অচেনা তুমি পর্বঃ১১

0
1287

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
পর্বঃ১১
স্ত্রীর ডাক শুনে মি.মঞ্জুর ও দৌড়ে আসে। সামনের মহিলাটিকে দেখে পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্জুর সাহেব দেখে মহিলাটির চোখ দুটো ভিজে আসছে। আজ কতো বছর পর সে তার প্রানপ্রিয় ভাই টাকে দেখছে। মি.মঞ্জুর সাহেবের মুখ থেকে আপনা আপনি বের হয়ে এলোঃ “নাজু!!!”
মালিহা বেগম তো তাড়াতাড়ি দরজার বাইরে গিয়ে মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে কাদছে রীতিমতো।
সাদাফের মাঃ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি বল তো তুই। আমরা এতোটাই পর হয়ে গিয়েছি যে তুই আমাদের ছেড়ে এতো বছর আলাদা থেকেছিস। দোষ না হয় তুই একটা করেছিলি, তাই বলে আমাদের এতোবছর সাজা দিয়ে চললি। একটুও কি মনে পড়ে না আমাদের।
সাদাফের বাবাঃ নাজু তুই এতো স্বার্থপর কি করে হলি। যে ভাই ভাবিকে ছাড়া একদিন থাকতে পারতি আজ তুই এতো বছর ধরে গা ঢাকা দিয়েছিলি? কাউসার তো আমারও বন্ধু ছিলো। আমি কি কখনোই আমার বন্ধুর উপর রাগ করে থাকতে পারতাম?
নাজমা চৌধুরী এবার ভাইকে জড়িয়ে ধরে কন্নার বন্যা ভাসিয়ে দেয়।
এদিকে নাদিম আর মেয়েটি অবাক চোখে একবার তাদের কান্ড দেখছে তো আরেকবার নিজেরা চাওয়ায়াচায়ি করছে। কি হচ্ছে কি এসব? এসেছিলো কোন কাজে আর হচ্ছে কি সব।
ড্রইংরুমের থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে সাদাফ আর শুভ্রার টনক নড়ে। তারা দুজনেই এসে দেখে সাদাফের বাবাকে শুভ্রার মা জড়িয়ে ধরে অনবরত কাদছে। অবশ্য সাদাফ নাজমা বেগম কে চিনে না তবে শুভ্রা দেখেই আম্মু বলে ডাক দিয়ে উঠলো।
শুভ্রাঃ আম্মু তুমি এখানে?
নাজমা চৌধুরী এবার সাদাফের বাবার পেছনে তাকিয়ে দেখে শুভ্রা দাড়িয়ে আছে।
শুভ্রা গিয়ে তার মাকে কান্নায় জড়িয়ে ধরে। সাথে নাজমার সাথে আসা মেয়েটিও।
নিজের মেয়েকে দেখে মায়ের কান্না আসবে সেটা স্বাভাবিক তবে তিনি আমার আব্বুকে কেন জড়িয়ে ধরে কাদছিলো আর আম্মু ও বা কেন কাদছে এসব মনে মনে ভাবতে থাকে সাদাফ।
সাদাফের বাবাঃ শুভ্রা তোর মেয়ে নাজু?
নাজমাঃ হ্যা ভাইয়া শুভ্রা আর কুবরা এই দুটুই আমার মেয়ে।
সাদাফঃ এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড আব্বু আম্মু। কি হচ্ছে কি এসব তোমারা আগে থেকে একে অপরকে চেনো?
সাদাফের মাঃ হ্যা চিনি। তোর মনে নেই আমরা তোর ফুপ্পির কথা বলি? নাজু ফুপ্পি? ইনিই সে।
মিসেস নাজমা এবার সাদাফের দিকে এগিয়ে এসে সাদাফের দুই গালে হাত দিয়ে বলে এটা আমার সেই ছোট্ট সাদাফ!!! যাকে আমি কোলে পিঠে করে ৫ টা বছর আগলে রেখেছিলাম ভাইয়া!!
সাদাফের বাবাঃ হ্যা রে এই সেই তোর কলিজার টুকরা ভাইপো। আমাদের কথা বাদ দে যাকে এতোগুলা বছর নিজের মায়ের মতো পেলেছিস তাকে ফেলে তুই কি করে চলে গিয়েছিলি।
সাদাফ তার মা বাবার কথা কিছুই বুঝছে না। শুধু তাকিয়ে আছে মিসেস নাজমার দিকে। কি মমতাময়ী মায়াবী চেহারা। একদম মা মা ভাব। যেন খুব খুব আপন কেউ। তাহলে কি ছোটবেলায় মায়ের মতো করে আদর করে বড় করেছিলো বলেই এই অনুভূতি?
সাদাফের মাঃ সব কথা পরে হবে। সবাই এসো। আমি আর কাউকে ছাড়ছি না। ভেতরে আগে সবাই বসো। সেই এসেছো থেকে সবাই শুধু কান্নাকাটি করে তো পুরো বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছো সবাই।
এরই মধ্যে মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়। সবাই গিয়ে আগ নামাজ পড়তে চলে যায়। শুভ্রাকে যে রুমে থাকতে দেওয়া হয় সেই রুমে বসে আছে শুভ্রার মা আর কুবরা।
শুভ্রার মাঃ জানিস আমার তোর জন্য কতো টেনশন হচ্ছিলো? অই বাড়িতে পরশু ও কোনো ফোন দিলি না কালও কোনো ফোন দিলিনা। ভেবেছিলাম প্রত্যেকদিন আর কি কথা বলবি তাই ফোন দিস নি। কিন্তু আজ কুবরার প্রাইভেটের বেতন দেওয়ার দিন। কাল, পরশু কোনো খবর ছিলো না বলে আমি আনিস ভাইকে কল দিয়েছিলাম। আনিস ভাই আমার কাছে শুধু ক্ষমা চাচ্ছে, বলে তোকে নাকি ভাবি ঝড়ের রাতে বের করে দিয়েছে অন্যদিকে ভাবি বলছে তুই নাকি তাদের মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিস। পাত্রপক্ষকে নাকি তাদের মেয়ের ব্যাপারে খারাপ খারাপ কথা বলেছিস। আর তোকে এসব বলায় তুই নাকি কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিস। সোহেল নাকি দেখেছে তোকে কারো সাথে নাকি রাতে হাত ধরে তুই পালিয়ে গিয়েছিস। জানিস এসব শুনে আমি পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় যাব কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
তারপর দুপুরের আগে সাদাফই আমাদের ফোন করে। বলে তুই নিরাপদে আছিস। আর আমাই ঠিকানা জানতে চাইলে আমাকে এই ঠিকানাই দেই সে।৷
কুবরাঃ তুমি যাই বলো আম্মু। আমি ওই কুটি বুড়ি লুতফার কথা বিশ্বাসই করি না। ওইসব নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য বলেছে।
শুভ্রার মাঃ আমি জানি কুবরা। আমি আমার মেয়েকে সেই শিক্ষা দিই নি। এবার বল আমাকে কি হয়েছিল। এরকম কেন করেছে তারা?
মায়ের কথা শুনে মায়ের বুকে হাউমাউ করে জড়িয়ে ধরে অনবরত কাদতে থাকে শুভ্রা।
মিসেস নাজমার বুকটা এক অজানা ভয়ে কাপতে শুরু করছে।
শুভ্রার মাঃ কি হয়েছে শুভি, বল আমায়। কান্না কেন করছিস শুধু শুধু।
শুভ্রাঃআম্মু ওরা খুব খারাপ আম্মু। আন্টি আর সোহেল ভাইয়া খুব খারাপ। আমাকে শুধু শুধু গায়ে হাত দেয়। থাপ্পড় মারে। জানো আম্মু ওই সোহেল খুব বাজে লোক। শুরু থেকেই আমার দিকে তার নজর খারাপ ছিলো। কথার কথা সুযোগ পেলেই শুধু ধরার চেষ্টা করে। উনিশ বিশ হতে না হতেই ওমনি চুলের মুঠি ধরে নাহলে থাপ্পড় মারে। কয়েকদিন আগে আমাকে বাড়িতে একা রেখে দিয়ে ওরা সবাই বিয়েতে যায় আমাকে বাড়িতে একা রেখে। ওই সোহেল দুপুর বেলা একটা মেয়ে নিয়ে বাড়ি আসে। আমি যখন নাস্তা দিতে ডাকতে যায় তখন ওদের নোংরা কাজ দেখে ফেলায় রাতে আমার রুমে ঢুকে আমার ওপর হামলা চালায়।
এই বলে হু হু করে জোরে কান্না করে উঠে। মিসেস নাজমা তো মেয়ের কথা শুনে চোখ জলজল করছে। তাহলে কি মেয়েকে তিনি তাদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছেন? নিজেদের সংসার চালানোর কথা ভেবে মেয়ের জিবনটা নষ্ট করে দিয়েছে?
শুভ্রা আবার বলে উঠেঃ আমি তবুও অনেক চেষ্টা করে নিজেকে বাচিয়ে নিয়েছি। আমার কিচ্ছু কর‍তে পারে নি। সকাল বেলা আংকেল কে এ বিষয়ে বলতে গেলে সেখানেও আমার দিকে রাগী ভাবে তাকিয়ে থাকে। কাজ তো আমার করতেই হবে নাহলে সংসার চালাবে কি করে? আর আমি যদি তাদেরই ছেলের ব্যাপারে এসব বলি তারা কি বিশ্বাস করবে আমার কথা?
ওই দিন সকালে তোমাকে টাকা পাঠানোর সময় মি.চৌধুরীর সাথে কথা বলছিলাম সেদিন সেটা ওই সোহেল দেখে ফেলেছিল । এটা নিয়ে সে আরো বানিয়ে বানিয়ে বাজে কথা বলে। বিশ্বাস করো আম্মু আমি তাদের মেয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু বলিনি বরং তিনি নিজেই তোমার নাম্বার নিতে চাচ্ছিলো বারবার। তারপর তারা বাড়িতে গিয়ে বলে সাদিয়া আপু কে তাদের পছন্দ হয় নি আর আমার আম্মুর নাম্বার টা খুজেছিলো। এসব নিয়ে আন্টি আমাকে খুব মেরেছে। ঝড়ের রাতে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বের করে দিয়েছে। (ফুপে ফুপে কাদতে কাদতে বললো শুভ্রা)
মা মেয়ে অঝর নয়নে কাদতে থাকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
এদিকে দরজায় মা মেয়ের কথা শুনে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে সাদাফের মা। তার চোখেও পানি। তিনি এসে এসব কথা শুনবেন তা প্রায় তার আশাতীত। অন্যদিকে দরজার আড়ালে টলটলে চোখ নিয়ে হাতের মুঠি শক্ত করে রক্তিম হয়ে দাড়িয়ে আছে সাদাফ। তার মাথায় শুভ্রার বলা সোহেলের কাজকর্ম কথায় ভনভন করছে শুধু।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here