অচেনা তুমি পর্বঃ৫৪ শেষ পর্ব

0
2067

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৫৪

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। যেই মানুষ গুলো মাস আটেক আগেও ছিলো চির অপরিচিত আজ তারা কেউ না কেউ কারো পরম আত্মীয় কিংবা পরম ভালোবাসার মানুষ । পরিচিতির বন্ধনে আজ সম্পর্কের নদীর জল গড়িয়ে চলেছে বহুদূর। কেউ থাকবে কাছাকাছি কেউবা অনেক দূরে।

প্রভাতী প্রহর শেষ প্রায়। শুভ্রা,সাদাফ, নাদিম, কুবরা এবং মা বাবা সহ সকলে পারভেজ দের বাড়ি যায়। বিয়ের ক্ষন শেষ হওয়ায় আত্মীয় স্বজনরা সবাই চলে গিয়েছে। যেহেতু কাল- পরশু তাদের চলে যেতে হবে। সদর দরজা খোলা থাকায় সকলে চুপিচুপি ঢুকে দেখে শাশুড়ী বউমা মিলে দুজনেই রান্না ঘরে কাজ করছে।

শুভ্রার মাঃ কই গো নতুন বউ। বাড়িতে সকলে চুপচাপ কেন?

ইলিয়ানা হাসি মুখে এসে সকলকে সালাম করে আর বসতে বলে চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে যায়।

শুভ্রাঃ আরে ইলু আপ্পি এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন? আমরা কি আর বাইরের মানুষ? চলো তোমায় হেল্প করি।

ততক্ষণে পারভেজ ও এসে সাদফ, নাদিম, আবির এর সাথে গল্পে মশগুল হয়ে উঠে। কিছুক্ষন পর ইলিয়ানা হাতে চা, বিস্কুট আর মিষ্টি নিয়ে সকলকে পরিবেশন করে।

সাদাফের মাঃ আপা তো এখন নতুন বউ পেয়ে খুব খুশি। এখন বোধহয় আর একাকী লাগবে না নিজেকে? ( চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে)

পারভেজের মাঃ সে আর কি। এখন তো বলছে ছেলে বিদেশ নিয়ে যাবে। আমার না মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের শশুর বাড়ি নিজের আপন জায়গা ছেড়ে কি করে যেতে ইচ্ছে করবে বলুন। এদিকে ছেলে বউকে ছাড়া একা ও লাগবে। আবার তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে আজকালকার দিনে কেউ কি আর স্বামী সংসার ছাড়া এতোদিন একা থাকতে পারে? তাই কোনো উপায় না পেয়ে চলে তো যেতেই হবে।

শুভ্রার মাঃ হুম তা ঠিক বলেছেন। আর মাত্র তো দুদিন আছে। আপনাদের গোছগাছ করারর সময় লাগবে। তাই চলে যাওয়ার আগে একটু ঘুরে দেখে যেতে এলাম।

পারভেজঃ সেকি আন্টি আজই চলে যাবেন নাকি?

শুভ্রার মাঃ হুম আজই চলে যাবো তোমাদের ও তো একটু সময় লাগবে বলো।

পারভেজঃ কোনো সময় লাগবে না। এইতো কয়েক দিন আগেই তো এলেন। আজকে অন্তত থাকুন আরেকটা দিন।

সাদাফঃ না না পারভেজ ভাই। আমার অফিসে আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছে। আসলে কুবরা আর নাদিমের বিয়েতে অনেক দিন অফ থাকায় অনেক কিছুই পেন্ডিং থেকে ছিলো। তার উপর এখানে এলাম ১ সপ্তাহ হলো। এবার দেরী হলে অনেক লস হয়ে যাবে ভাই। ( পারভেজের কাধে হাত দিয়ে)

নাদিমঃ হুম সেইম আমারো। অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। আর বেচে থাকলে তো অবশ্যই দেখা হবে তা কোনো ব্যাপার না। বিদেশ চলে যাবেন তো কি হয়েছে। আমরা না হয় হানিমুনে মালেশিয়াতেই যাবো।( কুবরার দিকে শয়তানি দৃষ্টিতে তাকিয়ে) তখন তো দেখা হবেই। কি বলেন পারভেজ ভাই?

এরকম আরো অনেক্ষন কথা বলতে বলতে সময় কেটে যায় আরো কিছুক্ষন। তারপর সকলে মিলে নিজ বাড়িতে ফিরে গোছগাছ করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে ঢাকার উদ্যেশ্য বের হয়।

“চলে যাচ্ছি ইলু আপ্পি। বিদেশ গিয়ে কিন্তু ভুলে যেওনা আমাদের। তোমায় খুব মিস করবো। “( ইলিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে শুভ্রা বলে)

ইলিয়ানাঃ ধ্যাত কি যে বলিস। তোরা দুজনেই তো আমার দুইবোন। তোদের কি করে ভুলি বলতো। আমার জীবনে তোদের মতো বেস্ট ফ্রেন্ড আর কেউ নেই। সেখানে ভুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। ( শুভ্রা আর কুবরাকে জরিয়ে কেদে দেয় ইলিয়ানা)

কুবরাঃ এই একদম কান্না করবে না বলে দিলাম। কান্না করে নিশ্চয় যাওয়ার পথে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে। এভাবে কেউ কান্না করে নাকি? বেচে থাকলে নিশ্চই দেখা হবে আপ্পি।

ইলিয়ানাঃ ইনশাল্লাহ হবে। তো বাবাই মামনী কোথায়? দেখছি না তো?

কুবরাঃ আসছে ভেতরে এখনো সবকিছু গোছগাছ করে আসছে। আমার তো এক্সাইটমেন্টে তর সইছে না আজ আমি প্রথমবার লঞ্চে চড়বো। ( এক তালিতে লাফিয়ে)।

ইলিয়ানাঃ লঞ্চ কিন্তু আমি তো কাল শুনলাম ফ্লাইটে যাবি। ক্যান্সেল করে দিয়েছিস?

শুভ্রার মাঃ ওই হতোচ্ছারির কথা আর কি বলবো। জোর করে সাদাফ কে প্লেনের টিকিট ক্যান্সেল করে লঞ্চের টিকিট কাটিয়েছে।

পারভেজঃ ও তাহলে এখন সবাই লঞ্চে করে যাবেন? কিন্তু আমি তো জানি আপনি বোটে চড়তেও ভয় পান। সেখানে লঞ্চে করে যেতে পারবেন?

শুভ্রার মাঃ পাগল পেয়েছো নাকি বাবা! আমি আমার প্রান বেচে থাকতে জীবনেও সমুদ্র ভ্রমন করবো না। তা ও ওই বড় বড় লঞ্চে। আচ্ছা এক্সিডেন্টের কি কোনো হাত পা আছে? যদি হুট করে ডুবে যাত তখন কি হবে বলোতো? আর এখন তো অই মেয়ের সাথে আমার জামাই রাও যোগ দিয়েছে।

কুবরাঃ উফ আম্মু। যেখানে সেখানে মান সম্মান পেলাস্টিক করে দাও একদম। সত্যি সত্যি ডুবে মরে গেলে এভাবে আর কাকে পচাও দেখবো।

শুভ্রার মাঃ শয়তান মেয়ে। সবসময় এমন কু মত তোর। কোথাও বের হচ্ছিস ভালো কথা বের হয় না তোর? ( কুবরার পিঠে আলতো করে এক ঘা লাগিয়ে) । প্লিজ মা যাস না। আমার ওসব ভয় করে।

শুভ্রাঃ আম্মু এতো করে যখন বলছে তখন যেতে দাও না। আমরা তো কোনো দিনই লঞ্চে চড়িনি। আর এতোগুলা মানুষ সারাজীবন যে লঞ্চে যাতায়াত করে তুমি দেখেছো তারা কোনো দিন ডুবে গিয়েছে?

মিসেস মালিহা বেগম আর তার মেয়ে আর জামাইদের কথা ফেলতে পারলেন না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে সাদাফের মা বাবা আর শুভ্রার মা রওনা দেয় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে আর সাদাফ শুভ্রা কুবরা নাদিম বিচের দিকে। প্রথমে তারা একটা ছোট শিপ নিয়ে চট্টগ্রামে পৌছায়। তারপর সেখান থেকে চট্টগ্রাম লঞ্চঘাটে পৌছায়।

বিকেল প্রায় ৪ টা বাজে। ঢাকাগামী লঞ্চ আসতেই সকলে তোরজোর করে লঞ্চে উঠে পড়ে। শুভ্রা আর কুবরা পছন্দ করে লঞ্চের দুই তলাতে দুইটি আলাদা কেবিন বুক করে। সবাই উঠে যাওয়ার পর প্রায় আধঘন্টা পর লঞ্চ ছাড়ে।

সূর্যাস্তমিত এক মনোরম প্রহর। সময় যতো ঘনিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে লাল কমলা রঙা বিরাত সূর্যটাও কেমন মিইয়ে যাচ্ছে।সমূদ্রে জলের ঢেউ ঢেউ ধাক্কা বার বার আড় কেটে যাচ্ছে লঞ্চের গায়ে।

দুতলা বিশিষ্ট লঞ্চের এক কিনারায় দাঁড়িয়ে শুভ্রা আর কুবরা উপভোগ করছে এক অপূর্ব দৃশ্য। লঞ্চের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের সাতে বিপরীতে উড়ে যাচ্ছে সারি সারি গাঙচিল। শুভ্রা নিজের হাতেই বিস্কিটের প্যাকেট থেকে কয়েক টুকরো বিস্কিট নিয়ে তাদের দিকে ছুড়ে দিতেই তাদের মধ্যে যে ধস্তাধস্তির লড়াই।

অপরদিকে খানিক দূরেই দাঁড়িয়ে অপলক ভাবে নিজেদের বউয়ের দুষ্টুমির কীর্তিকলাপ দেখতে ব্যস্ত নাদিম আর সাদাফ। শুভ্রা আর কুবরার কাছে বিষয়টা নতুন হলেও নাদিম আর সাদাফের কাছে এই ভ্রমন অতি সাধারণ আর পরিচিত। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো দুই বোনের খুনসুটি দেকে মনে হচ্ছে তারা যেন আবার নতুন করে প্রথমবার সমুদ্র ভ্রমন করছে।

রাত ৯ টা ছুইছুই। সাদাফ শুভ্রা, কুবরা, নাদিম এক কেবিনে বসে আছে। সামনের স্ট্যান্ডে মোবাইলটা রেখে ভিডিও কলে কথা বলছে সকলে মিলে। এবং মোবাইলের ওপারে সোফায় সুর করে বসে আছে সাদাফের মা বাবা আর শুভ্রার মা।

সাদাফের মাঃ বলছি খাওয়াদাওয়া করেছিস তো তোরা?

সাদাফঃ না এখনো তো অনেক সময় আছে মাত্র ন’টা বাজে। খাবো আর কি একটু পর। তোমরা খেয়েছো?

সাদাফের বাবাঃ এই তো ঘন্টা খানেক আগেই এলাম। রোমানার মাকে এসে রান্না বান্না করে যেতে বলেছি। তোর আম্মু আর মামনী তো শুধু প্লেন জার্নি করেই টায়ার্ড।

শুভ্রার মাঃ কি হতো বলতো একেবারে আমাদের সাথে চলে আসতি। এখন দেখ শুধু শুধু এতো রাতে বাইরে বাইরে ঘুরা।

কুবরাঃ আম্মু তুমি বুঝছো না এখানে কি মজাটাই না হচ্ছে। তুমি যদি একবার এই দৃশ্য টা দেখতে আমার মতো যাস্ট ফিদা হয়ে যেতে।

নাদিমঃ আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা। আমরা থাকতে আপনার মেয়েদের কিচ্ছু হবে না। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে আগলে রাখবো। ( কুবরার দিকে তাকিয়ে)

শুভ্রার মাঃ তোমরা আছো বলেই তো তোমাদের উপির ভরসা করে ওদের ছেড়ে এসেছি। নাহলে আমি কোনো দিন নিজেও লঞ্চে তো দূর বোটেও চড়িনি আর ওদের ও দি নি।

আরো কিছুক্ষন টুকটাক কথা বলে তারা সবাইকে বিদায় জানিয়ে কল রেখে দেয়। তারপর আসার সময় বক্স করে যে খাবার আনে সেগুলো ও খেয়ে নেয়। খাওয়াদাওয়া পরে সকলে মিলে কেবিনের সামনে ছোট হাটার জায়গাতে এসে দাঁড়ায়। আসেপাশের অনেক মানুষ ই তাদেত মতো রাতের ভুজ সারছে। এমন সোয়েটার আর মোটা কাপড় পড়া সত্ত্বেও বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরটা কেপে উঠছে বার বার। রাতের নিবিড় শান্ত পরিবেশে কোলাহল পূর্ণ লঞ্চ টা যেন এক চঞ্চল ময় আলোড়ন তৈরি করে রেখেছে।

১২ টা পের হতেই সম্পূর্ণ লঞ্চে যেন আস্তে আস্তে নীরবতার ছায়া নেমে এসেছে। অনেক বৃদ্ধ বৃদ্ধা শরীরের ক্লান্তিতে মাথাটা হালকা জিমিয়ে নেয়। আবার অনেকে এখনো মোবাইল জগতে মনোস্থির। তেমনি ভাবে নিজেদের কেবিনে পাতলা একটা লেপের তলে দুজনে মিলে স্বপ্নের ঘোরে মত্তো আছে সাদাফ আর শুভ্রা।

কেবিনের একটা কর্নারে ছোট একটা জানালা আছে। সেই জানালার ধারে আধশোয়া হয়ে বসার মতোর একটা বসার জায়গা ও আছে। সাদাফ আর শুভ্রা দুজনে মিলে লেপের তলে গুটিগুটি হয়ে সেই ছোট জানালা ভেদ করে বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত।

সাদাফঃ শুভি শীত করছে না তোমার? জানালা টা বন্ধ করে দিই?

শুভ্রাঃ উহু… জানালা টা খোলা বলেই তো বাইরের এই জগত টা দেখে ভালো লাগছে। আর এই শীত কি হবে? আপনি আছেন না? আপনার সাথে থাকলে কোনো শীতই কাজ করে না। ( সাদাফের বুকে গুজে)

সাদাফঃ হুম.. বুঝেছি মিস পালাই পালাই দেখি আজকাল খুবই আদোরেকাতর হয়ে উঠেছে। সব বাহানায় শুধু আমি তাই না? ( শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে)

শুভ্রাঃ তো আমি আদোরে কাতর না হয়ে আর কে হবে শুনি? আপনার আদর আমি কাউকেই শেয়ার করবো না শুধু আমিই পাবো বুঝছেন?

সাদাফঃ তাই বুঝি? আমাদের যে ছোট্ট একটা বাবু হবে তাকেও আদর করতে দিবে না?

সাদাফের মুখে ছোট বাবুর কথা শুনেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠে শুভ্রার দুই গাল। আকষ্মিক এমন কথা সে সাদাফের কাছ থেকে আশাই করেনি সে। হুট করে লজ্জা ভাবে সাদাফের চোখাচোখি হতেই সটান সাদাফের বুকে গিয়ে মুখ লুকায় শুভ্রা।

শুভ্রাঃ যাহ, আপনি অনেক ফাজিল একটা মানুষ। যখন তখন একদম আমাকে লজ্জায় ফেলে দেন। ( শাদাফের শার্টের বোতাম খুটে খুটে)

সাদাফঃ হা.. হা.. হা.. লজ্জার কথা কি বললাম আমি শুভি?? কেন তোমার একটা ছোট বাবু চাই না? যে আমাদেরকে সারাদিন বাব্বা-মাম্মা বলে ডাকবে, কোলে উঠার জন্য আকুতি মিনতি করবে, আমাদের ঘরটাকে মাতিয়ে রাখবে, আমাদের সংসার টাকে আরো পূর্ণতায় ভরিয়ে তুলবে। চাই না তোমার??

সাদাফের মুখে বাবা হওয়ার এক অনাগত আকাঙ্খা এক প্রষ্ফলিত খুশির আবেগ দেখে শুভ্রার মনেও যেন সেই আকাঙ্ক্ষার দৃঢ় প্রবনতার বেগ বেড়ে উঠে। সাদাফের কথায় সায় দিয়ে শুভ্রা ও সাদাফ কে জোরে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয় ” হুম চাই তো, খুব চাই।”

” এই চলুন না আমার এখানে ভালো লাগছে না মোটেও ” ( নাদিমের হাত ধরে টানতে টানতে বলে উঠে কুবরা)

নাদিমঃ কি বলো এতো রাতে তুমি কোথায় যাবা। আর লঞ্চ চলাকালীন তুমি কোথাও যেতে পারবা নাকি?

কুবরাঃ আরে না না চলুন না বাইরে হাটি। এমন সুন্দর একটা জার্নি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবো নাকি? আসুন আসুন।

নাদিমঃ কটা বাজে দেখেছো ১ বাজে অলরেডি। এখন বাইরে নিশ্চয় ভুত থাকবে। চলো তার বদল এই জানালা দিয়ে বাইরে দেখি চলো।

কুবরাঃ ধুর আপনি থাকুন। এত্তো বড় লোকের নাকি ভুতের ভয় করে। এটা কোনো কথা! থাকুন আপনি। আমি যাবো। ( বলেই কুবরা নাদিমের হাতটা ছেড়ে দিয়ে কেবিনের দরজা খুলে গটগট করে বেরিয়ে চলে যায়।

নির্মল হাড়কাঁপানো শীতল ঠান্ডা বাতাস বইছে। নাদিমের সাথে মাতামাতি দিয়ে সোয়েটার টাও পড়ে আসেনি। সেলওয়ারের পাতলা উড়না দ্বারা শীত নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করছে কুবরা। দুতলায় চারদিকে লাইট জ্বালানো থাকলেও সকলেই ক্লান্ততার ভিড়ে চোখ মুদে ঝিমুচ্ছে।

কুবরা হেটে হেটে গিয়ে কেবিনের থেকে একটু দূরে লঞ্চের সামনের খালি জায়গায় টায় গিয়ে দাঁড়ায়। একাকিত্বে মনে মনে হালকা ভয় ও লাগছে আবার ফিরেও যেতে মন চাইছে না জেদের বশে। হটাৎ পেছন দিয়ে পিঠে ভারী কিছুর অনুভব হতেই পেছনে ফিরার আগেই ঘাড়ে কারো মাথার ভর অনুভব করে কুবরা। সেই চিরপরিচিত ঘ্রান আর নিশ্বাসের শব্দে কুবরা বুঝে যায় আর কে হবে সেই লোক।

নাদিমঃ ভাঙবে তবে মচকাবে না এই তো? ( কুবরাকে জ্যাকেট পরিয়ে দিয়ে)

কুবরাঃ মানে কি বলতে চাচ্ছেন মি. পচা বাদাম..

নাদিমঃ বাবাহ মিস কুইন কুবরা দেখছি ফুলে পুরাই এটম বম হয়ে আছে। মানে বলছি যে শীতে কাপছেন অথচ তবু ও মুখ ফিরে ঘুরে যাবেন না এই তো?

কুবরাঃ আপনার না ভুতে ভয় করে বলেছেন? আবার এসেছেন কেন?

নাদিমঃ তুমি যেখানে সবচেয়ে বড় ভুত সেখানে অন্যসব তো ফিকে মাত্র। আমার বউটাকে একা একা রেখে আমি কি আর ঘুমাতে পারি?? ( কুবরার গলায় মুখ ডুবিয়ে)

নাদিমের উষ্ণ নিশ্বাস আর ঠান্ডা স্পর্শে মূহুর্তেই হাড় কাপানো কেপে উঠে কুবরা। যেন মাথার রাগ ছ্যাত করে কেপে কেপে পায়ের তলায় চলে যায়।

কুবরাঃ কারো রাগ কিভাবে গলাতে হয় সেটা সবাই আপনার কাছ থেকে শিখুক। আপনি জানেন এরকম করলে আমি কতোটা উইক হয়ে যাই। আর সেই সুযোগেই যখনই রেগে থাকি তখনই এমন করেন। আর এখানে তো মানুষ জন ও নেই চান্স তো বেশ ভালোই পেয়েছেন??

নাদিমঃ সব কিছু বুঝই তো। তুমি ছাড়া আর আমার কে আছে বলোতো। যেখানে তুমি পুরোটাই আমার উইক পয়েন্ট। সেখানে তোমাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে নেওয়াই তো আমার কাজ।

কুবরাঃ আচ্ছা সারাজীবন কি আমরা এরকমই এক থাকবো? কোনো তৃতীয় ব্যক্তি আসবে না তো কখনো?

নাদিমঃ তোমায় আমি কতোটা ভালোবাসি তা তোমার কল্পনাতীত। তুমি চাইলে আমি আমার প্রাণ টাই বিসর্জন দিয়ে দিতে পারি আমি। যেখানে তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না সেখানে তো তৃতীয় ব্যক্তির কোনো প্রশ্নই উঠে না। এই হাত যে একবার ধরেছি আর কখনো, কোনোদিন, কোনো পরিস্থিতিতে ছাড়বো না। ( কুবরার দুই হাত নিজের বুকে রেখে)

নাদিমের আবেগময় মনোভাব শুনে কুবরার দুচোখ চিকচিক করে উঠে। যা পূর্নিমার ওই ফকফকে আলোয় নাদিম পরিষ্কার দেখতে পায়। একটা মানুষ কাউকে কতোটা ভালোবাসলে নিজের প্রান বিসর্জনের কথা মুখে আনতে পারে। আর নাদিমেত বলা প্রতিটা কথাতেই কুবরা যে সততার অস্তিত্ব খুজে পায়।

কুবরাঃ এতোটা ভালোবাসেন আপনি আমায়?? ( অশ্রুসিক্ত চোখে)

নাদিমঃ খুব খুব খুব ভালোবাসি আমার এই পাগলী প্রেয়সিকে।( কপালে একটা উষ্ণ ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে)

কুবরাঃ আমিও আপনাকে খুব খুব ভালোবাসি। আমিও আপনাকে কোনো দিন কোনো পরিস্থিতিতে ছেড়ে যাবো না। সে যতো বড়ই বিপদ আসুক না কেন। ( নাদিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে)

দুজনে মিলে লঞ্চের সামনের দিকে খালি জায়গাটায় আসন পেড়ে বসে রাতের পূর্নিমাজ্জ্বল আকাশ দেখতে বসে। কুবরা নাদিমের বুকে হেলান দিয়ে বসে মনের ছন্দে ঘুমিয়ে পড়ে। নাদিমের ও কবে চোখ লেগে আসে সে খেয়াল ও নেই তার।

হঠাত পেছন থেকে এক বিকট আওয়াজে কাচা ঘুমটা ভেঙে যায় নাদিমের। এদিক এদিক তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায় না সে। আচমকা কোথা থেকে যেন পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে। কিন্তু নদীর এই মাঝরাস্তায় সে তো কোথায় পাশের দুই পাড়ে আগুন জ্বলছে বলে দেখতে পারছে না? আর গন্ধটাও কেমন আজব ধরনের! চোখের পলক পড়তে না পড়তেই নিচ থেকে এক বড় আগুনের ঝলকা বেরিয়ে আসে। নাদিমরা যে জায়গায় বসে ছিলো তার বরাবর নিচেই ইঞ্জিন ঘর ছিলো। নাদিম অনুভব কিরে যে, সে যেখানে বসেছে জায়গাটা কেমন গরম হয়ে উঠেছে।

” তবে কি শব্দটা ইঞ্জিন ঘর থেকেই এসেছে? তার মানে… ইঞ্জিনে..আগ..আগুন লেগেছে!! ”

কিছুক্ষনপরই নিচের তলা থেকে বড় বড় করে আওয়াজ আসছে “”আগুন…আগুন.. আগুন লেগেছে। ইঞ্জিনে আগুন লেগেছে! “”

শুনা মাত্রই নাদিমের বুক টা হু হু করে কেপে উঠে। এতো রাতে মাঝ পথে আগুন লাগাটা বিরাট বিপদের ব্যাপার। তার উপর আবার ইঞ্জিনে। চারদিকের হৈচৈ তে কুবরার ঘুম ও ভেঙে যায়। মূহুর্তের মধ্যে চারদিকে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। চোখের পলক ফিরাতে না ফিরাতেই আগুন দুতলাতে সহ ছড়িয়ে চলে আসে যা একেবারেই কল্পনাতীত ছিলো তাদের।

নাদিমঃ কুবরা!! সাবধানে আগুন…! ( নাদিম ঝাপটে এসে কুবরাকে সরিয়ে নেয়)

কুবরাঃ এসব কিভাবে হলো হঠাৎ করে? আমার অনেক ভয় করছে। ( ভয়ে নাদিমকে চেপে ধরে কান্না করে দেয় কুবরা)

নাদিমঃ শান্ত হও মাথা ঠান্ডা রাখো আগে কেবিনের দিকে যেতে হবে। সাদাফ আর ভাবি ওখানে আছে। ( কুবরাকে ভালো করে ধরে)

আগুনের উত্তাপ আগুনের জোরে যেন হাটা অনেক দায়ভার হয়ে উঠেছে দুজনের। তার উপর শুধু তারা একাই নই সম্পুর্ণ লঞ্চের মানুষ পালানোর জন্য ছোটাছুটি করছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের কান্নায় সারা লঞ্চে হাহাকার হয়ে উঠে। যে পারছে সে নিজের প্রানটুকু বাচানোর জন্য পানিতে ঝাপিয়ে পড়ছে। বুড়ো বয়ষ্ক যারা আছে তারা শুধু সাহায্যের মিনতি করছে আর অনেকে ছোট বাচ্চাদের ফেলে পানিতে ঝাপিয়ে পড়তে পারছে না বলে যথাসম্ভব গুটিয়ে রয়েছে। ৷ এইদিকে আগুন ধরা মাত্র স্বয়ং লঞ্চ ড্রাইভার নিজে বাচার জন্য সবার আগে পানিতে ঝাপ দিয়ে দেয়। যেই কারণে নদীর মাঝখানে লঞ্চটা থেমে দাড়িয়ে আছে। চারদিকে শুধু “আল্লাহ বাচাও, আল্লাহ রক্ষা করো ” এই প্রতিধ্বনি। নাদিম আর কুবরাও দুজনে হেটে যাওয়ার সময় হতের বাধন যেমন শক্ত করে ধরে আছে তেমনই ভেতরে ভেতরে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সামনে ওগিয়ে যাচ্ছে।

হঠাত পিঠে প্রবল উষ্ণভাব অনুভব করায় ঘুম ভেঙে যায় সাদাফের। মূহুর্তের মধ্যে চারদিক দিয়ে প্রবল কান্নার আওয়াজ আর আর চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এসবে শুভ্রার ঘুমটাও ভেঙে যায়। দুজনেই কি হয়েছে বলে লাফিয়ে উঠে। দুজনেই দুজনের চেহারার দিকে কিছু ঠাওর করার আগেই দরজার বাইরে দিয়ে শব্দ আসে আগুন আগুন আগুন লেগেছে।

আগুনের কথা শুনেই দুজনের বুকে ভয়ে হু হু করে কেপে উঠে। সাদাফ আর কোনো প্রকার দেরী না করে সটান দরজা খুলে চলে যেতে চায়। কিন্তু এতো চেষ্টা করার পরেও কোনো ভাবে দরজা খুলতে পারছে না সে। আগুনের উত্তাপে লোহার তৈরি দরজা গলে প্রায় লেগে গিয়েছে। যার কারনে দরজা আটকে আর খুলতে পারছে না সাদাফ। শুভ্রা ও এসে শামিল হয় সাদাফের সাথে। দুজনে এক সাথে গা লাগিয়ে ধাক্কা ও দিতে পারছে না গরমের জন্য। আবার পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে যথাসম্ভব খুলার চেষ্টা করতে শুরু করে।

সাদাফঃ শুভি এবার কি হবে। দরজা তো খুলতেই পারছিনা। কেউ কি বাইর থেকে লক করে দিয়েছে?

শুভ্রাঃ কেউ কেন বাইরে দিয়ে লক করে দিবে? উপরে দেখুন লোহা গলে পড়ে যাচ্ছে। এখন আমরা কি করবো?? ( কান্নারত ভাবে সাদাফকে জড়িয়ে ধরে)

সাদাফঃ কাম ডাউন শুভি। ভাগ্যে থাকলে ঠিক কোনো না কোনো উপায় হবে আর নাহলে আজই আমাদের শেষ সময়। সবই উপরওয়ালার হাতে। ( শুভ্রাকে শক্ত করে ধরে)

সাদাফ আর শুভ্রার কেবিনের দিকেই হম্বিতম্বি করে এগিয়ে আসছিলো নাদিম আর কুবরা। পাশ দিয়ে ৫/৬ নিয়ে একদল মানুষ তাদের সামনে দৌড়ে এসে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের পেছন পেছন আগুনের একটা বড় লোহার প্লেট নাদিম আর কুবরার সামনে পড়ে। যেটা নাদিমের বাহুতে লেগে সোয়েটার সহ হাত সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

কুবরাঃ সামলে!!! ( চিৎকার দিয়ে উঠে কুবরা)

ভয়ে রীতিমতো কাপাকাপি শুরু হয়ে যায় কুবরার। চারদিকের আগুনের ধমকা হাওয়া আর ঝলকা দেখে ভয়ে পা দুটো যেন অবশ হয়ে উঠেছে কুবরার।

নাদিমঃ ভয়ের কিছু নেই। যাস্ট একটু পুড়ে গিয়েছে। চলো আগে ওইদিকে যাই। ( কুবরার হাত শক্ত করে ধরে)

কুবরাঃ কিন্তু ওইদিকে তো আগুন আর আগুন পেরিয়ে যাবো কি করে। আর যতো তোতো তো বেড়েই চলছে। এখন কি করবো… ( কান্নায় কাতর হয়ে)

নাদিমের চোখে মুখে চিন্তার ভাজ ভেসে উঠে। এমন বিপদে মাথায় তার কিছুই আসছে না সে কি করবে। একদিকে বন্ধু আরেকদিকে জীবন। এখন কি করবে সে। আর সে তো সিউর ও নয় যে সাদাফরা আদেও সেখানে আছে কিনা।

নাদিমঃ আচ্ছা ওইদিকে তো আর কারো আনাগোনা দেখছিনা। নিশ্চয় আগুনের খবর পেয়ে ওরা বেরিয়ে গেছে। দেখো ওইদিকে কেউই নেই। শুধু আগুন ই তো দেখছি।

কুবরাঃ হ্যা হতেও পারে ওরা পানিতে ঝাপ দিয়েছে।

নাদিমঃ চলো আর দেরী না করে ঝাপ দাও। ভাগ্যে থাকলে ঠিকি দেখা হবে।

এরপর নাদিম আর কুবরা দুজনে মনে সাহস জুগিয়ে সকলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একসাথে ঝাপিয়ে পড়ে দুতলার উপর থেকে। কোনোরকম কিছু চিন্তা বিবেচনা না করে পানিতে ঝাপ তো দিয়েছে কিন্তু বড় মুশকিল এখন কুবরা সাতার কাটতে পারে না। পানিতে ঝাপ দেওয়ার পর নাদিম সাতরে মাথা তোলতে পেরেছে কিন্তু কুবরাকে আর সে খুজে পায় না।

নাদিমঃ কুবরা!! কুবরা!! কুবরা…….! ( বেশ বড় করে চিৎকার দিয়ে)

প্রায় মিনিট দুই এক হয়ে যায় এতো মানুষের ভিড়ে কুবরাকে খুজে পাওয়াও অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে নাদিমের জন্য।পাগলের মতো বার বার নিচে ডুব দিয়ে খুজতে গেলেও কিছু দেখতে পায় নাদিম। উপরেও পাগলের মতো এদিক ওদিক খুজতে থাকে।

হঠাত পানিতে ঝাপাঝাপির প্রবল আওয়াজ আর “নাদিম” “নাদিম ” চিৎকারে টনক নড়ে নাদিমের। কিছু দূরে কুবরা পানিতে ছটফট করছে কুবরা। সোজা দুতলায় থেকে ঝাপ দেওয়ায় আর সাতার না জানায় অনেক নিচে চলে গিয়েছিলো কুবরা। সাতার না জানা সত্ত্বেও ডুবে ডুবে যথাসম্ভব উপরে আসার চেষ্টা করে কুবরা কুবরাকে দেখতে পেয়ে প্রানে পানি ফিরে আসে নাদিমের। দ্রুত সাতরে নাদিম কুবরার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু ততোক্ষনে কুবরার নড়াচড়া যেন থেমে যায়। নাদিম তারাতাড়ি নিশ্বাস বন্ধ করে ডুব দিয়ে কুবরাকে আবার তুলে আনে। এতোক্ষন পানির ভেতর থাকায় যথেষ্ট পানি খেয়ে ফেলে কুবরা। আর সাতার কাটতে না জানায় পানি অতিরিক্ত পানি খেয়ে ফেলে জ্ঞান হারায় কুবরা।

নাদিমঃ কুবরা… কুবরা… চোখ খোলো কুবরা… তুমি কি সাতার জানো না কাম অন কুবরা.. ( কুবরার মুখে হালকা বারি দিয়ে)

নাদিমও এতোক্ষন কুবরার ভর সইয়ে উঠতে পারছে না। আবার সাতরেও পাড়ে উঠে যেতে পারছে না। চাদের আলোয় পাড় দেখা গেলেও তা অনেক দূরে। আর অতিরিক্ত পানি খেয়ে ফেলায় কুবরার ওজন ও অনেক বেড়ে গিয়েছে যার কারণে নাদিম কুবরাকে সাতরে নিয়ে যেতে পারছে না। আশেপাশের এলাকার মানুষের ও হয়তো এখনো কোনো খবর পায় নি। নাহয় নিশ্চয় বোট নিয়ে সাহায্যের জন্য চলে আসতো। এই মূহুর্তে নাদিমের নিজেকে বড্ড অসহায় বলে মনে হচ্ছে । না পেয়েছে নিজের পরম প্রিয় বন্ধুর কোনো খোজ খবর না পারছে নিজের প্রান প্রিয় ভালোবাসার কোনো হুদিশ।

কুবরাকে নিয়ে কোনো মিতেই নাদিম সাতরে যেতে পারছে না। কিছু দূর এগিয়ে যেতে পারলেও পাড় অনেক দূরে এখনো। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তিই যেন ফুরিয়ে এসেছে নাদিমের। কুবরাকে নিয়ে সাতরানো তো দূর নাদিম এখন আর নিজের শিরীর নিয়েও সাতরাতে পারবেনা। যদি বাচতেই হয় তবে একান্তে তাকে সাতরে চলে যেতে হবে।

” তোমায় আমি কথা দিয়েছিলাম কুবরা। তোমায় ছাড়া আমার বাকি জীবন অসম্পূর্ণ কুবরা। এভাবে তোমায় ছেড়ে আমার বেচে থাকার কোনো মানে নেই। তোমায় আমি বড্ড ভালোবাসি। জীবনের শেষ নিশ্বাস পড়া পর্যন্ত তোমার পাশে থাকবো বলেছি। সেই বেঈমানী আমি করবো না। যেখানে তুমি থাকবে না সেখানে আমি বেচে থেকে কি করবো? আম সরি কুবরা,, তোমাকে বাচাতে পারলাম না আমি। আমি আজ বড় ব্যর্থ, সবচেয়ে ব্যর্থ পুরুষ মানুষ আমি। আমায় ক্ষমা করে দাও কুবরা। ( কুবরাকে জড়িয়ে কান্নায় হুংকার দিয়ে উঠে নাদিম)

কিছুক্ষন পর নাদিমের নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে যায়। সকল প্রকার আকুতি, নিশ্বাস, আবেগ, মিনুতি, আকাঙ্খা যেন নিমিষেই মূহুর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। যে যার যার মতো পারছে নিজস্ব চেষ্টায় বেচে ফিরতে সেখানে দুটি চাঞ্চল্য প্রান ক্ষনিকের আলোকে নিবিড় তলায় গড়িয়ে যায়।

চারদিকের উত্তাপের জ্বালায় যেন কেবিনের ভেতর থাকা অনেক মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিচের তলার আগুনের উত্তাপে পায়ের জুতো ও গরমে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এদিকে আশেপাশের মানুষের হাহাকারে নিজেদের বড্ড অসহায় লাগছে। হঠাত দরজার দিকে বিকট শব্দে দেখে আগুনের তাপে দরজা আলগা হয়ে পড়ে গিয়েছে। বের হওয়ার রাস্তা তো হয়ে গেছে কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে বের হতে যাবে তো দূর উলটে আরো শা শা করে আগুনের ঝলকা কেবিনে ক্রমশ বেড়ে ঢুকে যাচ্ছে। সাদাফ যথাসম্ভব এগিয়ে শুভ্রাকে পেছন রেখে আগলে রাখে। সম্পূর্ণ বের হওয়ার রাস্তা আগুনে দাউদাউ করছে। সাদাফ নিজের জ্যাকেট খুলে শুভ্রাকে পড়িয়ে দেয় যেন আগুনের ঝলকা শুভ্রার গায়ে না লাগে।

শুভ্রাঃ আমার লাগবে না। আমি তো সোয়েটার পড়েছি। এই পাতলা শার্ট এখনই তো জ্বলে যাবে। আপনি এদিকে আসুন প্লিজ ওইদিকে আগুন…। ( ঢুকরে কেদে সাদাফ কে খামছে ধরে)

সাদাফঃ আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না। প্রান যতোক্ষন আছে তোমায় ততোক্ষন প্রটেক্ট করে যাবো। ( শুভ্রাকে আগলে ধরে)

শুভ্রাঃ যদি আপনার অস্তিত্বই যখন থাকবে না তখন আমি প্রটেক্টেড হয়ে কি লাভ। আমি জানি আজ আমাদের বেচে ফিরার কোনো চান্স ই নেই। আজই আমাদের শেষ দিন। ( সাদাফকে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে)

শুভ্রার মুখে এই কথা শুনে সাদাফের চোখে আর বাধ বেধে থাকতে পারলো না। নিজেও আজ শুভ্রার ন্যায় চোখের জ্বল ছেড়ে দিয়েছে। কারণ সামনে আগুন, ডান পাশে আগুন, বাম পাশে আগুন।

যেদিকে পা বাড়াবে সেদিকেই স্বচ্ছায় পুড়ে যেতে হবে। তার চেয়ে নিরাশায় চপচাপ দাঁড়িয়ে থাকায় শ্রেয়। চারদিকের কান্নার শুরগুল আর হাহাকারে নিজেদের ভেতর মৃত্যুর যন্ত্রণা আর আগুনের জ্বালার যন্ত্রণা যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

সাদাফঃ সরি শুভি এই জীবনে তোমায় আর মা ডাকটা শুনাতে পারলাম না। তোমায় একটা বেবি পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। আরো অনেক গুলো সময় আমরা আর একসাথে কাটাতে পারবো না। ভাগ্যের লেখনে আর সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে আজই হয়তো আমাদের জীবনের শেষ সময়। জানি না আম্মু আব্বু এই খবর টা পেয়ে কেমন করবে, কিভাবে সামলাবে কিন্তু আমরা যে আজ নিরুপায়। ( কাপা কাপা গলায় বলে সাদাফ)

শুভ্রা সাদাফের কোনো উত্তর দেওয়ার ভাষা খুযে পাচ্ছে না। কষ্টে, যন্ত্রণায়, জ্বালায়, যেন সে নির্বাক হয়ে উঠেছে। সাদাফের কথায় সায় দিয়ে হু হু করে চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শুভ্রা। ঝলসানো আগুন এবার তাদের কে পুরোপুরি ভাবে গ্রাস করে ফেলে। এরপর শুধু আগুন আর আগুন ছাড়া কোথাও কোনো কিছুর অস্তিত্ব দেখা যায় না। সাদাফ আর শুভ্রা কালেমা পড়ে নিজেদের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। ???

আজ প্রায় দুদিন হয়ে গেলো লঞ্চ জ্বলার ঘটনার। সারাদেশ যেন এই নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় এই নিয়ে। কেউ মা, কেউ বাবা, কেউ স্বামী, কেউ নিজে ভাই বোন কেউ বা নিজেদের সন্তান হারিয়ে পাগল হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ দেশ। ড্রাইভার আর ইঞ্জিনিয়ার এর এই হেয়ালিপনায় হারিয়ে যায় শত শত মানুষের প্রান।

ছেলে ছেলে বউয়ের মৃত্যুর খবর শুনে নাদিমের বাবা তো আজ স্ট্রোক করে কোমায় চলে গিয়েছেন। একদিন হলো তিনি হাসপাতালে শয্যাশায়ী। আগে তো সবচেয়ে বড় ধাক্কা নিজের প্রানপ্রিয় স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। আজ শেষ বয়সে এসে নিজের জীবিনের সবচেয়ে বড় খুটি ছেলে আর ছেলের বউকে হারিয়ে।

অন্যদিকে খবর পাওয়া মাত্রই শুভ্রা-কুবরা মা সেন্স হারিয়ে পড়ে যান। শুরু থেকেই এই নিয়ে তার মনে কু ডাকে। পই পই করে ছেলেমেয়েদের বারণ করা সত্ত্বেও জিদ করে সেই তারা গেলই। সাদাফের বাবা এমনিতেই হার্টের রুগী। তার ওপর একমাত্র ছেলের মৃত্যুর কথা শুনে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে তারা। সাদাফের মা তো চুপচাপ যেন নিথর শক্ত পাথরের ন্যায় হিয়ে ছিলেন খবর শুনা মাত্রই। আশেপাশের সবকিছুই যেন তাদের কাছে থমকে গেছে।

সবচেয়ে বড় অসহায় তো শুভ্রা-কুবরা আর নাদিমের বাবা। শেষ বয়সে এসে একজন স্বামী শোকে ছিলেন আরেকজন স্ত্রী হিনতায় ছিলেন। আজ তারা দুজনেই ছেলে মেয়ে হারা।

খবর পাওয়া মাত্রই পারভেজ ইলিয়ানা যতো দ্রুত সম্ভব ঢাকায় চলে আসে। আজই তাদের মালেশিয়া চলে যাওয়ার দিন ছিলো। ক্যারিয়ার গঠনের আগে নিজেদের প্রিয়জন সামলানো আগে জরুরি বেশি। কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করেই জরুরি টিকিট বুক করে ঢাকায় চলে আসে ইলিয়ানা আর পারভেজের পরিবার।

প্রায় দুদিন পর ডুবুরিরা নাদিম আর কুবরার দেহ উদ্ধার করতে পেরেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ডুবে যাওয়ার সময় তারা একে অপরকে যেভাবে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো এখনো সেই শক্ত বন্ধন অটুট হয়ে বেধে আছে। তাদেরকে উদ্ধার করার সময় পারভেজ আর ইলিয়ানা সেই স্পটে চলে যায়। এবং তাদের পড়নের কাপড় দেখে তারা বুঝে এরাই নাদিম আর কুবরা। দুজনকে এভাবে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইলিয়ানা। নিজের ছোট বোনের মতো এই কদিন হাসি ঠাট্টায় মজে ছিলো। আপন বোনের মতো মেনে নিয়ে তাদের দুবোনকে।

নাদিম আর কুবরাকে উদ্ধার করতে পারলেও সাদাফ আর শুভ্রাকে কোনো ভাবেই কেউ শনাক্ত করতে পারে নি। লঞ্চে থাকা সকল যাত্রীরাই সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ধবধবে সাদা লঞ্চ টাই পুড়ে ভেতরে বাইরে কালো-ধূসর রঙ ধারণ করেছে। তবে একটা বিষয় নিয়ে চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে কোনো এক কেবিনের ভেতর দুজন যাত্রী ছিলো যার মধ্যে একজন ছিলো পুরুষ আরেকজন ছিলো নারী। পুরুষটা সম্পূর্ণ জ্বলে পূড়ে গেলেই সে সেই মহিলাটিকে আগলে যথাসম্ভব পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য দুজনেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলো। যে কারণে মহিলাটি কম ভাবে জ্বললেও পুরুষ লোকটি সম্পূর্ণ ঝলসে যায়।

ওমন আলোড়ন ঘটনা শুনে ইলিয়ানার মনে যেন কেউ খুব করে এসে বলছে এরা সাদাফ-শুভ্রা ছাড়া আর কেউই হতে পারে না। দুজনের মধ্যে সে যতো প্রবল ভালোবাসা দেখেছে, এ একমাত্র সেই দুটি ভালোবাসার মানুষ ছাড়া আর কেউই হতে পারে না।

পুড়ে যাওয়া আর ডুবে যাওয়া মানুষের সকল মানুষকে উদ্ধার করে জানাজা পড়ে পার্শ্ববর্তি এলাকার সকল মানুষ। আর যারা বেচে ফিরেছে তাদের সকলকেই সরকার নিরাপদ ভাবে বাড়ি পৌছে দিয়েছে।

পারভেজঃ আর কোথাও যেতে হবে না। আমাদের দায়িত্ব এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। নিজের আপন জন দের চেয়ে বড় ক্যারিয়ার এর দাম খুব বেশি নই। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো ওদের সাথেই ওদের পাশে থাকবো। ( ইলিয়ানার হাত নিজের হাতে শক্ত করে আবদ্ধ করে)

ইলিয়ানাঃ হুম পারবো। ওদের মা বাবা মানে আজ থেকে আমাদের ও মা বা। আজ থেকে আমরা এক নতুন জীবিন শুরু করবো। ( চোখের জল মুছে) )

#সমাপ্ত।

( উপরোক্ত ঘটনাটি প্রায় দুই মাস আগে ঝালকাঠি থেকে ঢাকাগামী যে লঞ্চটিতে আগুন ধরেছিলো আমি সেটার ঘটনা টিই তুলে ধরেছে। সকল ভালোবাসার মানুষরাই বয়সের শেষ সীমানায় গিয়ে পর্যন্ত থাকে না এটাই তার প্রমান। জানি না আমি সেই ভাব টুকু কতোটা প্রকাশ করে তুলে ধরতে পেরেছি। কিন্তু সেদিন যখন মানুষের হাহাকার আর আকুতি মিনতি দেখেছিলাম আমার নিজের অজান্তেই আমি অনেক কেদেছিলাম। হ্যা আমার কোনো আত্মিয় মারা যায় নি । কিন্তু মনুষ্যত্বের টানে হয়তো আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। আজও গল্প লিখা সময় আমার সামনে মোবাইল স্ক্রিন বার বার ভিজে আসছিলো। আমার মনে যা ছিলো সেটাই আমি প্রকাশ করতে চেয়েছি কিন্তু পুরোপুরি আপনাদের মন পৌছানো মতো পেরেছি কিনা জানি না। আজ প্রায় গল্পের ২ মাস পূর্ণ হতে চলেছে। অবশেষে সকলকে এক বাস্তবিত ঘটনার মাধ্যমে সকলকে বিদায় জানালাম। ?? ধন্যবাদ ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here