অপরিচিত পর্বঃ ১৪

0
1090

অপরিচিত পর্বঃ ১৪
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা

#গল্পের_টার্নিং_পয়েন্ট_স্পেশাল

আরফা হাঁসি মুখে বললো, সত্যি একটা সুযোগ দেওয়া উচিত আপনাকে তাই না ?

আরফার কথায় রুমানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো। কিন্তু তা বেশি সময় স্থায়ী হলো না।

আরফা আবার বললো, আচ্ছা আপনি নিজের কোন ভুলটা বুঝতে পেরেছেন বলুন তো ? আমার বাবা টাকা রেখে যায়নি মনে করে যে ভুলটা করেছিলেন সেটা নাকি আমি এতোটা সফল হতে পারবো সেটা বুঝতে না পেরে যে ভুল করেছেন সেটা।

রুমানের মুখের হাসিটা গায়েব হয়ে গেলো সে বললো, এসব তুমি কী বলছো আরফা ? আমি বুঝতে পেরেছি তোমাকে একা ছেড়ে যাওয়া আমার ভুল হয়েছে।

আরফা প্রায় ধরা গলায় বললো, জীবনের যে সময়টাতে আপনাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো সেই সময়ে আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলেন। দুটো মাস ডিপ্রেশনে ছিলাম রুম থেকে বের হতে পারিনি। প্রায় একটা বছর সময় লেগেছে আমার ঘুরে দাঁড়াতে। পারবেন আমার সেই সময়গুলো ফেরত দিতে ? রাতের পর রাত চোখের পানিতে বালিশ ভিজেছে পারবেন সেই প্রত্যেক ফোঁটা পানির দাম দিতে ? আমার জন্য আমার মা যে কষ্ট পেয়েছে পারবেন তা ভুলিয়ে দিতে। আজ যখন আমাকে সফল একজন ডাক্তার দেখতে পেয়েছেন তখন আবার চলে এসেছেন ভালোবাসার দাবি নিয়ে। আগের বার তো আমার বাবার টাকা দেখে লোভে পড়েছিলেন এবার কেনো এসেছেন ? ডাক্তার হয়ে গিয়েছি অনেক টাকা ইনকাম করবো সেটা ভেবে ?

রুমান অস্থির গলায় বললো, আরফা আমার কথাটা শুনো, ভুল বুঝছো তুমি,,,,

আরফা হাত উচু করে বললো, আপনি আমার কথা শুনোন। যদি এটা ভেবে আসেন আমি অনেক টাকা ইনকাম করবো তাহলে আবারও ভুল ভেবেছেন। ইন্টার্নি শেষ করে আমি গ্রামে চলে যাবো। বাবার নামে ছোটোখাটো একটা হসপিটাল করে অসহায় মানুষের সেবা করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবো। আর একটা কথা কান খোলে শুনে রাখুন আপনি যে আরফাকে চিনতেন সে আমি নই। এই আরফার মনে রুমান বলে কারো অস্তিত্ব নেই। একটা কথা কী জানেন ? #অপরিচিত মানুষকে চেনা যায় কিন্তু মুখোশ পড়া পরিচিত মানুষকে কখনো চেনা যায় না। তাদের মুহূর্তেই পরিচিত মনে হয়ে আবার মুহুর্তেই মনে হয়, সামনে থাকা চেনা মানুষটা একদম #অপরিচিত। নিজের আত্মসম্মান বোধ থাকলে আর কখনো আমার সামনে আসবেন না এবং আমার সাথে যোগাযোগ করার কোনো প্রকার চেষ্টা করবেন না।

রুমানের উত্তরের অপেক্ষা না করে আরফা উঠে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো। রুমান ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার দিকে।

রুমান বিড়বিড় করে বললো, তুমি সত্যি আমার আরু নও, হতে পারো না।

চোখ মুছতে মুছতে কফিশপ থেকে বের হয়ে এলো আরফা। রুমানকে সত্যি ভালোবেসে ছিলো সে। জীবনের প্রথম প্রেম কখনো ভুলা যায় না তার প্রমাণ আরফা নিজে। কই এতো বছরেও তো সে ভুলতে পারেনি রুমানকে। আজও তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিলো মাফ করে দিতে। কিন্তু আজ রুমানকে মাফ করলে আরফা নিজের কাছে ছোট হয়ে যেতো। আত্মসম্মান বলতে কিছু থাকতো না। আর যাদের আত্মসম্মান বোধ নেই তারা মানুষের কাতারে পরে না। জীবনে সব কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করলেও আত্মসম্মানের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে নেই। কফিশপ থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে আরফা। হঠাৎই কেউ পেছন থেকে মুখে রুমাল চেপে ধরলো আরফার। কিছু বুঝার আগেই আসতে আসতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো আর একটা কালো গাড়িতে তাকে উঠিয়ে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো।

১৪

ভোরের আলো ফুটতেই আরফার ঘুম ভেঙে গেলো। মাথাটা প্রচন্ড ভারী ভারী লাগছে। নিজের অবস্থান বুঝার জন্য আসতে আসতে চোখ মেলে তাকালো। প্রথমেই চোখ পড়লো নিজের গায়ের কম্বলের দিকে। হঠাৎ চোখ দুটো আবার ঘোলা হয়ে গেলে আরফা চোখ বন্ধ করে নিলো। আসতে আসতে সব মনে করার চেষ্টা করলো।

ধীরে ধীরে গতকাল সন্ধ্যার কথা মনে পরে গেলো আরফার, রুমানের সাথে কথা শেষ করে কফিশপ থেকে বের হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম হঠাৎ কেউ মুখে রুমাল চেঁপে,,,,,

এটুকু মনে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আরফা। কোথায় আছে বুঝার জন্য আশেপাশে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো।

আ,,আআআ,,,,,আহ্

আরফার চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মেহরাব। বেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো মেহরাব। তার কোলেই এতোক্ষণ শুয়ে ছিলো আরফা।

মেহরাব ভেঙে ভেঙে বললো, ক,,,কী হয়েছে ?

আরফা চিৎকার করে বললো, আপনি এখানে কী করছেন আর আমিই বা এখানে কী করে এলাম ? তারমানে আপনি আমাকে কিডন্যাপ করেছেন। কিন্তু কেনো আমি তো বলেছি আমি আপনাকে হেল্প করবো।

মেহরাব রেগে বললো, What rubbish ? আমি আপনাকে কিডন্যাপ করতে যাবো কেনো বরং আমিই তো আপনাকে বাঁচালাম।

আরফা অবাক হয়ে বললো, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন মানে ?

,,,,,আরে আপনারা এভাবে ভেতরে ঢুকতে পারেন না। আপনারা এভাবে ভেতরে গেলে আমার চাকরি থাকবে না।

অনেক মানুষের চেঁচামেচি শুনে আরফা আর মেহরাব দুজনেই দরজার দিকে তাকালো। চেঁচামেচির শব্দ বাইরে ড্রয়িংরুম থেকে আসছে। দু’জনে একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বেড থেকে নেমে এলো বাইরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই একদল মানুষ হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে এলো আর ছবি তুলতে লাগলো।

ক্যামেরার ফ্লাশের আলোয় মেহরাব চোখে হাত দিয়ে বললো, আরে আপনার কারা এভাবে বেডরুমে ঢুকে এসেছেন কেনো ? এই দেশে কী ম্যানার্স বলে কোনো বস্তু নেই নাকি ?

আরফা মেহরাবের পিছনে বেডের উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো রুমে ঢুকে আসা মানুষগুলো দেখে আরফার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। দেশের নামকরা সব নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিকদের দেখে আরফার ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে।

হঠাৎই একজন সাংবাদিক মেহরাবের সামনে মাইক্রোফোন নিয়ে বললো, মিস্টার খান আমরা খবর পেয়েছি আপনার হসপিটালের ডক্টর মিস আরফার সাথে আপনার অবৈধ সম্পর্ক আছে। এটা কী সত্যি ?

সাংবাদিকদের কথায় আরফা আর মেহরাব দুজনেই আকাশ থেকে পড়লো। কী বলছেন কী এসব উনি ? কারো মাথায় আসছে না।

মেহরাব অনেকটা রেগে চিৎকার করে বললো, What are you talking nonsense ? How dare you talk so badly .

মেহরাবের কথায় সাংবাদিক আবার বললো, আমি যদি বাজে কথা বলে থাকি তাহলে আপনার বেডরুমে ডক্টর মিস আরফা কী করছে এই সময়ে ? আর সারারাত কোথায় ছিলেন উনি ? উনার মা থানায় মিসিং রিপোর্ট কেনো করিয়েছেন ?

মেহরাব অবাক হয়ে বললো, Whatttt,,,, missing report ?

একজন সাংবাদিক মেহরাবকে ছেড়ে আরফার সামনে গিয়ে বললো, ম্যাম আপনি বলুন। আপনি কী সারারাত এখানেই ছিলেন ? আমরা যা ইনফরমেশন পেয়েছি তা কী সত্যি ?

একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে আরফার সাথে সাথে এতো চাপ নিতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে নিচে পরে গেলো। সাংবাদিক একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো আর মেহরাব দৌড়ে এসে আরফার মাথা নিজের কোলে নিয়ে ডাকতে লাগলো। এর মধ্যেই মেহরাবের গার্ডরা এসে সবাইকে বের করে দিলো রুম থেকে৷ এতে করে সাংবাদিকরা নিজেদের মতো নিউজ বানিয়ে প্রচার করতে লাগলো। আরফাকে বেডে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে বেডে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো মেহরাব। কী হচ্ছে এসব কিছুই বুঝতে পারছে না ? আবার চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে আরফার কাছে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করলো। একটু পর চোখ পিটপিট করে তাকালো আরফা।

মেহরাব ব্যস্ত হয়ে বললো, আপনি ঠিক আছেন ?

আরফা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে মেহরাবের কলার চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, কী হচ্ছে এসব ? কেনো এমন করছেন আমার সাথে, কী অন্যায় করেছি আমি ?

মেহরাব নিজের কলার থেকে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো আরফার। রেগে চিৎকার করে বললো, আমি মনে হয় বুঝতে পারছি কী হচ্ছে এসব। গিয়েছিলাম আপনার উপকার করতে এখন মনে হচ্ছে নিজের বিপদে পা দিতে গিয়েছিলাম।

আরফা মেহরাবের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে কেঁদে চলেছে অনবরত। মেহরাব কী ভেবে রুমের টিভি অন করে দিলো।

আমরা কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছি দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি মিস্টার মুজাহিদ খানের একমাত্র নাতি মিস্টার মেহরাব খান দীর্ঘদিন পর কানাডা থেকে দেশে ফিরেছে। তার দুদিনের মধ্যেই খান ইন্ডাস্ট্রিস, মেহরাব হেলথ কেয়ার হসপিটাল এবং মেডিকেল কলেজের দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এসব তথ্য আমরা মিস্টার মুজাহিদ খানের মাধ্যমেই পেয়েছি। মাত্র একমাস যেতে না যেতেই মেহরাব খান সম্পর্কে আমাদের হাতে এসে পৌঁছালো এক নতুন তথ্য। মেহরাব হেলথ কেয়ার হসপিটালের নিউ ডক্টর মিস আরফার সাথে তার গোপন সম্পর্কের নিউজ ফাঁস হয়েছে গতকাল রাতে। গুঞ্জন শোনা যায় নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবেই হসপিটালের ওনারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন মিস আরফা এমনটাই জানা গিয়েছে। বিশেষ মাধ্যমে জানা যায় গতরাতে তারা দুজনেই নিজেদের মধ্যে একান্ত সময় কাটাতে মিস্টার খানের ফার্মহাউসে চলে গিয়েছিলেন। এদিকে মিস আরফার মা রাতে মেয়ে বাসায় না ফেরায় থানায় মিসিং কমপ্লেইন করেন। এ বিষয়ে আরো জানাতে এখন মিস্টার খানের ফার্মহাউস থেকে আমাদের সাথে সরাসরি যোগদান করবেন আমাদের সহকর্মী মিস লিলি,,,,

এটুকু শুনতেই মেহরাব হাতের রিমোট ছুঁড়ে দিলো টিভির দিকে। রিমোটটা ভেঙে গেলেও টিভির খুব একটা কিছু হলো না। এতে যেনো মেহরাবের রাগ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। উঠে টিভিটা তুলে সজোরে আছাড় দিলো ফ্লোরে তারপর বেশ কয়েকবার লাথি মেরে ভাঙতে লাগলো টিভিটা। এতেও রাগ কমছে না মেহরাবের। একে একে রুমের সব কিছু ভাঙতে লাগলো। এদিকে আরফা টিভির নিউজ শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ কোনো অনুভূতি কাজ করছে না তার মাঝে। যে আত্মসম্মানের জন্য এতোবছরের পুরনো ভালোবাসা পায়ে পিষে চলে এসেছে সেই সম্মান এক রাতে মাটির সাথে মিশে গেলো। একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার ইজ্জত তার চরিত্র। সেই চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে এই সভ্য সমাজ। নিজেকে মৃত লাশের মতো লাগছে আরফার। কী থেকে কী হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে। একটা কথায় তার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আরফা হসপিটালের ওনারের সাথে এমন সম্পর্কে জড়িয়েছে। মেহরাব তখনো নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে রুমের জিনিসপত্রের ওপর ঝড় তুলতে ব্যস্ত। সিনথিয়া ছাড়া জীবনে কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখেনি সে আর আজ কিনা তাকে এমন এক অপবাদের বোঝা মাথায় নিতে হবে কিছুতেই মানতে পারছে না সেটা। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মেহরাবের। এখন যদি সবাইকে বলে আরফা গতকাল কিডন্যাপ হয়েছিলো সে তাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছে সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই আরফা কিডন্যাপ হয়েছিলো। এদিকে আরফা ধীর পায়ে ছাঁদে চলে এসেছে। এই অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়ানোর শক্তি তার নেই। পারবে না সমাজের মানুষের বাজে কথা সয্য করে বেঁচে থাকতে। ছাঁদের একদম কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে আরফা, মৃত্যুর একদম কাছে, আর একপা আগাতেই মৃত্যু তাকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে নিবে।

এদিকে টিভির সামনে বসে নিউজ দেখে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করছে ইশতিয়াক। মেয়েটাকে বলেছিলো মুজাহিদ খানের থেকে দূরে থাকতে কিন্তু তার কথা না শুনে খোঁজে এনে দিয়েছে মুজাহিদ খানের প্রাণ, খান ইন্ডাস্ট্রিসের নতুন মালিককে। এবার নিজের জীবনের ধ্বংস দিয়ে তার মাশুল দিতে হচ্ছে।

বিশ্রি হাসি দিয়ে ইশতিয়াক বললো, তোমাদের দুজনের জন্য বাবা আমাকে অনেক অপমান করেছে আর আমি তোমাদের পুরো দেশের সামনে অপমানিত করলাম। আরফাকে বাঁচিয়ে ভালোই করেছো তুমি মেহরাব। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সু্যোগ করে দিয়েছো। এটা তো শুরু তারপর দেখো আরো কী কী করি আমি।

আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ইশতিয়াক। তাকে দেখে এখন পুরোপুরি একজন মানসিক রোগী মনে হচ্ছে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা চামচাদের কাছে।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here