অনন্যময়ী পর্ব_৫৮

0
5845

অনন্যময়ী পর্ব_৫৮
#সানজিতা_তুল_জান্নাত

রিশা আর মিথিলার বিয়েকে কেন্দ্র করে বাড়িতে উৎসব বেঁধে গেছে। রায়হান সাহেব আর রিশাদ বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেন নি। কোথাও কোন ভুল ধরার অবকাশ নেই। এই দুইজোড়া হবু দম্পতি বিয়ে নামক পবিত্র ও হালাল বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। সঙ্গীত,মেহেন্দি,গায়ে হলুদ কোন কিছুই বাদ রাখা হয়নি। দেশের সেরা ওয়েডিং প্ল্যানারকে হায়ার করেছে রিশাদ। বিয়ের ডেট ফিক্সড হওয়ার পর থেকেই রিশাদ আস্তে আস্তে সব প্রস্তুতি নিতে থাকে। কোথাও কোন ভুল চায়না সে।

বিয়ের প্রস্তুতির একটি মূল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই আজ শপিং করতে এসেছে রিশা-রাফি, মিথিলা-ইভান। আর এ সব কিছুর তত্ত্বাবধান করার জন্য অনি আর রিশাদও এসেছে। এই বিয়েটাকে ঘিরে অনি বেশ এক্সাইটেড। আগে কখনো বাঙালি বিয়েতে পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত থেকে বিয়েতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়নি। অদ্রির বিয়েতে নতুন মানুষ দের মাঝে নিজেকে বেশ ভালো ভাবেই গুটিয়ে রেখেছিল অনি। সেদিনকার অনন্যময়ী আর আজকের অনন্যময়ীর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। একসময় সে ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে নিজেকে আড়ালে রাখতো আর আজকের দিনে এসে সেই যেন সকল আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু।

সবাই মিলে প্রায় দুদিন ধরে ঘুরে ফিরে শপিং করে। প্রথম দিন শপিং করা হয় শুধু বর বউয়ের জন্য আর পরবর্তী দিন পরিবারের সকলের জন্য। পরিবারের জন্য যেদিন শপিং করা হয় হয় সেদিন রিশাদ আর অনি গিয়ে শপিং করে আনে। অনি নিজে পছন্দ করে সবার জন্য সবগুলো অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখে সবার জন্য শপিং করে।

রিশাদের জন্য পছন্দ করে দুটো পাঞ্জাবি কেনে। অনি জাহানারা বেগম সহ ও বাড়ির সবার জন্যও শপিং করে। নিজের জন্যেও কিছু কিনতে চাইছিল অনি। তবে কোন অনুষ্ঠানের জন্য কি কিনবে ঠিক বুঝতে পারছে না। রিশাদ তার এই সমস্যার সমাধান করে দেয়।

রিশাদ অনিকে নিয়ে প্রথমে একটা শাড়ির দোকানে যায়। অনেকগুলো শাড়ি দেখানোর পর একটা মেরুন কালারের শাড়িতে রিশাদের চোখ আটকে যায়। রিশাদ শাড়িটা ভালো ভাবে দেখার শাড়িটা হাতে নিয়ে অনির পেছনে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটার মতো করে পরিয়ে দেয়। তারপর সে তাকে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করায়। অনি নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে। শাড়িটা দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর।অনিকে বেশ মানিয়েছে। অনি আয়নার মধ্যেই রিশাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

রিশাদ অনিকে দুটো শাড়ি আর একটা গাউন টাইপ লেহেঙ্গা কিনে দেয় বিয়েতে পড়ার জন্য। আরো কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে অনি রিশাদ বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

বিয়ের কাজে কদিন যাবতই অনি রিশাদ বেশ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। তবুও কাজের ফাঁকেফাঁকে নিজেদেরকে সময় দিতে ভুলে যায় না তারা। কাজের মাঝেও চলমান থাকে তাদের ভালোবাসাময় খুনসুটি গুলো। সময়ের সাথে সাথে তাদের সম্পর্কের গভীরতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে তাদের দায়িত্বগুলো।

একটা লেকের ধারে এসে গাড়িটা থামে। অনির দৃষ্টি গাড়ির জানালা ভেদ করে এই অচেনা জায়গার চারদিক একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিশাদের দিকে তাকায়।

–এটা কোথায় নিয়ে এসেছো তুমি আমাকে?বাসায় কত কাজ কাজ আছে জানো?(অনি)

–জি ম্যাম আমি জানি।বাসায় সব কাজ সব সামলে নেবে। একটু আমার সাথেও সময় কাটাও।বলেই রিশাদ মুচকি হাসে।

অনি রিশাদেএ হাসিমুখের দিকে তাকয়ে আর কিছু বলতে পারে না।

গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা হাওয়া এসে অনির চোখেমুখে পরশ বুলিয়ে দেয়।আবহাওয়াটা বেশ শীতল। চারপাশটায় ভরপুর নীরবতা। লেকের সবুজ পানি হাওয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ তুলে এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটা মাছ লাফিয়ে উঠে সাথে সাথে ডুব দিচ্ছে। এটা যেন তাদের কাছে কোন খেলা। লেকের পাড় দিয়ে সারি সারি নারকেল গাছ। ঝুলন্ত পাতাগুলো হাওয়ায় দুলছে। অজানা কিছু ফুলের সুবাস ভেসে আসছে অনির নাকে। নিমিষেই অনির হৃদয় ভালো লাগায় ছেঁয়ে যায়।

রিশাদ তার প্রিয়তমার হাত ধরে লেকের দিকে এগিয়ে যায়। মার্বেল পাথর দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো ঘাট।সেখানে রয়েছে আবার বসার জায়গা। সেখানেই রাখা গোটা কয়েক নৌকা। অনি চারপাশটা একটু ঘুরে দেখে। জায়গাটা বেশ মনে ধরেছে। কোন উইকেন্ডে ফ্যামিলি নিয়ে পিকনিক করার জন্য উপযুক্ত একটি জায়গা। দম্পতিদের একান্তে সময় কাটানোর জন্যেও জায়গাটা মন্দ নয়। রিশাদ পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে আর অনি চারপাশটা দেখছিল। দূর থেকেই রিশাদ তার প্রিয়তমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল।অনির হাস্যজ্জ্বল চেহারা দেখে রিশাদের অন্তরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এই হাসিমুখ টার জন্য সে সকল কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছে। অবচেতন মনে রিশাদ তার প্রেয়সীর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে নানান ধরনের কল্পনার বুনন করতে থাকে।

অনি রিশাদের সামনে এসে হাত নাড়ানোয় রিশাদের ধ্যান ভাঙে। রিশাদ মুচকি হেসে অনির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। অনি তার হাতে নিজের হাতটা রাখতেই রিশাদ তাকে টানে নিয়ে তার পাশে বসিয়ে দেয়। রিশাদ শক্ত করে তার হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। অনি আবেশে দুচোখ বুজে রিশাদের কাঁধে মাথা রাখে।অনির এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে আসা চুলগুলো বার বার তার চোখে এসে বারি খাচ্ছিল।এ যেন বাতাসের তালে তালে ছন্দাকারের ঢেউ। রিশার হাত দিতে তা কানের পিঠে গুঁজে দেয়।

পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্যের নিস্তেজ এক ফালি সোনালি আলোক রশ্মি এসে অনির নাক বরাবর পড়ছে। নাকে দেয়া সাদা ডায়মন্ডের পাথরটা সোনালি হয়ে চক চক করছে। রিশাদের দৃষ্টি সেখানেই আবদ্ধ হয়ে আছে। ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়ার অদম্য ইচ্ছেটা সে এই মূহুর্তে জোর করে চেপে রাখে।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। গোধূলি বেলাও ফুরিয়ে এসেছে। সোনালি আভা দূর হয়ে অন্ধকারের ধূসর ভাব দৃশ্যমান হতে শুরু হয়েছে। অনি রিশাদ সাময়িকভাবে তাদের ভালোবাসার রেশ কাটিয়ে উঠে তাদের নিজেদের গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়।

জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে। গাড়িতে বসে অনি রিশাদ টুকটাক কথা বলছিল।মাঝে মাঝে অনি বাইরের দিকে তাকিয়ে রাতের ঢাকা শহরটা দেখছিল। চারপাশটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। গাড়িগুলো জ্যামের ফাঁকেফাঁকে নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধার দিয়ে বসেছে শত শত ক্ষণস্থায়ী দোকান। বেশির ভাগই মুখরোচক খাবারের দোকান। দোকানগুলোতেও রয়েছে উপচে পড়া ভিড়। দোকানিদের যেন কোনদিকে তাকানোর অবকাশ নেই। চায়ের আড্ডায় মেতে উঠেছে তরুণ থেকে বৃদ্ধ সকলেই। ব্যস্ত এই ঢাকা শহর অনির বরাবরই খুব পছন্দের। রিশাদের সাথে এর আগেও বেশ কয়েকবার সে ঘুরতে বেরিয়েছিল। দিনের বেলায় রিশাদের হাতে সময় থাকে না বলেই রাতেই বেরিয়ে পড়ে তার প্রিয়তমার হাত ধরে। কখনো পায়ে হেঁটে তো কখনো রিকশায়।

প্রায় আটটার দিকে অনি রিশাদ বাসায় ফেরে। ফিরতে দেরি হবে বলে আগে ভাগেই রিশাদ তার মাকে ফোন করে জানিয়ে রেখেছিল। অন্যথায় শায়লা বেগম চিন্তায় থাকতো আর তাদেরকে শুনতে হতো এক বস্তা বকুনি।

রাতে খাবার পর সবাই পারিবারিক আড্ডায় মেতে ওঠে। অনি এক এক করে সবার জন্য কিনে আনা জামা কাপড় গুলো সবাইকে দেখায়। অনি কিছুটা চিন্তায় ছিল।এই প্রথম সে সবার জন্য শপিং করছে। পছন্দ হবে কিনা দ্বিধায় ছিল। তবে সবার প্রতিক্রিয়া দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়।বেশ রাত পর্যন্ত সবাই আড্ডা দেয়। এইরকম সময় আবার কবে আসবে তা কারোরই জানা নেই। মিথিলা রিশা চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকাফাঁকা হয়ে যাবে। ভাবতেই অনির মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়।

দুটোর দিকে আড্ডার আসর জোর করে ভেঙে দেন শায়লা বেগম। বকুনি খাওয়ার ভয়ে যে যার মতো ঘুমোতে চলে যায়। ক্লান্ত অনি রিশাদ বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ জুড়ে ঘুম নামে।

ভোরবেলা একটু দেরিতেই ঘুম থেকে জাগা পায় অনি। খুব কষ্টে রিশাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় অনি। রিশাদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।রিশাদকে কয়েকবার ডেকেও সাড়া পায়না। অনি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। রিশাদকে জোর করে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। একসাথে ফজরের নামাজ পড়ে নেয়।

ঘুম ঘুম ভাব কাটাতে অনি রান্নাঘরে যায় কফি বানানোর জন্য। দুকাপ কফি বানিয়ে সে উপরে আসে মিনিট বিশেক পর। রুমে এসেই দেখতে পায় রিশাদ আবার ঘুমোচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে সে কফির কাপ দুটো টেবিলের উপর রাখে। রিশাদের গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করে। রিশাদের ঘুম থেকে ওঠার নামই নেই বরং সে অনির হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের কাজে টেনে নেয়। অনির তাল সামলাতে না পেরে রিশাদের উপর পড়ে যায়। উঠতে নিলে রিশাদ তাকে জড়িয়ে ধরেই কানের কাছে ঘুম ঘুম কণ্ঠে ফিস ফিস করে বলে;

–প্লিজ উঠো না। প্লিজ প্লিজ। দশ মিনিট পর আমি সত্যি ঘুম থেকে উঠে পড়বো। প্রমিস। (রিশাদ)

–আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে তো ছাড়ো। (অনি)

–উঁহু না। ছাড়ছিনা তোমাকে। থাকো না একটু প্লিজ।

অনি আর কথা বাড়ায় না। রিশাদ অনিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। মুখে তার হাসি লেপ্টে আছে।
ঘুম ঘুম চোখে অনির দিকে তাকায় রিশাদ। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। অনি রিশাদের চোখের দিকে তাকাতেই কেমন লজ্জা পাচ্ছে। রিশাদকে ধাক্কা দিয়ে উঠতে চাইলে রিশাদ তাকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়তমার উষ্ণতাগুলো যেন রিশাদ শুষে নিচ্ছে। ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠে তার স্নায়ুগুলো যেন ভালোবাসার নেশায় আসক্ত হয়ে উঠছে।

অনির গরম নিঃশ্বাস রিশাদের মাঝে যেন ক্রমশ শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। রিশাদ অনির ঠোঁটের কাছাকাছি বাম গালের লালচে তিলটায় ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয় গভীরভাবে। আবেশে অনি দুচোখ বুজে নেয়।

কিছুক্ষণ পরে রিশাদ অনিকে ছেড়ে দেয়। অনির দিকে তাকিয়ে রিশাদ মুচকি হাসি দিতেই যেন সে লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে। রিশাদ তার প্রেয়সীর এই লজ্জামাখা চাহনিতে ঘায়েল হয়ে যায়। অনিকে আলগা করে দিতেই সে রিশাদকে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ে। রিশাদ কিছুটা শব্দ করে হাসতে থাকে। অনি ভেংচি কেটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রিশাদ বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে কফির মগে চুমুক দিতেই অনুভব করতে পারে ঠান্ডা হয়ে গেছে কিছুটা। কিছু একটা ভেবে সে মুচকি হাসে। অতঃপর সে ঠান্ডা কফিটায় খেতে থাকে।অনির হাতে বানানো কফিটা সে কি করে মিস করতে পারে।

রিশাদ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। আজ তার বিশেষ কোন কাজ নেই। ছুটি নিয়েই বাসায় চলে আসবে। পরশুদিন সঙ্গীত ও মেহেন্দির আয়োজনের প্রিপারেশন নিতে হবে। অনি কিছু একটা ভেবে রুমে চলে আসে। বেশ কয়েকদিন ধরেই সে ভাবছিল ও বাড়িতে যাবে। কতদিন হলো দিদার সাথে দেখা হয়না। ওইদিনের ঘটনার পর আর যাওয়াই হয়নি। অনামিকা বেশ কয়েকবার তাকে যেতে বলেছে। যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার তবে জাহানারা বেগমের সাথে দেখা করতে মন চাচ্ছে তার। রিশাদকে বললে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝতে পারছে না।

রিশাদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট পরছিল। অনি রিশাদের কাছে গিয়ে রিশাদের হাতটা সরিয়ে শার্ট এর কলার ঠিক করে দিয়ে বোতামগুলো লাগিয়ে দিচ্ছিল। সকাল বেলার তার পছন্দের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এটি। অনিকে কিছুটা চুপ চাপ দেখাচ্ছে। রিশাদ অনিকে নীরব থাকতে দেখে বলে;

–কি হয়েছে?কার শোকে এত নীরবতা পালন করছো?(রিশাদ)

–উঁহু কিছুনা। (অনি)

–কিছু তো হয়েছে?এরকম চুপ করে আছো কেন?বলো প্লিজ।(রিশাদ)

–একটা কথা বলবো প্লিজ রাগ করবে না।(অনি)

রিশাদ মুচকি হেসে বলে; পাগলি কোথাকার।তোমার কথায় আমি কবে রাগ করেছি বলো তো। কি বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলো।

–আমি একটু আমাদের বাসায় যাব। প্লিজ অনেক দিন হলো দেখা হয়না দিদার সাথে। কিছুটা অসহায় চাহনি নিয়ে কথাটা বলে অনি।

রিশাদ অনির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে; খুব দরকার কি যাওয়ার?দিদাকে এখানে আসতে বলো তাহলেই তো হয়। আর দুদিন পর তো দিদারা আসছে।তখনও দেখা হবেই।

অনি কিছুটা হতাশ হয়ে বলে; আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি যখন না করছো তাহলে যাবো না আমি।

–আরে না বললাম কখন?(রিশাদ)

–যেতেও তো বলোনি!বলেই অনি গোমড়া মুখ করে।

–আচ্ছা বাবা ঠিক আছে যাবে। এখন হ্যাপি।(রিশাদ)

খুশিতে চক চক করে ওঠে অনির মুখ। রিশাদ তার প্রিয়তমার এই হাসিটা দেখার জন্যই রাজি হয়ে যায়। তবে অনিকে ওই বাড়িতে যেতে দিতে কোনভাবেই তার মন সায় দিচ্ছিল না।

রিশাদ অফিসে যাওয়ার আগে অনিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। অনিকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সে অফিসে চলে যায়। অফিসে বিশেষ কোন কাজ না থাকায় সে ঘন্টা দুয়েক পরে এসে অনিকে নিয়ে যাবে।

অনি হাতে কিছু শপিং ব্যাগ নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে যায়। অনি আসার আগে জাহানারা বেগমকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল। বেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়। অনির সামনে জাহানারা বেগমের হাস্যজ্জ্বল মুখটা ভেসে ওঠে।

অনি জাহানারা বেগমকে দেখেই প্রশ্বস্ত হাসি ফুটিয়ে তুলে তাকে জড়িয়ে ধরেন। জাহানারা বেগম এতদিন পর তার স্নেহের নাতনিকে জড়িয়ে ধরে শান্তি অনুভব করেন। জাহানারা অনির কপালে চুমু খেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে ভেতরে নিয়ে যান।

ভেতরে গিয়ে অনির আশরাফ সাহেবের সাথে দেখা হয়। আশরাফ সাহেব অনিকে দেখে বেশ খুশি হন। অনি তার সংকোচ ভুলে আশরাফ সাহেবকে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করে। আশরাফ সাহেবের ভালোবাসায় এতটা সিক্ত যে সে কারো কথাই তোয়াক্কা করেনা। আশরাফ জড়িয়ে ধরে মেয়েকে আদর করে দেন।

রান্নাঘর থেকে অনামিকা আসে। অনিকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অনি তাকে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করে। অনামিকার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে অনি তবে তাদের মাঝে এখনো বিশাল দূরত্ব বিরাজমান। দীর্ঘ তেইশ বছরের দূরত্ব তো আর দু এক মাসে মেটানো সম্ভব না। এই বিষয়টা অনামিকাকে মানসিকভাবে পীড়া দিলেও এটা মেনে নিতেই হবে। সে তো শুধুমাত্র তার কর্মফলই ভোগ করছে। অনামিকা মনে মনে কোথাও না কোথাও প্রত্যাশা করেছিলেন অনি তাকে জড়িয়ে ধরবে। অনামিকাকে শান্তভাবে উপেক্ষা করে অনি জাহানারা আর আশরাফের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। চোখে পানি চলে আসতে নিলে অনামিকা রান্নাঘরের দিকে যায়। অনি তার গমনপথের দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এবাড়িতে আসার পর সে একবারও অদ্রির রুমে যায়নি। অদ্রির সাথে দেখাও হয়নি তার। অদ্রি যথাসম্ভব ঘরেই থাকে। একা থাকতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজেকে পুরোপুরিভাবে গুটিয়ে নিয়েছে। রিশাদকে ভুলে থাকাটা তার কাছে প্রায় মৃত্যুর মতো যন্ত্রণাদায়ক। তবুও সে আস্তে আস্তে নিজেকে শক্ত করছে। অনির প্রতি রিশাদের ভালোবাসাটাই বার বার অদ্রিকে দূর্বল করব দেয়। অনির জায়গায় হয়তো অন্যকোন মেয়ে থাকলে মেনে নিতে এত কষ্ট হতো না।

জীবনে চলার পথে সাফল্য কুঁড়োতে কুঁড়োতে সুখের ঝুলিটাই সে মাঝপথে ফেলে রেখে চলে গেছে। যার উপর আজ অন্যের আধিপত্য বিরাজ করছে। নিজের এই অবস্থার জন্য কাউকে দোষারোপ করেনা সে। শুধু চায় ভালো থাকতে। আগের সেই রাগী অদ্রি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কারো উপর আর তার কোন ক্ষোভ নেই। মানসিক শান্তিই শুধু এখন তার কাম্য। কোথায় গেলে দুদণ্ড শান্তি পাবে সে।

অদ্রির রুমের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনি। ভেতরে ঢুকবে কিনা সে বিষয়ে দ্বিধায় ভুগছে সে। রিশাদ তাকে বার বার বলেছিল অদ্রির থেকে দূরেই থাকতে। সেদিন অনির গায়ে হাত তোলাটা রিশাদ মেনে নিতে পারেনি।এর জন্যে সে অদ্রিকে কোনদিনও ক্ষমা করবে না।

সকল সংকোচকে দূরে ঠেলে অদ্রির রুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অনি। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। রুমের লাইট অফ করা। জানলা খুলে দেয়া থাকলে পর্দা টেনে দেয়ায় আলো কম প্রবেশ করছে।

–অদ্রিপু!(অনি)

রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অনি ডাইরিটা বন্ধ করে ফেলে। পেছনে ফিরে সে অনিকে দেখতে পায়। অনির দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অদ্রি।

অনি বরাবরই তার থেকে বেশ সুন্দরী।দেখতে পুরোপুরি বিদেশিদের মতো হলেও তার চেহারায় বাঙালিয়ানার ছাপ দেখায় তার সৌন্দর্যটা সত্যিই খুব বিরল আর চোখে লাগার মতো। তবে অদ্রিও যে দেখতে খারাপ তা কিন্তু নয়। অনির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে অদ্রি; এই রূপের জন্যই কি রিশাদ অনিকে ভালোবেসেছে। আমি ছিলাম না বলে অনির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে! প্রশ্ন জাগে অদ্রির মনে।

রিশাদের থেকে বিচ্ছেদ তার মাথায় সব সময় এমনই সব উদ্ভট চিন্তাভাবনার আবির্ভাব ঘটায়। উত্তর হাতড়ে বেড়ায়। দিনশেষে তার অন্তরাত্মা তাকে বুঝিয়ে দেয় আসলে এইসব কিছুর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সে নিজেই দায়ী। বিষাদময় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অদ্রির। তবে অদ্রি অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে এত কিছুর পরেও অনি তার সাথে দেখা করতে এসেছে। এটা কি তার দয়া নাকি মজা নিতে এসেছে?এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেনা অদ্রি।

–কেমন আছিস?(অদ্রি)

–এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?(অনি)

–হুম ভালো। (অদ্রি)

অনি আর কথা খুঁজে পাচ্ছেনা। একসময় এই দুবোনের গল্পে গল্পে রাত ফুরিয়ে যেত।আর আজ কি বলবে তা বুঝতেই পারছে না। সময় ও পরিস্থিতি কতটা দূরত্ব তৈরী করে দিয়েছে। ভাবতেই অনির মনটা খারাপ হয়ে যায়।

দুজনের নীরবতার মাঝে অনির হাতের ফোনটা বেজে ওঠে। অনি একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে অদ্রির দিকে তাকায়।অদ্রি অনির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। অনির অস্বস্তিবোধের উদ্রেক হয়।

–ভালো থেকো আপু।আমি আসছি। বলেই অনি উত্তরের অপেক্ষা না করে রুম থেকে চলে যায়। অনির মুখে ভালো থাকার কথাটা শুনে অদ্রি মুচকি হাসে। অশ্রু ভেজা নয়নে অনির গমন পথের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলে;

–আমার ভালো থাকার কারণটা নিয়ে তো তুই খুব ভালো আছিস। একসাথে দুজন কীভাবে ভালো থাকা সম্ভব?বলেই অদ্রি চোখ বুজে নেয়। অশ্রুগুলো তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। অশ্রুগুলো মোছে না সে। অশ্রু মুছতে মুছতে আজ সে বড্ড ক্লান্ত।

বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে অদ্রি চেয়ার থেকে নেমে জানালার কাছে যায়। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতেই আলো এসে অদ্রির চোখে পড়ে। হঠাৎ আলো তার চোখে সহনীয় হয় না। চোখ দুটো কুঞ্চিত হয়। আস্তে আস্তে পুনরায় চোখ খোলার পর বাড়ির সামনের রাস্তাটা স্পষ্ট হয়।

গেটের সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে তার চেনা পরিচিত সেই প্রিয় মুখটা যার উপর এক সময় তার অধিকার সবচেয়ে বেশি হলেও আজ কোন অধিকার নেই।জানালার গ্রিল ধরে এক ধ্যানে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে সে প্রত্যাশা করছিল একবার না একবার রিশাদ হয়তো তার দিকে তাকাবে।

একটু পরেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অনি আর জাহানারা বেগম। রিশাদ গাড়ি থেকে নেমে কি যেন বলছে। বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে থাকে। তবে কি বলছে বুঝতে পারছে না। বোঝার চেষ্টাও করছে না সে। সে তো রিশাদকে দেখতেই ব্যস্ত।

কিছুক্ষণ পরেই জাহানারা বেগম ভেতরে চলে আসেন। রিশাদ গাড়ির দরজা খুলে অনিকে ভেতরে বসিয়ে দেয়। খুব যত্ন সহকারে সিটবেল্ট লাগিয়ে দেয়। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অদ্রি কতটা খুশি আছে তারা একে অপরের সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনি রিশাদ চলে যায়।

অদ্রির উদাস দৃষ্টি তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকে তার চিন চিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে নীরবে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানায়।

চলবে………..

আসসালামু আলাইকুম?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here