অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_১১
শরীরে হালকা কাঁপুনির পাশাপাশি কর্ণকুহরে নিজের নামটা প্রতিধ্বনিত হওয়ায় অনি চোখ মেলে তাকায়। শায়লা বেগমের অস্পষ্ট মুখাবয়ব স্পষ্ট হতেই অনি কিছুটা হকচকিয়ে যায়। চোখ কচলাতে কচলাতে শায়লা বেগমের দিকে তাকায়।কয়েক মূহুর্তেই তার কাছে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।
ঘুম ঘুম কণ্ঠে শায়লা বেগমকে বলে; সরি আন্টি।এখানে বসে থাকতে থাকতেই চোখ দুটো লেগে এসেছে। কিছু বলবেন??
শায়লা বেগম অনির কথায় অবাক হয়ে যায়। অনিকে বলেন; পাগলি মেয়ে।তুই সরি বলছিস কেন? আর আমি রুমে এসে দেখি তুই এখানে বসে ঘুমাচ্ছিস। তাই তো ডেকে তুললাম বিছানায় গিয়ে ঘুমা। অনেক ধকল গেছে তো তোর উপর দিয়ে। ক্লান্ত শরীর।বিছানায় শুয়ে রেস্ট নে।
অনি তরিত গতিতে উত্তর দেয়;
না না আন্টি ঠিক আছে।এখন আর ঘুমাব না। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি ঠিও আছি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলে; ৪টা বেজে গেছে। আছরের আযান টাও বোধ হয় দিয়ে দিছে। এখন ঘুমাতে গেলে আমার নামাজটা কাজা হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো আমি ফ্রেশ হয়ে নামাজটা পরে ফেলি।
শায়লা বেগম বলেন;
আচ্ছা ঠিক আছে তা না হয় বুঝলাম।কিন্তু তোর উপর আমি খুব রেগে আছি এখন।
অনি শায়লা বেগমের কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়।সে মনে মনে ভাবতে থাকে; আমি আবার কি করলাম?
শায়লা বেগম অনির উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় বলেন; তুই আমার একমাত্র ছেলের বউ। আর তুই আমাকে আন্টি বকে ডাকিস কেন বলতো?আমি কি এতটাই পর নাকি যে আমাকে মা ডাকতে পারিস না?
শায়লা বেগমের কথায় স্বস্তির পাশাপাশি অনির বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে মা শব্দটা শুনে। মা ডাকার অনুভূতিটার সাথে অনি একেবারেই অপরিচিত। মা মানে তার কাছে নিত্য প্রয়োগজনীয় কাজে কাগজে কলমে লেখার জন্য শুধু একটা নাম মাত্র। মা নামক কোন মানব সত্তার অস্তিত্ব তার জীবনে দৃশ্যমান ছিল না। তার কাছে মা মানে এক অজানা মানব সত্তা যা অনির ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। মা মানে তার কাছে এক অস্তিত্বহীন মরীচিকা ধরতে গেলেই শূন্যে মিলিয়ে যাবে।এই অজানা মানব সত্তাকে জানার জন্য মাঝে মাঝে ভাষাহীন নীরব আর্তনাদ গুলো জেগে ওঠে যা সবার সামনে অপ্রকাশিতই থেকে যায়।
অনিকে চুপ থাকতে দেখে শায়লা বেগম বলেন; কিরে কি ভাবছিস?
অনি আহ্লাদী সুরে বলে ; আমি আপনাকে মামনি বলে ডাকি??
শায়লা বেগম অনির কথায় খুশি হয়ে যায়। তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে; আচ্ছা তোর যা ভালো লাগে সেটাই ডাকবি।শুধু আন্টি ডাকবি না।
অনিও মুচকি হেসে মাথা নেড়ে তার কথায় সম্মতি জানায়। শায়লা বেগম চলে গেলে অনি অযু করে নামায পড়ে নেয়। রুম কিছুক্ষণ পাইচারি করে সে বাইরের দিকে যায়। পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে সে। নিচে নেমে ড্রইংরুমে কাউকে দেখতে পায় না সে। খুঁজে খুঁজে রান্নাঘরের দিকে যায়।
সেখানে গিয়ে শায়লা বেগমকে টুকিটাকি কাজ করতে দেখে। তার সাথে ছিলেন আরো দুইজন মহিলা একজন বয়স্ক মহিলার সাথে অল্প বয়সী মেয়ে। মেয়েটাকে অনি বিয়ে বাড়িতে এর আগে একবার দেখেছে তবে জানে না সে কে। বয়স্ক মহিলার সাদামাটা পোশাক হলেও শায়লা বেগমের তার সাথে কথা বলার ভঙ্গি দেখে তাকে কাজের লোক বোঝার উপায় নেই। অল্প বয়সী মেয়েটি এই বয়স্ক মহিলা কে মা বলে সম্বোধন করছে। শায়লা বেগমের অনির উপর নজর পরতেই তিনি অনিকে বলেন;
তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।
অনি শায়লা বেগমের পাশে এসে দাঁড়ালে শায়লা বয়স্ক মহিলাটা কে উদ্দেশ্য করে বলেন; ইনি হলেন সাবিনা আপা। আমার বোনের মত। তুই ওনাকে খালামণি বলে ডাকবি।আর এটা হলো মিলি আপার মেয়ে মিথিলা। রিশার সাথেই একি কলেজে পড়ে। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে অনি।
শায়লা বেগমের কাছে গিয়ে অনি বলে; কি করছো মামনি??
-সবার জন্য বিকেলের নাস্তা বানাচ্ছি। তোর কিছু লাগবে??(শায়লা বেগম)।
-না মামনি কিচ্ছু লাগবে না। আমি কোন হেল্প করব তোমাকে?(অনি)।
শায়লা বেগম কড়া গলায় বলে; একদম না।নতুন বউ তুমি নতুন বউয়ের মত থাকো। এখনি তোমাকে কাজ করতে হবে না বাপু। এখন একটু আনন্দ করবি মজা করবি তা না উনি আসছেন রান্নাঘরে মামানি তোমাকে একটু হেল্প করি বলতে। তুই ঘরে গিয়ে বোস।
অনি অসহায় মুখ করে; রুমে বসে থাকতে খুব বোর হচ্ছি মামনি প্লিয এখানে একটু থাকি প্লিজ।
শায়লা বেগম অনির কথায় না বলতে পারে নি। তার পাশে দাঁড়িয়ে অনি খুব মনোযোগ দিয়ে রান্না করা দেখছিল। শায়লা বেগম অনিকে বলেন; তুই কি খাবি বল? তোর জন্য কি বানাব? তুই তো আবার বাপু বিদেশি মানুষ এসব ওয়েল ফ্রায়েড খাবার খেতে পারবি তো?
-কি যে বলো না তুমি মামনি। দিদা আমাকে মাঝে মাঝেই স্পেশাল কিছু রান্না করে খাওয়াত। একদম পিউর বাঙালি খাবার।জানো মামনি দিদার কাছ থেকে বাঙালি খাবার রান্না শিখেছি।তোমার জন্য কিছু রান্না করি এখন মামনি?? (অনি)।
-এই না একদম না। আজকে না অন্য দিন খাওয়াবি।এখন বল মামনি তোর জন্য কি স্পেশাল রান্না করবে? তোর মামনি বাঙালি রান্নার সাথে চাইনিজ, ফাস্ট ফুড, কন্টিনেন্টাল সব রান্না পারে (শায়লা বেগম কোমড়ে হাত দিয়ে খুন্তি নাড়িয়ে কিছুটা ভাব নিয়ে বলে)
শায়লা বেগমের কথায় অনি ফিক করে হেসে দিয়ে বলে; ওয়াও মামনি তুমি তো গ্রেট।
– আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। এখন বল কি খাবি তুই? কি রান্না করব তোর জন্য?? (শায়লা বেগম)
-না না মামনি।কিচ্ছু করতে হবে না।তুমি যা বানিয়েছ আমিও তাই খাব।(অনি)।
-আমি তোকে বলতে বলেছি।বেশি কথা বলবি না (শায়লা বেগম)।
– আচ্ছা ঠিক আছে বলব কিন্তু একটা শর্ত আছে।(বাম পাশের ভ্রু উঁচিয়ে বলে অনি)।
– পাজি মেয়ে মামনিকে শর্ত দেখাচ্ছিস? (অনির কান ধরে শায়লা বেগম বলেন)।
– উফফ মামনি আমার পুরো কথাটা তো আগে শোন। তুমি যদি আমাকে সবার জন্য কফি বানানোর পারমিশন দাও তাহলে আমি তোমাকে বলব। (অনি)।
-আচ্ছা ঠিক আছে।শুধু কফি আর কিচ্ছু না।(শায়লা বেগম)
অনি শায়লা বেগমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে; ওকে মামনি থ্যাংক ইউ।লাভ ইউ।
শায়লা বেগম অনির কাণ্ডে শব্দ করে হেসে দেন।
-এখন বল কি খাবি তুই?
-উমমম মামনি তাহলে তুমি আমাকে শুধু পাস্তা বানিয়ে দাও তাহলেই হবে। বলেই অনি কাজে লেগে পরে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অনি শায়লা বেগমের সাথে ফ্রি হয়ে গেছে।যা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র শায়লা বেগমের স্নেহ ভালোবাসায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অনির কফি বানানো শেষ হয়ে যায়। এদিকে শায়লা বেগমেরও রান্না শেষ হয়ে যায়। শায়লা বেগম ট্রে তে করিয়ে সাজিয়ে ড্রইং রুমে নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকেই বসে বসে গল্প করছিল। রায়হান সাহেব রিশার সাহায্যে রিশাদকে নিচে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দেন। রিশাদকে বেশ হাসি খুশি লাগছে। তার হাসির পেছনে থাকা কষ্টগুলো সবার অগোচরে সুপ্ত হয়ে আছে।
কফি নিয়ে অনি ড্রইংরুমে যায়।অনিকে দেখে রিশা বলে ওঠে;
ভাবি তুমি কোথায় ছিলে?রুমেও তোমাকে দেখলাম না।
-এইত রিশা রান্না ঘরে ছিলাম মামনির সাথে।(অনি)।
সবার হাতে কফির মগ ধরিয়ে দেয় অনি। রিশাদ কফির মগে চুমুক দিয়ে শায়লা বেগম বলেন; কফিটা দারুণ বানিয়েছ তুমি মা। রিশাদের সাথে রিশা রায়হান সাহেব ও তাল মেলান।
শায়লা বেগম হেসে বলেন; কফিটা তো আমি বানাইনি।কফি বানিয়েছে আমার বউমা। দেখতে হবে না কার ছেলের বউ। কফিতো টেস্ট হবেই।
অনি কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। চারদিকে চোখ বুলিয়ে শায়লা বেগমকে বলেন;
মিথিলা আর খালামনি কোথায় মামনি??
শায়লা বেগমের এতক্ষণে হুশ হয়। তিনি বলেন; রান্নাঘরে আমার সাথেই তো ছিল সাবিনা আপা বিশ্রাম নিচ্ছে।কিন্তু মিথিলা কোথায় গেল? রিশা একটু ওর ঘরে গিয়ে দেখ তো মা কোথায় গেল মেয়েটা?
অনি বলে ওঠে; মামনি রিশা থাক আমি যাচ্ছি। তুমি আমাকে বলে দাও মিথিলার রুমটা কোন দিকে?
-আচ্ছা যা। সিঁড়ির ডান দিকে যেয়ে দ্বিতীয় রুমটাই মিথিলার রুম।
অনি কফির মগটা হাতে নিয়ে মিথিলার ঘরের দিকে যায়। দরজায় গিয়ে নক করে অনি।কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পায় না। তাই সে দরজাটা হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরের দিকে উঁকি দিতেই দেখতে পায় মিথিলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে সে।
অনি মিথিলার নাম ধরে ডাকতেই মিথিলা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। সে অনিকে বলে;
একি আপনি এখানে? কোন দরকার কি? আমাকে ডাকলেই হত কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল?
-না না সেরকম কিছুটা আমি তো তোমাকে বলতে এসেছিলাম ড্রইং রুমে সবাই তোমাকে ডাকছে। তুমি নেই তাই তোমার জন্য কফি নিয়ে আসলাম।এ বাড়িতে তো আসার পর থেকে তোমার সাথে সেরকমভাবে কথাই হয় নি তাই আর কি?(অনি)।
-ওহ আচ্ছা। আসলে আমার একটু মাথা ব্যথা করছিল তাই আরকি রুমে এসেছিলাম।(মিথিলা)
-তোমার মাথা ব্যথা করছে তাহলে তুমি কফি টা খেয়ে নাও একদম মাথা ব্যথা সেড়ে যাবে।(অনি)
অনি মিথিলার হাতে কফির মগটা দিয়ে তার দিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলায়। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর, পাতলা গড়নের, চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর। যে কেই তার চোখের মায়ায় হারিয়ে যেতে পারে। তবে অনি এই চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে তার ভেতরে প্রবাহমান এক অজানা দুঃখের আভাস পায় কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছে না। তাই ব্যাপার টা সাময়িক ভাবে সে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে।
আচমকাই মিথিলা শান্ত কণ্ঠে বলে; আমি আপনাকে কি বলে ডাকব?
অনি এ কথায় কিছুটা অবাক হয়। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অনির কোন জবাব না পেয়ে মিথিলা বলে;
আসলে আমরা তো এ বাড়ির আশ্রিতা। তাই বলছিলাম আপনি যদি কিছু মনে করেন।
অনি মিথিলার কথার কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। সে মিথিলার সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না। তাই সে মিথিলার কথার আগাগোড়া কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। সে মিথিলাকে বলে; তোমার যা ভালো লাগে তুমি তাই ডেক আমাকে। তুমি আর রিশা তো সমবয়সী তাইনা আর মামনিও তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে।তুমি আমাকে ভাবি বলেই ডাকতে পার।
মিথিলা নিজের অজান্তেই আওড়ায়; ভাবী….
কথাটা অনির কান অবধি পৌঁছায় আবার পৌঁছায় না।
সে মিথিলা কে বলে; মিথিলা তুমি চলো আমার সাথে মামনি তোমাকে খুঁজছে।
– সরি ভাবী আপনি যান। আমি একটু রেস্ট নিব। মণির সাথে আমি পরে কথা বলে নেব।(মিথিলা)
-আচ্ছা। তুমি তাহলে রেস্ট নাও মাথায় একটু মলম লাগিয়ে নিও। আমি আসছি। (অনি)।
অনি বেরিয়ে যেতেই মিথিলা ধুপ করে ফ্লোরে বসে পরে। তার নীরব অশ্রুগুলো গাল বেয়ে ফ্লোরে গড়িয়ে পরে। আর্তনাদ গুলো বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। ৫ বছর আগে থেকেই মিথিলা এই অসহ্যকর যন্ত্রণাগুলোকে আকড়ে বেঁচে আসে জানে না কবে মুক্তি পাবে সে। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে লুটিয়ে পরে মিথিলা। অশ্রুগুলো আজ তার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।
সাবিনা বেগম রুমে এসে মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখে তার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি তাড়াতাড়ি রুমের ভেতর ঢুকে মেয়েকে দুহাতে বুকের সাথে চেপে ধরে। মিথিলা মায়ের বুকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরায়। এ বাড়িতে একমাত্র সাবিনা বেগমই তার এই বেদনার সাক্ষী। বিগত পাঁচ বছর ধরে তিনি তার মেয়ের এই কষ্টগুলো কে মুখ বুঁজে সহ্য করছেন। মেয়ের সাথে তার চোখ দিয়েও অশ্রু গড়ায়। মিথিলাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সাবিনা বেগমের জানা নেই। কাঁদতে কাঁদতে মিথিলা তার বুকেই এক সময় ঘুমিয়ে পরে। সাবিনা বেগম তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়ের পাশে বসে তিনি নীরবে অশ্রু ঝরান।
চলবে………..