অপরিচিত পর্বঃ ০৩

0
1344

অপরিচিত পর্বঃ ০৩

লেখিকাঃ তাহমিনা তমা

একটা নদীর পাড়ে পাশাপাশি বসে আছে আরফা আর রুমান। ওদের থেকে একটু দূরে বসে ফোন টিপছে মিমি, কাবাবের হাড্ডি হতে চায় না সে, তাই দূরেই বসেছে। ওদের দেখতে পেলেও কথা শুনতে পাচ্ছে না মিমি। এদিকে রুমান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে আর আরফা সেগুলো খাচ্ছে। আরফা বকবক করছে আর রুমান মুগ্ধ হয়ে আরফাকে দেখছে আর তার বকবক শুনছে।

আরফা সেটা খেয়াল করে বললো, কী দেখছো এভাবে ?

রুমান মুচকি হেঁসে বললো, আমার তোতাপাখি দেখছি।

আরফা ভ্রু কুঁচকে বললো, তুমি কী ইনডিরেক্টলি আমাকে বাঁচাল বললে।

রুমান কপালে হাত দিয়ে বললো, হায় খোদা এই মেয়ে একটু রোমান্টিক কথাও বুঝে না।

আরফা তা দেখে মুচির হাসলো। আসলে ওর রুমানের পিছনে লাগতে খুব ভালো লাগে তাই বুঝেও এমন কথা বলে।

আরফা এবার মুখ গুমরা করে বললো, হ্যাঁ আমি তো কিছু বুঝিই না, তুমি নতুন কাউকে খোঁজে নাও গিয়ে।

রুমান এবার বললো, আমি বেশ বুঝতে পারছি তুমি এখন আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছো কিন্তু আমার একটু ইচ্ছে করছে না ঝগড়া করতে।

আরফা এবার কোমরে দুহাত দিয়ে বললো, তারমানে তুমি বলতে চাইছো আমি ঝগড়াটে, শুধু ঝগড়া করি।

রুমান হঠাৎ আরফাকে জড়িয়ে ধরলো আরফা কেঁপে উঠলো রুমানের হঠাৎ এমন কাজে।

রুমান ফিসফিসে গলায় বললো, তাকিয়ে দেখো চারপাশে কতো রোমান্টিক একটা পরিবেশ। ঐ নদীর দিকে তাকিয়ে দেখো কতটা চঞ্চল হয়ে ছুটছে তোমাকে পাশে পেয়ে আমার হৃদয়টাও এমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

আরফা চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি খুব রোমান্টিক একটা পরিবেশ। কলকল শব্দে নদীর পানি বয়ে যাচ্ছে, পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে গাছ থেকে আশেপাশে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। আরফার এখন কেমন যেনো লজ্জা লাগছে তাই রুমানের থেকে নিজেকে ছড়িয়ে নিয়ে সামনে তাকালো।

রুমান আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, কী হলো এমন ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলে কেনো ?

আরফা আমতা আমতা করে বললো, কিছু না এমনই।

রুমানের হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আরফা তার অনুমতি ছাড়া হাত ধরাও পছন্দ করে না সেখানে সে জড়িয়ে ধরেছে।

তাই আমতা আমতা করে বললো, সরি আসলে হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরা ঠিক হয়নি আমার।

আরফা এবার রুমানের দিকে তাকালো। মাঝে মাঝে আরফা খুব অবাক হয় রুমানকে দেখে। সবসময় আরফার ভালোলাগা খারাপলাগার দিকে খেয়াল রাখে সে যেমন পরিস্থিতি হোক। এখনো আরফার অনুমতি ছাড়া হাতও ধরে না। আরফা হঠাৎ করে রুমানের একহাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। আরফার এমন কাজে রুমান প্রথমে একটু অবাক হলো পরে মুচকি হেঁসে আরফার হাতটা শক্ত করে ধরে মাথাটা আরফার মাথার ওপর কাত করে দিলো। রুমানও দেখতে কম যায় না ৫ ফিট ১১” লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, হাসলে গালে টোলও পরে, মাথার চুলগুলো কুঁকড়া সব মিলিয়ে যে কেনো মেয়ের স্বপ্ন পুরুষ হওয়ার যোগ্য। আরফা অবশ্য রুমানের প্রেমে পড়েছে গালে টোল পড়া মুচকি হাসি দেখে। রুমান অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, পড়াশোনাতে খুব একটা মনোযোগ নেই, বাবার কিনে দেওয়া বাইক নিয়ে সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ায়। সেই বাইক এক্সিডেন্টে প্রথম দেখা আরফার সাথে। রুমান বাইক নিয়ে আরফাদের বাড়ির ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ একটা মেয়ে বাইকের সামনে এসে পড়ায় পাশ কাটাতে গিয়ে রাস্তায় জমে থাকা কাঁদার ওপর গিয়ে পড়ে। মেয়েটাকে ঝাড়ি মারার জন্য যখন ঘুরে তাকায় আরফাকে দেখে থমকে গিয়েছিলো রুমান। ছোট একটা পরী যেনো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আচ্ছা তুমি সবসময় আমাকে এমনই ভালোবাসবে ?

রুমান অতীতে বিচরণ করছিলো আরফার কথায় ঘোর কাটলো আর বললো, কী বললে বুঝতে পারিনি।

আরফা রুমানের কাঁধে মাথা রেখেই বললো, কোনোদিন আমাকে ভুলে যাবে না তো ? সবসময় এমনই ভালোবাসবে ?

রুমান আরফাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এভাবেই ভালোবাসবো। আমার অনার্স আর তোমার এইচএসসি শেষ হলে বাবাকে বলবো তোমাদের বাড়ি যেতে।

আরফা মন খারাপ করে বললো, কিন্তু বাবা তো চায় আমি যেনো ডাক্তার হই।

রুমান আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, তো কী হয়েছে বিয়ের পরও ডাক্তার হতে পারবে তুমি ?

আরফা খুশি হয়ে রুমানের দিকে তাকিয়ে বললো, সত্যি বলছো।

রুমান মুচকি হেঁসে বললো, হুম।

আরফা রুমানের সেই মুচকি হাসির ওপর ফিদা হয়ে গেলো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে রুমানের টোল পড়া মুচকি হাসি।

হঠাৎ রোমান্টিক মুহূর্তের বারোটা বাজাতে মিমি এসে বললো, আরফা আজ রাত কী এখানে থাকার প্ল্যান আছে তাহলে বলে দে আমি চলে যাচ্ছি আর তুই থাক।

মিমির কথা শুনে আরফা আর রুমান দুজনেই ওর দিকে তাকালো। মিমি কোমরে হাত দিয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে আর রুমান মিমিকে দেখে কপালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, চলে এসেছে কাবাবের হাড্ডি।

আরফা চারদিকে তাকিয়ে দেখলো বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে৷ রুমানের সাথে থাকলে তার সময় জ্ঞান হারিয়ে যায়। মাকে কী বলবে ভেবে ভয় করতে লাগলো।

আরফা রুমানের দিকে তাকিয়ে বললো, অনেক লেট হয়ে গেছে এখনই না গেলে রাত হয়ে যাবে আর মা আমাকে মেরেই ফেলবে।

রুমান বললো, ঠিক আছে চলো আমি নামিয়ে দিচ্ছি, বাইকে সময় লাগবে না বেশি।

আরফা চমকে বললো, পাগল হয়ে গেছো তুমি ? কেউ যদি তোমার বাইক থেকে নামতে দেখে কেলেংকারী হয়ে যাবে একদম।

আরে আমি তোমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে নামিয়ে দেবো কেউ দেখবে না আর যদি দেখেই ফেলে বলবে স্কুলের বন্ধু লেট হয়ে গেছে তাই লিফট দিয়েছে।

আরফা বললো, কিন্তু,,,

আরফা কথা শেষ করার আগেই মিমি বললো, যা করার তাড়াতাড়ি কর লেট হচ্ছে কিন্তু।

পরে আরফাও রাজি হয়ে গেলো। আরফা এমনই একটু নাদুসনুদুস তারপর দুজনের সিটে তিনজন যেতে একটু কষ্টই হলো ওদের। তাও ম্যানেজ করে চলে গেলো ওরা।

মেহরাবের কথা মনে করে সারারাত ঘুম হয়নি সিনথিয়ার। মেহরাব এমন কিছু করবে সে ভাবতেই পারেনি। মেহরাব তো বলেছিলো সে হিন্দি ভাষা বুঝে না। তাহলে কীভাবে সিনথিয়ার কথা বুঝতে পেরেছে এখনো ভেবে পাচ্ছে না সিনথিয়া। সারারাত ঘুম না হওয়ায় মাথাটা ধরেছে সিনথিয়ার। তাই ফজরের সময় হতেই নামাজ পরে এক কাপ কফি বানিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো সিনথিয়া। গতকাল সন্ধ্যার কথা মনে হতেই গায়ে শিহরণ জেগে উঠলো।

মে তুমসে বহত পেয়ার কারতি হো মেহরাব আব খুদছে ভী জিয়াদা তুমসে পোয়ার কারনে লাগি গো।

সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলেছিলো। বলা শেষে ভয়ে চোখ খোলতে পারছিলো না। সিনথিয়ার কথা শুনে মেহরাব গাড়ি ব্রেক কষলো তার সিনথিয়ার দিকে তাকালো। রক্তিম সূর্যের আভা পড়েছে সিনথিয়া মুখে যা এই সাধারণ মেয়েটাকে অসাধারণ করে তুলেছে। মেহরাব মুগ্ধ হয়ে সিনথিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে সিনথিয়ার লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট দুটো অবিরাম কাপছে আর সিনথিয়া একটা ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে। মেহরাবের ঘোর লেগে গেছে সেই ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ এমন একটা কাজ করে বসবে মেহরাব নিজেও বুঝতে পারেনি। মেহরাব আলতো করে সিনথিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আর তাতে সিনথিয়া কেঁপে উঠলো। চমকে উঠে মেহরাবের দিকে তাকালো।

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, তুমহে কেয়া লাগা থা মুঝে হিন্দি বিল কোল নেহি আতাহে ?

সিনথিয়া মেহরাবের মুখে হিন্দি শুনে আরো বেশি চমকে উঠলো। তারমানে আজ পর্যন্ত সিনথিয়া মেহরাবকে হিন্দিতে যা যা বলেছে সব সে বুঝতে পেরেছে সেটা ভেবে লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো।

সেটা দেখে মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, একদম ঠিক ভেবেছো, তুমি যা যা বলেছো সব বুঝতে পারতাম। আজ মম কী বলেছে জানো ?

সিনথিয়া আগ্রহ নিয়ে বললো, কী বলেছে ?

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, মেয়েটা খুব মিষ্টি তোর সাথে মানাবে। জানো আমি না ভালোবাসতে খুব ভয় পাই। হারিয়ে ফেলার ভয় তাই তোমার প্রতি অনুভুতিগুলো যতবার মাথা চারা দিয়ে উঠেছে ততবার নিজেকে দমিয়ে নিয়েছি। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো তবু সাড়া দিতে পারিনি। আজ মাকে ফিরে পেয়ে কোথা থেকে মনে অনেক সাহস জমেছে। কথা দাও কখনো ছেড়ে যাবে না আমাকে। আমার ভয়টা মিথ্যা প্রামণ করবে।

সিনথিয়া মুচকি হেঁসে বললো, যাবো না।

দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে না বলা অনেক কথা চোখের ভাষায় বলে নিচ্ছে।

এই সিনথিয়া ভার্সিটি যাবি না নাকি আর তোর ফোন বেজে চলেছে কখন থেকে শুনতে পাচ্ছিস না নাকি ?

রুমমেটের কথা শুনে সিনথিয়া দৌড়ে ফোনের কাছে গিয়ে দেখে মেহরাব অনেকবার কল দিয়েছিলো। সিনথিয়া কিছু না ভেবেই ব্যাক করলো।

মেহরাব রিসিভ করেই বললো, কোথায় থাকো এতোবার কল দিলাম শুনতে পাওনি ?

সিনথিয়া আমতা আমতা করে বললো, বেলকনিতে ছিলাম শুনতে পাইনি।

মেহরাব বললো, ওকে রেডি হয়ে নাও আমি আসছি একসাথে যাবো ।

সিনথিয়ার কাছে সব স্বপ্ন মনে হয়। এক পলকে জীবনের রং এভাবে পাল্টে যাবে ভাবতেই পারেনি। এখন মনে হচ্ছে মনের কথা না বললে খুব বড় একটা ভুল হয়ে যেতো আর আফসোস নিয়ে বাঁচতে হতো সারাজীবন। ফোন রেখে সিনথিয়া চলে গেলো কী পরে ভার্সিটি যাবে সেটা ঠিক করতে। সিনথিয়া অনেক খোঁজে একটা কালো টপস পেলো। মেহরাবের কালো রং খুব পছন্দের তাই জিন্স প্যান্ট সাথে কালো টপস আর হিজাব করে নিলো সাথে হালকা সাজ। নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো বেশ লাগছে তাকে।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে আরফা ধীরপায়ে চুপিচুপি বাড়ির গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। মাকে কী বলবে সেটা মনে মনে ঠিক করে নিলো। আরফা হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি তার জন্য এতো বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো বাড়িতে। বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই দেখতে পেলো বাড়িতে অনেক মানুষ কিন্তু পরিবেশ একদম থমথমে। আরফা যতো আগাতে লাগলো তার ভয় ততো বাড়তে লাগলো। সে দেড়ি করে ফিরেছে বলে এতো মানুষ নাকি অন্য কোনো কারণ আছে। একটু সামনে আসতেই নিজের মামাকে দেখতে পেলো আরফা।

আরফা নিজের মামাকে দেখে দৌড়ে তার সামনে গিয়ে বললো, মামা এতো মানুষ কেনো বাড়িতে ?

আরফার মামা আরফাকে দেখে চোখের পানি ছেড়ে দিলো আর আরফাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কী হচ্ছে আরফা কিছুই বুঝতে পারছে না। একটু দূরেই মামিকে দেখতে পেলো আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। মামার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আরফা চলে গেলো মামির কাছে।

মামি কী হয়েছে কেউ কিছু বলছে না কেনো ?

আরফার মামি আরফার দিকে তাকিয়ে বললো, কী বলবে তোকে বল ? জন্মের সময় মাকে খেয়েছিস আর আজ,,,,,,

মামির কথা শুনে আরফা একপা পিছিয়ে গেলো। জন্মের সময় মাকে খেয়েছে মানে ? তার মা তো তার কাছেই আছে তাহলে ? আর আজ কী ?

আরফা আবার বললো, এসব কী বলছো মামি ? আর আজ মানে কী ?

আরফার মামি কিছু বলবে তার আগেই আরফার না আরফা বলে চিৎকার করে উঠলো আর আরফা দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেলো। মা রুমের ফ্লোরে বসে আছে তার চারপাশে অনেক মহিলা বসে আছে।

আরফা মাকে জিজ্ঞেস করলো, মা মামি এসব কী বলছে ? আর কী হয়েছে তুমি এভাবে বসে আছো কেনো ?

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here