অপরিচিত লেখিকাঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ ১৮

0
1034

#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৮

মেহরাব চোখ পিটপিট করে তাকালো হাতের নিচে কী তা দেখার জন্য। কিন্তু যা দেখলো তাতে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। আরফার নরম পেটের ওপর হাত রেখে ঘুমিয়ে ছিলো মেহরাব এতক্ষন। দেখার পর হাতটা সরিয়ে নিবে তাও যেনো পারছে না। কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে। আরফার শাড়ী ঠিক নেই ফর্সা পেটটা পুরো বেড়িয়ে আছে। ডিম লাইটের আলোতে তা খুব বেশি আকর্ষণীয় লাগছে মেহরাবের কাছে। আরফার ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলো মুখের ওপর পরে আছে। শাড়ীর আঁচলটাও ঠিক জায়গায় নেই, নিচের দিকেও পা থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে শাড়ী, ব্ল্যাঙ্কেটটা মেহরাবের গায়ে আর বাকিটুকু দুজনের মাঝে পরে আছে, আরফা মৃদু কাপছে শীতে। আরফাকে এভাবে দেখে মেহরাব হঠাৎ ঘামতে লাগলো। এখনো শীত পরে ভালোই তবু ঘামছে মেহরাব। কানাডায় বড় হয়েছে সে, মেয়েদের শর্ট পোশাকেই দেখেছে সবসময়, তবে কখনো এমন অদ্ভুত ফিলিংস আসেনি মনে। তবে আরফাকে দেখে কেনো ? তাড়াতাড়ি আরফার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। হাতটা সরিয়ে আনতে গেলে আরফা ধরে ফেললো। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নড়েচড়ে এপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো গুটিশুটি মেরে। মেহরাব পড়লো মহা বিপদে এবার কী করবে ? আরফা বুকের সাথে শক্ত করে ধরে আছে মেহরাবের হাতটা। মেহরাব কখনো কোনো মেয়ের এতোটা কাছে যায়নি এমনকি সিনথিয়ারও না। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার, আরফা হাতটা একটু আলগা করতেই মেহেরাব খুব সাবধানে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। মেহরাব যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আরফার গায়ে ব্ল্যাঙ্কেটটা টেনে দিয়ে তাড়াতাড়ি বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৫ টা বাজতে ১০ মিনিট কম আছে এখনো। মেহরাব প্রতিদিনই ৫ টায় উঠে যায় কারণ স্বাস্থ্যের দিকে খুব সচেতন সে, একটু এক্সারসাইজ না করলে হয় না। আর ভোরের পরিবেশটা খুব ভালোলাগে মেহরাবের। ফেব্রুয়ারী মাস শেষের দিকে শীত অনেক কমে গেছে তবে এখনো হালকা শীত পরে। সূর্যোদয় হতে সাড়ে ছয়টা বেজে যায় তাই বাইরে অন্ধকার কমেনি এখনো। মেহরাব ছাঁদে চলে গেলো এক্সারসাইজ করতে এদিকে ফজরের আযান শুনে ঘুম ভেঙে গেলো আরফার। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রুমটা দেখে প্রথমে অচেনা লাগলেও পরে সবটা মনে পড়লো। উঠে বসতেই আরফার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো৷ গায়ের শাড়িটা খুলে খুব করুন অবস্থায় আছে। মেহরাব কোনরকমে ব্ল্যাঙ্কেটটা দিয়ে গিয়েছিলো আরফার ওপর একটু নড়াচড়া করতেই সরে গেছে গা থেকে। শরীরের বেশীরভাগ অংশ বের হয়ে আছে। আরফা তাড়াতাড়ি কাপড় ঠিক করতে করতে আশেপাশে তাকিয়ে মেহরাবকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো মেহরাব আগে উঠে গেছে মানে আরফাকে এভাবে দেখেছে। এটা মনে হতেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো আরফা। কিন্তু মেহরাব কোথায় গেলো বুঝতে পারছে না। গতরাতে শুয়ে পড়ার একটু পরই মেহরাব এসে শুয়ে পড়েছিলো সেটা আরফার মনে আছে। তাহলে গেলো কোথায় ? ওয়াশরুমের দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ। আযানটা শেষ হলেই আরফার মনে হলো আগে নামাজটা পরে নেওয়া উচিত। গতকাল নামাজ কাযা হয়ে গেছে আজ করা যাবে না। ঝটপট উঠে ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়ে নিলো জায়নামাজ আরফার লাগেজে ছিলো। নামাজ শেষে করে মেহরাবকে খুঁজতে লাগলো। বেলকনিতে গিয়ে দেখলো কেউ নেই, বেলকনি থেকে গার্ডেনের দিকটাও দেখে নিলো সেখানেও নেই, তাই রুম থেকে বের হয়ে মেহেকের রুমের সামনে আসতেই পা ধমকে গেলো আরফার। মেহেক কোরআন তিলাওয়াত করছে। মেহেকের কোরআন তিলাওয়াত শুনে আরফা মুগ্ধ হয়ে গেলো আর ভাবলো এতো মিষ্টি করে সে নিজেও হয়তো পারবে না তিলাওয়াত করতে। একটু শুনে আবার মেহরাবকে খোঁজার জন্য বের হয়ে গেলো। বাড়ির সব জায়গায় খুঁজে না পেয়ে ছাঁদের কথা মনে হলো তাই ছাঁদেই পা বাড়ালো। পূর্ব আকাশটা লাল হয়ে গেছে সাথে আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। সেই আলোয় আরফা দেখতে পেলো মেহরাব পুশআপ দিচ্ছে, গায়ে থ্রী-কোয়াটার প্যান্টটা ছাড়া কিছু নেই, ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে, বুকে কোনো লোম নেই মেহরাবের, একদম ক্লিন। এই প্রথম মেহরাবকে সম্পূর্ণ খালি গায়ে দেখলো আরফা। শুধু মেহরাবকে না এই প্রথম কোনো ছেলে মানুষ সামনে থেকে খালি গায়ে দেখলো। আরফার লজ্জা লাগছে এভাবে মেহরাবকে দেখতে। একটু আগে মেহরাব তাকে কীভাবে দেখেছে ভাবতেই আরো লজ্জা লাগছে। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে আরফা সেটা অনুভব করতে পারছে। লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মেহরাব দেখে ফেললো।

উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আরফা।

যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেলো আরফা। নিচের দিকে তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, জী বলুন।

মেহরাব আরফার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, তুমি এখানে কী করছো ?

আরফা দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে বললো, আপনাকে রুমে দেখছিলাম না তাই খুঁজতে এসেছিলাম।

মেহরাব আরফাকে ভালো করে দেখতে লাগলো। সাদা আর লালের কম্বিনেশনে একটা শাড়ী পরেছে আরফা। তখন শাড়ী খুলে যাওয়ার কারণ এখন বুঝতে পারছে মেহরাব।

আরফার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে বললো, তুমি মনে হয় শাড়ী পরতে জানো না।

আরফা নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে বললো, আসলে শাড়ী পরা হয়না তো তাই শেখাও হয়নি।

মেহরাব পাঞ্চিং ব্যাগে পাঞ্চ করতে করতে বললো, তাহলে এখন পড়তে বলেছে কে ?

আরফা মাথা নিচু করে বললো, মা শাড়ী ছাড়া কিছু দেয়নি।

মেহরাব বললো, শাড়ী পরলে আগে ভালো করে পরতে শিখে নিও, যাতে খুলে না যায় আর পরতে না চাইলে যেটা পরতে চাও সেটা কিনে নিও।

মেহরাবের কথা শুনে আরফার বুঝতে বাকি রইলো না কেনো কথাটা বলেছে। এতে আরফার মুখটা আরো ছোট হয়ে গেলো লজ্জায়।

আরফা ছোট করে বললো, ঠিক আছে।

মেহরাব আবার বললো, শীতের মধ্যে এতো সকালে শাওয়ার কেনো নিয়েছো ? শাওয়ার নেওয়ার মতো কিছু তো হয়নি গতরাতে।

মেহরাব খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বললো যেনো খুব সাধারণ কথা বলেছে। এদিকে আরফার ইচ্ছে করছে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে।

আরফা নিচু গলায় বললো, আমার আগে থেকেই সকালে শাওয়ার নেওয়ার অভ্যাস। শাওয়ার নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ি।

মেহরাব বললো, গুড।

কিছুসময় আবার চুপচাপ দুজনেই। হঠাৎ আরফা বললো, আপনি তো সকালেই উঠেন তাহলে নামাজ কেনো পড়েন না ?

আরফার কথা শুনে অদ্ভুতভাবে তাকালো মেহরাব, আরফা প্রথমে একটু ভয়ই পেলো।

মেহরাব আবার নিজের কাজ করতে করতে বললো, বাহ্ প্রথমদিনই বউয়ের মতো কথা বলা শুরু করে দিয়েছো।

আরফা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, তেমন কিছু না।

মেহরাব বললো, তাহলে কেমন কিছু ?

আরফা আর কিছু বললো না মেহরাবই আবার বললো, ছোটবেলায় দাদাজানের সাথে মসজিদে যেতাম আমার মনে আছে। কুরআন তিলাওয়াত শিখে ফেলেছিলাম সাত বছর বয়সেই। এখান থেকে যাওয়ার পর মম যতদিন বলেছে ততদিন মসজিদে যেতাম। আস্তে আস্তে মমের সাথে দুরত্ব বাড়তে থাকে আমিও নিয়ম শৃঙ্খলার বাইরে যেতে থাকি আর প্যালেসের আশেপাশে কোথাও মসজিদও ছিলো না। প্যালেস থেকে অনেকটা দূরে ছিলো মসজিদ। এভাবে একটু একটু করে দূরে সরে গেছি এসব থেকে। বছরে শুধু দুটো ঈদের নামাজ পড়া হয় এখন।

আরফা বললো, চাইলে আবার নতুন করে শুরু করতে পারছে।

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, চেষ্টা করবো।

আরফা মেহরাবকে যতবার দেখছে তত অবাক হচ্ছে। মেহরাবকে যেমন মনে করেছিলো তেমনটা সে নয়। আরফার মনে হয়েছিলো মেহেরাব বাজে ব্যবহার করবে তার সাথে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। তবে কী মেহরাব সিনথিয়াকে ভুলে গেছে ?

কী ভাবছো ?

মেহরাবের কথায় আরফা তার দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু না।

সূর্যোদয় দেখবে ?

আরফা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

মেহরাব ছাঁদের পূর্ব পাশে গিয়ে দাঁড়ালে আরফা তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। একটু পরেই লাল টকটকে একটা সূর্য উঁকি দিলো পূর্ব আকাশে। দুজন মানুষ তাকিয়ে আছে সেদিকে। মাত্র কিছুদিন আগেও তারা একে অপরের #অপরিচিত ছিলো কিন্তু আজ তারা একে অপরের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। মনটা অনেক হালকা লাগছে আরফার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আরফার মনে একের পর এক প্রশ্ন বুনে দিচ্ছে। কে জানে কবে পাবে সেই প্রশ্নের উত্তর।

তোমাকে আমার অনেক কিছু বলা বাকি আছে। হয়তো অনেক জেনে গেছো মমের থেকে আর কিছুটা বাকি থেকে গেছে। সেটা আমি বলবো তোমাকে সঠিক সময়ে।

মেহরাবের কথা শুনে তার দিকে তাকালো আরফা কিন্তু কিছু বললো না।

মেহরাব পেছনে ঘুরে চলে যেতে যেতে বললো, তুমি থাকো আমি শাওয়ার নিবো।

মেহরাব চলে গেলো আর আরফা আবার আকাশের দিকে তাকালো। কত তাড়াতাড়ি জীবন বদলে যায় সেটা চিন্তা করতে লাগলো। অনেকটা সময় ছাঁদে থেকে এক কাপ চা আর এক কাপ কফি বানিয়ে রুমে গেলো। মেহরাব শাওয়ার শেষ করে শুধু টাওয়েল পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে আরেকটা টাওয়েল দিয়ে। আরফা ট্রে টা বেডের পাশের টেবিলে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মেহরাবকে দেখলো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। আরফা কিছু সময়ের জন্য একদম জমে গেলো। হুঁশ ফিরতেই উল্টো ঘুরে গেলো।

বিড়বিড় করে বললো, আজ কী আমাকে শুধু লজ্জায় পরতে হবে নাকি ?

মেহরাব আরফার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো, কী হয়েছে কোনো সমস্যা ?

আরফা আমতা আমতা করে বললো, আপনার কফি এনেছিলাম।

মেহরাব হাতে টাওয়েল রেখে বললো, হ্যাঁ দাও।

আরফা বললো, আগে চেঞ্জ করে নিন।

মেহরাব নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো একবার তারপর সামান্য হাঁসলো। আরফার রিয়াকশনের কারণ বুঝতে পেরে।

মুচকি হেঁসে বললো, আমি ভুলে গিয়েছিলাম বাঙালী মেয়েদের লজ্জা একটু বেশি। ফরেনারদের সাথে বড় হয়েছি তো। তাই মনে ছিলো না বাংলাদেশের কালচার। তাদের ড্রেসআপ সম্পর্কে তো জানোই এসব কোনো ব্যাপার না তাদের কাছে। আমি ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে আসছি।

যেতে গিয়ে মেহরাব থেমে গেলো হঠাৎ মাথায় শয়তানি ভড় করলো তাই বললো, এক মিনিট তুমি এতো লজ্জা কেনো পাচ্ছো ? আমি তো তোমার হাসবেন্ড তাই না ?

মেহরাবের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আরফা তাকাতেই মুচকি হাঁসলো মেহরাব। আরফা এসব আর হজম করতে পারছে না। কী চলছে মেহরাবের মনে তাও বুঝতে পারছে না। মেহরাব ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে কফি নিয়ে সোফায় বসলো আর আরফাও মেহরাবের পাশে বসলো চায়ের কাপ নিয়ে। অন্যমনস্ক হয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগাতেই ছেঁকা লাগলো আর আরফা ওফ করে উঠলো।

মেহরাব কফির কাপটা টেবিলে রেখে ব্যস্ত হয়ে বললো, কী হয়েছে দেখি ?

আরফা ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বললো, ছেঁকা লেগেছে।

মেহরাব কপাল কুঁচকে বললো, তুমি কী বাচ্চা নাকি ? চা খেতে গিয়ে ছেঁকা লাগে।

মেহরাব আরফার ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে ফু দিতে লাগলো আর আরফা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো মেহরাবকে। আরফার চোখে বিস্ময়ের শেষ নেই। সিনথিয়ার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে আরফা। মেয়েটা কী হারিয়েছে সে হয়তো জানেই না। মেহরাব আরফাকে ভালোবাসে না তবু তার প্রতি এতো কেয়ারিং তাহলে যাকে ভালোবাসে তার জন্য কী করতে পারবে আরফা ভেবে পাচ্ছে না। ফু দিতে দিতে দুজনের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই করছে। মেহরাবের চোখ পড়লো আরফার ঠোঁটের দিকে। ভালোই ছেঁকা লেগেছে ঠোঁট দুটো লাল হয়ে গেছে। আরফার ঠোঁটে তাকিয়ে ঘোর লেগে গেছে মেহরাবের। মেহরাবের দৃষ্টি আরফার ঠোঁটের দিকে আর আরফার দৃষ্টি মেহরাবের চোখের দিকে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here