অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৫৭

0
5566

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৫৭

গোধূলি বেলার শেষ ভাগে রাশি রাশি আলোর ছটা ছড়ানো সূর্য কিছুটা নেতিয়ে পড়েছে। লালচে কমলা রঙের সূর্যটাকে দূর আকাশে ডুবে যেতে দেখাচ্ছে গাছের ফাঁক গুলোর মধ্যে দিয়ে। আকাশে উড়ন্ত সব পাখিগুলো দল বেঁধ নীড়ে ফেরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তো অন্যদিকে নিশাচরেরা খাবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। পড়ন্ত বিকেলে পার্কের পুকুরে জলে দুজন মানব মানবীর লম্বা ছায়া দেখা যাচ্ছে।

রিশা আর রাফি একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। শীতল অভিমানে গড়ে ওঠা বিশাল বরফ পাহাড় গলতে শুরু করেছে ভালোবাসার তীব্র উত্তাপে। বিচ্ছেদ ব্যবধানের অনলে পুড়তে থাকা দুটো হৃদয় আজ বড্ড ক্লান্ত। হয়েই যাক না আজ এই বিষাদময় বিচ্ছেদের অবসান।

উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল রাফির, চোখেটা ভীষণ লাল হয়ে আছে। ভাজ পড়ে কুঁচকে যাওয়া শার্ট; ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে রিশা বুঝতে পারে কাল রাত থেকে এই একই শার্ট গায়ে দিয়ে আছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রিশার দিকে। যেন বহুকাল পরে তার মনের মানুষের দেখা মিলেছে। রিশার দৃষ্টি ক্রমশ নমনীয় হয়ে আসছে।রাফির অবচেতন মন এই দৃষ্টির ভাবার্থ মানতে চাইলেও মস্তিষ্ক যেন তা মানতে নারাজ। তাইতো সে অসহায় চাহনি নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিশার দিকে।

বিচ্ছেদে পাওয়া প্রতিক্ষণের মানসিক যন্ত্রণা আর রাশি রাশি বেদনার চেয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে একটা সুযোগ দেয়া কি শ্রেয় নয়?অনির কথাগুলোর মাধ্যমে বার বার এই একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল রিশার মাথায়। অবশেষে ভালোবাসার কাছেই পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয় রিশাকে। এ পরাজয়ে নেই কোন আত্মকষ্ট; রয়েছে শুধু ভালোবাসার সুখানুভূতিকে ঝুলিতে ভরে নিয়ে এক সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

এক বছরের বিচ্ছেদ টা যেন মনে হচ্ছিল এক যুগের বিচ্ছেদ। প্রেমের সম্পর্কের সূচনালগ্নে রাফি যেমন নতজানু হয়ে তার মায়াবতীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছিল ঠিক তেমনি ভাবে এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ এগিয়ে দিয়ে তার সামনে প্রেম নিবেদন করে রিশা। রিশার কাছ থেকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন কিছু প্রত্যাশা করা রাফির জন্য কল্পনাতীত ছিল। নিশ্চিতভাবেই জীবনের মূহুর্ত হিসেবে চিরকাল রাফির অন্তরে অক্ষত থাকবে। অতি সুখে যেন সে তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কখনো কখনো মানুষ তার কল্পনার বাহিরের কিছু দেখে ফেললে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। রাফির ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটছে। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে রাফির কাছে।

বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারায় রাফির অশ্রুগুলো যেন প্রতিযোগিতায় নেমে গেছে বেরিয়ে আসার। এ অশ্রুতে বিষাদ নেই ; বরং এতে তো আরও সকল বিষাদ ক্ষয় হয়ে বিলীন হয়ে যাবে।

রাফি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না।ধপ করে হাঁটু উপর ভর করে রিশার সামনে বসে পড়ে। কাঁপাকাঁপা হাতে রিশার হাত দুটো আঁকড়ে ধরার জন্য বাড়িয়ে দেয়।

রিশার কাছে পুরো ঘটনাটা কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রাফি সারপ্রাইজড হবে তা সে জানতো তবে এতটা বেশি তা সে কিছুতেই কল্পনা করেনি। অনুভূতিগুলো আজ প্রকাশ করতে বেশ কসরত করতে হচ্ছে রিশাকে।

রাফি রিশার দুহাত নিজের মুঠোয় বন্দী করে নিয়ে তাতে ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে দেয়। নীরবতার মাঝেও যেন আজ স্পষ্টভাবেই তাদের মাঝে ভাবের আদান প্রদান বেশ সাবলীলভাবে ঘটে যাচ্ছে।

রাফির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন রিশার চোখে জল চলে এসেছে সে টেরই পায়নি। রাফির কান্নায় আজ সুখ ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারছে না। একটা মানুষ কাউকে কতটা ভালোবাসলে এভাবে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত করতে পারে।এরচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় একজন প্রেমিকার চেয়ে আর কি হতে পারে।

রাফি অশ্রুসিক্ত নয়নে রিশার দিকে তাকায়। রিশার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুগুলো সযত্নে মুছে দিয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে;

–আর কখনো তোমার অশ্রুর কারণ হতে চাইনা শুধু তোমার হাসি মুখের কারণ হতে চাই। তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। হারিয়ে তোমার গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও প্রিয়।আজকে আমি কতটা খুশি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না। খুব ভালোবাসি। কখনো আর ছেড়ে যাবে না তো!কথা দাও আমাকে কখনো আমাকে একা ফেলে যাবে না। যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক না কেন আমাকে শাস্তি দেবে তবুও প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। তোমাকে ছাড়া জীবনটা কতটা কঠিন তা শুধু আমিই জানি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যায় ভালো থাকা সম্ভব নয় প্রিয়।(রাফি)

–তোমাকে ছাড়া কি আমি ভালো থাকতে পেরেছি। প্রতিটা মূহুর্তে তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি। অনেক বেশি শাস্তি দিয়ে ফেলেছি তোমাকে। মাফ করে দিও আমাকে। তোমাকে ছাড়ার কোন প্রশ্নই আসেনা। খুব বেশি ভালোবাসি তোমাকে। বলেই রিশা রাফির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাফির শুন্য বুকটা আজ যেন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য হৃদয়টা খাঁখাঁ করছিল। প্রশান্তিময় সুখানুভূতি গুলো ছন্দাকারে অন্তর জুড়ে ঢেউ খেলে যায়। তাদের এই ভালোবাসার সাক্ষী হয় পড়ন্ত বিকেলের গোধূলি লগ্ন,অস্তপ্রায় সূর্য, আকাশের সব নাম না জানা পাখিগুলো।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই রিশা আর রাফির। নিভৃতে একসাথে সময় কাটায় দুজন। অতঃপর সন্ধ্যা হয়ে গেলে রাফি নিজে রিশাকে বাসায় রেখে আসে। রিশা একটু ইতস্ততবোধ করছিল তবে রাফি তাকে আস্বস্ত করে কিছু হবে না। রিশা ভাবছিল বাসায় কেউ দেখে ফেললে হয়তো কিছু জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই সে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থেকে নেমে যায়।

বহমান সময়ের সাথে সাথে রাফি আর রিশার সম্পর্ক আরো বেশি দৃঢ় হয়ে যায়। রিশার ভালো থাকার কথা ভেবে অনিও আর এই বিষয়ে বিশেষ কোন আপত্তি করেনা। তবে রাফিকে একবারেই চেনে না কেউ। তাই রাফি বাস্তবে কেমন সম্পর্কে কারো কোন ধারণা নেই। এই কারণেই সে ভাবছিল বিষয়টা নিয়ে রিশাদের সাথে আলোচনা করবে। তবে রিশাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে কথাটা জানার পর তা নিয়েই ভাবছে অনি।

রাতে সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করে। অনি হাতের কাজগুলো সেরে রুমে চলে যায়।রিশাদ রুমে বস ল্যাপটপে কিছু একটা দেখছিল। অনিকে দেখে সে ল্যাপটপটা সরিয়ে সাইড টেবিলে রাখে। অনি দরজাটা লাগিয়ে রিশাদের পাশে বসে পড়ে। অনিকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে যা রিশাদের নজর এড়ায় নি।

কিছুটা সময় নিয়ে রিশাদকে অনি রিশা রাফির ব্যাপারে সবটা খুলে বলে। রিশা আর রাফির সম্পর্কের শুরু থেকে আজ অবধি সবটাই অনি রিশাদের সামনে তুলে ধরে। রিশাদ সবটা শুনে পুরোপুরিভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়।

এমন কিছুর জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। এতদিনে সে বিন্দুমাত্রও টের পায়নি। কি অদ্ভুত ব্যাপার। তার ছোট্ট রিশা যে এখনো একটুতেই তার দিকে তেড়ে আসে মারার জন্য সে কবে এতটা বড় হয়ে গেল। ভাবতেই পারছে না। রিশাদ কিছুক্ষণ নীরব থাকে। কেমন এক বিশৃঙ্খল ভাব মনের মাঝে। কিছুটা অশান্তিবোধ হচ্ছে তার।

অনি বুঝতে পারছে না রিশাদের মনের মধ্যে কি চলছে। তাই সে রিশাদের কিছুটা কাছে গিয়ে তার হাতে হাত রাখে। রিশাদ অনির দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে;

–আমাদের ছোট্ট রিশা কবে এত বড় হয়ে গেল অনন্যময়ী বুঝতেই পারলাম না। (রিশাদ)

অনির কাছে এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। সে বুঝতে পারছে না রিশাদকে কি বলবে।

–জানো রিশাদ রাফির সাথে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবার পর আমি রিশাকে যতটা খুশি থাকতে দেখেছি এ বাড়িতে আসার পর থেকে এর আগে কখনোই দেখিনি। আমার শুধু একটাই চিন্তা ভবিষ্যতেও যেন সে ভালো থাকে রাফির সাথে। যফি ওরা দুজন একসাথে ভালো থাকে তাহলে এতে দোষের কি বলো। (অনি)

–হ্যা ঠিকি বলেছো।আমার বোনটার ভালো থাকাউ আমার কাছে সব। ভালোবাসার মানুষটাকে যদি সঠিক হয় তবে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের চার হাত এক করে দেব। আমি জানি ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টকর। শেষ কথাটা অনির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে রিশাদ।

অনি কোন প্রতি উত্তর করে না। অনিকে নীরব থাকতে দেখে রিশাদ পুনরায় বলে;

–হারাম সম্পর্কগুলো কখনোই সুখকর হয় না। ক্ষণিকের জন্য আনন্দ দিলেও তা দীর্ঘস্থায়ী কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি যে ভুলটা করেছি আমি চাইনা আমার বোনটাও সেই ভুলই করুক। যদি সবাই সম্মতি দেয় তবে খুব দ্রুত তাদের চার হাত এক করে দিয়ে হালাল করে দিতে চাই। কি বলো তুমি?(রিশাদ)

–তুমি যা ভালো মনে করো। তোমার সব সিদ্ধান্তেই আমি তোমার পাশে আছি। কারণ আমি জানি তুমি কখনোই রিশার খারাপ চাইতে পারো না। বলেই অনি মুচকি হাসে।

অনি আর রিশাদ আরো কিছুক্ষণ টুক টাক কথা বলে। কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে যায়। অনি রিশাদ ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন রিশাকে না জানিয়েই রাফিকে মিট করার জন্য বলে রিশাদ। রাফি রিশাদের কথায় রাজি হয়ে যায়।রাজি না হয়ে কোন উপায়ও ছিল না রাফির কাছে। একদিন না একদিন তাকে এই সময়ের সম্মুখীন হতেই হতো।

রাফি নিঃসন্দেহে রিশার জন্য একজন যোগ্য পাত্র।যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও বাস্তবে বিশ্বাসী সে। কোনদিক থেকে তার কোন কমতি নেই। দেখতেও যেমন সুদর্শন ঠিক তেমনি নামডাক তার ব্যবসার জগতে। নিত্যদিনই খবরের কাগজগুলোতে তার নাম দেখা যায়। তবে প্রেমিকার ভাই বা অভিভাবক এর সাথে যখন দেখা করার পালা আসে তখন প্রত্যেক প্রেমিকই কেমন যেন ভীত হয়ে পড়ে। এক বুক শঙ্কা আর কিছুটা নার্ভাসনেস নিয়ে রাফি দেখা করতে যায় রিশাদের সঙ্গে।

কেমন ভয় ভয় লাগছে তার। রিশাকে প্রপোজ করতেও সম্ভবত এতটা ভয় পায়নি সে। রিশাদেফ দেয়া এড্রেসে পৌঁছে যায় রাফি। রেস্টুরেন্টে ঢুকে বেশ খোলামেলা একটা টেবিলে বসে। একটু আগেই চলে এসেছে সে। সে চায়নি দেরিতে গিয়ে রিশাদের সামনে নিজের ফার্স্ট ইম্প্রেশনটা খারাপ করতে। আর রিশাদের রাগ সম্পর্কে আগে থেকেই কিছুটা ধারণা আছে রাফির। সেদিন অনিদের বাসায় যখন রেহানা বেগম হিমাদ্রী আর অনির বিয়ের কথা বলেছিল তখনই সে রিশাদের রাগটা দেখে নিয়েছিল।

ঘটনাটার কথা মনে করে রাফি দু তিনবার দোয়া ইউনুস পড়ে,আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নেয়। রাফি দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় রিশাদ ভেতরে প্রবেশ করছে। রাফি সোজা হয়ে বসে পড়ে।

রিশাদ এসে বসতেই রাফি বিনীত স্বরে সালাম জানায়। রিশাদ মুচকি হেসে রাফির সালামের জবাব দেয়। রাফির অবস্থাটা সে বুঝতে পারছে। কেননা সে নিজেও এই রকম সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে গেছে। অদ্রির বাবার সামনে সেও একদিন ঠিক এভাবেই বসে ছিল। সে যাই হোক আগের কথাগুলো ভেবে সে বিন্দু মাত্রও সময় নষ্ট করতে চায় না।

রাফির সাথে পরিচিত হয়ে রিশাদের বেশ ভালো লাগে। সে খোঁজখবর নিয়েও দেখেছে ছেলে হিসেবে রিশাদ বেশ ভালো। তাই সে ভনিতা না করে সরাসরি রাফির সামনে রিশাকে বিয়ে করার প্রস্তব দেয় কেননা সে চায়না হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে থাকুক তার বোন।ভাই হিসেবে বোনকে হেদায়েতের পথে আনা তার একান্ত দায়িত্ব।

রিশাদের কথায় রাফি কিছুটা হকচকিয়ে যায়। তবে রিশাদের প্রস্তাবটাও রাফির বেশ মনে ধরেছে। কে না চাইবে ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে নিতে। তাই সে বিনা বাক্য ব্যয়ে রিশাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। বরং সে যেন বেশিই খুশি রিশাদের কথায়।

রাফি এত দ্রুত রাজি হবে তা ভাবতে পারেনি রিশাদ। সে হয়তো ভেবেছিল রাফি কিছুটা সময় চাইবে। তবে রাফির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দেখতে পেরে সে বুঝতে পারে কতটা ভালোবাসে সে রিশাকে। তাই রিশাদ শুক্রবার দিন রাফিকে তার পরিবার নিয়ে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ দেয়।

রাফির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় রিশাদের। তারা দুজনেই প্রায় সম বয়সী তাই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ফ্রি হয়ে যায় রিশাদের সাথে। রিশাদকে যতটা রাগী ও গম্ভীর ভেবেছিল আসলে সে সেরকম না। রিশাদকে মানুষ হিসেবে বেশ ভালো লাগে রাফির।

সৌজন্যতার খাতিরে এক কাপ কফি খেয়ে আজকের পরিচিতি পর্বের ইতি টানে রাফি ও রিশাদ। রিশাদ সেখান থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় আর রাফি তার নিজের গন্ত্যবের দিকে যায়।

রিশাদ গাড়িতে যেতে যেতে অনিকে ফোন করে সবটা জানিয়ে দেয়। অনি উত্তেজনায় ও খুশিতে যেন ঠিকমতো কথাই বলতে পারছে না। সে শুধু কল্পনায় ভাবছে রিশার হাসিমুখের কথাটা। রিশা কতটা খুশি হবে জানতে পারলে।

তবে রিশাদ অনিকে নিষেধ করে দেয় সে যেন কিছুই না জানায় রিশাকে। রিশা রিশাদের কাছ থেকে রাফির ব্যাপারটা গোপন করার জন্য সে নিজের স্টাইলে ওকে একটু হ্যারাস করতে চায়। যত বড়ই হোক না কেন তাদের ছেলে মানুষি গুলো কোনদিনও যাবার নয়।

রিশাদ রাফিকেও নিষেধ করে যেন আজকের ব্যাপারে বা তাদের বিয়ের ব্যাপারে কোন কিছু না জানায় রিশাকে। তাদের মধ্যে আগেও যেমন যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল এখনই যেন তাই থাকে। শুধু যেদিন রিশাকে দেখতে আসবে তার আগের দিন থেকে রাফি যেন রিশার সাথে যোগাযোগ টা বন্ধ করে দেয়।

রিশাদের প্রস্তাবটা মেনে নিতে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায় রাফি। তবে সে রিশাদের কথায় রাজি হয়ে যায়। যদি আবার বিয়েটাই না দেয় এই ভয়ে। কিন্তু তার চেয়ে আরো একটা বড় ভয়ের নাম হলো রিশা। রিশা যদি জানতে পারে রাফি এসিব বিষয়ে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে তবে তার আর রক্ষে নেই ভাবতেই কেমন যেন পানি পিপাসা পায় রাফির। গলা শুকিয়ে আসে।

অতঃপর চলে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। যার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল রিশাদ, অনি, রাফি। তবে যার জন্য এত আয়োজন সেই কিছু জানে না। সেই দুশ্চিন্তায় মরছে। রাফির সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে রিশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে পুনরায় রাফিকে ভুল বুঝছে। বার বার সে তার মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছে রাফি এমনটা করতে পারে না।

অনিকে বলেও আজ কোন কাজ হচ্ছে না। আর রিশার তো সাহসই নেই তার ভাইকে কিছু বলার। তার ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে তার বেশ ভালোই ধারণা আছে। হুট করেই শুক্রবার দিন সকাল বেলা রিশাদ রিশাকে জানায় তার বন্ধু ও বন্ধুর পরিবার রিশাকে দেখতে আসছে। আর রিশা যেন যথাসময়ে রেডি হয়ে থাকে।

রিশা অনেক বার বলে সে বিয়ে করতে চায়না। তবে কেন করতে চায়না তার উত্তর নেই তার কাছে। পড়াশোনার দোহায় দিয়েও কাজ হয়না। কেননা রিশাদ বলে বিয়ের পরেও রিশাকে পড়াশোনা করতে দেবে পাত্রপক্ষ। কোন কূল কিনারা না পেয়ে অনির শরণাপন্ন হয় রিশা। অনি পড়েছে দোটানার মধ্যে। রিশাকে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে রাজি করায় অনি। রিশাকে সে বলে আজকের দিনটা কোনভাবে পার করতে। দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয় না। রিশাও কিছুটা আশার আলো দেখতে পায়। তবে রাফির সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় সে কিছুটা হতাশ হয়।

বিকেলের দিকে রাফি তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাজির হয়। রাফির পরিবার বলতে শুধু তার বাবা। তার জীবনে মায়ের ভূমিকায় একটা বড় অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে রেহানা বেগম। রেহানা বেগম আগের ঘটনাটার জন্য কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিলেন। তবে রাফির কথা ভেবে তিনি নাও করতে পারছিলেন না। রাফির জীবনে রেহানা বেগমের ভূমিকার কথা জানতে পারার পর রিশাদ নিজে রেহানা বেগমকে আসার জন্য অনুরোধ করেন। রেহানা বেগমের পুরো পরিবারকে আসার জন্য অনুরোধ করে সে। সেদিনের মিসবিহেভ করার জন্য সে বিনয়ের সাথে রেহানা বেগমের কাছে ক্ষমা চায়।

রাফির কথা ভেবে রেহানা বেগম আর রিশাদকে না করতে পারেন না। রাফি আর হিমাদ্রীকে কখনো আলাদা করে দেখেন নি। সবাই রিশাদদের বাড়িতে আসলেও হিমাদ্রীকে জোর করেও কোন কাজ হয়নি। সে চায়নি অনন্যময়ীর মুখোমুখি হতে। না পাওয়া ভালোবাসার মানুষটার মুখোমুখি হওয়া কতটা কষ্টকর তা হয়তো কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে রাফির জোরাজুরিতে হিমাদ্রী তাকে কথা দেয় আজ না গেলেও সে অবশ্যই রাফির বিয়েতে যাবে।

জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন সে তার ভাই সমতুল্য বন্ধুকে পাশে পাবে না ভাবতেই রাফির কিছুটা খারাপ লাগে। তবে হিমাদ্রীর অবস্থাটাও সে বুঝতে পারছে। তাই সে আর জোর করে না। রাফি তাকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়েছে। সেদিনের ঘটনাটার পর থেকেই হিমাদ্রী কেমন সবার থেকে দূরে দূরে থাকে। নিজেকে যেন সে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছে। তার কারণ কারো কাছেই অজানা নয়।

অনি আর রিশাদ মিলে অতিথিদের আপ্যায়ন করে।গুনগুনকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। মেয়েটা কিছুটা বড় হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কথাগুলোও বলছে পাকা বুড়ির মতো। অনি শায়লা বেগমের হাতে হাতে সব কাজ করে দেয়। এখন পালা আসে রিশাকে নিয়ে আসার।

অনি রিশাকে একটা সুন্দর সালোয়ার কামিজ পরিয়ে দেয়। মিথিলা হালকা মেকাপ করে দেয়। রিশার এইসব কিছু খুব অসহ্যকর লাগছে। মনে হচ্ছে সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে চুপ চাপ রুমে একা বসে থাকতে। তবে সে এখন খুব অসহায়। এসব কিছুই করতে পারবে না। বার বার সে ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। রাফির কোন রেসপন্স নেই। সে যে কি পরিমাণ রেগে যাচ্ছে রাফির উপর শুধু সেই জানে। রাফি বাইরে বসেও এর কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু তার হাতে কিছুই করার নেই।

কিছুক্ষণ পর রিশাকে নিয়ে নিচে নামে মিথিলা। রিশার মাথায় ওড়নাটা দিয়ে ঘোমটা দেয়া। মাথা নিচু করে আছে সে। এসব তার কাছে খুব অসহ্যকর লাগছে। তবে সে চায়না বাইরের লোকজনদের সামনে কোন সিন ক্রিয়েট করতে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে যাচ্ছে আর মনে মনে রাফির গুষ্টি উদ্ধার করছে।

রাফি একবার রিশার দিকে তাকায়। ওড়নার আড়াল থেকে রিশার মুখটা দেখেই সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তার কপালে যে কি আছে আল্লাহ ভালো জানে। অনক রিশাকে রেহানার পাশে বসায়। রিশা আগের মতোই নিচের দিকে তাকিয়ে আছেম রেহানা রিশার ঘোমটা টা কিছুটা সরিয়ে দিয়ে তার থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খায়। রিশার বিরক্ত লাগলেও সে সেদিকে ফিরেও তাকায় না।

টুকটাক কথাবার্তা শেষে রাফির বাবা রাফিকে উদ্দেশ্য করে বলে;তোমার কি কিছু বলার আছে?

রাফি হালকা কেশে ওঠে। কাশির শব্দটা রিশার পরিচিত মনে হয়। রাফি আমতা আমতা করে বলে; না না বাবা আমার কিছু বলার নেই। তোমরাই কথা বলো।

রাফির কণ্ঠস্বর রিশার কানে ভেসে আসতেই সে প্রায় বিদ্যুতের গতিতে রাফির দিকে তাকায়। এই মূহুর্তে সে জীবনের বড় ধাক্কাগুলোর মধ্যে একটা ধাক্কা খায়। রাফি অসহায় ভাবে রিশার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশা সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাফির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

উপস্থিত সবার মাঝে রিশা তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে কিছুটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে; বাবা আমি এই বিয়ে করবো না। তোমার ছেলে যদি আমাকে জোর করে বিয়ে দেয় আমি কিন্তু বিয়ের পরের দিনই পালিয়ে আসবো। তোমরা সবাই মিলে আমার সাথে ষড়যন্ত্র করেছো।বলেই রিশা আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে উপরে চলে যায়।

রিশার কথা শুনে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।যেন ছোট খাটো ঝড় বয়ে গেল রাফির মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। সে ভাবতে পারেনি রিশা এই কথাটা বলতে পারে। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সবাই হাসিতে মেতে ওঠে যা রিশার কানেও পৌঁছায়। এতে তার আরো বেশি মেজাজ খারাপ হয়।

সবাই হাসতে পারলেও রাফির মুখে হাসির ছিটেফোঁটা নেই। কেমন যেন মনে হচ্ছে আজ তার উপর দিয়ে টর্নেডো, আয়লা,ঘূর্ণিঝড়, সিডর সব যাবে।

রিশা উপরে চলে গেলে সবাই এক দফা হেসে নেয়। রিশাকে না জানানোর ব্যাপারটা দুই পরিবারের সবাই ই জানতো। তাই তারা কিছু মনে করেনি। সবাই মিলে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে। মিথিলা আর রিশার বিয়ের ডেটটা একই দিনে ফিক্সড করা হয়।

বাড়ির দুই মেয়ে একসাথে বিদায় হয়ে যাবে ভেবেউ সবার মনটা ভারী হয়ে আসে। তবে এতে কিছুই করার নেই। সবাইকেই একদিন এই দিনটা পার করতে হবে। তাই মন খারাপ করে কোন লাভ নেই। তবুও মায়ের মন কি আর মানতে চায়। সন্তান যে তার কলিজার টুকরা।

আলোচনার পর্ব শেষে সবাইকে খাওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওদিকে রাফি রিশাদকে বলে ম্যানেজ করে রিশার সাথে কথা বলার জন্য। রিশার রুমের সামনে নিয়ে যায় রাফিকে। রাফি দোয়া ইউনুস পড়ে কয়েকবার ফুঁ দিয়ে দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে কোন শব্দ আসেনা একদম নীরব। এটা যেন ঝড় আসারই পূর্বাভাস।

রাফির ডাকে সাড়া দেয় না রিশা। অসহায়ভাবে রিশাদের দিকে তাকায় রাফি। রিশাদ তার কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করে।

রিশাদ বেশ কয়েকবার ডাকার পর দরজা খুলে দেয় রিশা। রিশা দরজা খুলেই রাফিকে দেখে বলে; ভাইয়া তুই রুমে আসতে চাইলে আসতে পারিস ওকে রুমে আসতে দিবো না আমি।

রাফি অসহায় কণ্ঠে বলে;আমি কি করেছি বলো সব তো তোমার ভাইয়াই প্ল্যান করেছে।

–কিহ ভাইয়া তুইও!তোরা সবাই খুব খারাপ। আমার সাথে কেউ কথা বলবি না। তোরা ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করিস।(রিশা)

–আর তুই যে না জানিয়ে এতদিন ধরে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস সেটার কিছুনা তাইনা।মানুষের ভালো করতে চাইলেও দোষ হুহ।তুই যখন বিয়েটা করবিই না তাহলে ঠিক আছে। আমি তো আর জোর করতে পারিনা। বলেই রিশাদ মেকি রাগ দেখায়।

রিশাদের কথায় রিশা কিছুটা দমে যায়।

–ভাইয়া তুই সব সময় আমার সাথে এমন করিস!বোনটা বিয়ে করে চলে যাচ্ছে তাও শান্তিতে থাকতে দিবি না। (রিশা)

–কেন আজকেই তুই চলে যাচ্ছিস নাকি?(রিশাদ)

–না মানে বিয়ে করে তো চলেই যাব। তাই বললাম। (রিশা)

–তার মানে তুই বিয়েতে রাজি?এই না বললি বিয়ে করবি না!(রিশাদ)

–উফ ভাইয়া। কিছুটা লজ্জা পায় রিশা।

রিশাদ আর রিশাকে ক্ষেপায় না। মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরে একবার। রিশাও যেন সাদরে তার ভাইয়ের স্নেহ গ্রহণ করে। কবে আবার এই সুযোগ আসবে জানা নেই। কিছুদিন পরেই তো এই ঘরটা ফাঁকা করে দিয়ে চলে যাবে। কার সাথে ঝগড়া করবে সে। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।

দরজায় দাঁড়িয়ে রাফি ভাই বোনের এই অপূর্ব ভালোবাসার দৃশ্য উপভোগ করে। রিশাদ আর রিশার সম্পর্কটা সত্যিই অন্যরকম। খুব ভালো লাগে রাফির।

ভাই বোনের কথা বলা শেষ হলে রাফিকে রিশার সাথে কথা বলার জন্য রুমে পাঠিয়ে নিচে চলে যায় রিশাদ। রাফি রুমে আসতেই ধুপ ধাপ করে রিশা রাফির বুকে মারতে থাকে। নিজেকে সামলাতে না পেরে সোফার উপরে রিশাকে নিয়ে পড়ে যায় রাফি।

রিশার এই মূহুর্তে খুব কান্না পাচ্ছে। সারাদিন কতটা টেনশনের মধ্যে ছিল সে। রাফি অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার অভিমানিনীর মান ভাঙায়।

বাড়ির বড়দের খাওয়া শেষ হলে ছোটরা সবাই খেতে বসে। রাফি, রিশা, মিথিলা, অনি, রিশাদ, কাব্য,নিরা,আর গুনগুন একসাথে খেতে বসে। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ করেই গুনগুনের হাত লেগে পানি পড়ে যায় নিরার শাড়িতে।শাড়িটা প্রায় ভিজে যায়।অনির খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।অনি নিরাকে নিয়ে নিজের রুমে যায় তাকে শাড়ি চেঞ্জ করানোর জন্য। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে নিরার হাতে দেয়।

বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটায় নিরার সাথে অনি। নিরার সঙ্গ অনির বেশ ভালো লাগে। খুব আপন আপন লাগে নিজের বোনের মতোই স্নেহ করে অনিকে।

কথায় কথায় নিরাকে কাব্যর ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করে অনি। অনেক দিন ধরেই তার জানার আগ্রহ ছিল জানার। সেরকম সুযোগ বা সময় কোনদিনই পায়নি।

নিরা প্রথম থেকে সবটা বলতে শুরু করে অনিকে। কাব্যর এক্সিডেন্টের পর ঘটনাচক্রে এ্যানি কাব্যকে খুঁজে পায়। এ্যানি মূলত বাংলাদেশে এসেছিল একটা সেমিনার এটেন্ড করতে। তার মা জন্মগতভাবে বাংলাদেশি তবে বিয়ে হয়েছিল ফ্লোরিডাবাসী একজন খ্রিষ্টান ডকটরের সাথে যিনি ছিলেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। খুব অল্প বয়সেই এ্যানির মা মারা যায়। তারপর থেকে সে তার বাবার কাছেই মানুষ হয়। খুব ছোটবেলা থেকেই তার সখ্যটা গড়ে ওঠে এরিকের সাথে। এরিকের পরিবারও তাকে নিজেদের মেয়ের মতোই ভালোবাসতো। এরিক আর এ্যানির সম্পর্ককে পর্যবেক্ষণ করে দুই পরিবার তাদের বিয়ে ঠিক করে। এতে তারা দুজনেই বেশ হাসিখুশি ছিল।

একদিন প্ল্যান করে তারা ট্রাভেলং এ বের হয়। বেশ কিছু জায়গায় তারা সাতদিন যাবত ঘুরে বেড়ায়। লাস্ট দিনে তাদের প্ল্যান ছিল সী বীচে যাওয়া। প্ল্যান অনুযায়ী তারা ঘুরতে যায়। মাঝ সমুদ্র ভ্রমণ করার জন্য তারা স্পীড বোট ভাড়া করে নেয়। সবকিছু ভালোই চলছিল।মাঝ সমুদ্রে এসে তারা বেশ আনন্দ পাচ্ছে। সমুদ্রের নীল পানিতে ভাসমান শার্ক গুলো দেখে এ্যানির উৎসাহের সীমা নেই।

এ্যানির লাইফ জ্যাকেটের লকটা খুলে যায়। সে একা লাগাতে পারছিল না। তাই এরিক দু হাত দিয়ে লক লাগানোর চেষ্টা করে। লকটা লাগিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে যেতে নেয় এরিক। মাঝ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে তাদের বোটে আঘাত হানে। নিজের তাল সামলাতে না পেরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এরিক উল্টে পড়ে যায় সমুদ্রের মাঝে। কোনমতে বোটটা আঁকড়ে ধরে লাইফ জ্যাকেটের বলে সে পানিতে ভেসে থাকে। এ্যানি চিল্লিয়ে উঠে এরিককে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ায়। বোটম্যান এসে এরিককে সাহায্য করে। তবে ভাগ্য এরিকের সহায় হয়নি।

একটা ক্ষুধার্ত শার্ক এসে এরিকের পায়ে কামড় বসিয়ে দেয়। গগণবিদারী চিৎকার দেয় এরিক। তবুও সে হাল ছাড়ে না। বোটে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিছুতেই এরিক পেরে ওঠে না। অন্যদিকে বোটম্যান আর এ্যানিও চেষ্টা করে এরিককে বোটে তুলতে পারে না।

একসময় এরিক হাল ছেড়ে দেয়। এ্যানির হাতটা আলগা করে দিয়ে এরিক সমুদ্রে পড়ে যায়। সাথে সাথেই শার্কটা এরিককে নিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে যায়। শার্কটা যে পথ দিয়ে যায় তা রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। এ্যানি আর্তনাদ করে ওঠে এরিকের নাম নিতে নিতে। পাগলের মতো ছুটে সে সমুদ্রে লাফ দিতে যায়। বোটম্যান তাকে আটকে নেয়।

বোটম্যানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতেই জ্ঞান হারায় সে। এরপর আর কিছু মনে নেই তার।

সময়ের সাথে সাথে এ্যানির মানসিক অবস্থাটা খারাপ হতে থাকে। সে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। এরিকের মৃত্যু সে মেনে নিতে পারেনি। এরিকের কল্পনার মাঝে ডুবে থাকত সে

এরপর প্রায় তিন বছর সময় লাগে এ্যানির ঠিক হতে। তার বাবার আপ্রাণ চেষ্টাতেই সে সুস্থ হয়। তার কিছু মাস পরেই এ্যানির জীবনে আসে কাব্য। কাব্যর এক্সিডেন্টের পর সে কোমায় ভলে যায়। তার ব্রেইনেও ড্যামেজ পরে। আমেরিকার উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে প্রায় ছয় মাস পর সে কোমা থেকে বেরিয়ে আসে। এই ছয় মাস এ্যানি কাব্যকে সুস্থ করে তুলতে উঠে পড়ে লেগে যায়।তারা কাব্যর নামটাও জানত না। এ্যানি কাব্যর প্রতি টান অনুভব করতো তাই সে তার নাম দেয় এরিক।

কোমা থেকে বেরিয়ে আসার পর কাব্যর কিছু মনে ছিল না। যেটুকু স্মৃতি অবশিষ্ট ছিল তাও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় কোমায় থাকার ফলে। এর ফলে অতীত জীবন সম্পর্কে তার স্মৃতির পাতা একেবারেই শুন্য।

তাই এ্যানির বাবাও সুযোগ বুঝে কাব্যকে নিয়ে এক ভয়ংকর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দেন। হিপনোটাইজ করে কাব্যর মাঝে এরিকের স্মৃতি গুলো আস্তে আস্তে ভরিয়ে দেন। এরিকের ছোটবেলা থেকে সকল কিছু তার মাঝে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কিছুটা পরিমার্জনও করা হয়। যেমন এরিকের বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছে তারপর সে এ্যানির বাবার কাছেই মানুষ হয়েছে।

সব কিছুতে সফল হলেও তিনি কাব্যর স্মৃতিতে এ্যানির জন্য ভালোবাসার উদ্রেক ঘটাতে পারেননি। তবে সময়ের সাথে সাথে এ্যানি কাব্যর মনে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করে। কিন্তু বন্ধুত্বের বেশি আগাতে পারে না।

বেশ ভালোই কাটছিল তার দিন। তবে এ্যানির বাবার মারা যাওয়ার পর সে পুনরায় ভেঙে পড়ে। কাব্য তার বাবাকে মারা যাবার আগে কথা দিয়েছিল যে সে এ্যানিকে বিয়ে করবে।

শুরু থেকেই কাব্যর টান ছিল বাংলাদেশের প্রতি। তাই সে এখানে সে তার বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ্যানি মানতে না চাইলেও কাব্যর কাছে হার মানতে হয়। তারপর ঘটনাক্রমে কাব্য তার বাসায় পৌঁছে যায়।

এইটুকু বলে থেমে যায় নিরা। অনির চোখের কোনায় জল চিক চিক করছে। নিরার গলাও ভারী হয়ে এসেছে।

তারপর আবার নিরা বলতে শুরু করে;

–এ্যানি আর কাব্য যখন গুনগুনের কথা ভেবে তাদের বাড়িতে থাকতে শুরু করে তখনই এ্যানির আচরণ অদ্ভুত লাগে সবার কাছে। তাই হিমাদ্রী খোঁজখবর নিয়ে ফ্লোরিডা যায়। সেখানে বেশ কয়েকদিন যাবত অনুসন্ধান করে এসব সত্যি সামনে আসে। এ্যানি এসব কিছুই স্বীকার করতে চায়নি। কিন্তু দুদিন পর থেকেই সে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। তার মানসিক সমস্যা শুরু হয়। অবস্থা খারাপ হতে থাকায় তাকে মেন্টাল এসাইলামে পাঠানো হয়।সেখানেই তার চিকিৎসা চলছে। এদিকে কব্যর কাছে সবটা কেমন ধোঁয়াশা হয়ে যায়। সে কিছুই মনে করতে পারছে না তার আগের জীবনের কথা। আমেরিকার একজন স্পেশালিষ্ট এর আন্ডারে কাব্যর ট্রিটমেন্ট করায় সে এখন প্রায় সুস্থ।আগের সব কথা তার আস্তে আস্তে মনে পড়ছে।

চলবে…..

আসসালামু আলাইকুম?
সরি রিচেক করা হয়নি।ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here