অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_২০

0
6656

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_২০

২০ মিনিট পর হোটেল ড্রিম পার্কের সামনে এসে গাড়ি থামায় হিমাদ্রী। পার্কিং জোনে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে শার্ট এর হাতা ফোল্ড করতে করতে গার্ডেন এরিয়ার দিকে যায়। গার্ডেন এরিয়ার একটা ছাউনির নিচে চোখ মুখ কুঁচকে বসে ছিল রাফি।

হিমাদ্রী রাফির দিকে এগিয়ে যায়। রাফির মাথায় একটা টোকা দিয়ে হিমাদ্রী তার সামনে বসে পড়ে।

রাফি কিছুটা চটে যায়। তবুও সে শান্ত গলায় বলে; ভাই তুই আমাকে এখানে কেন ডাকলি বল তো।আমি কত ইম্পরট্যান্ট একটা কাজ করছিলাম সেইটা রেখে এসে তোর জন্য মশার কামড় খাচ্ছি এখানে বসে। তোর মতলবটা কি আমাকে বল তো ??

হিমাদ্রী একটা শয়তানী হাসি দিয়ে বলে; কি মতলব থাকবে আবার? কোন মতলবই তো নেই। তুই সব সময় আমাকে ভুল বুঝিস কেন বলতো? বলেই হিমাদ্রী গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।

রাফি বিরক্তি নিয়ে বলে; হইছে মামা তোমার নাটক থামাও এবার। কি কাজে আইছ সেইটা তাড়াতাড়ি বলো আমার অনেক কাজ আছে।

হিমাদ্রী হাসি মুখে বলে; একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছি।

রাফির চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। হিমাদ্রীর মুখে এসব কি কথা শুনছে যে। যে হিমাদ্রী সব সময় মেয়েদের এড়িয়ে চলত আজ সেই একটা মেয়ের খোঁজে এখানে এসেছে। ব্যাপারটা রাফি ঠিক হজম করতে পারছে না। হিমাদ্রীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সে।

হিমাদ্রী চোখ কুঞ্চিত করে রাফির দিকে তাকিয়ে বলে; কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

রাফি নিজের হাতে চিমটি কেটে অবাক হয়ে বলে;
কি বললি আরেকবার বল।আমি মনে হয় এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তুই আর মেয়ে!!!
ভাই রে ভাই আমি মনে হয় ভুল শুনছি। কানাডার নামকরা শিল্পী দেশের সেরা বিজনেসম্যান হিমাদ্রী চৌধুরী নাকি একটা মেয়ের খোঁজে এখানে এসেছে। সিরিয়াসলি মামা এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে??

হিমাদ্রী চোখ মুখ কুঁচকে বলে; চুপ কর তো ফাজলামি করিস না। আমি সিরিয়াস চল তো এখন আমার সাথে।

রাফিকে হিমাদ্রী একরকম টেনে নিয়ে যায়। রাফি এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

হিমাদ্রী সেদিন যে জায়গায় অনিকে দেখেছিল সেই জায়গায় যায় সেখানে কাউকে পায় না। ইউনিফর্ম পরিহিত একজন ওয়েটারকে দেখতে পায় সে। ওয়েটারকে কাছে ডেকে বলে; এক্সকিউজ মি। এক সপ্তাহ খানিক আগে এখানে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। মিষ্টি কালারের সালোয়ার কামিজ পড়া ফর্শা করে হিজাব পড়া ছিল। আপনি কি চেনেন তাকে।

ওয়েটার টা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। প্রতিদিন এখানে অনেক মানুষ জম আছে তাদের মধ্যে এভাবে একজন মেয়েকে কিভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ওয়েটারটা হিমাদ্রীকে বলে; সরি স্যার আমি তো দেখি নি আপনি রিসিপশনে খোঁজ নিতে পারেন। হোটেলে কেউ এলে সেখানেই চেক ইন করতে হয়। বলেই সে সেখান থেকে চলে যায়।

হিমাদ্রী আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে। তারপর সে রিসিপশনে যায়। কিন্তু সেখানেও নিরাশ হয়। এরপর সে পকেট থেকে অনির একটা স্কেচ বের করে দেখায় রিসিপশনের মেয়েটিকে। কিন্তু সে চেনে না বলে জানায় হিমাদ্রীকে।

হিমাদ্রী হতাশ হয়ে রাফিকে নিয়ে কফিশপে বসে।
রাফি এতক্ষণ চুপচাপ নীরব দর্শক হয়ে দেখে যাচ্ছিল। এবার সে হিমাদ্রী কে বলে;
কি ব্যাপার বলতো কোন মেয়েকে খুঁজছিস কেন খুঁজছিস?

হিমাদ্রী স্কেচটা রাফিরকে দেখিয়ে বলে এই মেয়েটাকে খুঁজছিলাম আমি। তারপর পুরো ঘটনাটা রাফিকে খুলে বলে। রাফি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অপরদিকে হিমাদ্রী রেগে বারুদ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর তারা হোটেল থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে যায়। তবে হিমাদ্রী মনে মনে হাল ছাড়ে না। সে তার মায়াবতী কে যে করেই হোক খুঁজে বের করবেই।

অনি কাজ শেষ করে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে দেখে রিশাদ ঘুমিয়ে আছে। ল্যাপটপটা রেখে অনি রিশার রুমে যায়। রিশা তখন রুমে ছিল না বিধায় সে শায়লা বেগমের কাছে যায়। শায়লা বেগম তখন রুমেই টুক টাক কাজ করছিলেন। অনিকে দেখে তিনি হাসিমুখে তার পাশে বসান।

অনি বলে; কি করছো মামনি??

-এইত কাপড় গুলো একটু গোছাচ্ছিলাম।(শায়লা বেগম)

অনিও শায়লা বেগমের সাথে হাত লাগিয়ে কাপড় গোছানো শুরু করে। গল্পে আড্ডায় শ্বাশুড়ি বউমা খুব ভালো সময় কাটায়।

একটু পরেই একজন কাজের লোক এসে বলে যায় কে যেন এসেছে ড্রইংরুমে বসে আছে। শায়লা বেগম কাপড় গুলো আলমারি তে রেখে বাইরে যান। অনিও তার পিছনে পিছনে যান।

ড্রইংরুমের সোফায় জাহানারা বেগমকে বসে থাকতে দেখে অনির চোখ মুখ চক চক করে ওঠে। সে দিদা বলে চিল্লিয়ে উঠে জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে। জাহানারে বেগম দুহাত দিয়ে অনিকে আঁকড়ে ধরে। অনিকে ছাড়া তিনি কখনো কোথাও যান না। এই কয়েকদিন তার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। অনিকে বুকে জড়িয়ে যেন আজ তার বুকটা ভরে গেছে। অনি দিদাকে সালাম জানিয়ে তার সাথে কুশল বিনিময় করে। এতক্ষণে তার চোখ পাশে থাকা অনামিকা শেখের দিকে যায়। অনামিকা শেখকে দেখে তার হাসি কিছুটা মিলিয়ে যায়।

অনি অনামিকা শেখকে শুধু সালাম জানায় আর কোন কথা বলে না। জাহানারা বেগমের পাশে বসে পড়ে তার সাথে গল্প জুড়ে দেয় অনি।অনামিকা শেখ শুন্যতায় ভরা চোখে অনির দিকে তাকিয়ে থাকে।

শায়লা বেগম এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। শায়লা বেগমের সাথে কথা বলতে অনামিকা শেখের কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করছে। কিন্তু শায়লা বেগমের স্বাভাবিক ব্যবহার তার অপরাধবোধ টাকে কিছুটা কাটিয়ে দেয়। তবুও সংকোচবোধ তার মস্তিষ্ক থেকে বিদায় করাতে পারেন নি। হাসি মুখে শায়লা বেগমের সাথে কথা বলে অনামিকা শেখ।

-আপা আপনারা এসেছেন কিন্তু সাথে এত কিছু আনার কি প্রয়োজন ছিল বলেন তো আপনারা আমাদের লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন।(শায়লা)

-মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে প্রথমবার এসেছি। খালি হাতে আসলে লোকে কি বলবে বলুন তো। (অনামিকা)

শায়লা বেগম সবার সাথে বসে টুকটাক কথা বলে। এরপর শায়লা বেগম নাস্তা বানানোর জন্য উঠে যেতে নিলে অনি বলে; মামনি তোমার সাথে আমিও আসছি।

শায়লা বেগম কড়া গলায় বলেন ;কোন দরকার নেই সারাদিন তো আমার সাথেই থাকিস।আমার আগে পিছে ঘুর ঘুর করিস। এখন ওনাদের সাথে একটু বোস আমি আসছি। বলেই তিনি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান।

অনি ও শায়লা বেগমের মাঝে এত ভালোবাসার সম্পর্ক দেখে শায়লা বেগমের চোখ দুটো ভিজে আসে। খুব সাবধানে তিনি নিজেকে সামলে নেনে। অনি নামক মেয়েটা এখন তাকে সময়ে অসময়ে কাঁদায়। তারও খুব ইচ্ছে করে অনিকে কাছে টেনে নিতে। তার ভুলগুলোর জন্যই আজ তাদের মাঝে সীমাহীন দুরত্ব হয়েছে।

হিমাদ্রী অফিসে বসে কোন কাজে মনোযোগ বসাতে পারছে না। তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে সবটা মায়াবতীর ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে। সে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। রাফি হিমাদ্রীর এ ধরনের আচরণে বিরক্ত হলেও এখন তাকে বিষয়টা ভাবাচ্ছে। প্রথমে সে ব্যাপারটা গায়ে না লাগালেও এখন তাকে বিষয়টা ভাবাচ্ছে। তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে।

হিমাদ্রীকে বলে; চল আজকে তোর মায়াবতী কে খুঁজে বের করবোই। শুনেই হিমাদ্রীর চোখ দুটো খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে।

রাফি হিমাদ্রীকে নিয়ে আবার হোটেল ড্রিম পার্কে চলে আসে। রিসিপশনে গিয়ে মেয়েটার কাছে বলে; এক্সকিউজ মি ইয়াং লেডি। ক্যান ইউ টক প্লিয।

-ইয়াহ সিউর স্যার। হাই ক্যান আই হেল্প ইউ?? (মেয়েটি)

-একচুয়ালি আমরা কিছুদিন আগে এখানে একটা জরূরি মিটিং এর জন্য এসেছিলাম। আমাদের একটা ইম্পরট্যান্ট ফাইল হারিয়ে গেছে। আমাদের মনে হচ্ছে আমরা কোন ভাবে এখানে আমাদের ফাইলটা হারিয়ে ফেলেছি। আপনি একটু চেক করবেন প্লিয। (রাফি)

মেয়েটি রাফিকে বলে; ওকে স্যার।গিভ মি টু মিনিটস প্লিজ। বলেই মেয়েটি কাকে যেন ফোন করে পুরো ঘটনাটা বলে। অপর পাশের ব্যক্তি কি বলে তা শুনতে পায় না রাফি হিমাদ্রী।

মেয়েটি ফোন রেখে বলে; সরি স্যার।এধরনের কোন ফাইল পাওয়া যায় নি। আপনারা হয়ত অন্য কোথাও ফেলেছেন।

রাফি মনে মনে খুশি হয়ে যায়। সে তো এটাই চাইছিল। এবার সে মেয়েটিকে বলে; ফাইল্টা আমাদের খুব কনফিডেনসিয়াল। আমার যতদূর মনে আছে আমি এখানেই কোথাও ফেলে গেছি। আপনি কি প্লজ সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখতে পারবেন প্লিজ??

-সরি স্যার। এটা তো আমি পারব না আমাদের ম্যানেজার স্যার এর সাথে কথা বলতে হবে তাহলে। (মেয়েটি)।

এরপর রিসিপশনের মেয়েটি রাফি আর হিমাদ্রী কে নিয়ে ম্যানেজারের কেবিনে নিয়ে যায়। সেখানে রাফি ম্যানেজার কে সবটা বললে উনি ফুটেজ চেক করতে রাজি হয়। এরপর ম্যানেজার তাদেরকে নিয়ে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যায়। সেখানে
তারা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে।

হিমাদ্রী মনে করে সেদিনের ডেটটা বলে। তারপর তারা খুব মনোযোগ দিয়ে চেক করে। এরপর হিমাদ্রী অনিকে যে জায়গায় দেখেছিল সেই জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে বলে। একটু পরেই কম্পিউটার স্ক্রিনে অনিকে দেখতে পায় হিমাদ্রী। রাফিকে ইশারায় বলে যে এই মেয়েটাই তার মায়াবতী।

রাফি কায়দা করে ম্যানেজারকে বলে; অনিকে দেখিয়ে বলে এই মেয়েটা কে??

ম্যানেজার সাহেব বলে; এই মেয়েটাকে তো আমরা চিনি না স্যার। বাট ওনার সাথে যে ছেলেটি উনি আমাদের রিশাদ স্যার। এই হোটেলের ওনারের ছেলে আর পাশের মেয়েটি হলেন ওনার ফিয়ন্সে। কিছুদিন আগেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল লাস্ট মোমেন্টে বিয়েটা আর হয় নি। অনি আর রিশাদের বিয়ের বিষয়টা ফ্যামিলির মানুষ গুলো ছাড়া আর কেউ জানে না।

রাফি কিছুক্ষণ ভেবে বলে; আচ্ছা আপনার রিশাদ স্যার এর সাথে দেখা করা যাবে??

-এখন তো সম্ভব নয় স্যার আসলে ওনি এক্সিডেন্টে করেছেন। তাই হোটেলে আসেন না এখন। আর হোটেলটাও ওনার বাবাই রান করে। উনি খুব একটা আসেন না। (ম্যানেজার)

রাফি কায়দা করে ম্যানেজারের কাছ থেকে এড্রেস টা নিয়ে রাখে। এরপর তারা ম্যানেজারকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে চলে যায়।

হিমাদ্রী রাফি গাড়িতে বসে এক দফা হাসি দেয়। হিমাদ্রীর খুব খুশি খুশি লাগছে। সে রাফিকে বলে; মামা তুমি তো একদম ফাটাই দিছো। কি বুদ্ধি টাই না বের করলি রে ভাই তুই।

রাফি একটু ভাব নিয়ে হিমাদ্রী কে বলে; কোয়ালিটি আছে বস বুঝতে হবে। তোমার দ্বারা তো এসব সম্ভব না আমি না থাকলে যে কি হতো তোর আল্লাহ মালুম।

হিমাদ্রি শব্দ করে হেসে দেয়। এর মধ্যেই রেহানা বেগমের কলে ফোনটা বেজে ওঠে। হিমাদ্রী রেহানা বেগমের সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে দেয়। তারপর সে রাফিকে নিয়ে বাড়িতে যায়।

বাড়িতে ঢুকতেই ছোট ছোট দুটি পা হাসিমুখে হিমাদ্রীর দিকে দৌঁড়ে আসে। হিমাদ্রী হাটু গুঁজে বসে দুই হাত মেলে দাঁড়ায়। বাচ্চা মেয়েটি এসে হিমাদ্রী কে ছোট ছোট হাতে জড়িয়ে ধরে। হিমাদ্রী দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দেয়।

বাচ্চা মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ওঠে। হিমাদ্রী আদুরে গলায় বলে; কেমন আছে আমার গুন গুন সোনাটা?

গুন গুন গাল ফুলিয়ে রাগী গলায় বলে; গুনগুন সোনা চাচ্চার উপর রেগে আছে।

হিমাদ্রী অসহায় ভাব নিয়ে বলে; গুনগুন সোনাটা চাচ্চুর উপর রেগে আছে কেন??

-চাচ্চু খুব পচা। আমাকে একদম ভালোবাসে না। আমার সাথে দেখা করতে আসে না। (গুনগুন)

-কে বলেছে চাচ্চু তো তার গুন গুন সোনাকে এত্তোগুলা ভালোবাসে। বলেই হিমাদ্রী গুনগুনের পুরো মুখ জুড়ে চুমু খায়। গুনগুন খিল খিল করে হাসতে থাকে। তার ঝুটি গুলো হাসির সাথে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছে।

হিমাদ্রী গুনগুনকে কোলে নিয়ে খুনসুটি করতে করতে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। গাড়ি পার্ক করে এসে রাফিও বাড়ির ভেতরে যায়।

চলবে…..

আসসালামু আলাইকুম ??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here