অপরিচিত লেখিকাঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ১৩

0
1032

#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ১৩

দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। হসপিটাল বিজনেস সবজায়গায় মেহরাবকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব এখন মেহরাবের আন্ডারে কাজ করছে। এদিকে দিন দিন আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছে বাবা ছেলে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছে। মেহরাব এখনো আসল শত্রুকে খোঁজে বার করতে পারেনি তাই কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। হসপিটাল সামলাতে পারলেও বিজনেস সম্পর্কে ধারণা নেই মেহরাবের তাই আপাতত হসপিটালের হালই ধরেছে তবে বিজনেসের যে কোনো কাজ করতে মেহরাবের অনুমতি নিতে হচ্ছে হাসান মাহমুদকে সে জন্য তার রাগ দিন দিন আকাশ ছুঁতে চলেছে। এদিকে ইশতিয়াকের এতোদিন করা গন্ডগোল একটু একটু করে সামনে আসছে মেহরাবের যার জন্য ভয়ে আছে ইশতিয়াক। অন্যদিকে সেদিনের পর আরফার সাথে মেহরাবের দেখা হলেও কথা হয় না প্রয়োজন ছাড়া সবসময় কেমন উদাসীন থাকে আরফা। এদিকে হসপিটালের সব ইয়াং লেডি ডক্টরসহ সব লেডি স্টাফদের ক্রাশ হয়ে গিয়েছে মেহরাব। সে যেখানে যায় মেয়েরা কাজ বাদ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া যেনো আরো সুন্দর করে তুলেছে তাকে।

নিজের কেবিনে বসে এক রোগীর রিপোর্ট দেখেছিলো আরফা তখনই এক ওয়ার্ডবয় নক করলো দরজায়।

আসবো ম্যাম ?

ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আরফা বললো, হ্যাঁ আসুন।

ওয়ার্ডবয় ভেতরে গিয়ে বললো, ম্যাম আপনাকে মেহরাব স্যার এখনই তার কেবিনে যেতে বলেছে।

ওয়ার্ডবয়ের কথায় কপাল কুঁচকে গেলো আরফার। মেহরাব তাকে কেনো ডাকবে বুঝতে পারছে না।

আরফা বললো, আমাকে কেনো ডাকছে ?

ওয়ার্ডবয় দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই বললো, আমি জানি না ম্যাম। তবে স্যার এখনই যেতে বলেছে আপনাকে।

আরফা ফাইল বন্ধ করে বললো, ঠিক আছে আপনি যান আমি আসছি।

ওয়ার্ডবয় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বের হয়ে গেলো আরফার কেবিন থেকে। কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল চিন্তা করে আরফা পা বাড়ালো মেহরাবের কেবিনের দিকে।

May i come in, sir ?

মেহরাব হসপিটালের ফিনানশিয়াল ডিপার্টমেন্টর পুরোনো কিছু ফাইল দেখছিলো আরফার গলা পেয়ে ফাইল রেখে দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, Come in.

আরফা ভেতরে গিয়েই বললো, আমাকে কেনো ডেকেছিলেন স্যার ?

আগে বসুন তারপর বলছি।

আরফা সামনের চেয়ার টেনে বসতেই মেহরাব বললো, এই হসপিটাল আর মেডিকেল কলেজের প্রত্যেকটা বিষয়ে আমার গন্ডগোল লাগছে। আপনাকে ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাসও করতে পারছি না তাই আপনাকেই বলতে বাধ্য হলাম। আপনার সাহায্য লাগবে এই সব সমস্যার সমাধান বের করতে।

আরফা বললো, কিন্তু স্যার আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি ?

মেহরাব বললো, আপনি এই হসপিটালে জয়েন করেছেন কতদিন হলো ?

আরফা একটু চিন্তা করে বললো, স্যার চার মাসের মতো হবে।

তাহলে এমন অনেক কিছু জানেন যা আমি জানি না। তাই আপনার হেল্প প্রয়োজন আমার।

আরফা একটু চিন্তা করে বললো, ওকে স্যার আমি হেল্প করবো।

মেহরাব হাসি মুখে বললো, আর আজ থেকে আপনি আমার আন্ডারেই থাকবেন এতে কারো সন্দেহ হবে না।

আরফা বললো, ঠিক আছে স্যার, এখন তাহলে আমি আসছি।

ওকে আসুন।

আরফা মেহরাবের রুম থেকে বের হয়ে এলো কিছু চিন্তা করতে করতে। নিজের কেবিনে ঢুকবে তখনই হাতের ফোনটা কেঁপে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো রুমানের কল। এই কয়েকদিনে অসংখ্যবার কল দিয়েছে রুমান। আরফা রিসিভ না করে এড়িয়ে গিয়েছে। তবে আজ রিসিভ করলো।

আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম,,, তুমি আমার ফোন রিসিভ কোনো করো না আরফা ?

কঠিন গলায় আরফা বললো, #অপরিচিত কারো সাথে কথা বলা পছন্দ করি না আমি।

অবাক হয়ে রুমান বললো, আমি তোমার #অপরিচিত আরফা ?

শান্ত গলায় আরফা বললো, জী আপনি আমার #অপরিচিত।

হতাশ গলায় রুমান বললো, আপনি,,, তুমি আমার সাথে আপনি করে কথা বলছো আরফা ?

আমি কোনো অভদ্র মেন্টালিটির মানুষ নই যে অপরিচিত কারো সাথে তুমি করে কথা বলবো ?

আরফা আমি রুমান যাকে তুমি ভালোবাসো, যার সাথে ছোট একটা সংসার সাজানো স্বপ্ন দেখতে। তুমি তোমার সেই রুমানকে অপরিচিত বলছো ?

আরফা এবার কঠিন গলায় বললো, দেখুন মিস্টার রুমান আপনার ভুল হচ্ছে। আমি আপনাকে নয় আপনার মতো দেখতে একজনকে ভালোবাসতাম, সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখতাম। আবারও বুঝিয়ে বলছি বাসতাম এবং স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু এখন না তাকে ভালোবাসি আর না স্বপ্ন দেখি। আর যাকে ভালোবাসতাম সেটাও কিন্তু আপনি নন আপনার মতোই দেখতে একজন ছদ্মবেশী। যাকে ভালোবাসতাম সে ছিলো আমার আপনজন, চীরচেনা পরিচিত একটা মুখ, আমার বাবার দাফনের সাথেই দাফন হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব। বুঝতে পেরেছেন আপনি ?

প্লিজ আরফা আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আজ পাঁচ বছর ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি কেউ তোমার খোঁজ দেয়নি আমাকে। অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছি তোমাকে। একটা সুযোগ দাও একবার দেখা করো আমার সাথে। যা বলার সামনাসামনি বলো প্লিজ।

দেখা করতে চান, রাইট ?

একটা সুযোগ দাও প্লিজ আরফা।

ঠিক আছে আজ বিকেল চারটায় *কফিশপে থাকবেন যা বলার সেখানেই বলবো।

Thank you Arfa,,, I really don’t understand how I can thank you.

আরফা রুমানের কথার কোন উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। আজ এর শেষ দেখে ছাড়বে আরফা। এভাবে চলতে পারে না।

একবার তুমি আমার সাথে দেখা করো আমি তোমার সব রাগ দুর করে দিবো। আমি জানি তো তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে একবার সরি বললে মাফ করে দিবে আমাকে সেটা আমি জানি।

১২

বাইরে তুষার পড়ছে সেই কনকনে ঠান্ডায় বেলকনিতে বসে আছে মেহেক। রাত প্রায় দুটো বাজে ঘুম নেই চোখ। মেহরাব বাংলাদেশে গেছে আজ কতগুলো দিন কেটে গিয়েছে। ছেলেটাকে ছেড়ে কখনো একা থাকেনি মেহেক। সারাদিন হসপিটালে কাটালেও দিন শেষে বাড়ি ফিরে ছেলের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস নিয়েছে। যে রাতে বাড়ি ফেরা হয়নি ভিডিও কলে একবার দেখে নিয়েছে। আজ কতগুলো দিন ছেলেকে দেখে না তার কণ্ঠে মম ডাক শুনে না। অভিমান করে ছেলের একটা কলও রিসিভ করেনি। অনেক ম্যাসেজ করেছে সেগুলো একটাও বের করে দেখেনি রাগ করে। কিন্তু আজ একটু বেশি মনে পড়ছে ছেলের কথা। মেহেকের মম ড্যাড দুজনেই মারা গেছে চার বছর হলো। দুই ভাই অন্য শহরে থাকে বিজনেসের জন্য। প্যালেসটা মেহেককে দিয়ে গেছে তার ড্যাড। মেহেক, মেহরাব আর কয়েকজন সার্ভেন্ট থাকে প্যালেসে। মেহরাব চলে যাওয়ায় একদম একা হয়ে পড়েছে সে। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে চারপাশটা। নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে ল্যাপটবটা নিয়ে মেহরাবের ম্যাসেজগুলো দেখতে লাগলো। প্রথমেই চোখে পড়লো মেহরাবের দেওয়া মুজাহিদ খানের মেডিকেল রিপোর্টের ছবিগুলো। একজন অভিজ্ঞ সার্জেনের সময় লাগলো না রিপোর্টগুলো বুঝতে। মুজাহিদ খানের কন্ডিশন দেখে চোখ পানিতে ভড়ে উঠলো তার। এতো বছরের জমানো অভিমানের বরফ গলতে শুরু করলে। তবে কী এবার সময় হয়েছে তার স্বামীর বাড়িতে ফেরার ?

আজ রবিবার সিহাবের অফিস নেই আর তার চোখের মণি সোহানারও স্কুল নেই। বাবা-মেয়ে কিচেনে চকলেট কেক বানাচ্ছে আর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে সিনথিয়া। এদের দু’জনকে একসাথে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ এরা দুজন। যখন একসাথে থাকে কারো ঠোঁটের কোণ থেকে হাসিটা যেনো সরতেই চায় না। বাবার নাকে ময়দা লাগিয়ে খিলখিলিয়ে হাঁসছে মেয়েটা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সিনথিয়া।

ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছো ? আসো হেল্প করো আমাদের।

সিহাবের কথায় ঘোর কাটলো সিনথিয়া কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পরে গেলো সে। থতমত খেয়ে বললো, না আমি পানি নিতে এসেছিলাম চলে যাচ্ছি।

সিহাব আবার বললো, আরে চলে যাবে কেনো আসো তিনজন একসাথে কেক বানাবো তারপর একসাথে খাবো, তাই না মাম্মাম ?

এসো না মাম্মি একসাথে অনেক মজা হবে।

সিনথিয়া কিছু বলার আগেই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ছোট পরীটা। সিনথিয়াও আর কিছু বললো না সিহাবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সিহাব সব একে একে দিচ্ছে বোলে।

হঠাৎ সোহানা বললো, এভাবে হবে না মাম্মি শুধু দাঁড়িয়ে আছে হেল্প করছে না তো।

সিহাব বললো, কী হেল্প করবে বলো তো মাম্মাম ? সব তো হয়েই গিয়েছে এখন শুধু মিক্সড করতে হবে।

সিমথিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তা দেখে সোহানা একটু চিন্তা করার ভাব করে বললো, সব তো পাপা করেছে এখন মাম্মি মিক্সড করবে আর পাপা হেল্প করবে।

সিহাব হেঁসে বললো, ওকে ডান, সিনথিয়া তুমি মিক্সড করো আমি তোমাকে হেল্প করছি।

সিনথিয়া মাথা দিয়ে সায় জানিয়ে মিক্সড করতে লাগলো আর সিহাব সিনথিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে সিনথিয়ার হাতের ওপর হাত রাখলো। সিনথিয়া খানিকটা কেঁপে উঠলো সিহাবের স্পর্শে। এতো বছরেও সিহাবের স্পর্শটাতে সহজ হতে পারেনি সিনথিয়া। যখনই সিহাব তাকে স্পর্শ করে তাতে কেঁপে উঠে সিনথিয়া। এদিকে পাপা আর মাম্মিকে একসাথে কাজ করতে দেখে সোহানা হাত তালি দিচ্ছে আর লাফাচ্ছে। সিনথিয়ার দৃষ্টি নিচের দিকে আবদ্ধ থাকলেও সিহাবের স্থির দৃষ্টি সিনথিয়ার দিকে।

এতোগুলা বছর একসাথে থেকেও তোমার মনের কোণে একটু জায়গা করে নিতে পারিনি আমি সিনথিয়া ?

সিহাবের হিম শীতল গলায় চমকে উঠলো সিনথিয়া অবাক হয়ে তাকালো সিহাবের দিকে। সিহাবের চোখ দুটো টলমল করছে পানিতে। এর উত্তরে কী বলবে সে ? সত্যি কী সিহাব তার মনে একটু জায়গা করতে পারেনি ? হঠাৎই সিহাব তাকে ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো কিচেন থেকে আর পাপার পিছনে ছুটলো মেয়ে। সিনথিয়া একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বাকি কাজটা করে নিলো।

১৩

বিকেল চারটা কফিশপের একদম কর্ণারের টেবিলে বসে আছে আরফা আর রুমান। দুজনেই চুপচাপ কারো মুখে কোনো কথা নেই। আরফার দৃষ্টি বাইরের দিকে আর রুমানের দৃষ্টি আরফার দিকে৷ স্কুল পড়ুয়া আরফা আর এখন রুমানের সামনে বসে থাকা আরফার আকাশ পাতাল তফাত দেখতে পাচ্ছে রুমান। মুখের কিশোরী ভাবটা কেটে গিয়ে পূর্ণ নারীর আভা ফোটে উঠেছে। সে আর এখন নাদুসনুদুস নেই একদম ফিট যাকে বলে জিরো ফিগার। আগের থেকে কয়েকগুণ সুন্দরী হয়ে গেছে।

নিরবতা ভেঙে রুমান বললো, কেমন আছো ?

আরফা রুমানের দিকে তাকালো। গালে ঘন চাপদাড়ি, চোখে চমশা, মাথার চুলগুলো আগের মতোই আছে, দেখতে আগের থেকেও সুদর্শন লাগছে, মায়াভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরফার একবার ইচ্ছে করলো সব ভুল মাফ করে দিতে পরক্ষণেই কানে বেজে উঠলো রুমানের বলা প্রত্যেকটা কথা।

একটু সময় নিয়ে বললো, যতটা খারাপ থাকবো ভেবেছিলেন তার থেকেও কয়েকগুণ ভালো আছি।

রুমান মলিন মুখে বললো, আমাকে মাফ করে দাও আরফা, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে অনেক খুঁজেছি তোমাকে কিন্তু পাইনি। তুমিও তো ভালোবাসো আমাকে একটা সুযোগ দাও।

আরফা হাঁসি মুখে বললো, সত্যি একটা সুযোগ দেওয়া উচিত আপনাকে তাই না ?

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here