অপরিচিত লেখিকাঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ ১৯

0
899

অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৯

আরফার নিশ্বাস মেহরাবের মুখে পড়ছে হঠাৎ আরফার কী হলো জানে না। উঠে দাড়ালো সোফা থেকে আর তাতে মেহরাবেরও ঘোর কাটলো। সে তাকালো আরফার দিকে। আরফা কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মেহরাবের নিজেরই তো বিশ্বাস হচ্ছে না সে আরফার এতো কাছে গিয়েছে। পর মুহূর্তেই ভাবলো যেতেই পারি সি ইজ মাই ওয়াইফ। ওর আরো কাছে যাওয়ার রাইট আমার আছে। মেহরাব বেলকনিতে গিয়ে কাউকে কল দিলো কাজ কতদূর জানার জন্য। একটু পর আরফা এলো রুমে।

ব্রেকফাস্ট করতে যেতে বলেছে মা।

মেহরাব তাকিয়ে দেখলো আরফা নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।

মেহরাব বললো, কী হয়েছে নিচের দিকে তাকিয়ে আছো কেনো ? আমার থেকে ফ্লোর কী বেশি সুন্দর নাকি ? (মজা করে বললো)

আরফার লজ্জা করছে মেহরাবের দিকে তাকাতে। তখনকার কথা মনে হলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কত কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো তারা।

মেহরাব আবার বললো, কী হয়েছে কথা বলছো না কেনো ?

আরফা বললো, কিছু না।

মেহরাব বললো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।

আরফা মেহরাবের দিকে তাকিয়ে বললো, কী কথা ?

মেহরাব বললো, আগে বসো আমার কাছে।

আরফা কিছু না বলে মেহরাবের সামনে গিয়ে বসলো। মেহরাব বললো, তোমার ফোন কোথায় ?

আরফা নিজের ফোন মেহরাবের সামনে ধরলো। মেহরাব আরফার হাত থেকে ফোন নিয়ে সেদিনের ম্যাসেজ বের করে আরফার সামনে ধরলো। কিছুদিনের ঝামেলায় আরফা ফোন চেক করেই দেখেনি। ম্যাসেজ দেখে মেহরাবের হাত থেকে নিয়ে ম্যাসেজটা পড়ে দেখলো।

মেহরাব বললো, এই কথাগুলো তোমাকে কে বলেছিলো ? আমি নাম্বার থেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ফেইক নাম ঠিকানায় রেজিস্টার করা।

ম্যাসেজ দেখেই আরফার ইশতিয়াকের কথা মনে পড়ে গেলো আর ভাবতে লাগলো, তারমানে দাদাজানকে হেল্প করার জন্যই ইশতিয়াক স্যার আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলো।

আরফাকে কিছু নিয়ে ভাবতে দেখে মেহরাব বললো, কী হলো মনে পড়েছে কে বলেছিলো ?

আরফা মেহরাবের দিকে তাকালো কিন্তু বুঝতে পারছে না ইশতিয়াকের কথা মেহরাবকে বলা ঠিক হবে কিনা। তাই আমতা আমতা করতে লাগলো।

মেহরাব বললো, আরফা ভয় পেয়ো না বলো আমাকে আর না বললে আমি বুঝতে পারবো না। বুঝতে না পারলে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে যাবে।

আরফা অনেক ভেবে মেহরাবকে সব সত্যি খুলে বললো। ইশতিয়াক তাকে কী কী বলেছিলো ? এসব শুনে মেহরাব রাগে লাল হয়ে গেলো। কতবড় সাহস ইশতিয়াকের সেটাই চিন্তা করছে।

মেহরাবকে রাগতে দেখে আরফা ভয়ে ঢোক গিলে নিলো। ফর্সা মানুষ রেগে লাল হয়ে গেছে।

মেহরাব গম্ভীর গলায় বললো, তুমি যাও ব্রেকফাস্ট করে নাও।

আরফা অনেকটা সাহস নিয়ে বললো, আপনি করবেন না ? মা আর দাদাজান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি একটু পর।

আরফা চলে গেলে মেহরাব কপালে আঙুল ঘষে কিছু চিন্তা করে কাউকে কল দিলো। কথা শেষ করে ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে গিয়ে দেখে সবাই বসে গেছে আর সার্ভেন্ট সার্ভ করছে। মেহরাব আরফার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।

গুড মর্নিং মম এন্ড দাদাজান।

মেহেক আর মুজাহিদ খান মেহরাবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, গুড মর্নিং।

খাবার মুখে দিতে দিতে মুজাহিদ খান বললো, দাদুভাই বিয়ে তো হয়েই গেলো আর আজ ফাংশন ও হয়ে যাবে। তোমরা হানিমুনে কবে যাচ্ছো ?

আরফা কেবল একটু খাবার মুখে দিয়েছিলো দাদাজানের কথায় তার কাশি শুরু হয়ে গেলো। মেহরাব তাড়াতাড়ি পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি খাওয়াতে লাগলো। মেহেক ছেলের দিকে তাকালো স্বস্তিরভাব নিয়ে।

মেহরাব কপাল কুঁচকে দাদাজানের দিকে তাকিয়ে বললো, দাদাজান তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেনো আমরা লাভ ম্যারেজ করেছি। আর এখানে আমার এখন অনেক কাজ আছে।

দাদাজান বললো, বিয়েটা এভাবে হয়েছে দেখেই যেতে বলছি তোমরা দুজন দুজনকে চেনাজানার সুযোগ পাবে।

মেহেক বললো, বাবা তো ঠিকই বলেছে মেহরাব। তুমি আর আরফা কোথাও গিয়ে ঘুরে আসো।

মেহরাব মমের দিকে তাকিয়ে বললো, মম তুমিও দাদাজানের মতো পাগলামি করছো। আমার এখন অনেক কাজ আছে এখন কোথাও যাওয়া পসিবল না আমার পক্ষে।

সবার কথার মাঝে আরফা চুপচাপ বসে আছে কিছু বলছে না।

মুজাহিদ খান বললো, কিন্তু,,,,

কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহরাব বললো, আর কোনো কথা হবে না এ বিষয়ে। সময় হলে আমি নিজেই যাবো।

মেহরাবের কড়া কথায় আর কেউ কিছু বললো না। খাওয়া শেষে মেহরাব উঠে বললো, মম আমি একটু বাইরে যাচ্ছি কাজ আছে।

মেহেক বললো, আরে তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো ? আজ তোমার রিসিপশনের পার্টি আছে।

মেহরাব বললো, সময় মতো চলে আসবো।

আরফা বরাবরের মতোই নিরব দর্শক। সে খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো। এই বাড়িতে খুব বোরিং লাগছে আরফার। এতো বড় বাড়িতে মাত্র চারজন ফ্যামিলি মেম্বার আর গুটি কয়েক সার্ভেন্ট। তবু সবাই মনে হয় হিসেব করে করে কথা বলে। মেহরাবের কোন ভাইবোনও নেই তাদের সাথে কথা বলবে। সারা বাড়ি ডেকোরেশন করা কিন্তু মনে হচ্ছে না এটা বিয়ে বাড়ি কারণ কোনো মানুষের কোলাহল নেই। বিয়ে বাড়ি মানে হইচই এটাই জেনে এসেছে এতোদিন কিন্তু নিজের বিয়ে দেখে ধারণা পাল্টে গেছে তার। আরফার মনে হচ্ছে এখানে কিছুদিন থাকলে সে বোবা হয়ে যাবে। আরফা নিজের মাকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললো। কথা শেষে আবার একা একা লাগছে। ভাবলো বাড়িটা ঘুরে দেখা যাক।

১৬

বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসতেই মেহরাবের ফোন বেজে উঠলো। ব্লুটুথ কানে লাগিয়ে ফোন রিসিভ করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো।

Hello,,, Doctor Mehrab Khan speaking. Who do you want to talk ?

স্যার আমি অফিস থেকে একাউন্ট ম্যানেজার জুনায়েদ বলছিলাম। আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।

মেহরাব বললো, অফিসের বিষয়ে তো আমি কিছু জানি না, ঐ বিষয়ে আপনি দাদাজানের সাথে কথা বলুন।

জুনায়েদ ব্যস্ত হয়ে বললো, স্যারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে লাভে হবে না। হলে আরো আগেই স্যারকে বলতাম। আমি জানতে পেরেছি আপনি হসপিটাল অফিস সব বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন তাই আপনাকে ফোন করেছি। অনেক কষ্টে আপনার সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ পেয়েছি।

মেহরাব কপাল কুঁচকে বললো, ওকে বলুন কী বলতে চান।

জুনায়েদ বললো, স্যার এতো কিছু ফোনে বলা পসিবল নয় সামনাসামনি বলতে হবে।

মেহরাব বললো, ওকে তাহলে আমি অফিসে আসছি সেখানেই বলেন।

জুনায়েদ ব্যস্ত হয়ে বললো, না না স্যার অফিসে বলা যাবে না। আমি আপনাকে একটা এড্রেস দিচ্ছি আপনি এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছান।

মেহরাব ওকে বলে কল কেটে দিলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সকাল দশটা বাজে প্রায়। একজনের সাথে দেখা করতে বের হয়েছিলো এখন আরো একজন বের হলো। এক মাস ধরে চালানো ইনভেস্টিগেশনের ফলাফল জানতে পারবে আজ মেহরাব। জানতে পারবে কে এই আড়ালে থাকা শত্রু। এখন আবার এই জুনায়েদ কোথায় থেকে এলো ? মেহরাব ভেবে দেখলো রিয়ানের সাথে পরেও দেখা করা যাবে আগে জুনায়েদের সাথেই করা যাক। তাই জুনায়েদের দেওয়া ঠিকানায় চলে গেলো। এতোদিনে ঢাকা শহর ভালোই চিনে নিয়েছে মেহরাব তবু ঠিকানাটা খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হলো। কারণ যে ঠিকানা দিয়েছে সেটা শহরের বাইরে হাইওয়ে রোডের পাশে ছোটখাটো একটা ধাবা। এক ঘন্টার জায়গায় দু ঘণ্টা লেগে গেলো এখানে আসতে। গাড়ি থেকে নেমে আগের নাম্বারে কল দিলে একটা ছেলে এগিয়ে আসে মেহরাবের দিকে।

আমি জুনায়েদ আহমেদ। আপনাদের অফিসের একাউন্ট ম্যানেজার।

মেহরাব পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিলো ছেলেটাকে। বয়স মেহরাবের মতোই হবে। দেখতে অনেকটা হ্যাংলা পাতলা।

মেহরাব আশেপাশে তাকিয়ে বললো, এখানে কেনো আসতে বলেছেন ?

জুনায়েদ বললো, আগে বসি তারপর সব বলছি।

ভেতরে গিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়লো দুজন। মেহরাবের জায়গাটা বেশি পছন্দ হয়নি।

জুনায়েদ বুঝতে পেরে বললো, স্যার এখানে বলাটা সেভ মনে হয়েছে আমার তাই।

ঠিক আছে কী বলতে ডেকেছেন সেটা বলুন।

স্যার আমার বাবা আপনাদের অফিসে সততার সাথে কাজ করেছে দীর্ঘদিন। একদিন বাসায় ফিরার পথে এক্সিডেন্ট মারা যান। তখন আমি কেবল ইন্টারে পড়ি। এই অসহায় অবস্থায় আপনার দাদাজান আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাই তার সাথে বেইমানি করতে পারবো না।

মেহরাব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, মানে ?

জুনায়েদ বললো, আমি একাউন্ট ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করার পর জানতে পারি বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা গড়মিল হচ্ছে। আর এসব করছে আমাদের ম্যানেজার হাসান মাহমুদ স্যার।

Whatttt ,,,, ? উনিতো দাদাজানের অনেক বিশ্বস্ত মানুষ।

সেই জন্যই স্যারকে জানাতে সাহস হয়নি। যদিও আমার কাছে সব প্রমাণ আছে তবু কিছু করতে পারিনি কারণ আমার থেকে উনার পাওয়ার অনেক বেশি আর স্যারও আমার থেকে উনাকে বিশ্বাস করে।

আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে এসবের ?

জুনায়েদ সব প্রমাণ বের করে মেহরাবকে দিয়ে দিলো আর বললো, স্যার প্লিজ আপনি বলবেন না এসব প্রমাণ আমি দিয়েছি তাহলে আমার পরিবারের ক্ষতি করবে।

মেহরাব চিন্তিত হয়ে বললো, ওকে কেউ জানতে পারবে না আর তুমি তোমার এই কাজে জন্য যোগ্য পুরষ্কার পাবে।

মেহরাব এটুকু বলে বের হয়ে আসলো। রিয়ানের অফিসের দিকে যেতে লাগলো। মেহরাবের বন্ধু দিয়ানের বড় ভাই রিয়ান উনি পুলিশ কমিশনার। মুজাহিদ খানের খাবারে ড্রাগস পাওয়ার পর দিয়ানই মেহরাবকে তার ভাই রিয়ানের সাথে যোগাযোগ করতে বলে। এই এক মাস রিয়ান গোপনে ইনভেস্টিগেশন করেছে এই বিষয়ে। মেহরাব আজ কল দিয়ে কাজ কতদূর জানতে চাইলে অফিসে আসতে বলে। এসব ভাবতে ভাবতে মেহরাব রিয়ানের অফিসে পৌঁছে যায়। রিয়ানের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর কাজের কথায় আসে।

মেহরাব কাজটা করতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ মিস্টার মাহমুদের সাথে তোমার বাড়ির সার্ভেন্ট থেকে শুরু করে, অফিসের এমপ্লয়ি আর হসপিটালের নার্স পর্যন্ত সবাই জড়িত। হাসান মাহমুদ আর ইশতিয়াক মিলে তোমাদের বিশ্বস্ত যত কর্মচারী ছিলো একে একে পরিবর্তন করে নিজেদের লোক ঢুকিয়েছে। তাদের সবাইকে খোঁজে বের করতে এতো সময় লেগেছে। আমাদের কাছে এখন যথেষ্ট প্রমাণও আছে তুমি চাইলে এরেস্ট করবো।

মেহরাব থম মেরে বসে আছে চেয়ারে। যতটা না রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে দাদাজানের জন্য। জুনায়েদের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারলেও রিয়ানের কথা আর এতগুলো প্রমাণ অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়। মেহরাব ভেবেছিলো হয়তো শুধু ইশতিয়াকই জড়িত। কিন্তু দাদাজানের এতো বিশ্বাস আর ভালোবাসার এই মর্যাদা পেলো শেষে। যে এতো বিশ্বাস করেছে তাকেই তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিয়েছে এরা। একেই হয়তো বসে সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো বা পেছন থেকে ছুড়ি মারা।

মেহরাব কিছু বলছো না কেনো ?

মেহরাব হতাশ গলায় বললো, ভাবছি দাদাজান এসব জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাবে। এমনই দাদাজানের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ।

রিয়ান বললো, কী আর করা যাবে ? উনাকে তো জানাতেই হবে নাহলে কিছু করা যাবে না আর ওরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করে দিবে।

মেহরাব দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে জুনায়েদের দেওয়া প্রমাণগুলোও দিয়ে বললো, এখানে অনেক প্রমাণ আছে কাজে লাগবে। আজ সন্ধ্যায় রিসিপশন পার্টিতে সবাই থাকবে। প্রেস, মিডিয়ার লোকও থাকবে সেখানেই যা করার করেন। আমি তাহলে এখন আসছি।

মেহরাব রিয়ানের অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। মেহরাব দুপুরে কিছু খাওনি। ধীর গতিতে বাড়ির গেইটে প্রবেশ করে বুঝতে পারলো পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট সব কমপ্লিট। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দেখতে পেলো এক বিশ্বাসঘাতককে। রাগে হাতের মুঠো বন্ধ হয়ে গেলো আর কপালের রগ ফোটে উঠলো। ধীর পায়ে আগাতে লাগলো সেদিকে।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here