার ওই অভিমানী প্রেমের জন্য আমি হাজারবার মরতে রাজি আছি! হাজার বছর তোমার ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে রাজি আছি!

– তাহলে তো আপনাকে আমার দরকার নেই!.. শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার খেয়াল রাখবে কে? চাকরি-বাকরিই বা কে করবে?.. না খেয়ে থাকবো না কি আমি?

প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠলো আবির। সেই হাসির তালে তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো প্রাপ্তিও। মুগ্ধ প্রেমিক জুটির হাসাহাসির সুন্দর সে দৃশ্য!
____________________________

প্রেম হয়ে গেছে আবির-প্রাপ্তির। দুজনে চুটিয়ে প্রেম করছে এখন। গল্পের পাতা একটা একটা করে এগোচ্ছে। যোগ হচ্ছে তাদের মিষ্টি-দুষ্টু-খুনসুটিময় প্রেমের কাহিনি! অভিমানী কন্যা প্রাপ্তির অভিমান, কিছুটা রাগী ছেলে আবিরের প্রেম কাহিনি!

অনেক্ষণ ধরে একটা পাঁচিলের উপর বসে আছে প্রাপ্তি। এটা তার আর আবিরের দেখা করার স্থান। লোকে প্রেমিক প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য নানরকম জায়গা ঠিক করে। পার্ক, রেস্টুরেন্ট সুন্দর সুন্দর দর্শনীয় স্থান, এইসবে গিয়ে বসে বসে প্রেমালাপ করে সেখানে। কিন্তু আবির-প্রাপ্তি আলাদা! তারা ওইসব জায়গায় দেখা করে না কখনো। খুবই সাধারণ কিছু জায়গা, হোক সেটা ব্যাক সাইড, ফাঁকা, সমস্যা নেই। তারা নিরিবিলিতে বসে সময় কাটায় কিছুক্ষণ।

বেশ কিছুক্ষণ পর আবিরকে আসতে দেখা যায়। আজ ও পরেছে একটা ফিরোজা রঙের পাঞ্জাবি। ও সবসময়ই হাঁটুর একটু উপর থেকে ওঠা সর্ট পাঞ্জাবিগুলো পরে। আজও তাই পড়েছে। সঙ্গে সাদা রঙের একটা প্যান্ট। প্রাপ্তি আড়চোখে লক্ষ্য করে এই বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর ছেলেটা যে ড্রেসটাই পরে না কেন, তাকে ভীষণ সুন্দর লাগে! একদম রাজপুত্তুর টাইপ! কিন্তু এই রাজপুত্রের চেহারা দেখে তো গলে যাওয়া যায় না! সে দেরি করে এসেছে, মহা দেরি!

– আসতে একটু দেরি করে ফেললাম। সরি!

আবিরের কথার কোনো জবাব দেয় না প্রাপ্তি। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে। ওর অভিমানটা বুঝতে পারে আবির। মেয়েটা যে কেন এতো অল্পতেই অভিমান করে বসে কে জানে!

আসতে সামান্য একটু দেরি হয়েছে। খুব বেশি হলে আধঘন্টা হবে। তাতেই মেয়ে অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে দেবে? এতো অভিমানী হলে সংসার কেন প্রেমই তো টিকবে না! ভেবেই একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ও। ওকে ম্যানেজ করার জন্য বলে,

– তুমি কি আমার ওপর রাগ করলে প্রাপ্তি? রাগ করো না, প্লিজ। আসলে এখানে আসার সময় হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল আমার এক ছোট ভাইয়ের সাথে। অনেক দিন পর দেখা.. বোঝোই তো..

বলেই হাসার চেষ্টা করে ও। প্রাপ্তি অভিমানী চোখে তাকায়। চোখ দুটো তার কষ্টে ছলছল করছে। অক্ষি কোটরে যেন জল এসে উপচে পড়ছে, যে কোন সময়েই ঝরে পরতে পারে। আবির আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এতো অল্পতেই কেন কাঁদতে বসে ও? এতো কেন ওর অভিমান?

প্রাপ্তি নিজের কান্না আটকানো রুদ্ধ গলায় বললো,

– দুনিয়ার সবার কথা তোমার মনে থাকে। সবার জন্য সময় হয় তোমার!…অথচ আমার বেলায় সব ফাঁকা। একটুও সময় দাও না তুমি আমায়! আমার কষ্ট হয়, আবির! খুব কষ্ট হয়!

আবির কী করবে ভেবে পায় না। কাছে এসে ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে। অভিমানী মেয়েটা তার বুকের উষ্ণ পরশ পেয়ে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। ও আহত গলায় বললো,

– আ’ম সরি, প্রাপ্তি! আই সয়ার নেক্সট টাইম আর এমন হবে না। আমি ঠিক টাইমে চলে আসবো!.. দরকার হয় আগেই আসবো। তাও তোমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখবো না। এই প্রমিজ করছি!

– সত্যি?

প্রাপ্তি মুখ তুলে তাকায়। আবির তার মুখের পানে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। ওর চুলগুলোয় হাত চালিয়ে দিয়ে বললো,

– সত্যিই!

কথাটা শুনে খুব খুশি হয় প্রাপ্তি। ওর গায়ের কাছ থেকে সরে একটু দূরত্বে গিয়ে বসে। সামনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একসময় খুবই ধীর এবং লাজুক গলায় বলে ওঠে,

– আচ্ছা, বাবা-মাকে আমাদের বিয়ের কথা বলেছিলে? কি বললেন তারা?

– না আসলে.. এখনো সেভাবে…

আমতা আমতা করতে থাকে আবির। প্রাপ্তি একমুহুর্তের জন্য অবাক চোখে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে বলে,

– তুমি এখনো জানাও নি?… কেন, আবির? তুমি কি চাচ্ছো না আমাকে বিয়ে করতে? নাকি তুমি কনফিউজড?..

– আসলে তেমন কিছু না। আমি… আমি..

আবিরকে কথা শেষ করতে দেয় না প্রাপ্তি। তার আগেই অন্য দিকে তাকিয়ে বলে,

– বুঝতে পেরেছি। তোমার কাছে আমার কোনো দামই নেই!.. যদি থাকতো তাহলে তুমি এমন করতে না।..

– তেমনটা না প্রাপ্তি। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো না!.. আমি আসলে বাবা-মা কে বলতাম.. কিন্তু সময় করে উঠতে পারছি না!

আবিরের কথা শুনে খুব বিরক্ত হয় প্রাপ্তি। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। কাটকাট ভাষায় বললো,

– একদম লেইম এক্সকিউজ দিবে না, আবির!.. এসব লেইম মার্কা কথা শুনলে আমার গা-পিত্তি জ্বলে যায়।.. সামান্য একটা কথা, বিশাল কোনো রচনাও না। শুধু বাবা-মা কে গিয়ে বলবে বিয়ের কথা। তা না.. তুমি এই কথা বলতে গিয়ে দিনের পর দিন পার করছ.. এটা কেমন কথা?.. হ্যাঁ, তোমার আসলে মতলবটা কি? বিয়ে কি করবে আমায়?

– তুমি তাহলে কি চাইছো? আমরা এখনই বিয়ে করি?

কিছুটা রেগে ওঠে আবির। ও প্রাপ্তিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে ওর বর্তমান সিচুয়েশনটা কিন্তু ও কিছুতেইকিছু বুঝতে চাচ্ছে না। আচ্ছা, নিজের বিয়ের কথা কি নিজেই গিয়ে বাবা-মার সামনে বলা যায়? বাবা-মায়ের সামনে কী তাহলে লজ্জা-শরম কিছু অবশিষ্ট থাকে? দুনিয়া যাক বা থাক, আবির একটা কথা জানে ও কিছুতেই ওর বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে ওর আর প্রাপ্তির বিয়ের কথা পাড়তে পারবে না! এটা পারার বিষয়ও না! অমন নির্লজ্জের মতো একটা কাজ তার দ্বারা হবে না। কিন্তু প্রাপ্তি সেটা মানছে না। “বিয়ে” “বিয়ে” করে মাথা খারাপ করে ফেলছে! অবশ্য সে জন্য জিহানদেরও সাহায্য নিবে ও। ওরা নিজেরাই রাজি হয়েছে সেজন্য আসিয়া বেগমের সাথে কথা বলতে। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করার সমস্যা ওদেরও!

কথার জবাবে কিছু বলতে শোনা যায় না প্রাপ্তিকে। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কি যেন দেখতে থাকে। ভাবটা এমন যে এখানে আবির নামের কেউ যে বসে আছে সেটা যেন জানেই না ও! মেয়েটা অভিমানী, কিছুটা ক্ষেপাটে। সহজে পোষ মানতে রাজি নয়! ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর কাছে এসে বসে। কিছুটা চাপা রাগ। করেই বললো,

– ঠিক আছে, চলো বিয়ে করি?

– ঠিক আছে।

সানন্দে সায় জানায় প্রাপ্তি। ওর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় আবির। ও ভেবেছিল এখনই বিয়ের কথা শুনলে কিছুতেই রাজি হবে না সে। কারণ ও যতটা জানে তাতে প্রাপ্তির সাথে ওর বাবা-মার সম্পর্ক খুবই ভালো। একদম মিষ্টি মধুর। এমন একটা সম্পর্কের মধ্যে থেকে ও যে কোনোভাবেই তাদের না জানিয়ে বিয়ে করবে না এমনটাই ভেবেছিল আবির। কিন্তু ওকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে প্রাপ্তি বললো,

– কী হলো? চলো.. বিয়ে করবে না?…আচ্ছা,আমরা কোন কাজী অফিসে যাবো?.. কাছে পিঠেই কোথাও যাই?.. ওহ্, একটা কথা মনে পড়েছে… যাওয়ার আগে তোমার বন্ধুদেরও ডাকতে হবে কিন্তু। নয় তো সাক্ষীর অভাবে আমাদের বিয়েই পড়ানো হবে না!.. তন্ময়, রাজিব আর জিহান ভাইয়াকে ডাকো.. আর হ্যাঁ, আদ্রিকেও ডেকে নাও তো!

– আর ইউ সিরিয়াস?!

বিস্ময়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে আবির। তার দু চোখের কোটরে যেন বড় বড় এক্সক্লাম্যাশন মার্ক ঝুলছে! প্রাপ্তি একপলক ওর দিকে তাকালো। প্রশ্নটা যেন একেবারে অহেতুক এমন একটা ভঙ্গি করে বললো,

– হ্যাঁ!.. তোমার কী মনে হয়, বিয়ের মতো সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে আমি ফাজলামো করবো?.. আ’ম সিরিয়াস আবির.. লেটস গো!

– কিন্তু তাই বলে কাউকে কিছু না জানিয়ে… তোমার বাবা-মা, আমার বাবা-মা, এনাদের কাউকেই কিছু জানাবো না?

– জানাবে না কেন? অবশ্যই জানাবে… তবে বিয়ের পর!.. এই জানো, আমার না ছোটবেলা থেকেই পালিয়ে বিয়ে করার খুব শখ!

প্রাপ্তির কথার প্রতি উত্তরে কী বলা যায় তা আর ভেবে পেল না আবির। মেয়েটা যে কী! এতো পাগলামো কী করে যে করতে পারে! উফ্! তবুও বলে,

– ঠিক আছে, কিছুদিন পরে করি?.. এখন তো প্রিপারেশন নেই!..

– আরে প্রিপারেশন নিয়ে বিয়ে করলে কি আর পালিয়ে বিয়ে হবে?.. করতে হবে হুটহাট করে। যাতে ফিলিংসটা থাকে..

– আচ্ছা, ঠিক আছে। তাই করবো। কিন্তু আর কয়েকটা দিন পরে করি?

– না, কোনো পরে না। চলো এখনই যাবো আমরা কাজী অফিসে। ফোন দাও তোমার। আদ্রিকে কল দেই, আর হ্যাঁ, রাজিব ভাইয়াদেরও ডাকো। নাও, নাও। চলো!

বলেই ওখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায় প্রাপ্তি। আবিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে সামনে আগাতে থাকে। আর বারবার নিজের ছোটবেলার স্বপ্ন, বিয়ের প্ল্যানিং নিয়ে কথা বলতে থাকে। সে এখন মনে মনে অনেক খুশি। তার বহুদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হচ্ছে। আহা! পালিয়ে বিয়ে! কী যে মজা!

আবির বেচারা চুপ করে থাকে। বাড়তি টু শব্দ করে না। বোঝাই যাচ্ছে প্রাপ্তির এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে রাজি হওয়ায় সে শক খেয়েছে। মস্ত বড় শক!

তবে সে দুঃখ কেটে গেল খুব তাড়াতাড়িই। প্রাপ্তির খুশির কথা ভেবে দ্বিধা করলো না। বরং যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখারই চেষ্টা করলো। আর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই এই পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে খুব ইন্টারেসটিং মনে হতে লাগলো! আসলেই তো, পালিয়ে বিয়ে করার তো ফিলিংসটাই আলাদা! সেও সানন্দে রাজী হয়ে গেল।

প্রাপ্তি নিজেই কল করে ওর বাকি বন্ধুদের ডেকে আনলো। আদ্রিতাকেও খুঁজে বের করে ফেললো। সবাইকে বলা হলো আজ ওরা বিয়ে করবে, পালিয়ে বিয়ে! ওরা আসতেই সবাই একসাথে রওনা হলো কাজী অফিসের উদ্দেশ্যে! আজ আবির-প্রাপ্তির বিয়ে!

#চলবে——

[আগামী পর্বেই শেষ করে দিবো, ইনশাল্লাহ। ততক্ষণ পর্যন্ত হ্যাপি রিডিং…?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here