অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত বোনাস_পার্ট

0
5736

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
বোনাস_পার্ট

রুমের ভেতরে প্রবেশ করে অনি। অনির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে মিথিলা। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে সে।

একটু আগেই সাবরিনা বেগম যে কথা গুলো বলছিলেন সেগুলোই তার মস্তিষ্কে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে।

সাবরিনা বেগমের কোলে মাথা রেখে নীরবে অশ্রুপাত করে যাচ্ছিল। সন্তানের এই অসহনীয় অবস্থায় তার মনটা যেন ক্রমাগত ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল। এসময় তার মাথায় আসে অনির কথা। অনির জীবনের কথা।

অনির জন্মের আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা তুলে ধরে মিথিলার সামনে। সাবরিনা বেগমের কিছুই অজানা ছিলনা। শায়লা বেগমের কাছে সবটাই শুনেছিলেন তিনি। এসবের কিছুই মিথিলার জানা নেই। যদি আগে থেকেই জানা থাকত তবে মিথিলা হয়ত এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দশবার ভাবত। যদিও মিথিলা নিজেও অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছে তবুও সে এক পরিপূর্ণ পরিবারের মাঝে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তার জীবনটাও খুব একটা সুখকর ছিল না।

সাবরিনা বেগমের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে মিথিলা। অনির সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিল না। আজ এতকিছু জানার পর অনির প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা ছাড়া কিছুই জন্মায় না। যদিও অনির প্রতি কোনরূপ খারাপ ধারণা বা খারাপ মনোভাব তার ছিল না। মানসিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে।

সে তো শুধুমাত্র তার অপ্রকাশিত একতরফা ভালোবাসা নিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল। আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। তবে তার ভাগ্য ভালো ছিল। সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচার সুযোগ দিয়েছে। তাই সে চায় এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তার ভুল শুধরে নিতে।

মিথিলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনি। মিথিলা ইশারায় পাশে বসতে বলে।

অনি মিথিলার পাশে বসে পড়ে। মিথিলার সামনে দাঁড়াতেই একরাশ অপরাধবোধ তাকে ঘিরে ধরে। তার উপর মিথিলার এমন অদ্ভুত চাহনিতে অনি যেন আরো বেশি অস্বস্তিতে পড়েছে।

–“কেমন আছো মিথিলা?এখন শরীর ঠিক আছে?”(অনি)

–“এইতো ভাবী। এখন অনেকটাই ভালো আছি।তোমার কি খবর বলো। তুমি কেমন আছো?”(মিথিলা)

–“আমি?আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি।”(অনি)

মিথিলার সাথে আরো কিছুক্ষণ টুক টাক কথা বলে অনি। মিথিলার চেহারায় মলিনতা থাকলেও অনির সাথে বেশ জোর করেই হেসে হেসে কথা বলে মিথিলা।

এ বাড়িতে আসার পর থেকে এই প্রথম সে মিথিলার সাথে এভাবে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। মূলত আগে থেকেই মিথিলার সম্পর্কে জানার কৌতূহল ছিল তার। তবে মিথিলা এমন ভাবে নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রেখেছিল যে সেভাবেই কোনদিন সুযোগই হয়নি তার সাথে কথা বলার।

মিথিলার সাথে বেশ ভালো সময় কাটে অনির। মিথিলাকে এভাবে হাসিখুশি দেখে সব থেকে বেশি যে মানুষটা খুশি হন তিনি হলেন সাবরিনা বেগম। মিথিলাকে খাইতে দিতে চাইলে মিথিলা তাকে আটকে দেয়।

মিথিলার আবদার সে অনির হাতে খাবে। অনিও বেশ খুশি হয় এত অল্প সময়ের মধ্যেই মিথিলাকে তার সাথে এত সহজ হতে দেখে। কি অদ্ভুত ব্যাপার তার মনেই হচ্ছে না এই সেই মিথিলা যে দুদিন আগেই নিজের প্রাণ শেষ করার চেষ্টা করেছিল নিজেকে সবার আড়ালে আড়ালে রাখতো। যে মেয়েটা অনির সামনেও আসতো না আজ সেই অনির হাতে খাওয়ার জন্য আবদার করছে।

অনি মিথিলার এমন আবদার শুনে মুচকি হাসে। সাবরিনা বেগমের হাত থেকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেন মিথিলাকে। খুব যত্ন নিয়ে সে মিথিলাকে খাইয়ে দেয়। অনির সাথে কথা বলে মিথিলার বেশ হালকা লাগছে। তার কষ্ট বোধ হয় কিছুটা কমতে শুরু করেছে। মিথিলাকে খাইয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটায় অনি।

মাগরিবের আযান দিলে মিথিলার রুম থেকে বেরিয়ে আসে অনি। রুমে গিয়ে রিশাদকে কোথাও দেখতে পায়না। হয়তো মসজিদে গেছে মাগরিবের নামাজ পড়তে। অনি নিজেও অযু করে এসে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নেয়। নামাজ শেষ করে জাহানারা বেগমের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে অনি।

কথা বলা শেষ করে অনির খেয়াল হয় রিশাদ এখনো বাড়ি ফেরেনি। অনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। রিশাদকে কল দেয় অনিম তবে ফোন রিসিভ করেনা। দুতিনবার কল দিয়েও রিশাদের কোন রেস্পন্স পায়না অনি।
হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে নিচে নেমে আসে।

ড্রইংরুমে বসে কফি খাচ্ছিলেন রায়হান সাহেব। অনি নিচে এসে রায়হান সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ বসে গল্প করে। শায়লা বেগম অনির জন্যও এককাপ কফি পাঠিয়ে দেন। কফির আড্ডায় বেশ ভালো একটা সময় পার করে অনি আর রায়হান সাহেব। রায়হান সাহেবের সাথে এভাবে আড্ডা দিয়ে মনটা ভালো হয়ে যায় অনির।

একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে রিশাদ। রায়হান সাহেবের পাশে বসে পড়ে সে।

–“কি ব্যাপার তোমার এত দেরি হলো কেন আসতে?নামাজ পরতে তো আমার সাথেই বেরিয়েছিলে। নামাজ পড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেছিলে বলো তো?(রায়হান সাহেব)

–“মসজিদ থেকে বেরিয়ে শিউলির সাথে দেখা হয়ে গেছিল। ওর সাথেই কথা বলতে বলতে ওদের দোকান থেকে একটু চা খেয়ে আসলাম আর কি।”(রিশাদ)

–“ওহ আচ্ছা। আমাকে বললেও পারতি আমিও যেতাম তোর সাথে।”(রায়হান সাহেব)

–“তুমি তো আগেই চলে এসেছিলে মসজিদ থেকে।”(রায়হান সাহেব)

রায়হান সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রিশাদ। কথার ফাঁকেফাঁকে অনির দিকে তাকায় রিশাদ। কেমন থম থমে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন কোন ঝড়ে পূর্বাভাস। কিন্তু কেন?

রিশাদের দিকে কেমন অদ্ভুত চাহনি অনির। মনে হচ্ছে কোন কারণে খুব রেগে আছে যা সে চেপে রাখার চেষ্টা করছে অনি। কিন্তু কি করলো রিশাদ যে এভাবে রেগে আছে অনি। রিশাদ ভাবনায় পড়ে যায়। অন্যমনস্কভাবে তার বাবা রায়হান সাহেবের কথায় শুধু হু হা করে যাচ্ছে।

সে ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিল যে কখন অনি তার সামনে থেকে উঠে চলে গেছে তা টেরই পায়নি অনি। রিশাদ চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোথাও অনিকে দেখতে না পেয়ে তার বাবাকে বলে বসেঃ

–“বাবা অনন্যময়ী কোথায় গেল?”(রিশাদ)

রায়হান সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

–“অনন্যময়ী কোথায় গেল মানে? এইতো এক্ষুণি বলে গেল যে রুমে যাচ্ছে। কোথায় হারিয়েছিলি তুই?”(রায়হান সাহেব)

–না কিছুনা। (রিশাদ) বলেই রিশাদ উঠে উপরে নিজের রুমের দিকে যায়।

রুমে ঢুকেই দেখতে পায় অনি বিছানায় বসে ফোনে কিছু একটা দেখছিল। রিশাদ রুমে এসেছে একবারও সেদিকে তাকায় না অনি। অনি যে ইচ্ছে করেই এমন ভাব করছে তা রিশাদ বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে।

রিশাদ গিয়ে অনির কাছে বসে পড়ে। অনেকটা কাছাকাছিই বসে পড়ে সে। অনির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। সে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কোন এক মহাকাজে ব্যস্ত। বাকি কোন কিছুর খেয়াল নেই তার।

রিশাদ অনির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হালকা কাশি দেয় এতেও সে অনির কোন হেলদোল দেখতে পায়না।

কিছুটা শব্দ করে বিড় বিড় করে বলে;

–“মেমসাহেব আজ খেপেছে।”(রিশাদ)

রিশাদের কথা অস্পষ্টভাবে অনির কানে পৌঁছায়। বাম পাশে ভ্রু বাঁকিয়ে রিশাদের দিকে তাকায় অনি। অনির এমন চাহনি রিশাদের খুব নজর কাড়ে। রেগে গেলে অনির তাকানোর ধরনটা অন্যরকম মনে হয় তার কাছে। ঘোর লাগানো চাহনি। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে রিশাদ অনির দিকে।

রিশাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনির মেজাজটা আরো খারাপ হয়। চোখ মুখ খিচিয়ে রিশাদের দিকে তাকায়। অনিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে যায় রিশাদ।

রিশাদ মিন মিন করে বলেঃ

–“কি হয়েছে আপনার?এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”(রিশাদ)

–“আপনার ফোন কোথায় একবার বের করে দেখুন তো।”(অনি)

রিশাদ ফোন বের করে তার চোখ কপালে ওঠে। অনির অনেকগুলো মিসড কল। নামাজ পড়ার সময় সাইলেন্ট করে রেখেছিল। পরে চেক করতে ভুলে গিয়েছিল।

–“সরি!আসলে নামাজ পড়ার সময় সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম।পরে ভুলে গিয়েছি। প্লিজ সরি।”(রিশাদ)

–“তা না হয় বুঝলাম। আপনি একা একা গিয়েছিলেন কেন চা খেতে?”(অনি)

–“মানে?আমি তো প্রায়ই একাই চা খেতে যাই। আর কাকে নিয়ে যাবো?”(রিশাদ)

–“আগে যেতেন এখন আর যাবেন না।”(অনি)

–“আচ্ছা ঠিক আছে যা বলবেন তাই হবে। কিন্তু কাকে নিয়ে যাবো আমার সাথে।”(রিশাদ)

–“কেন আপনার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে নিয়ে যাবেন।”(অনি)

–“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে তো আমি খুঁজেই পাইনা সারাদিন। আপনি আবার যাবেন আমার সাথে চা খেতে। এতো আমার পরম।সৌভাগ্য ম্যাম।এই তো সেদিন বলছিলেন আমি অফিস যাওয়া শুরু করলে নাকি আপনি বাসায় বসে বসে বোর হবেন। তো আজ বিকেল থেকে আপনাকে তো একবারও আমার ত্রিসীমানায় দেখলাম না।”(রিশাদ)

–“আপনি সব সময় এত বেশি বোঝেন কেন বলুন তো?বিকেল বেলা তো আমি মিথিলার রুমে ছিলাম। “(অনি)

–“ওহ হ্যা ভালো কথা মিথিলা এখন কেমন আছে? “(রিশাদ)

–“এখন অনেকটাই বেটার। অনেকক্ষণ ধরেই আজ কথা হয়েছে ওর সাথে আমার।”(অনি)

–“ওহ আচ্ছা। আপনাকে কি কিছু বলেছে নাকি?আপনি কি কিছু জানতে পেরেছেন?”(রিশাদ)

–“কোন ব্যাপারে বলুন তো?”(অনি)

–“এই যে হঠাৎ করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলো কেন?”(রিশাদ)

রিশাদের কথায় অনি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেছে। রিশাদকে কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে সে কারণটা জানা সত্ত্বেও রিশাদকে এই সময় বলতে চাচ্ছেনা মিথ্যাও বলতে পারবে না। তাই সে কৌশলে রিশাদের প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। রিশাদের কিছুটা খটকা লাগে। তার মনে হচ্ছে অনি এই বিষয়ে কিছু একটা জানে কিন্তু তাকে বলতে চাচ্ছে না। রিশাদ আপাতত এ বিষয়ে ভাবতে চাচ্ছে না। মিথিলার এমন একটা কাজের পেছনের কারণটা জানার চেয়ে বেশি জরুরি তার সুস্থতা।

অনির সাথে কথা বলতে বলতেই শায়লা বেগম সবাইকে নিচে ডাকেন ডিনার করার জন্য। অনি রিশাদ নিচে নেমে আসে।

ডাইনিং টেবিলে সবাই উপস্থিত হয়েছে। একটু পরেই মিথিলাকে ধরে ধরে নিয়ে আসে সাবরিনা বেগম। অনি তার পাশের চেয়ারটা টেনে মিথিলাকে বসতে দেয়। মিথিলা ম্লান হাসি দিয়ে অনির পাশে বসে পড়ে।

মিথিলাকে দেখে সবাই বেশ খুশি হয়। ঝড় ঝাপটা শেষে আজ বেশ কয়েকদিন পর পুরো পরিবার একসাথে খাবার খাচ্ছে। অনি প্রতিনিয়ত এই পরিবাবের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। পরিবারের প্রতিটি মানুষের মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে অনি। যত দিন যাচ্ছে সম্পর্কগুলো আরও দৃঢ় হচ্ছে। কোন এক অলৌকিক শক্তির বলে যদি সারাজীবন এই পরিবাবের মানুষগুলোর সান্নিধ্য পেত খুব কি মন্দ হতো??মাঝে মাঝে তারও ইচ্ছে এই পরিবারকে দু হাতে আঁকড়ে ধরতে;সংসারের মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করতে।

চলবে………..

আসসালামু আলাইকুম?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here