অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৩৪

0
5617

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৩৪

বসন্ত পেরিয়ে আরো এক নতুন বসন্ত হাতছানি দিচ্ছে। তবে অনামিকার জীবনে আসেনি আর কোন বসন্ত। গাছের ঝরা পাতার মতো ঝরে গেছে তার সকল হাসি। অচঞ্চলতা,নীরবতা গেঁথে গেছে তার হৃদয়, মস্তিষ্ক জুড়ে।

অনামিকার অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। পরিবারের সবাই অনামিকাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। আদনান সাহেব যেন পুরোপুরিভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছেন। তবুও যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন তার কলিজার টুকরো বোনকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখার। কিন্তু বিপত্তি তখনই বাঁধে যখন অনামিকা শেখের মাঝে বেড়ে ওঠে অনির অস্তিত্ব।

অনামিকার অবস্থা পাগলপ্রায় হয়ে যায়। অনাগত এই সন্তানের আগমন বার্তা যেন তাকে আরো বেশি আঘাত হানে। নিজের পেটের সন্তানকেই যেন তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা মনে করছিলেন। সন্তানের বাবার প্রতি যেমন সীমাহীন ঘৃণা ছিল তার প্রভাব পড়েছিল সন্তানের ওপরেও। ঘৃণার পরিমাণ এতোটাই অধিক ছিল যে এই সন্তানটা তারও সেটা তিনি হয়তো ভুলেই গেছিলেন। মানসিক যন্ত্রণায় এতোটা বিপর্যস্ত ছিলেন যে নিজের গর্ভজাত সন্তানের প্রতি তার তিল পরিমাণ ভালোবাসাও ছিল না। যদি মহাপাপ না হতো হয়তো এই সন্তানকে তিনি পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বেই শেষ করে দিতেন। তার ধর্মীয় অনুশাসনের জোরেই হয়তো এই পাপকাজ হতে বিরত ছিলেন কোথাও কোন ভালোবাসা ছিল না তার সন্তানের প্রতি। একেবারেই অনুভূতিশূন্য অনামিকা।

দিন যত এগিয়ে আসছে অনামিকা আরো বিধ্বস্ত হচ্ছে শারীরিক ও মানসিকভাবে। আদনান সাহেব আর জাহানারা বেগম সমান তালে অনামিকার যত্ন করছেন। তারা কোথাও আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। এই সন্তানের আগমনে হয়তো তাদের অনামিকা প্রাণ ফিরে পাবেন। কেননা অনামিকা বরাবরই বাচ্চাদের প্রতি একটু বেশিই দূর্বল। যা সবাই খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। ছোট্ট অদ্রির প্রতি অনামিকার আদর স্নেহ সবারই নজর কেড়েছে।

অনামিকার এই দুঃসময়ে আদনান সাহেবের পাশে যে ব্যক্তি সব সময় ছায়ার মতো ছিলেন তিনি হলেন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু আশরাফ শেখ। আদনান আর আশরাফ বাল্যকালের বন্ধু পাশাপাশি বিজনেস পার্টনার। সেই সুত্রেই অনামিকাদের বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাতায়াত।

আশরাফ সাহেবের একমাত্র কন্যা হলো অদ্রি। বছর তিনেক বয়স হবে তার। জন্মের সময়ই মারা যায় তার মা।এরপর থেকে আশরাফ শেখ নিজ হাতে তার সন্তানের লালন পালন করছেন। কাজের সূত্রে এবাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত হওয়ায় ছোট্ট অদ্রিও এ বাড়ির মানুষদের আদর স্নেহ পেতে থাকে। বিশেষভাবে যে মানুষটার সাহচর্য পায় তা হলো অনামিকা। অনামিকার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে অদ্রি।

অনামিকার কাতর চাহনিতে যখন আদনান সাহেব ভেঙে পড়েন তখন তার কাঁধে হাত রেখে সাহস জোগান আশরাফ সাহেব। আশরাফ পাশে থাকায় কিছুটা ভরসা পান আদনান সাহেব।

সন্তানে আগমনের বার্তা পৌঁছে যায় রাহাতের কাছেও। আদনান সাহেব তার বিরুদ্ধে মামলা করলেও তিনি কোন সুফল পাননি। কেননা অনামিকা তার বিবাহিত স্ত্রী। অনামিকার অনুপস্থিতিতে রাহাতের মধ্যে এক আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বিগত দিনগুলোর নিষঙ্গ জীবনযাপনে তিনি জীবনের আসল মানে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। অনামিকা শূন্যতায় ভুগছে সে। আদনান সাহেব অনামিকার সামনে যে বিশাল প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে তা ভেদ করে পৌঁছতে পারেননি রাহাত অনামিকার কাছে।

রাহাতের মধ্যে জেগে ওঠা অপরাধবোধগুলোও তাকে আটকে দিচ্ছিল অনামিকার সামনে দাঁড়ানো থেকে। তিনি চাচ্ছিলেন অনামিকার থেকে দূরে থাকতে। যে কটা দিন অনামিকা তার সাথে ছিল সে খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে অনামিকা তাকে কতটা ঘৃণা করে। তখন অনামিকার এই অবহেলা, ঘৃণায় রাহাতের মাঝে কোন ভাবান্তর হয়নি। তবে আজ তা রাহাতের মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুতাপ অনুশোচনা,অপরাধবোধে জরাজীর্ণ হয়ে আছে রাহাত। তাইতো সে এতদিন যাবত নিজেকে দূরে রেখেছে অনামিকার থেকে। যতবারই সে অনামিকার সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে অনামিকা আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যা রাহাতের জন্য ছিল আরো বেশি কষ্টকর।

নিজের সন্তানের আগমনের খবর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় রাহাত। পরক্ষণেই মলিনতা ছেয়ে যায় তার মনের আকাশে। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক হতো অনামিকার সাথে তবে হয়তো আজ অনামিকার সাথে আনন্দের সাগরে ডুবে থাকত। অনামিকার পাশে থাকতে পারত। হতে পারত সুখী দম্পতী। আফসোস!অন্যের কথায় প্ররোচিত হয়ে সে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছে। যে করেই হোক তাকে এই ভুলটা শোধরাতেই হবে।

এলোমেলো রাহাত ছুটে চলে যায় অনামিকার বাড়ির প্রাঙ্গণে। গেটে দারোয়ান তাকে আটকে দিলে এক দফা ধ্বস্তাধস্তি হয়। শোরগোলের শব্দ পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আদনান আর আশরাফ সাহেব। রাহাতকে দেখে চড় চড় করে রেগে যায় আদনান সাহেব। দারোয়ানকে রাহাতের হাত থেকে ছেড়ে নিয়ে রাহাতকে থাপ্পড় মারে আদনান সাহেব।

থাপ্পড়ের শব্দে কেপেঁ ওঠে চারপাশ।রাহাতের কোন ভাবান্তর হয়না। তার কাজের ফল হিসেবে এর চেয়েও আরো বেশি শাস্তি পাওয়ার কথা। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে আদনানের দিকে। আদনান সাহেব রাহাতকে যা তা বলে অপমান করেন। রাহাত একবার অনামিকার সাথে দেখা করতে চায়।তার কৃতকর্মের জন্য মাফ চায়। কিন্তু আদনান সাহেব কোনমতেই তার কোন কথা শোনে। বাইরে এতো শোরগোলের আওয়াজ শুনে জাহানারে বেগমের হাতে কিছুটা ভর দিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে বেরিয়ে আসে অনামিকা। তার শরীরটা ফুলে গেছে। পেটটাও বেশ বড় হয়ে গেছে। পা ফেলতে যেন তাকে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে।

অনামিকাকে দেখে রাহাতের চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা দেয়। যা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অনামিকার মলিন চাহনির দিকে নজর পড়তেই রাহাতের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। নিজের প্রতি ঘৃণা হয় তার। অন্যদের কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছে।

অনামিকা জাহানারা বেগমের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাহাতের দিকে এগিয়ে আসে। রাহাত অনামিকা মুখোমুখি হয়। যেখানে রাহাত নতমস্তকে অপরাধবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনামিকা সেখানে রাহাতের উপর ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

নীরবতা ভেদ করে রাহাত বলে ওঠেঃ”অনামিকা!আমি জানি আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তুমি এর জন্যে আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি তাই মাথা পেতে নেব। তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি তোমার কোন ক্ষতি হতে দেব না।।প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দেবে? আমি তোমাকে আর আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমাকে দেবে একটা সুযোগ। প্লিজ অনামিকা আমার সন্তানকে আমার থেকে দূরে রেখো না। আমার অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়। তবুও আমি তোমার কাছে একটা সুযোগ ভিক্ষে চাইছি। ”

রাহাতের কথা শুনে অনামিকা হালকা হেসে ওঠে।সবাই অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। অনামিকার পাগলামি কারোই বোধগম্য হয় না।

অনামিকা রাহাতের কথায় জোরালো ভাবে কোন উত্তর দেয় না। ম্লান কণ্ঠে বলে;

–“আপনি তো আমার জীবনটা অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছেন। যেটুকু নষ্ট হওয়ার বাকি ছিল তা আপনার অনাগত সন্তান করে দিয়েছে। আপনাকে ঠিক যতটা ঘৃণা করি তার এক বিন্দুও কম ঘৃণা করিনা আপনার এই অনাগত সন্তানকে। খুব ভালো প্রতিশোধ নিয়েছেন মি.রাহাত। ”

কথাগুলো শুনে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। পরিস্থিতি কিভাবে একজন মা কে নিজের সন্তানের প্রতি ঘৃণা জন্মিয়ে দিয়েছে তা দেখে সবাই যেন নির্বাক।

অনামিকা আর কিছু না বলে আস্তে আস্তে পেছনে ফিরে রুমের দিকে যায়। রাহাত অনামিকার কথাগুলো মানতে পারছে না। তাকে অনামিকা ঘৃণা করুক ঠিক আছে এটাই তার প্রাপ্য। কিন্তু তাদের সন্তান তো কোন অপরাধ করেনি। তাহলে সে কেন এই শাস্তি পাবে। কি দোষ করেছে সে??

রাহাত সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বার বার অনামিকার নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু অনামিকা কোন সাড়া দেয় না। এদিকে আদনান আর আশরাফ রাহাতকে গেটের বাইরে ধাক্কা দিয়ে বের করে তালা ঝুলিয়ে দেয়। রাহাত ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। ধূলোয় গড়াগড়ি খায়। খুব অসহায় লাগছে তার নিজেকে। তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষ বলে মনে হচ্ছে তার।

রাহাত নিজেকে সামলে নিয়ে অনামিকার বাড়ি থেকে চলে যায়। বাড়ি ফিরতেই রাহাতের মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। রাহাতকে ধূলোয় মাখা মলিন মুখে দেখে রাহাতের মায়ের চোখে পানি চলে আসে। রাহাত তার মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। অনামিকার জন্য তার ছেলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। রাহাতের মা রাহাতকে সামলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে রাহাত ঘুমিয়ে পড়ে।

রাহাত ঘুমিয়ে পড়লে রাহাতের মা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় অনামিকার বাড়ির উদ্দেশ্যে। অনামিকাদের বাড়ির ঠিকানা তিনি জানতেন না। তাই রাহাতের এক বন্ধুকে কল করে সাথে নিয়ে যান।

অনামিকাদের বাড়িতে গিয়ে রাহাতের মাকে যথাযথ সম্মান করা হলেও তিনি যখন অনামিকা আর রাহাতের একসাথে থাকার কথা বলেন তখন আদনান আর চুপ থাকতে পারেন না। রাহাতের মা কিছুটা অপমানিত হয়ে বেরিয়ে যায়।

সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেছে। রাহাত কিছুটা নীরব হয়ে গেছে। সব সময় শুধু একটা কথাই ভাবছে কিভাবে অনামিকাকে সে ফিরে পাবে। আর এদিকে অবামিকার ডেলিভারির দিনও হয়ে এসেছে প্রায়। তবে এতে অনামিকার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এই সন্তান তার পেট থেকে সরাতে পারলেই যেন বোঝা নেমে যাবে।

রাহাত কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। তার মনটা কু ডাকছে। অনেক ভাবনা চিন্তা শেষে সে অনামিকার বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গাড়ু নিয়ে বেরিয়ে যায় তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

আগের দিন দারোয়ানের সাথে ঝামেলা হলেই আজ সে দারোয়ানকে অনুরোধ করে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। ঢুকতেই দেখা হয়ে যায় আদনান সাহেবের সাথে।

–তোমার সাহস কি করে হলো আবার এবাড়িতে আসার?আমার বোনের জীবনটা শেষ করে দিয়েও তোমার শান্তি হয়নি?কি চাও আর তুমি?এক্ষুণি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।এ বাড়ির আশেপাশে যেনো আর কোনদিনও তোমাকে না দেখি!(আদনান)

–ভাইয়া প্লিজ আমি একবার শুধু অনামিকার সাথে দেখা করতে চাই।প্লিজ ভাইয়া আমাকে শুধু একবার অনামিকার সাথে কথা বলার সুযোগ দিন। আমাদের সন্তান এই পৃথিবীতে আসতে চলেছে।আমি শুধু একবার অনামিকার সাথে দেখা করতে চাই।প্লিজ ভাইয়া আমাকে একটা সুযোগ দিন।আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।অনামিকার সাথে যা করেছি আমি অন্যায় করেছি।আপনি আমাকে যে শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নেব। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দিন ভাইয়া।আমি অনামিকাকে ভালোবাসি ভাইয়া।ও আমার সন্তানের মা হতে চলেছে। প্লিজ ভাইয়া আমি অনামিকাকে ফিরে পেতে চাই। দরকার হলে আমি ওর পা ধরে মাফ চাইবো।প্লিজ ভাইয়া আমাকে একটা সুযোগ দিন আমার ভুলগুলো শোধরানোর।আমি আমার স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে চাই।প্লিজ ভাইয়া আমাকে একটা সুযোগ দিন।অনামিকার কোন ক্ষতি আমি করবো না। দয়া করুন আমাকে ভাইয়া। কথা গুলো বলতে বলতে ক্রমাগত কান্নার বেগ বেড়ে যায়। রাহাত আদনানের পায়ের কাছে বসে পড়ে।

রাহাতের কথায় আদনানের মন গলেনি। যা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। রাহাতের কাছে থেকে দূরে সরে এসে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে; তোমার ওই মুখে আমার বোনের নাম যেন আমি না শুনি। তোমার মতো নিচে নামার আগেই তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেছে। আমার বোনের নাম দ্বিতীয় বার আর মুখে আনবে না। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। তোমার গুন্ডামি পুরা এলাকায় চললেও এখানে চলবে। জাস্ট গেট আউট ইউ ইডিয়ট।

–প্লিজ ভাইয়া আমাকে একটা সুযোগ দিন।আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছি। শুধু একবার অনামিকার সাথে কথা বলার সুযোগ দিন। আমি অনামিকার পা ধরে ক্ষমা চাইব।অনামিকা যদি আমাকে ক্ষমা না করে আমি আর আপনাদের বিরক্ত করবো না।প্লিয ভাইয়া আমাকে একটা সুযোগ দিন।

রাহাত কোনভাবেই অনামিকা অবধি পৌঁছাতে পারেনা। কিছু একটা ভেবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অনামিকাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে নজর রাখে। কিছুক্ষণ পরেই সে কাউকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে মুচকি হাসে। সে ভাবে আদনান বেরিয়ে গেছে। বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে সে প্রাচীর টপকে প্রবেশ করে।

রাহাত পাইপ বেয়ে ছাদে পৌঁছে যায়। অনামিকা একটু ফ্রেশ হওয়ার জন্য ছাদে এসে দোলনায় বসে চোখ বুজে ছিল। জাহানারা বেগম অনামিকাকে রেখে নিচে গেছেন মিনিট পাঁচেকের জন্য।

রাহাত এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পায়না। দোলনায় কাউকে বসে থাকতে দেখে। কিছু একটা ভেবে পা টিপে টিপে সেদিকে এগিয়ে যায়। দোলনার সামনের দিকে আসতেই অনামিকার মুখ স্পষ্ট হয়।

কপাল কুঞ্চিত করে চোখ বুযে হেলান দিয়ে শুইয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। মুখে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে। অনামিকার দিকে তাকিয়ে স্বস্তি অনুভব করে রাহাত। অনামিকাকে দেখে যেন তার তৃষ্ণা মিটছে না। আবেগে সে অনামিকার সামনে চলে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিতে হাত বাড়ায়।

কারো স্পর্শ অনুভব করতে পেরে অনামিকা কিছুটা কেঁপে ওঠে। চোখ মেলে রাহাতকে দেখার জন্য অনামিকা একদম প্রস্তুত ছিল না। রাহাত অনামিকার থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়।

অনামিকা রাহাতকে দেখেই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে যায়। রাহাত অনামিকাকে উত্তেজিত হতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। অনামিকার কাছে গিয়ে অনামিকা সামলাতে চাইলে রাহাতকে দূরে সরিয়ে দিতে যেয়ে অনামিকা টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যাতে নেয়। রাহাত অনামিকাকে ধরতে যায়। অনামিকাকে সামলে নিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায় রাহাত। অনামিকা রাহাতের উপর পরে যায়। তবে বিশেষভাবে কোন আঘাত লাগে না।

সেই মূহুর্তে নিচে থেকে উপরে আসেন জাহানারা বেগম আর আদনান সাহেব। রাহাত আর অনামিকাকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে আদনান সাহেব ভাবেন রাহাত অনামিকার সাথে জোরজবরদস্তি করছে। ক্রোধে ফেটে পড়েন তিনি। অনামিকাকে জাহানারা বেগম সামলে নেয়।

আদনান সাহেব রাহাতকে মারতে শুরু করেন। রাহাত হতভম্ব হয়ে যায়। আদনানকে আটকানোর চেষ্টা করে না সে।নীরবে সে আঘাতগুলো সহ্য করে নেয়। আদনান সাহেব রাহাতকে মারতে মারতে একেবারে ছাদের ধারের দিকে চলে আসেন। রাহাত টাল সামলাতে না পেরে রেলিং এর সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যেতে নেয়।

আদনান সাহেব রাহাতকে মারলেও তার উদ্দেশ্য ছিল না রাহাতকে এভাবে নিচে ফেলে দেওয়া। তিনি রাহাতের হাত চেপে ধরেন। রাহাতের শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে সব আধারে পরিণত হয়। রাহাতের শরীরের ভার বেশিক্ষণ টেনে রাখতে পারেননি আদনান সাহেব। তার হাত কিছুটা আলগা হতেই রাহাতের হাতটা পিছলে বেরিয়ে যায়। নিচে মুখ থুবড়ে পরে যায় রাহাত। আদনান সাহেব চিৎকার করে বলে ওঠেনঃ

–“রাহাত”!

দৌঁড়ে নিচে নামে আদনান সাহেব। রক্তাক্ত অবস্থায় রাহাতকে দেখে বোধ হারিয়ে ফেলেন।এটা কি করে ফেললো সে। রাহাতের মাথার দিক থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। শরীরটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে। দারোয়ানের সহায়তায় রাহাতকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

হাসপাতালে সব ফর্মালিটিস পূরণ করে রাহাতের বাড়িতে ফোন দেয় সে। আশরাফকে দু তিনবার কল দেয়। মিটিং এ থাকায় সে কল রিসিভ করতে পারে না । রাহাতের ওটির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সে। হয়ত একটু পরেই রাহাতের মৃত্যুর সংবাদ তার কানে ভেসে আসবে।

আদনানের ফোনটা বেজে ওঠে। মা জাহানারা বেগম বাড়ি থেকে কল করে তাকে জানান দেয় প্রসব বেদনায় কাতর অনামিকার কথা। আদনান হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায় গাড়ি নিয়ে। তার হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সে কি মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে।

গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। অনামিকাকে এই মূহুর্তে হসপিটালে এডমিট করতে হবে। বেশ মানসিক চাপে আছেন আদনান সাহেব। হিতাহিত জ্ঞান যেন লোপ পাচ্ছে তার। মস্তিষ্ক সংকীর্ণ হচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে তার। এমন সময় সামনে থেকে এগিয়ে আসা ট্রাকের দিকে নজর পড়েনি তার। হাইওয়ে ক্রস করতেই ট্রাকটা এসে ধাক্কা দেয় আদনান সাহেবের গাড়িতে। এক ধাক্কাতেই যেন আদনান সাহেব সহ পুরো গাড়িটা ছিটকে পড়ে যায়। গাড়ির ধাক্কার শব্দে পুরো শহরটা যেন কেপে ওঠে। চলমান মানুষেরা স্থির হয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে কোলাহলে ছেয়ে যায়। সব মানুষেরা এগিয়ে আসে।

গাড়িটার বেহাল দশা। স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে আদনান সাহেবকে উদ্ধার করে। তবে যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেছে ইতিমধ্যে। আদনান সাহেবের জীবনাবসানের জন্য একটা ধাক্কাই যথেষ্ট ছিল। হয়ত এখনো ক্ষীণ শ্বাস চলছে কি চলছে না তা বোঝা মুশকিল।

অন্যদিকে প্রসব বেদনায় কাতর অনামিকার অবস্থা ক্রমাগত আরো খারাপ হচ্ছে। জাহানারা বেগম এলাকার একজন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে আসেন যিনি এসব বিষয়ে পারদর্শী। আদনান আসছে না ভেবে তার জন্যও চিন্তা হচ্ছে। ওদিকে রাহাতের ও কোন খবর পাওয়া যায়নি।

একটু পরেই গাড়ির হর্ণের শব্দ আসায় খুশি হয়ে যান জাহানারা বেগম। আদনান এসেছে ভেবে বেরিয়ে আসেন। তবে আশরাফকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পান। আশরাফ মিটিং থেকে বেরিয়ে আদনানকে ফোন দেয় তবে সংযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। এই মূহুর্তে এই বিষয়ে না ভেবে সে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায় অনামিকাকে।

অনামিকাকে হসপিটালে নেয়ার পর ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে আশরাফ আর জাহানারা বেগম। আদনানকে ক্রমাগত কল দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু কোন উত্তর পাচ্ছে না। ওয়েটিং রুমের বাইরে বেশ শোরগোল শুনে কিছুটা কৌতূহলবশত বের হয়ে আসে আশরাফ।

লোকমুখে সে শুনতে পায় কোন এক্সিডেন্টের কথা। কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপ দেখায় না। সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। দুজন ওয়ার্ড বয় একটা স্ট্রেচার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আশরাফ দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আদনানকে কল দিয়ে কানে ফোন ধরে।তার নজর ছিল তার দিকে এগিয়ে আসা স্ট্রেচারের দিকে। স্ট্রেচারটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।

আশরাফের চোখের সামনে আদনানের রক্তাক্ত দেহটা স্পষ্ট হয়। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে আশরাফের। দুকদম পিছিয়ে যায় সে। কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় সবটা বুঝে উঠতে। কিভাবে কি হলো কিচ্ছু বুঝতে পারে না সে।

দৌঁড়ে গিয়ে আদনানের কাছে যায় আশরাফ। এতক্ষণে জাহানারা বেগমও তার ছেলের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন। ছেলের এই অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে ওঠেন। উপস্থিত সবার চোখেই পানি চলে এসেছে। আশরাফের অবস্থাও পাগল প্রায়।

ক্ষীণ শ্বাস চলছে আদনানের।নিভু নিভু প্রদীপের মতো। যেকোন মূহুর্তে তা নিভে যেতে পারে। আদনান হালকা চোখ খুলে একবার মায়ের দিকে তাকায়। আশরাফের হাতে মুষ্টিবদ্ধ আদনানের কিছুটা নড়ে ওঠে।

আধো আধো কণ্ঠে আদনান আশরাফকে বলেঃ

–“আমার পরিবার কে একটু দেখে………. ”

আদনানে কথা পুরোপুরি শেষ হয়না। শেষ হওয়ার পূর্বেই চোখ দুটো স্থির হয়ে যায়। চারদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরিবেশটা ক্রমাগত বিষাদঘন হয়ে যায়।

ফ্লোরে বসে পড়েন জাহানারা বেগম।আশরাফ সাহেব জাহানারা বেগমকে সামলে নেন। আশরাফকে জড়িয়ে ধরে কষ্টের অশ্রুগুলো ছেড়ে দেন জাহানারা বেগম। আশরাফও ক্রমাগত অশ্রুপাত করে চলেছে।

তাদের কান্নার শব্দের সাথে মিশে যায় নবজাতক শিশুর আগমন বার্তার কান্না। একজন নার্স বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে এসে জাহানারা বেগমের কোলে তুলে দেন।

জাহানারা বেগমের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছুটা স্তব্ধ হয়ে যায় সে। জাহানারা বেগম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদতে থাকেন। বাচ্চাটার মাঝেই এক নতুন আলোর আশা খুঁজে পান।

চলবে……….

আসসালামু আলাইকুম। দেরিতে দেয়ার জন্য দুঃখিত।আমার পরীক্ষার জন্য দেরি হয়ে গেছে। বোনাস পার্টটা নেক্সট দিন দিবো।ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ। আজকের পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন।ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here