অচেনা তুমি পর্বঃ১২

0
1310

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ১২
ড্রয়িংরুমে সকলের পিনপতন নীরবতা। শুভ্রার মা চুপচাপ মাথানিচু করে বসে আছে পাশে শুভ্রা আর কুবরা। শক্তমুখে বসে আছে সাদাফের বাবা পাশে সাদাফের মা। সাদাফ দেওয়ালে এক হাত ঠেস দিয়ে আর এক হাত পকেটে গুজে মাথা নিচু করে চোখমুখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে। আপাতত সে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে। তার মাথায় শুধু সোহেলের করা কাজগুলো ভো ভো করে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর নাদিম চুপচাপ এক কোণায় বসে আছে। এসবের পারিবারিক কথাবার্তার কিছুই সে বুঝছে না।
সাদাফের বাবাঃ তুই কিনা শেষে মেয়েকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছিস? কেন রে তোর বাপের কি টাকা পয়সা কম ছিলো? আর কাউসার ই না কোথায়। ও কেমন বাপ হ্যা, যে বাপ থাকতে মেয়েকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে হয়?
ভাইয়ের কথা শুনে মিসেস নাজমা কান্নায় ভেঙে পড়ে । কান্নার জন্য তিনি কথা ও বলতে পারছে না। তারপর শুভ্রা মুখ খুলে।
শুভ্রাঃ আব্বু মারা গিয়েছেন।
সাদাফের বাবাঃ কি!!!!!! মারা গিয়েছে মানে? কবে? কিভাবে?
শুভ্রাঃ আব্বু একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতেন। স্কুলটা অনেক দূরে ছিলো। আব্বু পাচ বছর টাকা জমিয়ে একটা মোটরসাইকেল কিনেছিল। দুই বছর আগে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আব্বুর গাড়ির সাথে একটা বাস এর ধাক্কা লাগে… তার..পর….. (শুভ্রার কান্না গলার কথাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে) । পুলিশ জানায় যে ধাক্কা লাগায় আব্বুর শরীর পুরোই বাসের চাকার নিচে চলে যায়। ( হু হু করে কেদে উঠে শুভ্রা)
সাথে কুবরা আর মিসেস নাজমা ও। নিজের ছোট্টবেলাকার প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর কথা শুনে মি.মঞ্জুর চৌধুরীর চোখ দুটো ভিজে আসছিলো।
সাদাফের মাঃ তারপর কি হয়েছিলো??
এবার মিসেস নাজমা কান্নারত অবস্থায় মুখ খুললেন।
শুভ্রার মাঃ তুমি তো জানই কোনো কিছুর সাপোর্ট ছাড়াই আমি আর কাউসার পালিয়ে এসেছিলাম। বিয়ের আগের দিন আমার বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক করে ফেলেছিলো বলে আমি রাতে আমি আব্বুকে আমার আর কাউসার এর সম্পর্কের কথা বলি। কাউসার এতিম বলে আব্বু তাকে আগে থেকেই দেখতে পারতো না।তার উপর তখনও কাউসার নিজের পায়ে দাড়ায়নি যে তাকে আব্বু মেনে নিবে। আমি যদি দ্বিতীয় বার কাউসার এর সাথে দেখা সাক্ষাত করি তাহলে আব্বু আমাকে ত্যায্যকন্যা করবে বলেছিলো। সেই অবস্থায় সাদাফ অসুস্থ ছিলো বলে তোরা ঢাকার বাইরে ছিলি। এদিকে আব্বু অন্যজনের সাথে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে ফেলে। তাই আমি তোকে চিঠিটা লিখে পালিয়ে চলে আসি। কাউসার ও ভয় পেয়েছিল এই ভেবে যে সে তো এতিম৷ আমাদের মতো প্রতিপত্তি তো তার নেই। তাই তুমিও ওর বিরুদ্ধে যাবে বলে বিষয়টা তোমাকে জানায় নি ভাইয়া।
সাদাফের বাবাঃ আব্বু মুখের ওপর বলেছিল আর তুই বিশ্বাস করে নিলি? জানিস তোদের পালানোর কথা জানার পর আব্বু স্ট্রোক করেছিলো? আরে সে তো আমাদেরই বাবা। বেশি খারাপ কি চাইতো। তুই চলে যাবার পর প্রত্যেক দিন আমাদের শুধু তোর কথা বলতো। তোকে ভুলতে পারে নি আব্বু, মরার আগে একটাই আশা ছিল তার যে সে একটি বার তোকে দেখতে চায়। আর সে আশা পূরণ করার জন্য কোথায় খুজিনি আমরা ঢাকা শহরের।
একে তো স্বামীর মৃত্যুর কথা উঠায় কাদছিলো এখন বাবার মৃত্যুর কথা শুনে আবারো অঝুরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শুভ্রার মা। কিছুক্ষন পর শান্ত হয়ে আবার বললেন।
তারপর আমি আর কাউসার আমাদের কিছু জমানো টাকা নিয়ে সোজা কক্সবাজার চলে আসি। আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই ওর একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি হয়ে যায়। আমিও প্রথম প্রথম টিউশনি করতাম। তবে শুভ্রা হওয়ার পর ছেড়ে দিই। আর কাউসার এর বেতন ও ভালো ছিলো। গ্রামে থাকতাম বলে সেখানে শহরের মতো এতো আর্থিক চাহিদা বেশি ছিলো না। এক বছর পর কুবরা ও হয়। সব কিছু ভালোই চলছিলো। তবে এমন নয় যে আমার তোমাদের কথা মনে নেই। এখানে আসার পর তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে সেই নাম্বার বারবার বন্ধ আসতো। আর ঢাকায় গিয়ে আব্বুর সামনে আমরা কোন মুখে দাড়াতাম। শুভ্রা যখন ক্লাস ৮ এ তখন যে.এস.সি পরিক্ষা চলছিলো। ভেবেছিলাম ওর পরিক্ষার পর ছুটিতে সবাই ঢাকা যাবো। কিন্তু মেয়েটার পরিক্ষা যেদিন শেষ হয়েছিলো, সেদিন ই কাউসার আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলো ( কান্না করতে করতে) ।
শুভ্রাঃ আব্বু চলে যাওয়ার পর আমাদের প্রায় পথে বসার অবস্থা। কোনো দিক থেকেই আর্থিক সাপোর্ট ছিলো না আমদের। আমি কোনো রকম আমার জে.এস.সি তে প্রাপ্ত বৃত্তির টাকা নিয়ে পরিক্ষা টা দিই। প্রাইভেট পরতে না পারায় ভালো রেজাল্ট ও করতে পারিনি। এরই মধ্যে আনিসুর আংকেলের বউ আমাকে তাদের বাড়িতে ডেইলি ৫০০ টাকার বেতন দিবে বলেন যদি তাদের বাড়ির কাজকর্ম সব করে দেই। আমি না হয় পড়াশোনা করবো না কিন্তু দুবোনের মধ্যে একজন ও পড়ালেখা না করলে যে ভবিষ্যত পুরো অন্ধকার। তাই আমি তাদের কথায় রাজি হয়ে যাই। আমি না হয় পড়ালেখা নাই করলাম আমার বোনটা তো মানুষ হতে পারবে।
সাদাফের বাবাঃ বোন আমার এতো কিছু হয়ে গিয়েছে আর আমরা কিছু জানতেই পারলাম না। একটা বার আমাদের সাথে যোগাযোগ করতি তুই। যেখানে আব্বু তোর নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আর ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে গিয়েছে সেখানে আমার এই ভাগ্নি কে লোকের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে হয়েছে( শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে)। বিশ্বাস কর তোর নামের একটা প্রপার্টি ও আমি উনিশ বিশ করি নি। আমার গাঢ় বিশ্বাস ছিলো একদিন না একদিন তুই ফিরবিই। আজ আল্লাহ কতো বড় মিরাক্কেল করে আমাদের সাক্ষাত করিয়ে দিলেন। সবই আমার এই মা টার জন্যে ( শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে) ।
শুভ্রার মাঃ না ভাইয়া আমার এসব সম্পত্তি তম্পত্তি কিচ্ছু চাই না। আমি শুধু আমার মেয়ে দুটি কে মানুষের মতো মানুষ করে সুখি দেখতে চাই। আর কিচ্ছু না।
সাদাফের মাঃ তাই তো আল্লাহ যাই করেন ভালোর জন্যই করেন। আমি তো প্রথম প্রথম শুভ্রাকে আমার সাদাফের গার্লফ্রেন্ড ভেবেছিলাম। আর আমি তো ওকে মনে মনে আমার বউমা ভেবে ফেলেছিলাম। ভাবছি এই হয়তো সেই রাজপরি যার জন্য আমার ছেলে এতোগুলা সম্মন্ধ নাকুচ করেছে। আর এখন তো বউমার পাশাপাশি আমার মেয়ে ও হয়ে গেছে ।অবশ্য নাজু,,, তুই তো বলতিই সাদাফ কে তোর মেয়ে জামাই বানাবি। এবার তো আমার মনে হচ্ছে তা সত্ত্যি হতে চলেছে রে।
এমন মূহুর্তে মায়ের এমন উদ্ভট কথা শুনে সাদাফ ভঢ়কে যায়। শুনা মাত্রই হনহন করে রমের দিকে এগিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সাদাফ। তার রাগের মূলত একটাই কারন সোহেল। সোহেলকে যে সে কোনো মতে ছাড়বে না সে তার চেহারাতেই বুঝা যাচ্ছে। তবে মনের কোনো এক কোনায় খুব ভালো লাগছে যে শুভ্রার সাথে তার মা বিয়ের কথা বলেছে। যদিও সাদাফের মা কথাটা মজার ছলেই বলেছেন। তবু মনে মনে তার বেশ খুশি খুশি লাগছে।
কথাবার্তা শেষে সবাই রাতে খেতে বসলেও সাদাফ আর খেতে আসে নি। মিসেস মালিহা কয়েকবার ডাকলেও সাদাফ বলে সে খাবে না তার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। এবার মিসেস মালিহার নিজেরই কপাল চাপড়াইতে ইচ্ছে করছে।
মিসেস মালিহাঃ উফফ কেন যে ওই সময় কথাটা বলতে গেলাম। আর আমিও যত্তসব পেট পাতলা। সত্যিই হয়তো তাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ভালা দুই দিনের পরিচিতি তে কি করে কোনো সম্পর্ক হবে। আর যেখানে শুভ্রা কোনো বাড়িতে কাজ করতো সেখানে আমার লাটসাহেব কি করে শুভ্রাকে পছন্দ করবে। ধুর মাথায় আমার সত্যিই গোবর ভরা। এতো বয়স হচ্ছে তবুও আক্কেল হলো না। ( মনে মনে বলতে থাকে সাদাফের মা)
এতো কিছুর মাঝখানেও আমাদের প্লে বয় নাদিম কুবরা কে ফ্লার্ট করা ছাড়ে নি। সে ঠিকই মাঝেমধ্যে কুবরার দৃশ্য আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই তো খাবার টেবিলেও কোবরা কে এটা খাবেন? ওটা নিবেন? এটা ভালো হয়েছে খেতে এসব বলে কথা বলার সুযোগ খুজছিলো। কিন্তু আমাদের ঘাড়ত্যাড়া কুবরা ও এটিটিউড এ কম যায় না। সে ঠিকই নাদিম কে এড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন জানি তার নাদিম কে ভালো ছেলে বলে সুবিধার লাগছে না। এরই মধ্যে শুভ্রার মা বলেঃ তুমি কে বাবা তোমাকে তো চিনতে পারলাম না? ( নাদিম কে উদ্দেশ্য করে)
কুবরাঃ ওনি মনে হয় মামা মামিদের কেয়ার টেকার। আসছি থেকে দেখছো না এটা লাগবে নাকি ওটা লাগবে জিজ্ঞেস করছে।
শুভ্রা ওমনি গিয়ে কুবরার পেটে চিমটি কাটে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকে বোনের দিকে।
শুভ্রাঃ আরে না না আম্মু। উনি হলেন মি.চৌধুরীর বেস্ট ফ্রেন্ড। আংকেল আন্টির ছেলের মতোন ই।
শুভ্রার মাঃ দেখেছো বাবা আমি তোমাকে চিনতেই পারি নি। আর আমার এই গর্ধবটাও হয়েছে তেমন। বলি এতো বড় হয়েছিস, মিনিমাম আক্কেল জ্ঞান কবে হবে তোর? আর বললেও এভাবে বলে কেউ? বাড়ি চল তোর হবে খবর। বাবা তুমি কিছু মনে করো না বাবা হ্যা?
শুভ্রার মায়ের কথায় নাদিম শুধু মেকি হাসে। কুবরার কথাটা যে তার গায়ে লেগেছে তা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
কুবরা জানে নাদিম কোনো কেয়ার টেকার ফেয়ার কিছু না। নাদিমের গেটআপ আর আচরণ দেখে কেউই একথা বলবে না। তবে নাদিমের এসব ফ্লার্টইং কথাবার্তা চুপ করানোর জন্যই এটা বলা।
তখনই সাদাফের মা এসে বলেঃ হ্যা রে শুভ্রা ঠিকই বলেছিস, নাদিম আমার আরেকটা ছেলেই বটে। ওর মা নেই তো কি হয়েছে আমিই না হয় ওর আরেকটা মা। ছোট বেলা থেকেই অর্ধেক সময় সে আমাদের সাথে কাটিয়েছে। আমি তাকে নিছক ছেলের মতোই তাকে দেখে এসেছি।
মিসেস মালিহার কথায় নাদিমের চোখমুখ খুশিতে ভরে উঠেছে। এই একটাই মানুষ যার কাছে সে মায়ের মতোই ভালোবাসা পায়। তাই তো প্রায় তাদের সাথেই থেকে যায় সে।
সাদাফের মা আবার বলেনঃ আর আংকেল আন্টি কি রে? এসব কেমন পর পর শুনাচ্ছে। আমাকে মামনি ডাকবি দুজনেই।
সাদাফের বাবাঃ আর আমাকে বাবাই ডাকবি কিন্তু।
সাদাফের মাঃ হ্যাঁ একদম। চল এবার খেয়ে নে সবাই।
এভাবেই সবার খাওয়া শেষ হলে শুভ্রা আর কুবরা দুজনে শুতে চলে যায়। নাদিম ও সাদাফের ঘরে চলে যায়।
আজ সারারাত ই ভাই বোন ভাবি মিলে জিবনের দুঃখের সুখের গল্প করবে। কতোদিন পর তাদের দেখা।
পরদিন সকাল বেলা শুভ্রা সকাল সকাল উঠে পড়ে। বড়রা সারারাত গল্প করায় ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর শুভ্রা আর কুবরা নামাজ পড়তে উঠে। নামাজ পড়ার পর তারা রান্নাঘরে যায় নাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে। নাস্তা টেবিলে রেডি করতে করতে সাদাফ আর নাদিম ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাহির থেকে আসে। সম্ভবত জগিং করতে গিয়েছিল দুজনে। নাস্তা করার জন্য তারা ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে শুভ্রার মা আর সাদাফের বাবা মা ও চলে আসে।
সাদাফ আর নাদিম ও রেডি হয়ে চলে আসে। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসে। খাওয়ার একপর্যায়ে সাদাফ বলে উঠলোঃ মিস শুভ্রা রেডি হয়ে নিন আমারা থানায় যাবো।
#চলবে।
(এলাকায় কারেন্ট ছিল না তাই গল্প দিতে পারি নি মোবাইলে চার্জ ছিলো না তাই)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here