অপরিচিত লেখিকাঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ ২৪

0
1350

#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৪

কিছুর শব্দে আরফার ঘুম ভেঙে গেলো। অনুভব করলো কেউ তার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। শব্দের উৎস খোঁজার জন্য আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো নার্স নিচু হয়ে ফ্লোরে বসে কিছু তুলছে। উঠে দাঁড়িয়ে সোজা মেহরাবের দিকে তাকালো নার্স। মুখ দেখেই আরফা নার্সকে চিনে গেলো নাম মোহনা বেশ চটপটে একটা মেয়ে। বয়সে আরফার থেকে একটু ছোট হবে। আরফা মোহনার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখতে পেলো মেহরাব তার হাতটা ধরে বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় অদ্ভুত মায়া ভড় করেছে তার মুখে। আরফা আবার মোহনার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সে মেহরাবের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আরফার একটা কথা মনে পড়ে গেলো। মোহনার ডিউটি সেদিন আরফার সাথে পড়েছিলো। সারাদিন মেহরাবের কথা বলে বলে মাথা খেয়ে নিয়েছিলো পুরো।

ফ্ল্যাশব্যাক

আরফার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে মোহনা বললো, ম্যাম আমাদের নতুন স্যারকে দেখেছেন ?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে আরফা তার দিকে তাকিয়ে বললো, এটা কেমন প্রশ্ন ? স্যার এসেছে অনেকদিন হয়ে গেছে দেখবো না কেনো ?

মোহনা একটু লজ্জা পেয়ে বললো, আমি বলছি কতো কিউট খেয়াল করেছেন আর স্যারের সাথে আমার নামের কত মিল দেখেছেন ম্যাম ? মেহরাব আর মোহনা কতো মিল নামের।

মোহনার কথা শুনে আরফা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখলো মোহনা কথাগুলো বলছে আর লজ্জায় মুচকি মুচকি হাঁসছে। আরফার মাথায় হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধি ভড় করলো।

আরফা শয়তানি হেঁসে বললো, ঠিক বলেছো নামের কতো মিল, মনে হয় আপন ভাইবোন। জানো তো মোহনা ভাই-বোনের নাম সবসময় মিলিয়ে রাখা হয়।

আরফার কথায় মোহনার লজ্জা রাঙা মুখটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে দিবে। মোহনার মুখ দেখে আরফা হাসি চেপে রাখতে পারলো না অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মোহনা তখনো মুখ ফুলিয়ে আছে।

এদিকে আরফা পেট চেপে হাঁসছে হঠাৎ মোহনা মলিন মুখে বলে উঠলো, আর কখনো এমন মজা করবেন না ম্যাম। আমি স্যারকে ভালোবেসে ফেলেছি।

আরফা অবাক হয়ে বললো, আরে স্যার আসছে এখনো মাস হয়নি আর তুমি বলছো ভালোবেসে ফেলেছো ?

মোহনা মুচকি হেঁসে বললো, ভালোবাসার জন্য মাস বা বছরের প্রয়োজন হয় না ম্যাম। এক পলক দেখায় ও ভালোবাসা হয়ে যায় আবার বছরের পর বছর সাথে থেকেও ভালোবাসা হয় না। অনেক সময় দেখবেন কারো সাথে হওয়া কয়েক মিনিটের আলাপ আমরা সারাজীবন ভুলতে পারি না আবার বছরের পর বছর একসাথে থেকে মনে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করলেও দিতে পারি না। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন।

আরফা অবাক হয়ে শুনতে থাকে মোহনা নামের মেয়েটার কথা। সবসময় বাচ্চামি করা মেয়েটার মধ্যেও ভালোবাসার এতো বড় ব্যাখ্যা আছে আরফা ভাবতে পারেনি। আরফা প্রথমে মনে করেছিলো মেহরাব মোহনার চোখের মুগ্ধতা মাত্র কিন্তু তার বলা প্রত্যেকটা কথায় আরফা বুঝতে পারে মোহনা সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে মেহরাবকে।

বর্তমান

আরফা অতীত থেকে বেড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা এখনো মেহরাবের দিকে তাকিয়ে আছে আর চোখদুটো ছলছল করছে পানিতে। মোহনার জন্য খারাপ লাগলেও কেনো যেনো মেহরাবের দিকে তাকিয়ে থাকা সয্য হচ্ছে না আরফার। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে আরফার। কিন্তু কেনো তবে কী সেও ভালোবেসে ফেলেছে মেহরাবকে। এর উত্তর আরফার কাছে নেই কিন্তু মোহনার দৃষ্টি তার সয্য হচ্ছে না। আরফা মেহরাবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মেহরাবের ঘুম ভেঙে গেলো।

হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে বললো, ক,,,কী হয়েছে আরফা, আবার খারাপ লাগছে তোমার ?

মেহরাবের কথায় মোহনারও ঘোর কাটলো আর তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলো। একতরফা ভালোবাসা গুলো সবসময় নিজের মধ্যেই গুমরে মরে কেউ জানতে পারে না সেই যন্ত্রণার কথা। মোহনা সত্যি ভালোবেসেছিলো মেহরাবকে, সেটা হয়তো কোনোদিন মেহরাব জানতেও পারবে না, কারণ মোহনা নামের কাউকে হয়তো সে চেনেই না। মোহনা তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে।

মেহরাব আবার বললো, কী হলো কথা বলছো না কেনো, খারাপ লাগছে আবার ?

আরফা ধীর কণ্ঠে বললো, ওয়াশরুমে যাবো।

মেহরাব বুঝতে পেরে বললো, ওহ্ সরি।

মেহরাব কিছু না বলে কোলে তোলে নিলো আরফাকে তাতে আরফা চমকে বললো, আমাকে নামিয়ে দিন, শুধু হাতটা একটু ধরুন আমি হেঁটে যেতে পারবো।

আরফার বলা শেষ হতে হতে মেহরাব ওয়াশরুমে চলেই এসেছে। আরফাকে সাবধানে নামিয়ে দিয়ে বললো, হয়ে গেলে আমাকে বলো আমি নিয়ে যাবো আর সাবধানে কিন্তু, পরে যেও না আবার। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি লক করতে হবে না।

আরফার উত্তরের অপেক্ষা না করে মেহরাব বের হয়ে গেলো। আরফা নিজেকে দেখে নিলো একবার আয়নায়। মুখে এখনো সেদিনের সাজের ছাপ আছে হালকা। তবে একদম ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে। যতটা পারে ফ্রেশ হয়ে নিলো আরফা কিন্তু তাতে শান্তি লাগছে না।

এই যে শুনছেন হয়ে গেছে আমার।

মেহরাব মনে হয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আরফার হালকা আওয়াজে ভেতরে চলে এলো আর আরফাকে কোলে তোলে নিলো।

আরফা বললো, একটা কথা বলবো ?

মেহরাব ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে বললো, একটা কেনো হাজারটা বলো।

আরফা মিনমিন করে বললো, আমার গা কেমন কুটকুট করছে শাওয়ার নেওয়া যাবে ?

আরফার কথা শুনে মেহরাব অবাক হয়ে তাকালো আর বললো, নিজে ডাক্তার হয়ে এমন কথা কীভাবে বলতে পারো তুমি ? কোনোভাবে ক্ষত স্থানে পানি লাগলে কী হবে ভালো করেই জানো তুমি আরফা।

আরফা বললো, জানি কিন্তু এভাবেও থাকতে পারছি না আমি। মাথাও কেমন যেনো ভারী ভারী লাগছে প্লিজ প্লিজ।

মেহরাব কড়া চোখে তাকালো আরফার দিকে বিনিময়ে আরফা অসহায় ফেস করে শব্দ ছাড়া শুধু ঠোঁটের ইশারায় বলতে লাগলো প্লিজ।

মেহরাব বললো, ওকে ওকে কিন্তু শাওয়ার নেওয়া যাবে না। আমি গরম পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে বলছি নার্সকে।

আরফা মুখ কালো করে বললো, এতে কী আর মাথার ভারী ভারী ভাব যাবে নাকি ?

মেহরাব বললো, মাথাও ধুয়ে দিতে,,,,,, ওকে ওয়েট।

মেহরাব আরফাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে মগ আর বালতি ভর্তি পানি নিয়ে এলো। আরফার মাথা নিচে ওয়াটারপ্রুফ কাপড় দিয়ে নিলো যাতে বেড ভিজে না যায়। তারপর মাথা ধুয়ে দিতে লাগলো। আরফা অবাক হয়ে শুধু দেখছে।

আরফার চুল দেখে মেহরাব বললো, এটা তো আরেক ঝামেলা বাধালাম। তোমার চুল যে ঘন আর লম্বা শুকাবো কীভাবে ?

আরফা কিছু বলছে না। মেহরাব আরফার মাথায় পানি ঢালছে আর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আরফার মনে অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। পানি দেওয়া শেষে আরফাকে বেডে হেলান দিয়ে বসিয়ে চুল মুছে দিলো ভালো করে।

টাওয়েল দিয়ে চুল পেঁচিয়ে দিয়ে বললো, বাকিটা তো আর আমি করতে পারবো না,,,,

আরফা কিছু না ভেবেই কথা শেষ হওয়ার আগেই বললো, কেনো ?

মেহরাব ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরফার দিকে তারপর বললো, কেনো মানে ?

আরফা কী বলে ফেলেছে ভেবে দাঁত দিয়ে জিব কাটলো। মেহরাব দুষ্টুমি করে বললো, আমি করে দিলে হবে ?

আরফা ব্যস্ত হয়ে বললো, না না আ,,আপনি নার্সকে,,,

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, ওকে রিলাক্স এতো হাইপার হতে হবে না আমি নার্সকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার শরীর মুছিয়ে দিবে। আমি ততক্ষণে আমার কেবিন থেকে ফ্রেশ হয়ে তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি।

আরফা কিছু না বলে মাথা নাড়ালো। মেহরাব মুচকি হেঁসে বের হয়ে গেলো। একটু পর কেবিনে এলো মোহনা।

জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, কেমন আছেন ম্যাম ?

আরফা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ,,, তুমি কেমন আছো ?

মোহনা আবার সেই আগের হাসি টেনে বললো, ভালো।

আর কোনো কথা বললো না গরম পানিতে স্পঞ্জ ভিজিয়ে মুছে দিচ্ছে আরফার শরীর। মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে মুখটাও শুকিয়ে গেছে। আরফার খারাপ লাগছে মোহনার জন্য।

আরফা বললো, তুমি ঠিক আছো মোহনা ?

মোহনা জোরপূর্বক হেসে বললো, আমার কী হবে ? আমি একদম ঠিক আছি।

আরফা কী বলবে মেয়েটাকে ? মেহরাবের সাথে আরফার বিয়ে না হলেও যে সে মেহরাবকে পেতো সেটা আরফার মনে হয় না।

আরফা বললো, মোহনা তুমি তো জানো বিয়েটা কীভাবে হয়েছে,,,,

মোহনা হেঁসে বললো, আপনি শুধু শুধু এমন মন ছোট করছেন ম্যাম। স্যারের সাথে আপনার বিয়ে না হলেও আমি কোনোদিন তাকে আমার মনের কথা জানাতে পারতাম না। আর আমরা যাকে নিয়েই স্বপ্ন সাজাই না কেনো আল্লাহ তাআ’লা যার সাথে আমাদের ভাগ্য জোরে রেখেছে সেই আসবে আমাদের জীবনে।

আরফা মোহনার কথা মন দিয়ে শুনছে। মেয়েটার কথায় মাঝে মাঝে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় আরফা। এখন যে কথাটা বলেছে সেই কথার সাথে আরফা তো নিজের জীবনেরই মিল পেয়েছে। আরফা তো স্বপ্ন সাজিয়েছিলো রুমানকে নিয়ে আর মেহরাব সিনথিয়াকে নিয়ে কিন্তু ওপরওয়ালা হয়তো তাদের ভাগ্য দুজন দু’জনের সাথে জোড়ে দিয়েছিলো। তাই তো কয়েকদিন আগেও যে মানুষটা আরফার #অপরিচিত ছিলো, পৃথিবীর দুই প্রান্তে ছিলো দুজন আজ তারা একে অপরের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে গেছে।

ম্যাম হয়ে গেছে আমি আসছি।

মোহনা চলে যেতে গেলে আরফা পেছন থেকে বললো, তোমার ভাগ্য যার সাথে জোড়ে আছে, সে মানুষটা হয়তো এখনো তোমার জীবনে আসেনি। #অপরিচিত হয়েও রয়ে গেছে। তার অপেক্ষা করো তার আগমনে হয়তো জীবন আবার সুন্দর হয়ে উঠবে মোহনা।

মোহনা পেছনে ঘুরে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বের হয়ে গেলো। বেড়িয়ে ঘুরে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মেহরাব ব্রেকফাস্ট নিয়ে কেবিনের দিকে আসছে। মোহনা চুপচাপ সরে গেলো সেখান থেকে। আরফা মোহনার জন্য মন খারাপ করে বসে আছে। মেয়েটার মুখে দুষ্টু হাঁসি আর বোকাবোকা কথাই মানায়। এমন গম্ভীর মুখে ভারী ভারী কথা নয়।

মেহরাব খাবার নিয়ে কেবিনে ঢুকে বললো, তোমার খাবার নিয়ে এসেছি। আজ দুদিন পর খাবার মুখে দিবে একটু খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। সবটা না খাওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না।

মেহরাবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরফা হঠাৎ বলে উঠলো, কেনো করছেন এসব মেহরাব ? আপনার জীবন বাঁচিয়েছি বলে দয়া করছেন নাকি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন বলে বাধ্য হয়ে দায়িত্বও পালন করছেন।

আরফার কথায় বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো চমকে তাকালো মেহরাব। সত্যি তো সে কেনো আরফার জন্য এতোকিছু করছে। দায়বদ্ধতা, দ্বায়িত্ব, দয়া নাকি,,,,,,,,,

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here