অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_১২

0
6925

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_১২

মিথিলার ঘর থেকে বেরিয়ে অনি ড্রইং রুমের দিকে যায়। মিথিলা মেয়েটাকে অনির কিছটা অস্বাভাবিক লাগে। মেয়েটার চোখে মুখে অস্পষ্ট দুঃখের ছাপ। মিথিলা সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনির বেড়ে যায়। তবে এই মূহুর্তে সে তা স্থগিত রেখে ড্রইং রুমের দিকে যায়।

শায়লা বেগম অনিকে নিজের পাশে বসিয়ে পাস্তার বাটিটা হাতে নিয়ে নিজ হাতে তার মুখে তুলে দেয়। অনি শায়লা বেগমের কাজে আবেগপ্রবণ হয়ে পরে। খুশির কয়েক ফোটা অশ্রু বার বার উঁকি দিতে চায়। অনি কঠোর ভাবে অশ্রুগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। শায়লা বেগম তাকে পরম যত্নের সাথে খাইয়ে দেন। তার এ ধরনের কাজগুলো অনিকে এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা অনুভব করে।শায়লা বেগম নিজেও যেন অনিকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালোবাসা দেয়ার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। বোধ হয় অনির জীবনের কথা গুলো তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন। তাই হয়ত তাকে সব সময় ভালোবাসায় মুড়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

অনি মনে মনে ভাবে সময়টা এখানে থেমে গেলেও পারতো। এই মানুষটা আরো আগে তার জীবনে এলে তার জীবনটাও ভালোবাসায় মুড়ে থাকত। এভাবেই সে তার জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় শুধু মাত্র এই মানুষটার কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। অনির খুব স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে ভালোবাসা পাওয়ার লোভে। তবে সে খুব ভালো করেই জানে এই অপ্রত্যাশিত বিয়ে, পরিবার,সংসার ছেড়ে তাকে একদিন চলে যেতে হবে কেননা রিশাদের জীবনে অদ্রি ব্যতীত অন্য কারো জায়গা হয়ত নেই। অনি নিজেও তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার ভালোবাসার মানুষকে নিজের বলে কখনোই গণ্য করে না।

হঠাৎ রিশাদের কথায় অনি ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে।

-দেখেছিস বুড়ি আম্মু তার অসুস্থ ছেলে ফেলে তার ছেলের বউকে নিয়ে ব্যস্ত। ছেলের বউকে পেয়ে ছেলেই পর হয়ে গেছে। বলেই রিশাদ অসহায় ভাব দেখায়।

রিশা রিশাদের সাথে তাল মিলিয়ে বলে; হ্যা রে ভাইয়া ঠিকি বলেছিস। তুই তো আমাকে বলিস যে আমাকে নাকি কুড়িয়ে আনছে। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তোকেও কুড়িয়ে আনছে। বেচারা তোর তো কপাল টাই খারাপ রে ভাইয়া। কি হবে তোর এখন। এ জীবন রেখে লাভ কি তোর বল?? বলেই রিশা শব্দ করে হেসে দেয়।

রিশার সাথে সবাই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে। রিশাদ নিজেই বেশ জব্দ হয়ে রিশার মাথায় চাটি মারে।

রিশা চিল্লিয়ে বলে; তুই আবার আমাকে মারলি?? এক হাত তো ভেঙেই রেখেছিস আর এক বার যদি আমাকে মারিস তোর ওই হাতটাও ভেঙে গলার সাথে ঝুলিয়ে দেব হুহ। বলেই রিশা রিশাদ কে ভেংচি কাটে।

– আশি বছরের বুড়ি নাকি আমার হাত ভেঙে দিব। আর কত কি শুনাবি রে বইন তুই। এবার একটু চেপে যা।

রিশাদের কথায় রিশা আরো বেশি রেগে গিয়ে তার দিকে তেড়ে আসে।

শায়লা বেগম রিশা রিশাদ কে ঝাড়ি দিয়ে বলেন; তোরা মানুষ হবি না। একজনকে দেখো হাত পা ভেঙে গলার সাথে ঝুলে আছে তবুও মশকরা বন্ধ হয় নি। আর আরেকজন অসুস্থ ভাই এর দিকে তেড়ে যাচ্ছে তাকে মারার জন্য। তোদের জন্য আমি একটুও শান্তি পাইনা। তোরা কি বড় হবি না নাকি?? আমাকে একটু শান্তি দে।

রাইয়ান সাহেব শায়লা বেগমের কথার মধ্যে বলে; উফফফ শায়লা ছেলে মেয়েদেরকে একটু মজা করতেই দিবে না নাকি। খালি ক্যাচর ম্যাচর।

শায়লা বেগম অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলেন; কিহহহহ আমি ক্যাচর ম্যাচর করি। আমি দেখে তোমার সংসার করছি অন্য কেউ হলে তো এতদিনে রাস্তার মোড়ে তোমাদেরকে ফেলে দিয়ে চলে যেত।

-রিল্যাক্স আম্মু। এটা তোমার কমন ডায়লগ। জন্মের পর থেকে আমি শুনে আসতেছি। দেশের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তবুও তোমার ডায়লগ পরিবর্তন হচ্ছে না। (রিশাদ)

-শয়তান ছেলে, পাজি বজ্জাত কোথাকার মায়ের সাথে ফাজলামি করিস। দিব এক চড় দুনিয়াদারি ভুলে যাবি।(শায়লা বেগম)

রিশাদের কথায় অনি মিটমিট করে হাসতে থাকলেও বাকি সবাই শব্দ করে হেসে ওঠে। শায়লা বেগম রেগে মেগে আগুন হয়ে যায়।

– থাকব না তোদের সংসারে আমি। যেদিকে মন চায় আমি চলে যাব। তবুও তোদের সাথে থাকব না আমি। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। এদের জন্য আমি খেটে খেটে মরি আর আমাকে নিয়েই মজা করে। ন্যাকা কান্না করতে করতে বলেন শায়লা বেগম।

রিশাদ বলে; দেশে সরকারের পরিবর্তন হলেও এই সরকারের পরিবর্তন হবে না। তাইনা বাবা।

রায়হান সাহেব রিশাদের কথায় সহমত প্রকাশ করলে অনি হু হা করে হাসতে থাকে। সবাই একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে হাসতে থাকে। শায়লা বেগমও তাদের সাথে হাসিতে মেতে ওঠে। এই হাসিখুশি পরিবারই শায়লা জীবনের সবচেয়ে পরম প্রাপ্তি। তার চোখের কোণে খুশির অশ্রুর আগমন ঘটে। আজ নিজেকে বড্ড সুখি মনে হচ্ছে তার। ক জনের কপালে এম্ন সুখ মেলে। শায়লা বেগমের মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়।

একই ছাদের তলায় দুটি ভিন্ন গল্প। কেউ পরম প্রাপ্তির সুখে অশ্রুপাত করছে তো কেউ না পাওয়ার অসুখে অশ্রুপাত করছে। পাল্লার এক পাশটা সুখের ভারে যতটা নুইয়ে পরছে তো অপর পাশটা সুখহীনতায় ঠিক ততোটাই উপরের দিকে উঠছে। জীবনে খুবই অদ্ভুত। হাসি খুশি পাওয়া না পাওয়ার সংমিশ্রণেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে কিছু কিছু মানুষের অপ্রাপ্তির তালিকার কাছে প্রাপ্তির তালিকা অতিব ক্ষুদ্র হলেও এতেই যেন তারা এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা পাওয়ার সুখানুভূতি লাভ করে।

রাতের খাওয়া শেষ করে অনি রিশাদকে নিয়ে রুমে আসে। রিশাদকে হুইলচেয়ার থেকে বিছানায় হেলান দিয়ে শুইয়ে দেয় অনি। রিশাদের প্রতিটি স্পর্শ অনির চারপাশে অস্বস্তিবোধের ভিড় জমায়। সংকোচ, অস্বস্তিবোধ দূরে ঠেলে অনি তার দায়িত্বগুলো পালন করে যাচ্ছে। সে নিজেকে রিশাদের জীবনে কিছু দিনের মেহমান হিসেবে মনে করে। অনি রিশাদের এই গল্পটার একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে অদ্রির আগমনে। অনি সেই দিনটার অপেক্ষাতেই আছে। এক অজানা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।

রিশাদ একজন বাস্তবতায় বিশ্বাসী মানুষ। অনির জীবনের সাথে নিজের জীবনটা জড়িয়ে ফেলা এই মূহুর্তে তার কাছে সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনে হচ্ছে যা শোধরানোর কোন উপাউ সে দেখতে পাচ্ছে না। দীর্ঘ পাচ বছরের সম্পর্ককে মাটি চাপা দিয়ে কাগজে কলমে একটা নতুন সম্পর্কে সে জড়িয়েছে ঠিকি তবে তা মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। বাবা মায়ের সামনে হাসি খুশি থাকলেও দিনশেষে তার সবটা জুড়ে থাকে শূন্যতার হাহাকার যার সাথে যুক্ত হয়েছে অনিকে বিয়ে করার গ্লানিবোধ। অনির যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে প্রকৃত পক্ষে স্ত্রীর মর্যাদা সে তাকে দিতে পারছে না। সবকিছু মিলিয়ে রিশাদের মস্তিষ্ক কাজ করছে না।

অনি রিশাদকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে রিশাদের পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোফার কাছে যেতে উদ্যত হয়।

রিশাদ বলে ওঠে; একি আপনি বালিশ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? ঘুমাবেন না?

অনি পিছনে ফিরে উত্তর দেয়; হ্যা ঘুমাব। আপনি বিছানায় ঘুমান আমি সোফায় শুয়ে পরছি।

রিশাদ কিছু একটা ভেবে উত্তর দেয়; আপনি চাইলে এখানে ঘুমাতে পারেন যদি আপনার কোন প্রব্লেম না থাকে।এমনিতেও বেডটা বড় ই আছে। আমার কোন প্রবলেম হবে না।

-ইটস ওকে। আপনি ঘুমান আমার সোফায় ঘুমাতে কোন প্রবলেম নেই।(অনি)

রিশাদ আর কথা বাড়ায় না। দায়িত্ববোধ থেকে সে অনিকে বিছানায় ঘুমানোর কথা বললেও তার সাথে এক বিছানায় থাকার কথা ভাবতেই রিশাদের মনে মস্তিষ্কে সংকোচবোধ এসে ভিড় জমায়। তবে অনি না বলায় সে মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পায়। অনি লাইটটা অফ করে দিয়ে সোফায় শুয়ে পরে।

রাতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে অনি রিশাদের চোখের পাতা যেন এক না হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাদের কারো চোখেই ঘুম নেই। রিশাদ তার অতীত স্মৃতিকাতরতায় ভুগছে তো অপরদিকে অনি অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত।তার জীবনে ক্ষণিকের জন্য বসন্তের হাওয়ার মত ভালোবাসার পরশ এসেছে তা পুরোপুরিভাবে অনুভব করার পূর্বেই যেন হারিয়ে যাবে। অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু হবে না। কেননা এসব তার কোনদিনই পাওয়ার কথা ছিল না। যেটুকু পেয়েছে তাতেই সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছে।

অনন্যময়ী রিশাদের সাথে আরো একজোড়া চোখ রাত জাগছে। দুচোখ বুজলেই অবচেতন মনে ভেসে ওঠা অবয়বকে রং তুলির ছোঁয়ায় ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলায় রত আছে। বাইরে তুষারপাতের সাথে পাল্লা দিয়ে তার হাতের রঙ ছোঁয়ানো তুলি চলছে। সম্পূর্ণ মুখাবয়ব ফুটিয়ে উঠতেই মুচকি হেসে আওড়ায়; মিষ্টি মায়াবতী।

চলবে…………

আসসালামু আলাইকুম?
এটা আমার প্রথম গল্প। জানিনা কতোটা ভালো গুছিয়ে লিখতে পারছি। ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটা কেমন লাগলো প্লিজ জানাবেন।
ধন্যবাদ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here