অপরিচিত লেখিকাঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ ০৪

0
1096

#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৪

আরফা মায়ের দিকে তাকিয়ে অস্থির গলায় বললো, মা কী হয়েছে এখানে ? এতো মানুষ কেনো বাড়িতে আর মামি এসব কী বলছে ?

তাইয়েবা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্থির গলায় বললো, তোর বাবা চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।

তাইয়েবার শান্ত গলায় বলা একটা কথা আরফার পুরো পৃথিবী নাড়িয়ে দিলো। তাইয়েবার থেকে ছিটকে দূরে সরে গেলো। মনে হচ্ছে পায়ের নিচের মাটি আর মাথার ওপর আকাশ দুটোই সরে গেছে আরফার। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর।

আরফা ভেঙে ভেঙে বললো, এ,,এসব তুমি কী বলছো মা ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বাবার কিছু হয়নি, আর কিছু হতেই পারে না।

তাইয়েবা বেগম মেয়ের এমন হাল দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললো, মরে গেছে তোর বাবা, চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। আর কোনদিন তোকে মা বলে ডাকবে না বুঝতে পারছিস তুই ?কোনো ভুল কিছু বলছি না আমি।

আরফার চোখ থেকে টপ টপ পানি গড়িয়ে পড়ছে সেই অবস্থায় চিৎকার করে বললো, বিশ্বাস করি না আমি এসব বাজে কথা। আমার বাবা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না। আ,,,আমি এখনই বাবাকে কল দিচ্ছি সবার সব ভুল ভেঙে যাবে এখনই।

আরফা কাঁধের স্কুল ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে নিজের রুমে গেলো আর ফোন এনে কল দিতে লাগলো আলতাফের নাম্বারে কিন্তু কল যাচ্ছে না। কিন্তু আরফা পাগলের মতো চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

তাইয়েবা মেয়ের পাগলামি দেখে উঠে গিয়ে মেয়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললো, শুনতে পাচ্ছিস না আমার কথা এই কল আর কোনোদিন যাবে না।

আরফা তাইয়েবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, কেনো মিথ্যা বলছো আমাকে ? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা প্লিজ এই মিথ্যে বলা বন্ধ করো। দম বন্ধ হয়ে আসছে নিতে পারছি না আমি।

আরফার পাগলামি দেখে তাইয়েবা আরফার দুগালে সজোরে দু’টো থাপ্পড় মেরে চিৎকার করে বললো, কেউ কোনো মিথ্যা বলছে না তোকে। তুই যা শুনেছিস সব সত্যি, মরে গেছে তোর বাবা, মরে গেছে তোর ডাক্তারি পড়ার টাকা জোগাড় করার মেশিন।

কথাটা বলে তাইয়েবা আবার ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আরফা হঠাৎ বাবা বলে একটা চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো। আরফার চিৎকারে মনে হয় পুরো আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো।

আজ সাতদিন পর আরফার বাবার লাশ দেশে এসেছে। মালিক ভালো ছিলো তাই এতো তাড়াতাড়ি লাশ আনতে পেরেছে তবে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে লাশ আনতে। সাতদিনে আরফা আর তার মায়ের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। লাশ সামনে নিয়ে আরফা একটুও কাঁদেনি লাশের পাশে বসে নিরবে শুধু একটা কথাই বলে গেছে বাবা তুমি এমনটা কী করে করতে পারলে ? কী করে পারলে এমন ধোঁকা দিয়ে চলে যেতে। বিদেশ ফেরত লাশ বেশি সময় রাখা সম্ভব নয় তাই তাড়াতাড়ি দাফন করা হলো আলতাফের লাশ। কবরটা বাড়িতেই দেওয়া হয়েছে। বাড়ির পেছন দিকে আরফার রুমের জানলা খুললে দেখা যায় কবরটা, মাটির মাত্র কয়েক মিটার নিচেই আরফার বাবা নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে আরফা সেটা সারাদিন তাকিয়ে দেখে।

দেখতে দেখতে কেটে গেলো দুটো মাস। কিন্তু আরফার কোনো পরিবর্তন নেই। বাবা পাগল মেয়ে ছিলো আরফা। স্কুল যায় না, খাওয়াদাওয়া করে না, সারাদিন রুমের জানলা খোলে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফোন বেজে উঠলে এখনো দৌড়ে যায় রিসিভ করতে, বাবা দেয়নি তো ফোনটা কিন্তু মুহুর্তেই ভুল ভাঙে আরফার। বাবা তো তার চোখের সামনে ঘুমিয়ে আছে। মাঝে মাঝে রাতের বেলা কবরের পাশে গিয়ে শুয়ে থাকে। মেয়ের চিন্তা দিনদিন বাড়ছে তাইয়েবা বেগমের। যে চলে গেছে তাকে আর ফেরানো যাবে না কিন্তু মেয়েটার কিছু হলে সে কীভাবে বাঁচবে ? এদিকে এতো বিপদ তাইয়েবা বেগমের তার ওপর আত্নীয় স্বজনগুলো শকুনের মতো চারদিকে ঘুরছে আলতাফের রেখে যাওয়ার টাকার হিসাব করতে। ইনিয়ে বিনিয়ে এটাই জানতে চায় কতো টাকা রেখে গেছে আলতাফ তাদের জন্য। তাইয়েবা বেগম সদ্য বিধবা হওয়া এক বিধস্ত নারী আর আদরের মেয়ে দিনদিন মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছে। যেখানে আত্নীয় স্বজনের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো কিন্তু সেটা না করে তারা টাকার হিসাব করতে ব্যস্ত। একবার টাকার হিসাব পেয়ে গেলে শেয়াল শকুনের মতো ছিঁড়ে খাবে তাদের মা-মেয়েকে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তাইয়েবার। অতিষ্ঠ হয়ে বলেছে আলতাফ কোনো টাকা রেখে যায়নি বরং পাকা দালান তোলে আর গরুর খামার করে ঋণের বোঝা দিয়ে গেছে তাদের ঘাড়ে। আস্তে আস্তে আত্নীয় স্বজনের আনাগোনা কমতে দেখে তাইয়েবা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মেয়েকে ডাক্তার বানানোর মতো ব্যবস্থা করে গেছে আলতাফ কিন্তু সেটা কাউকে জানাতে চায় না তাইয়েবা। মাথার ওপর বটগাছ না থাকলে বুঝা যায় সূর্যের তাপের তেজ কতটা। এখন এটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে তাইয়েবা। রাতের খাবার নিয়ে তাইয়েবা আরফার রুমে গেলো। আরফা জানলার কাছে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। আরফার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাইয়েবা আলতাফের কবর দেখতে পেলো। এখন মনে হচ্ছে মেয়ের কথায় কবরটা বাড়িতেই দেওয়া ঠিক হয়নি তাইয়েবার। তাইয়েবা আরফাকে জানলার কাছে থেকে সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টোলে বসিয়ে দিলো তারপর গিয়ে জানলা বন্ধ করে দিলো। আরফা কিছুই বলছে না একটা পুতুলের মতো বসে আছে। তাইয়েবা চিরুনি দিয়ে আরফার মাথা আঁচড়ে চুল বেধে দিয়ে খাবার নিয়ে মুখের সামনে ধরলে আরফা মুখ সরিয়ে নিলো।

তাইয়েবা খাবার পাশে রেখে আরফার মুখটা নিজের দু’হাতের আজলে নিয়ে বললো, এভাবে আর কতদিন চলবে আরফা ? সামনে পরীক্ষা স্কুলে যাস না দুমাস। তুই কী চাস তোর বাবার সাথে তার স্বপ্নটাও দাফন করতে ?

আরফা এবার ভরা চোখে মায়ের দিকে তাকালো, এমন কেনো হলো মা ?

তাইয়েবা এক লোকমা খাবার মুখের সামনে তুলে দিয়ে বললো, বাবা-মা কারো চিরদিন বেঁচে থাকে না। সবারই একদিন যেতে হবে যে চলে গেছে তার জন্য জীবন থামিয়ে রাখা যাবে না।

আরফা অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবার মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলো। তাইয়েবা খাবার মাখছিলো তখনই আরফা বলে উঠলো, সেদিন সবাই যা বলছিলো সব কী সত্যি মা ?

তাইয়েবার হাত থেমে গেলো আরফার কথা শুনে। একটু থেমে আবার নিজের কাজ করতে করতে বললো, কীসের সত্যির কথা বলছিস ?

আরফা মায়ের দিকে স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আমার মা কে ?

তাইয়েবা জানতো আরফা এমন কিছুই জিজ্ঞেস করবে। কারণ এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে আলতাফের মৃত্যুর পর। আরফা তো বাচ্চা মেয়ে নয় যে কিছু বুঝতে পারবে না। তাইয়েবা নিজেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করেই রেখেছিলো। তাইয়েবা আরফার মুখে খাবার তোলে দিয়ে বললো, আমার কোনো ব্যবহারে তো কোনোদিন মনে হয়েছে আমি তোর মা নই ?

আরফা খাবার চিবোতে চিবোতে বললো, না।

তাইয়েবা আবার বললো, আমাকে মা হিসাবে পেয়ে কী তুই খুশি না ?

আরফা একটু বিচলিত হয়ে বললো, এটা কী বলছো মা ?

তাইয়েবা নির্লিপ্ত গলায় বললো, সেদিন তোর মামি যা বলেছে সব সত্যি। তুই আমার বড়বোন তাহেরার মেয়ে। তবে আমি কখনো সেটা তোকে মনে করতে দিয়েছি কিনা সেটা তুই ভালো বলতে পারবি। যদি মা হিসাবে ব্যর্থ হয়ে না থাকি তাহলে আমি চাই না আমার মেয়ের মুখে বা মনে এই প্রশ্ন দ্বিতীয় বার আসুক।

আরফা মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, আজ থেকে তুমি শুধু আমার মা নও আমার বাবাও তুমি।

তাইয়েবা খাবার মুখে দিতে গেলে আরফা মাথা দিয়ে না করলো আর খাবে না। তাইয়েবা আর জোর করলো না খাবারের প্লেট পাশের টেবিলে রেখে হাত ধুয়ে আচলে মুছে নিলো তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

তাইয়েবা বললো, আগামীকাল থেকে স্কুলে যাবি আবার।

আরফা আর কিছু বললো না। কাল থেকে মা-মেয়ের জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হবে। যেখানে লড়তে হবে নিজের সাথে আশেপাশের মানুষের নানা কথার সাথে। তার জন্য দুজনেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে লাগলো। সকালে আরফাকে ডাকতে এসে তাইয়েবা খানিকটা অবাকই হলো। মেয়ে সুন্দর করে কুরআন তিলাওয়াত করছে হয়তো ফজরের নামাজও পড়েছে।

তাইয়েবা বললো, আজ এতো আগে উঠেছিস ?

আরফা পড়া বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, শুধু শুধু চোখের পানি না ফেলে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বাবার জন্য দোয়া করলাম আর তার আত্মার শান্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করছি।

তাইয়েবা গিয়ে মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বললো, আমার বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে।

আরফাও মাকে জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো।

তাইয়েবা আরফার মুখটা হাতের আঁজলে নিয়ে পানি মুছে দিয়ে বললো, আর একটু পড়ে খেতে এসো তারপর রেডি হয়ে স্কুলে যাবে।

আরফা বললো, হুম কারো জন্য সত্যি জীবন থেমে থাকতে পারে না।

তাইয়েবা চলে গেলো আর আরফার চোখ থেকে গড়গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। আরফার ভেতরের যন্ত্রণাটা কেউ হয়তো দেখতে পাচ্ছে না তাই বুঝতে পারছে না মেয়েটা শুধু বাবাকে হারিয়ে এতোটা ভেঙে পড়েনি। বাবার সাথে নিজের প্রথম ভালোবাসা হারিয়েছে, ঠকে গেছে সে ভালোবেসে। আরফার বাবার মৃত্যুর ৭ দিন পর্যন্ত রুমান খুব সাপোর্ট করেছে তাকে। যেদিন আরফার বাবার লাশ বাড়িতে আনা হয় রুমানও সেদিন এসেছিলো জানাযায় অংশগ্রহণ করতে। আরফাদের বাড়ি এসে কানাঘুঁষায় জানতে পারে আলতাফ টাকা তো রেখে যায়নি বরং আরো দেনা করে গেছে। সেদিন থেকে রুমানের বদলে যাওয়া শুরু। দুদিনে আরফাকে একটা কলও দেয়নি। আরফা অনেকবার দিয়েছে কিন্তু রুমান রিসিভ করেনি। একদিকে বাবার এমন হঠাৎ চলে যাওয়া আর অন্যদিকে রুমানের কোনো খোঁজ নেই আরফা যেনো পাগল প্রায়। পরদিন বারবার কল দেওয়ার পর রুমান রিসিভ করে।

কর্কশ গলায় রুমান বলে, কী হয়েছে বারবার কল কেনো দিচ্ছো ?

আরফা ভেজা গলায় বললো, যখন তোমাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই তুমি আমার সাথে এমন কেনো করছো রুমান ?

রুমান একইভাবে বললো, দেখো ব্যস্ত আছি বারবার কল দিও না। বাড়িতে অনেক মেহমান আছে বারবার কল আসলে ঝামেলা হবে।

আরফা বললো, কীসের মেহমান ?

রুমান নির্লিপ্ত গলায় বললো, খালামুনিরা এসেছে রুমানার সাথে আমার বিয়ের ঠিক করতে।

এ কথা শুনে যেনো আরফার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। ভয়ে কেঁপে উঠলো সারা শরীর। কাঁপা গলায় বললো, এসব কী বলছো রুমান ? তুমি তো বলেছিলে আমাকে বিয়ে করবে তাহলে ?

রুমান এবার রেগে গিয়ে বললো, দেখ একদম নেকামি করবি না। তোর ঘ্যানঘ্যান একদম ভালো লাগছে না। তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কারণ তোর বাপের বিদেশি টাকা ছিলো তাই। এখন তো তোর বাপের সাথে সাথে বিদেশি টাকাও গোল্লায় গেছে। রয়ে গিয়েছিস মুটকি তুই আর তোর সৎমা। তোদের ঘাড়ে নিয়ে বিপদে পড়বো নাকি আমি।

আরফা চমকে উঠে বললো, এসব কী বলছো রুমান ?

রুমান আগের মতো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, একদম ঠিক বলেছি। রুমানার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা সেই ছোটবেলা থেকে। তাই তো আমার নামের সাথে ওর নাম মিল রেখে রুমানা রাখা হয়েছে। আর ও না তোর মতো মুটকি না দেখতে একদম জিরো ফিগার। দেখলে মাথায় আগুন ধরে যায়।

রুমানের এসব কথা শুনে আরফা চোখ বন্ধ করে নিলো শক্ত করে। তার কাছে এখনো সব দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। মায়ের ডাকে হয়তো এখনই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে আর উঠে দেখবে এসবই মিথ্যা।

কিন্তু আরফার ঘুমটা ভাঙলো না তার আগেই রুমান আবার বললো, আর জানিস রুমানার বাবা কী বলেছে ? পড়াশোনা শেষ হলে চাকরি নিতে যত টাকা লাগবে সব তারা দিবে। এতো সুন্দরী বউ তার সাথে টাকা ফ্রি একদম সুপার অফার। এমন চান্স কেউ মিস করে ?

আরফা এবার শব্দ করে কান্না করে দিলো আর বললো, প্লিজ রুমান আমার সাথে এমন করো না আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। বাবাকে হারিয়ে আমি এমনই মরে গিয়ে বেঁচে আছি তুমি চলে গেলে সত্যি মরে যাবো।

রুমান বিরক্ত হয়ে বললো, তো জা না কেউ বাঁধা দিচ্ছে নাকি তোকে। বাঁচ মর যেখানে ইচ্ছে যা কিন্তু আমাকে আর কল দিবি না।

আরফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো রুমান। দিনরাত চেষ্টা করেও আরফা রুমানের ফোন অন পেলো না। সেদিনের পরই আরফা নিজেকে ঘর বন্দী করে নেয়। দেখতে দেখতে দুমাস পার হয়ে গেলো কিন্তু রুমানের আর কোন খোঁজ পায়নি আরফা। অনেকবার কল করেছে পায়নি। আরফা সম্পর্কে রুমান সব জানলেও রুমানকে ছাড়া তার কাছের আর কাউকে চিনে না আরফা তাই খুজতেও পারেনি।

আরফা রেডি হয়ে নে মিমি চলে এসেছে তোকে ডাকতে।

তখনই মিমি আরফার রুমে প্রবেশ করলো। মেয়েটা অনেক সাপোর্ট করেছে তাকে। মিমি না থাকলে হয়তো মরেই যেতো। আরফা কিছু না বললেও যখনই সময় পেতো একা একাই আরফার সামনে বসে বকবক করতো।

মিমি বেডে বসে আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, আন্টি গতকাল রাতে ফোন দিয়ে বললো তুই আজ থেকে স্কুলে যাবি তাই আগেই চলে এলাম। আমি অনেক খুশী হয়েছি তুই আবার স্কুলে যাবি।

আরফা উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো, তুই বস আমি রেডি হয়ে আসছি তারপর একসাথে নাস্তা করে স্কুলে যাবো।

মিমি আরফার হাত টেনে ধরে বললো, সব ভুলে যা আরফা আমি তোর পাশে আছি সাহায্য করবো অতীত ভুলতে।

আরফা মুচকি হেঁসে বললো, হুম।

আরফা চলে গেলো ওয়াশরুমে আর মিমি সেদিকে তাকিয়ে বললো, আজ দুমাস পর তোকে হাসতে দেখে কতটা ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না আরফা। আমি জানি উপরে যতই স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করসি কিন্তু ভেতরে অনেক কষ্ট জমে আছে। আমি তোকে সাহায্য করবো সেই কষ্ট থেকে দূরে থাকতে।

আরফা আর মিমি একসাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হলো। দুমাসে আরফা একদম বদলে গেছে। চঞ্চল মেয়েটা একদম নিরব। দেখতে আর নাদুসনুদুস নেই গলার হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় তাকে দেখে অনেকে অনেক কথাই বলছে।

,,,,ইশ মেয়েটা একদম শুকিয়ে গেছে গো। কী কপাল নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে ? জন্মের সময় মা আর এখন বাবা দুজনেই ছেড়ে চলে গেলো।

এমন আরো অনেক কথা। আরফা এসবে কান না দিয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়ালো। গেটের সামনে আসতেই চোখ গেলো সেই জায়গাটাকে যেখানে রুমান ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। মুহূর্তে চোখের কোণে পানি জমে গেলো। যতটা সাহস জমিয়ে এসেছিলো এক মুহুর্তে সব হারিয়ে গেলো। হঠাৎ মিমি শক্ত করে হাত ধরলো আরফার। আরফা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর মিমির দিকে তাকালো।

মিমি আরফার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, পিছনে ফিরে তাকাস না আরফা। যে অতীত আমাদের কষ্ট দেয় সেই অতীত সাথে নিয়ে নয় বরং পেছনে ফেলে সামনের দিকে চলতে হয়। আজ যে তোকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে কাল তোকে দেখে সেই যেনো আফসোস করে বলে কেনো চলে গিয়েছিলাম সেদিন।

আরফা মিমি দিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করে বললো, হুম।

মিমি হেসে বললো, এই তো আমার সাহসী দোস্ত।

আরফা দুষ্টুমি করে বললো, তুই এতো বড় বড় কথা কী করে শিখলি ? একদম বড়দের মতো কথা বলছিস।

মিমি হাসি বজায় রেখে বললো, তোর জন্য বড় হয়ে গেলাম।

আরফা মুচকি হেঁসে উঠলো মিমির কথা শুনে। দুজনেই স্কুলের ভেতরে চলে গেলো। আরফা স্কুলে যাওয়া শুরু করলেও পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছিলো না। বাবা আর রুমান দুজনের স্মৃতি ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো। কিন্তু সবসময় পাশে পেতো মিমিকে। দেখতে দেখতে মিডটার্ম পরীক্ষা হয়ে গেলো। কিন্তু আরফার রেজাল্ট দেখে সবাই চরম অবাক। ক্লাস ওয়ান থেকে প্রথম স্থান অধিকার করা মেয়েটা দুই বিষয়ে ফেল করেছে। তার রেজাল্টে স্যাররাও হতাশ। স্যারেরা মনে করেছিলো স্কুল থেকে একটা জিপিএ ফাইভ পেলেও সেটা আরফা পাবে। কিন্তু আরফার রেজাল্টে সবার স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। আরফা বাড়ি এলে রেজাল্ট শুনে তাইয়েবা কিছুই বললো না। মেয়ের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। আরফাকে বকবে ভেবে মিমিও সাথে এসেছিলো৷ তাইয়েবা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর মিমি আরফাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো গালে। আরফা অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে তাকালো মিমির দিকে।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here